৫৮ বর্ষ ৫১ সংখ্যা / ৬ আগস্ট, ২০২১ / ২০ শ্রাবণ, ১৪২৮
কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার স্মরণে
সুকান্ত কোঙার
কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার
জন্মঃ ৫ আগস্ট, ১৯১৫ মৃত্যুঃ ২৩ জুলাই, ১৯৭৪
১৯১৫ সালে অবিভক্ত বর্ধমান জেলার রায়না থানার কামারগড়িয়া গ্রামে এক সচ্ছল পরিবারে কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙারের জন্ম। এলাকাটা ছিল বন্যাপ্রবণ। তাঁর পিতা শরৎচন্দ্র কোঙার পরবর্তীকালে চলে আসেন মেমারিতে। কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৩০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে কংগ্রেসের ডাকা সত্যাগ্রহ আন্দোলনে তিনি যোগদান করেন। তাঁর পিতা অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। কমরেড বিনয় চৌধুরীর ভাষায়ঃ ‘‘১৯৩০-এর দশক ছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক ধারার গতি পরিবর্তনের যুগ। কমরেড হরেকৃষ্ণ-র রাজনৈতিক ধ্যানধারণা এই দশকেই বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের ভিতর দিয়ে কমিউনিস্ট মতবাদে পরিণতি লাভ করে।’’ কংগ্রেসের অহিংস আন্দোলন তাঁকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। ১৯৩২ সালে যখন তাঁর বয়স ১৭ এবং তখন তিনি ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের ছাত্র - সেই সময়ে ব্রিটিশ শাসকের উচ্ছেদের আন্দোলনে তিনি গ্রেফতার হন। তাঁর ৬ বছরের জেল হয়। তাঁকে প্রথমে মেদিনীপুর জেল ও পরে আন্দামান জেলে নির্বাসিত করা হয়। তখনকার দিনে আন্দামান জেলে তাঁদেরই পাঠানো হতো, যাদের ‘ভয়ঙ্কর’ মনে করা হতো। জেলে থাকাকালীনই তিনি মার্কসবাদে দীক্ষিত হন।
১৯৩৮ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি তাঁর মার্কসবাদী সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। আন্দামান সেলুলার জেলকে যাঁরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পাঠশালায় পরিণত করেছিলেন, কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। তাঁরা বুঝেছিলেন যে, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ হলো মানবমুক্তির ধ্রুবতারা, এটাই হলো শোষণের ব্যবস্থার উচ্ছেদের মতাদর্শ। সেই সময়ে যাঁরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতাদর্শে দীক্ষিত হন, কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার-এর মতন তাঁদের অনেকেই এসেছিলেন সচ্ছল পরিবার থেকে। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের শ্রেণিচ্যুত করেছিলেন। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে বির্সজন দিয়ে বেছে নিয়েছিলেন এক কঠিন, কঠোর, অনিশ্চিত জীবন। এটা তাঁরা করতে পেরেছিলেন শোষণের ব্যবস্থার প্রতি তীব্র ঘৃণা এবং মেহনতি মানুষের প্রতি অসীম মমত্ববোধ থেকে। তাঁর সম্পর্কে কমরেড সুধাংশু দাশগুপ্ত লিখেছেনঃ ‘‘বিপ্লবীদের কাছে জীবন মানেই সংগ্রাম... এই সত্যই সহযোদ্ধাদের স্মৃতিপটে এঁকে রেখে গেলেন কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার তাঁর জীবনধারার মধ্য দিয়ে। - কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার তাঁর কর্মময় জীবনের মধ্য দিয়ে এই শিক্ষাই আমাদের দিয়ে গেলেন যে, কমিউনিস্টরা এক বিশেষ ধাতুতে গড়া, আদর্শে তাঁরা অটল, সংগ্রামী চেতনায় তাঁরা সমৃদ্ধ, মার্কসবাদ লেনিনবাদই তাঁদের জীবনের ধ্রুবতারা।’’ মার্কসবাদ কোনো মুখস্তবিদ্যা নয়। একে বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ করতে হয়। কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার তাঁর সমগ্র জীবনে এই তত্ত্বকে বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ করেছেন। শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষকে সংগঠিত করার জন্য তিনি প্রতিনিয়ত কাজ করে গেছেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় রিলিফের দাবিতে, ক্যানাল আন্দোলনে, জমিদারদের বেআইনি জমি দখলের আন্দোলনে, গরিবের মজুরির আন্দোলনে তিনি হাতে-কলমে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি ব্রিটিশ আমল ও কংগ্রেসের আমলে বারে বারে জেলে গেছেন, আত্মগোপনে থেকেছেন, আক্রান্ত হয়েছেন। কোনো কিছুই তাঁকে সংগ্রামের ময়দান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। স্বাধীন ভারতে ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হওয়ার পরে তিনি আত্মগোপনে চলে যেতে বাধ্য হন। একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত আত্মগোপনে থেকে পার্টির কাজ করে যান। ১৯৬২ সালে চীনের দালাল ও ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের দালাল বলে অন্যান্য কমিউনিস্টের মতো তাঁকেও জেলে পোরা হয়। অথচ কমিউনিস্টরাই হলো সবচেয়ে বড়ো দেশপ্রেমিক। ব্রিটিশ আমলে কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব ছিল খুবই দুর্বল। কিন্তু আত্মত্যাগের নিরিখে কমিউনিস্টরাই ছিলেন সেরা।
আন্দামান জেল থেকে বের হওয়ার পরে তাঁর পিতা প্রত্যাশা করেছিলেন যে, তিনি পিতার ব্যবসাতে যোগ দেবেন। কিন্তু তা হয়নি। পিতা ভেবেছিলেন যে, বিয়ে দিয়ে দিলে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে সংসারী হবে। ঠিক সেটাও হয়নি। বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই স্ত্রীকে নিয়ে তাঁকে আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে হয়। পার্টির আর্থিক অবস্থা তখন খুবই খারাপ। বাবার কাছ থেকে পাওয়া সোনা বিক্রি করে কমিউন চালাতে হয়েছে। এর জন্য কোনো আক্ষেপ ছিল না, সব সিদ্ধান্তই নিয়েছেন হাসিমুখে।
কিছুদিন তিনি ট্রেড ইউনিয়নের কাজে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রাদেশিক কৃষক সভার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৮ সালে মাদুরাইতে অনুষ্ঠিত সারা ভারত কৃষক সভার ১৯তম সম্মেলনে তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যদিও সেই সময়ে পশ্চিমবাংলায় প্রচণ্ড দমন-পীড়ন চলছে। ফলে তিনি সহ পশ্চিমবাংলার প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে যোগ দিতে পারেননি। তারপর থেকে আমৃত্যু তিনি সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
১৯৩৮ সালে তিনি পার্টির সদস্যপদ পান। ১৯৫৮ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মতাদর্শগত কারণে ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) গঠিত হওয়ার সময় তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তখন তিনি জেলে। পার্টির ভিতরে মতাদর্শগত সংগ্রামের ক্ষেত্রে তিনি উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে গেছেন। দক্ষিণপন্থী বা বামপন্থী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রামে তিনি ছিলেন আপসহীন। সংশোধনবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সম্পর্কে কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার বলেছেনঃ ‘‘লেনিনের মতে সংশোধনবাদী চক্র হলো শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে বুর্জোয়া বাহিনী। ধনিকশ্রেণির নিজেদের লোক অপেক্ষা এরা অনেক সময় ভালোভাবে বুর্জোয়া স্বার্থ রক্ষা করে। এরা মুখে মার্কসবাদের কথা বলে ও জনগণের দাবিদাওয়া নিয়ে কিছু সংস্কারবাদী আন্দোলন করে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখে এবং তাকে ধনিক শ্রেণির স্বার্থে ব্যবহার করে। ...