E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৬ আগস্ট, ২০২১ / ২০ শ্রাবণ, ১৪২৮

প্রয়াত কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরী


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা, পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য, প্রাক্তন সাংসদ ও রাজ্যের প্রাক্তন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরীর জীবনাবসান হয়েছে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫। ৩১ জুলাই দুপুরে অসুস্থতার কারণে তাঁকে হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায় একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভরতি করা হয়েছিল, সেখানেই এদিন রাতে তিনি হৃদরোগাক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর স্ত্রী, পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতি রয়েছেন। ১ আগস্ট কমরেড রায়চৌধুরীর ইচ্ছানুসারে চিকিৎসা বিজ্ঞানের স্বার্থে তাঁর মরদেহ এসএসকেএম হাসপাতালে দান করা হয়েছে। তার আগে প্রয়াত নেতার মরদেহ পার্টির রাজ্য দপ্তর মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে নিয়ে আসা হলে পার্টি নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন বামপন্থী দল ও গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ ফুল, মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরীর প্রয়াণে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, পার্টির হুগলি জেলা কমিটির সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ সহ বামপন্থী আন্দোলন ও শিক্ষক আন্দোলনের বহু নেতৃবৃন্দ। পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত, তপন সেন এবং হান্নান মোল্লা ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা করে কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরী কীভাবে ছাত্র আন্দোলনের সময় অভিভাবকসুলভ ভূমিকা পালন করেছিলেন তার উল্লেখ করে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকে সিপিআই(এম) নেতা ও প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সহযোদ্ধা ছিলেন সুদর্শন রায়চৌধুরী। তাঁর প্রয়াণে শোকজ্ঞাপন করেছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সিপিআই(এম)’র ত্রিপুরা রাজ্য কমিটির সম্পাদক গৌতম দাশ শোকবার্তা পাঠিয়েছেন।

ওয়েবকুটার সাধারণ সম্পাদক কেশব ভট্টাচার্য গভীর শোক প্রকাশ করেছেন সংগঠনের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরীর প্রয়াণে। এসএফআই, এবিটিএ, এবিপিটিএ’র পক্ষ থেকেও শোক প্রকাশ করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের হুগলি জেলা কমিটির অন্যতম সহ সভাপতিও ছিলেন কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরী, তাঁর প্রয়াণে শোক প্রকাশ করেছেন সংগঠনের রাজ্য সভাপতি পবিত্র সরকার ও সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায়।

১ আগস্ট দুপুর আড়াইটায় কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরীর মরদেহ নিয়ে আসা হয় মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ভবনে। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম তাঁর মরদেহ রক্তপতাকায় ঢেকে দেন এবং মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানান। এখানে অন্যান্যদের মধ্যে শ্রদ্ধা জানান পার্টিনেতা রবীন দেব, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, মদন ঘোষ, মিনতি ঘোষ, সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ী, দীপক দাশগুপ্ত, কান্তি গাঙ্গুলি, এসএফআই’র রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য, রাজ্য সভাপতি প্রতিকুর রহমান, ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সম্পাদিকা কনীনিকা ঘোষ, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভাপতি তুষার ঘোষ, ওয়েবকুটার সম্পাদক কেশব ভট্টাচার্য, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের রাজ্য সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি, গণশক্তি পত্রিকার সম্পাদক দেবাশিস চক্রবর্তী ও সহকারী সম্পাদক অতনু সাহা, দেশহিতৈষী পত্রিকার পক্ষে অশোক বন্দ্যোপাধ্যায় সহ রাজনৈতিক ও গণআন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থার রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর পক্ষ থেকে শান্তি ও সংহতি আন্দোলনে অধ্যাপক সুদর্শন রায়চৌধুরীর অবদান উল্লেখ করে শোক প্রকাশ করা হয়েছে।

শোক জানিয়েছেন সিআরএলআই নেতা অসীম চ্যাটার্জি, সিপিআই(এমএল) সন্তোষ রানা গোষ্ঠীর পক্ষে ইন্দ্র দস্তিদার, নির্মল ব্রহ্মচারী, আরসিপিআই নেতা মিহির বাইন প্রমুখ। রাজ্য দপ্তরে শ্রদ্ধায় বিদায় জানানোর পরে কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরীর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। সেখানে পার্টি নেতা মহম্মদ সেলিম, রবীন দেব, শ্রীদীপ ভট্টাচার্যের উপস্থিতিতে মরদেহ প্রদান করা হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে।

১ আগস্ট সকালে কলকাতায় তাঁর মরদেহ আনার আগে কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরীর মরদেহ তাঁর কোন্নগরের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। বাড়িতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রয়াত কমরেডের স্ত্রী, মহিলা আন্দোলনের নেত্রী মীনা রায়চৌধুরী, পুত্র অভিরূপ রায়চৌধুরী। শ্রদ্ধা জানান কোন্নগর পৌরসভার পৌর প্রশাসক বাপ্পাদিত্য চ্যাটার্জি, বিজেপি নেতা প্রবীর ঘোষাল, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের নেতা অপূর্ব পাল, সিপিআই(এম) কোন্নগর এরিয়া কমিটির সম্পাদক অভিজিৎ চক্রবর্তী ও পার্টিনেতা রজত ব্যানার্জি।

