৫৮ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৬ আগস্ট, ২০২১ / ২০ শ্রাবণ, ১৪২৮
কৃষি ফসলের ন্যুনতম সহায়ক মূল্য নিশ্চয়তা আইনের দাবি জানালো কিষান সংসদ
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কৃষকের ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্য (এমএসপি)-র নিশ্চয়তা আইন তৈরির ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছে কিষান সংসদ। সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে সংসদে বাদল অধিবেশন চলাকালীন যন্তরমন্তরে যে কিষান সংসদ সংগঠিত হচ্ছে তা ৪ আগস্ট দশম দিনে পড়েছে। এদিন কিষান সংসদে বিতর্ক ও আইন তৈরির কেন্দ্রে ছিল এমএসপি’র আইনি গ্যারান্টির দাবি। এদিনের আলোচনায় কৃষক প্রতিনিধিরা একযোগে জানিয়েছেন, দেশের কৃষিক্ষেত্র এবং কৃষককে বাঁচাতে সব ফসলের এমএসপি নিশ্চিত করা দরকার। এই ব্যবস্থার আইনি সুরক্ষা থাকাও প্রয়োজন। অন্নদাতাদের এই দাবি কেন্দ্র না মানায় এবং সরকারের যাবতীয় কৃষকবিরোধী নীতির প্রতিবাদে ৬ আগস্ট নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রীসভার বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সংযুক্ত কিষান মোর্চার পক্ষে ৪ আগস্ট এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, আগামী ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে সারা দেশে ‘কিষান মজদুর আজাদি সংগ্রাম দিবস’ পালন করবেন কৃষক ও শ্রমিকরা। সাইকেল, মোটরবাইক, গোরুর গাড়ি, ট্রাক্টর ইত্যাদিতে তেরঙ্গা পতাকা উড়িয়ে ওই দিন দেশের কৃষক এবং শ্রমিকরা মিছিল করে সমস্ত ব্লক, মহকুমা ও জেলার সদরে সমবেত হবেন। সেই সমস্ত স্থানেই আন্দোলনের দাবি তুলে ধরা হবে।
প্রসঙ্গত, দিল্লি সীমান্তে গত আট মাস ধরে চলতে থাকা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব সংযুক্ত কিষান মোর্চার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দিল্লির যন্তরমন্তরে এই কিষান সংসদ চলছে। মোর্চা জানিয়েছে, সংসদের বাদল অধিবেশন যতদিন চলবে, ততদিনই এই কিষান সংসদ চলবে। এজন্য দিল্লি সীমান্তের আন্দোলনস্থল থেকে প্রতিদিন নতুন করে ২০০ জন কৃষক এসে যন্তরমন্তরে কিষান সংসদ বসাচ্ছেন। মূলত দেশের কৃষকের সমস্যা এবং কৃষক আন্দোলনের দাবিগুলি প্রচারের লক্ষ্যে কিষান সংসদে বিতর্ক ও আলোচনা চলছে।
কিষান সংসদের দশম দিনে সব কৃষকের সব ফসলের এমএসপি’র আইনি নিশ্চয়তার লক্ষ্যে একটি বিল পেশ করা হয়। সেই বিলে মূলত চাষের খরচের বিজ্ঞানসম্মত হিসেব সি২+৫০ শতাংশ নীতির ভিত্তিতে এমএসপি নির্ধারণ, উৎপাদিত ফসলের অন্তত ৫০ শতাংশ সরকারি ক্রয়, কৃষি বাজারে যথাযথ সরকারি হস্তক্ষেপ এবং এমএসপি’র নিচে কোনো ব্যবসায়ীর ফসল কেনা নিষেধ ইত্যাদির সংস্থান রয়েছে। কিষান সংসদের প্রতিনিধিরা সকলেই প্রস্তাব সমর্থন করে এমএস স্বামীনাথন কমিশনের অন্যান্য সুপারিশগুলিও মনে করিয়ে দেন। কৃষক প্রতিনিধিরা বলেছেন, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী কৃষিজমি সুরক্ষিত রাখা, কার্যকরী ফসল বিমা, কৃষক পরিবারের শ্রমকে দক্ষ শ্রম হিসেবে গণ্য করা, এমএসপি’র হিসেবের ক্ষেত্রে পারিবারিক শ্রমের মজুরি অন্তর্ভুক্ত করা ইত্যাদি পদক্ষেপও নেওয়া দরকার।
ইতিমধ্যেই গত কয়েকদিনের কিষান সংসদে মোদী সরকারের কৃষকবিরোধী তিন কৃষি আইন প্রত্যাখ্যান করে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এছাড়াও প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল, বায়ু দূষণ বিল প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে কিষান সংসদ।
এদিকে মধ্য প্রদেশে সেঞ্চুরি মিলসের ৭০০ শ্রমিক সহ সমাজকর্মী মেধা পাটেকরকে গ্রেপ্তারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। অবিলম্বে তাঁদের মুক্তির দাবিও জানানো হয়েছে।