কমিউনিস্ট পার্টি যথার্থ কমিউনিস্ট পার্টি থাকতে পারে একমাত্র মার্কসবাদের ভিত্তিতেই। পার্টি ঐক্য একমাত্র এই ভিত্তিতেই হতে পারে। তাই মার্কসবাদ ছেড়ে দিলে এবং মার্কসবাদকে রক্ষার জন্য যারা সংগ্রাম করে তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালালে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতাকে, সেই সঙ্গে পার্টিকে ভাঙা হয়... সংশোধনবাদ ও মার্কসবাদের মধ্যে সংগ্রাম আজ আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই দু’য়ের মধ্যে কোনো ঐক্য বা সমঝোতা হতে পারে না।’’
তাঁর মৃত্যুর পর আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি শোকবার্তায় লিখেছিলঃ ‘‘তাঁর জীবন ছিল সম্পূর্ণরূপে উৎসর্গীকৃত স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের জন্য। ...১৯৬৭ ও ১৯৬৯ সালে স্বল্প সময়ের দু’টি যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে ভূমি ও ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী থাকাকালীন তিনি দেখিয়েছেন, আমলাতন্ত্রের উপর নির্ভর না করে কৃষক এবং খেতমজুরদের সংগঠিত করে সীমাবদ্ধ ভূমি সংস্কার কেমনভাবে কার্যকর করতে হয়।’’
সেই সময়ের কৃষক আন্দোলন পশ্চিম বাংলার মাটিতে গ্রামাঞ্চলে পার্টির প্রভাব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অসাধারণ। তিনি বলতেন -‘‘কৃষক আন্দোলনের লক্ষ্য কৃষকদের উপকার করা নয়, চামচ দিয়ে দুধ খাওয়ানো নয়। কৃষক আন্দোলনের লক্ষ্য কৃষকদের শোষণের ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন করা, কৃষকদের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সংগ্রামের ক্ষমতাকে জাগিয়ে তোলা। কৃষকদের দুধ-মধুর গল্প শোনালে হবে না।’’ তিনি বলতেন, ‘‘অনেকের ধারণা হরেকৃষ্ণ কোঙার গরিবদের জমি দিয়েছেন। এটা ঠিক নয়। কৃষকরাই লড়াই করে জমি দখল করেছে। আমি বড়োজোর কৃষকদের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা সংগ্রামী চেতনাকে জাগিয়ে তুলেছি।’’ কংগ্রেস ভূমি সংস্কার আইন করেছিল। কিন্তু সেই আইনের মধ্যে অনেক ফাঁক রেখেছিল। সেই ফাঁককে ব্যবহার করে জমিদারেরা কোর্ট থেকে ইনজাংশন জারি করে জমি বিলি বন্ধ করে দিতো। তিনি কৃষকদের পরামর্শ দিলেন, ‘‘হে কৃষক - আমি মন্ত্রী, আমি সংবিধানের নামে শপথ নিয়েছি, আমি কোর্টের নির্দেশ মানতে বাধ্য। কিন্তু তুমি তো আর মন্ত্রী নও। তুমি তোমার লাঙলের ফাল দিয়ে ইনজাংশন তুলে দাও, আর জমি দখল করো।’’ ওই সময়ে জমির আন্দোলনে গরিবদের মধ্যে একটা উন্মাদনা দেখা যায়। আন্দোলনের মধ্যে কিছু ভুল হয়, বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। কেউ কেউ জমি দখলের আন্দোলন বন্ধ করার পরামর্শ দিলেন। কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার বললেন, ‘‘বাচ্চা হাঁটতে শিখলে বারে বারে পড়ে যাবে। তার জন্য বাচ্চাকে হাঁটতে শেখানো বন্ধ করলে চলবে না। ভুলগুলো সংশোধন করে নিতে হবে।’’ অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি। গরিবদের প্রতি কী মমত্ববোধ।
