৫৮ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৬ আগস্ট, ২০২১ / ২০ শ্রাবণ, ১৪২৮
কাকাবাবুকে স্মরণে রেখে
বিমান বসু
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ (কাকাবাবু)
জন্মঃ ৫ আগস্ট, ১৮৮৯ মৃত্যুঃ ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭৩
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের আজ ১৩৩ তম জন্মদিবস। তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও পরবর্তী সময়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গড়ে তোলার অন্যতম পথিকৃৎ।
আমাদের সকলের জানা বিষয় যে ভারতের বুকে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার সলতে পাকানোর কাজ রুশ দেশের তাসখন্দে ১৯২০ সালে শুরু হয়েছিল এবং ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়েছিল। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ ১৯২০ সালকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার সূচনা হিসাবে বিবেচনা করতেন। ১৯২০ সালের পরে দেশের বুকে যে সব শ্রমিক কৃষক আন্দোলন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত কমিউনিস্টদের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবির লড়াইয়ের ভিত্তিতে অভিজ্ঞতা নিয়ে ১৯২৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। কানপুর সম্মেলন থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের সমাবেশের ওপরে যে নৃশংস আক্রমণ সংগঠিত হয়েছিল তা প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে।
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ ১৯১৭ সালে রুশদেশে সফল বলশেভিক বিপ্লবের বার্তা পাওয়ার পর থেকে আমাদের দেশে শ্রমিক কৃষকদের সংগঠিত করা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিকল্পিতভাবে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার কাজে তিনি যুক্ত থাকার ফলশ্রুতিতে ইংরেজদের পুলিশের নজরদারি তাঁর ওপর চলতে থাকে। তাই তাঁকে অনেক সময় পুলিশের নজর এড়িয়ে আত্মগোপনে থেকেও আন্দোলন সংগ্রাম ও সংগঠনের কাজ পরিচালনা করতে হয়েছে। একবার আত্মগোপনে থাকার সময়তেই তাঁর পরিচয় গোপন করার উদ্দেশ্যে তাঁকে সবাই কাকাবাবু নামে সম্বোধন করা শুরু করেন। আর এই থেকেই কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ সকলের কাছে কাকাবাবু হয়ে ওঠেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পরাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলা ও আন্দোলন সংগ্রামের পরিকল্পনা গ্রহণ করা খুব সহজ কাজ ছিল না। ছিল না বলেই স্বাধীনতা সংগ্রাম ও কমিউনিস্ট কার্যকলাপে যুক্ত থাকার ‘অপরাধে’ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা, মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা ও লাহোর ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়েছিল। কাকাবাবুকে মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার আসামি হিসাবে ইংরেজরা অভিযুক্ত করেছিল। কাকাবাবুরা জেলে বন্দি থেকেছেন, নির্যাতন সহ্য করেছেন, আবার তাঁরা যে কোনো ষড়যন্ত্রে শরিক নন, তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামী এই সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ যুক্তি তর্কের অবতারণা করে মুক্তিলাভ করেছেন।
আজ আমাদের স্মরণ করতে হবে যে কাকাবাবুরা তৎকালীন সময়ে শোষিত বঞ্চিত মানুষের শোষণমুক্তির লড়াই করার জন্য যে সংগঠিত প্রয়াস জারি রেখেছিলেন তার ফলশ্রুতিতে ১৯২৭ সালে খড়গপুর কারখানায় মজুর ধর্মঘট, ১৯২৮ সালে লিলুয়ায় মজুর ধর্মঘট, ১৯২৮ সালের মার্চ ও জুন মাসে কলকাতায় মেথর ঝাড়ুদারদের ধর্মঘট, চেঙ্গাইলে ১৯২৮ সালে লাডলো জুটমিলে শ্রমিকদের ধর্মঘট, ১৯২৮-২৯ সালে বাউড়িয়া চটকলে ধর্মঘট সংগঠিত হয়েছিল। গত শতাব্দীর বিশের দশক ও তিরিশের দশকে এরকম অসংখ্য ছোট ছোট লড়াই সংগ্রামের পথ বেয়ে বড় লড়াইয়ের ভিত্তি গড়ে উঠেছে। আমরা যেন ভুলে না যাই আজকেও স্থানীয় ভিত্তিতে