এরপর কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরীর মরদেহ শ্রীরামপুরে পার্টির জেলা অফিসে নিয়ে আসা হলে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সিপিআই(এম)’র নেতা শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, রবীন দেব, পার্টির হুগলি জেলা কমিটির সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ, পার্টি নেতা তড়িৎবরণ তোপদার, পরেশ পাল, শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায়, রূপচাঁদ পাল, মিতালি কুমার, শ্রতিনাথ প্রহরাজ, জ্যোতিকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান, শুভঙ্কর সরকার, প্রীতম ঘোষ, মহিলা আন্দোলনের নেত্রী স্বপ্না ভট্টাচার্য, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের রাজ্য সভাপতি হিরন্ময় ঘোষাল সহ সিপিআই, আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক, সিপিআই(এমএল), এসইউসিআই(সি) প্রভৃতি রাজনৈতিক দল ও গণ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। শ্রীরামপুর পার্টি অফিস থেকে মরদেহ নিয়ে কলকাতায় আসার পথে শোকমিছিল বের হয় বেল্টিং বাজার মোড় অবধি।

১৯৪৬ সালে কলকাতায় সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরীর। কলকাতায় মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে পড়ার সময় থেকেই তিনি ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন। মেধাবী ছাত্র ছিলেন তিনি। ১৯৬৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ভরতি হন এবং বিপিএসএফ’এর নেতৃত্বে উঠে আসেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্র আন্দোলনের জন্য কর্তৃপক্ষের তরফে শাস্তির মুখেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে। এরপর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও বাংলা দুটি বিষয়েই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শাখার সম্পাদক ছিলেন, বিপিএসএফ’র কলেজ স্ট্রিট-বৌবাজার কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন এবং ১৯৬৭ সালে কলকাতায় বিপিএসএফ’র সভাপতি ছিলেন। ৬-এর দশকে ছাত্র আন্দোলন করতে করতেই তিনি সিপিআই(এম)’র সদস্যপদ অর্জন করেন। পার্টির শিয়ালদহ বিদ্যাসাগর আঞ্চলিক কমিটির সদস্য হিসাবে ছাত্র আন্দোলন পরিচালনায় নেতৃত্ব দিতেন। খাদ্য আন্দোলনেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের দিনগুলিতে একদিকে নকশালপন্থীদের অন্যদিকে কংগ্রেসের আক্রমণের মুখেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে। সংশোধনবাদ ও সঙ্কীর্ণতাবাদ দুই স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ছাত্র আন্দোলন সংগঠিত করা এবং বিপিএসএফ থেকে এসএফআই গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। ১৯৭০ সালে এসএফআই গড়ে তোলার প্রস্তুতি কমিটিতেও ছিলেন তিনি। পরে অবশ্য অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হয়ে তিনি আর এসএফআই’তে থাকেননি, তবে শিক্ষা আন্দোলনের সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন।

১৯৭১ সালে তিনি শ্রীরামপুর কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। ছাত্রদের মধ্যেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। শিক্ষা আন্দোলনে ও কলেজ শিক্ষকদের আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ওয়েবকুটার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। শ্রীরামপুরে অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পার্টির হুগলি জেলার সাংগঠনিক কাজে যুক্ত হয়ে যান। পরে শ্রীরামপুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে সিপিআই(এম) প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নবম ও দশম লোকসভায় পরপর দু’বার নির্বাচিত হয়েছিলেন যথাক্রমে ১৯৮৯ সালে এবং ১৯৯১ সালে। ২০০৬ সালে জাঙ্গিপাড়া বিধানসভা কেন্দ্র থেকে রাজ্যের বিধানসভায় নির্বাচিত হয়ে বামফ্রন্ট সরকারের উচ্চশিক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৪ সাল থেকে তিনি সিপিআই(এম)’র হুগলি জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন, ২০১২ সালে তিনি হুগলি জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং সিপিআই(এম)’র রাজ্য কমিটির সদস্যও ছিলেন। সুবক্তা ও সুলেখক হিসাবে জনপ্রিয় ছিলেন কমরেড সুদর্শন রায়চৌধুরী। মার্কসবাদের গভীর চর্চা ছাড়াও বিস্তৃত বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল। ১৯৭৪ সালে স্তালিন রচনাবলি ১৬ খণ্ডে প্রকাশিত হয়, তার সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন তিনি। তাঁর রসবোধ ছিল প্রখর। লেনিন, রুশ বিপ্লব, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো, লাতিন আমেরিকার মুক্তিসংগ্রাম ইত্যাদি সম্পর্কে তাঁর লেখা বইগুলি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।