সবাই কৃষকের কথা বলে, গরিবের কথা বলে। কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামই প্রত্যেক বুর্জোয়া দলের স্বরূপ তুলে ধরে। কৃষকদের সচেতন করার জন্য তিনি বলতেন, ‘‘কলের গানের রেকর্ড সবই কালো রঙের, পিন লাগালে তবেই বোঝা যায় কোন্টা নবদ্বীপ হালদারের, কোন্টা হেমন্তের গলা। তেমনই সবাই কৃষক দরদি সাজে, কিন্তু শ্রেণিসংগ্রামের বা জমির আন্দোলনের পিন লাগালে ধরা পড়ে কোন্টা জোতদারের, আর কোন্টা কৃষকের পক্ষের গলা।’’
তাঁর মৃত্যুর পর ভারতের কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা কমরেড আবদুল্লাহ রসুল লিখেছিলেনঃ ‘‘আমাদের সামনে তাঁর ছবিটাই কেবল থাকবে না, থাকবে কৃষক ও খেতমজুর আন্দোলনে তাঁর বহু বছরের কাজকর্মের ও নেতৃত্বের অতি মূল্যবান অবদান ও শিক্ষা। তাঁকে আমাদের আগামীদিনের আন্দোলনের কাজে ব্যবহার করতে হবে।’’ ভূমি সংস্কার সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানের জন্য আইএএস অফিসারদের ট্রেনিংয়ে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হতো।
তিনি ছিলেন একজন অসাধারণ বক্তা। জনগণের সমস্যাগুলিকে তিনি মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সহজ সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করতে পারতেন। গ্রাম-শহরের গরিব মানুষদের বোঝার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হতো না। জনসভার মধ্যে দিয়ে শোষণের সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি যে বক্তব্য তুলে ধরতেন, তার মধ্যে দিয়ে জনগণের চেতনাকে অনেকটা উন্নত করতে পারতেন। মানুষ বুঝতে পারত যে, আমাদের পার্টিটা ভোটের পার্টি নয় - সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের পার্টি। কমরেড সৈয়দ সাহেদুল্লাহ’র ভাষায় - তিনি ছিলেন সেই সময়কার সেরা বক্তা।
১৯৬৭ সালের পর থেকে রাজ্যের কৃষক আন্দোলন যে গতি পেল, সেই গতিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য ৭০-এর দশকে নেমে এলো আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস। তখনকার কংগ্রেস সরকার রাজ্যের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার জন্য পশ্চিমবাংলায় ৬০ হাজার পুলিশের সঙ্গে ৫০ হাজার করে সিআরপি এবং মিলিটারি নামায়। ১৯৭০-এর দশকে কংগ্রেসের আক্রমণ সম্পর্কে কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার বললেন - ‘‘কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলার দায়িত্ব আমরা পেয়েছি, এরজন্য আমরা গর্বিত।’’ এই সময়ে আক্রমণের পাশাপাশি বড়ো বড়ো প্রতিরোধও গড়ে ওঠে। আহ্লাদিপুর, বিজুর, চকবলরাম, চৈতন্যপুর, সাঁইবাড়ি সহ রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। আক্রমণের প্রতিবাদে বড়ো বড়ো জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় অন্যতম প্রধান বক্তা থাকতেন কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার। তাঁর উৎসাহমূলক বক্তব্য মানুষের মধ্যে প্রতিরোধের ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলত। তখন আক্রমণ ছিল তীব্র, কিন্তু লালঝান্ডা ছিল মানুষের হৃদয়ে।
বিপ্লব সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘‘কিছু নেতা বক্তৃতা দিলেই তাঁদের কথা শুনে জনগণ বিপ্লবী হয়ে ওঠে না। জনগণ শেখে নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। নেতৃত্বের কাজ হলো জনগণের দৈনন্দিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের সংগঠিত করা এবং সেই সঙ্গে মার্কসবাদী প্রচারের দ্বারা তাদের চেতনাকে ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক স্তর থেকে রাজনৈতিক স্তরে উন্নীত করা। জনগণ অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে এর সত্যতা বুঝতে শেখে এবং ধাপে ধাপে নেতৃত্বের চেতনা জনগণের চেতনায় রূপান্তরিত হয়।’’