কেন্দ্রের মোদী সরকার কোনোরকম আলোচনা ও বিতর্ক ছাড়াই সংসদে পরপর ১২টি বিল পাশ করিয়ে নেওয়ায় প্রবল অসন্তোষ প্রকাশ করেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। ৩ আগস্ট এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে সংযুক্ত মোর্চা বলেছে, সংসদের যাবতীয় নীতিনিয়মকে চুরমার করে এমন পদক্ষেপে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতাই স্পষ্ট হচ্ছে। কিষান সংসদে যে গণতান্ত্রিক পথে এবং অংশগ্রহণকারী পদ্ধতিতে কাজ চলছে তা থেকে কেন্দ্রের শিক্ষা নেওয়া উচিত বলে জানিয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা।
সংসদের ভেতরে যে সব সাংসদ কৃষক স্বার্থের বিরোধিতা করেছেন, তাঁদের হুঁশিয়ারি দিয়েছে মোর্চা। গত আট মাস ধরে দিল্লি সীমান্তে চলতে থাকা কৃষক আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী শীর্ষ সংগঠন সংযুক্ত কিষান মোর্চার বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এতদিন পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও রাজস্থানে কৃষকবিরোধী বিজেপি’র নেতা ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট আন্দোলন চলছিল। কৃষক স্বার্থের বিরোধিতা করায় এই নেতাদের বিরুদ্ধে কৃষকরা কালো পতাকা দেখাচ্ছিলেন। এবার এই আন্দোলন উত্তর প্রদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। গত ২ আগস্ট বিজেপি’র এক মন্ত্রী পিলভিটে এক অনুষ্ঠানে গেলে সেখানে কৃষকরা দলবদ্ধভাবে তাঁকে কালো পতাকা দেখান। হরিয়ানা ছারখি দাদরি অঞ্চলেও কৃষকদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন এক বিজেপি নেতা।
প্রসঙ্গত, মোদী সরকারের তিন কৃষি আইন বাতিল, ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্যের আইনি গ্যারান্টির দাবিতে গত নভেম্বর মাস থেকে দিল্লির সীমান্তে টানা আন্দোলন চালাচ্ছেন কৃষকরা।
২ আগস্ট কিষান সংসদে কেন্দ্রীয় বায়ু দূষণ বিলটি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এব্যাপারে মোদী সরকার যেভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে কৃষকদের বিরুদ্ধে শাস্তির আইনি সংস্থান চাপিয়ে দিতে চাইছে, তার তীব্র নিন্দা করেছেন কিষান সংসদের প্রতিনিধিরা। কৃষকদের বিরুদ্ধে শাস্তির এই আইনি সংস্থান অপসারণের দাবি জানান তাঁরা।
কিষান সংসদে কৃষক প্রতিনিধিরা বলেছেন, চাষের খেতে আগাছা এবং খড়কুটো পোড়ানোর ব্যাপারে কৃষকদের ফৌজদারি শাস্তির আওতায় আনতে উঠে পড়ে লেগেছে কেন্দ্রের বিজেপি জোট সরকার। দিল্লিতে বায়ু দূষণ কমানোর অজুহাতে লকডাউনের সুযোগে অত্যন্ত অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক পথে একটি অর্ডিন্যান্স জারি করে কেন্দ্র। সেই অর্ডিন্যান্সের মেয়াদ ফুরানোর পর গত ১৩ এপ্রিল ফের নতুন করে তা জারি হয়। এখন এই অর্ডিন্যান্স বিল আকারে সংসদে পেশ করা হয়েছে। কিষান সংসদ মনে করিয়ে দিয়েছে, ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মোদী সরকারের মন্ত্রীরা কৃষক নেতৃত্বকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছিলেন যে, প্রস্তাবিত আইনে কৃষকদের বিরুদ্ধে আইনি শাস্তির কোনো সংস্থান থাকবে না। কিন্তু দেখা গেল নয়া বিলে কৌশলে এই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে সরকার।
কিষান সংসদে নয়া বিল থেকে কৃষকদের বিরুদ্ধে আইনি শাস্তির সংস্থানটি বাদ দেওয়ার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। একই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য ভারতীয় সংসদকেও আহ্বান জানিয়েছে কিষান সংসদ। তারা স্পষ্ট বলেছে, ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্যের আইনি গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে পারলেই চাষের খেতে আগাছা এবং খড়কুটো পোড়ানোর সমস্যাটির স্থায়ী সমাধান হতে পারে। তাই ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্য নিশ্চিত করে ভারতীয় সংসদে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে কিষান সংসদ। একই সঙ্গে আগাছা পোড়ানোর সমস্যার আন্তরিক সমাধানের স্বার্থে আর্থিক দিকগুলি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতেও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।