ছোট ছোট লড়াই সফলভাবে সংগঠিত করার ভিতের ওপর দাঁড়িয়েই ভবিষ্যতে বড় লড়াই সংগঠিত করার দামামা বেজে উঠবে। আবার চল্লিশের দশকের প্রথম পর্বে বঙ্গপ্রদেশে মুনাফাখোর মজুতদারদের অর্থলালসায় যে ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল তখন দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের স্বার্থে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বিভিন্ন জেলায় লঙ্গরখানা, অসুস্থ মানুষের রোগ নিরাময় করায় উদ্যোগী ভূমিকা এক গৌরবজনক গাঁথা হয়ে রয়েছে। এই পৃষ্ঠভূমিতেই গড়ে উঠেছিল ‘পিপলস রিলিফ কমিটি’ যা এখনো দুঃস্থ সাধারণ মানুষের সেবায় নিবেদিত রয়েছে। আবার চল্লিশের দশকের দ্বিতীয় পর্বে কৃষকদের নেতৃত্বে যে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল তাতেও কমিউনিস্টদের গৌরবজনক ভূমিকা ছিল। এই সব কাজে কাকাবাবুদের নেতৃত্বে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি কৃষক জনগণের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল।
আমরা যারা এখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র সঙ্গে যুক্ত রয়েছি আমি সহ তাদের সকলকেই আত্মজিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন যে আমরা পার্টির জন্য কত সময় ব্যয় করি? কাকাবাবুদের সবসময় ধ্যানজ্ঞান ছিল কী করে পার্টি জনগণের জীবনযন্ত্রণা লাঘব করতে পারে, একাজে কত ভালোভাবে নিজেকে যুক্ত করা যায়। জনগণের মধ্যে পার্টিকে প্রসারিত করতে পার্টি পরিচালিত বিভিন্ন গণসংগঠনের প্রাত্যহিক কার্যকলাপ পরিচালনা করতে যা যা করা উচিত তা কি আমরা সব ঠিকঠাক সম্পন্ন করার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করি? কাকাবাবুরা তা করতেন। কাকাবাবু নিজে কৃষক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন, এবং তার জন্য যা যা তাঁর করা প্রয়োজন তা করতেন। আবার পার্টি সংগঠন পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন হয় এবং সেকাজেও হাতে কলমে তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে তা সম্পন্ন করতেন। কাকাবাবু যখন থেকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন দপ্তর লেক প্লেসে থাকতেন তখন নানা কাজে আমাকে সেখানে যেতে হতো, তখন কাকাবাবুর কাছেও কথা বলতে যেতাম। একবার কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে বলেছিলেন, তাঁর চলাফেরার ওপরে পুলিশের নজরদারি রয়েছে তাই তিনি কোট প্যান্ট টাই হ্যাট পরে ম্যাকফারসন পার্কে বসে রয়েছেন, কেউ কেউ তাঁকে কিছু অর্থ দিয়ে যাবেন। কিন্তু তাঁর হঠাৎ মনে হলো , তাঁকে কেউ কেউ পর্যবেক্ষণ করছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি পার্কটা ঘুরে বেরিয়ে চলে গেলেন। বলেছিলেন, এতে আমাদের খুব অর্থ সঙ্কটে কয়েকদিনের জন্য পড়তে হয়েছিল। তাঁর নিজস্ব ডোনার লিস্ট ছিল। তৎকালে এরকম ডোনার লিস্ট অনেকেরই থাকত। তিনি এও বলেছিলেন, পার্টির স্বার্থে জনগণ ও পরিচিতদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ না করলে পার্টির কাজ পরিচালিত হবে কী করে! আন্দোলন সংগ্রামই বা কীভাবে সংগঠিত করা যাবে! কীভাবেই বা পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী যাদের লেনিনের ভাষায় প্রফেশনাল রেভল্যুশনারি বলা হয় তাদের ন্যূনতম ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে! এখনকার সময়েও একথা সত্য। পার্টির সদস্যদের পার্টির লেভির টাকায় পার্টি চালানো যায় না বা আন্দোলন সংগ্রামের জন্য অর্থ ব্যয় করাও যায় না। এখনও নিয়মিত গণ অর্থসংগ্রহের ব্যবস্থা হয়, কিন্তু তা সম্ভবত অনেক গুণ বাড়ানো প্রয়োজন।
আজ কাকাবাবুর ১৩৩তম জন্মদিবসে আমাদের শপথ গ্রহণ করা উচিত যাতে আমরা পার্টির যে স্তরে থেকেই কাজ করি না কেন তা পরিকল্পিতভাবে ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমাদের শ্রেষ্ঠ শ্রম ও সময় দেবো। অবশ্যই আমরা পার্টিকে শক্তিশালী ভিতের ওপর গড়ে তুলব।
(৫ আগস্ট, ২০২১ 'গণশক্তি'তে প্রকাশিত।)