তিনি ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন সেখানকার ঐতিহাসিক লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা নিতে। কমরেড হো চি মিন এবং অন্যান্য নেতৃত্বের সঙ্গে আলোচনা করে সেই বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি লেখেনঃ ‘‘নেতৃত্বের কাজ শুধু সঠিক নীতি নির্ধারণই নয়, সেই নীতিকে জনগণের নীতিতে পরিণত করা, সেইমতো জনগণকে সংগঠিত করা ও তাদের সংগ্রাম পরিচালনা করা ...বহু অভিজ্ঞতার বিনিময়ে মানুষ লড়াইয়ে শামিল হয়। সশস্ত্র প্রতিরোধ দেওয়ালে রাইফেল আঁকার মতো সোজা নয়। ‘লড়বো ও মরবো’ এই মনোভাবে উদ্দীপ্ত হলেও সেইমতো প্রস্তুত হলে তবেই জনগণ বিপ্লবী পরিস্থিতিকে সফলভাবে কাজে লাগাতে পারে। সত্যিই লেনিনের এই কথা আমরা কেবল পড়েছি, হৃদয়ঙ্গম করিনি। মরতে প্রস্তুত হলেই মানুষ লড়তে পারে। আর লড়তে শিখলে তবে সে বাঁচবে। নিজেরা বাঁচতে যারা পাগল তাঁরা বাঁচতে জানে না। জীবনকে ভালবাসতে যে জানে, সে শত্রুকে ঘৃণা করতেও জানে। স্ত্রী, স্বজন, পরিজন ও জনগণের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে ন্যায় সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে। যে শত্রুকে ঘৃণা করতে অক্ষম, সে জনগণকে ভালোবাসতে পারে না।’’
তিনি ছিলেন একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা। তাঁর মৃত্যুর পর কমরেড বিনয় চৌধুরী লিখেছিলেনঃ ‘‘কমরেড হরেকৃষ্ণ’র কার্যকলাপ সমগ্র দেশবাসীর মনে কী গভীর রেখাপাত করেছিল - তাদের কী সুগভীর ভালোবাসা কমরেড হরেকৃষ্ণ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল - তা আমরা ২৪শে জুলাই, ১৯৭৪ অবিস্মরণীয় শোকযাত্রায় লক্ষ করেছি - লক্ষ করেছি সারা দেশে সর্বত্র যেভাবে কমরেড হরেকৃষ্ণ’র শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে।’’
তিনি ছিলেন একজন খাঁটি মার্কসবাদী, সুবক্তা, ভালো সংগঠক, কঠোর পরিশ্রমী। মাত্র ৫৯ বছর বয়সে আমরা তাঁকে হারিয়েছি। পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বড়ো ক্ষতি হয়েছে তাঁর অকাল মৃত্যুর মধ্যদিয়ে। আজ আমরা এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। পশ্চিমবাংলায় আমাদের পার্টির জনসমর্থন ভীষণভাবে হ্রাস পেয়েছে, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে। কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙারের জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের প্রতি দীর্ঘ আত্মপ্রত্যয় নিয়ে, শ্রমজীবী মানুষ সহ সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলে পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। কমরেড শান্তিময় ঘোষ তাঁর মৃত্যুর পর লিখেছিলেনঃ ‘‘তিনি জানতেন সমস্যার মধ্য থেকেই তার সমাধান পথ খুঁজে নেবে। আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর প্রগাঢ়। আর এই অগাধ আত্মবিশ্বাসেই প্রতিটি সঙ্কট মুহূর্তের বিভেদ, বিভ্রান্তি ও হতাশা কাটিয়ে সাধারণ মানুষ ও সংগঠকদের অগাধ আস্থা ও আদর্শের প্রতি অবিচল থাকতে অসাধারণভাবে উদ্বুদ্ধ করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন।’’
হরেকৃষ্ণ কোঙার লাল সেলাম।