৬০ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২১ পৌষ, ১৪২৯
নন্দকুমারে আবাস যোজনায় দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে পুলিশের বর্বরোচিত হামলা
আবাস যোজনায় দুর্নীতির প্রতিবাদে নন্দকুমারে সিপিআই(এম)-র বিক্ষোভে পুলিশের বর্বর আক্রমণ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ বর্ষ শেষ হবার মুখে আবারও রাজ্যের তৃণমূল সরকারের পুলিশের নৃশংস বর্বরতার সাক্ষী থাকলো রাজ্য। গত ৩০ ডিসেম্বর পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দকুমারে আবাস যোজনায় ঘর চাইতে গিয়ে ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর সরকারের পুলিশের নৃশংস আক্রমণে আহত হলেন প্রায় শতাধিক মানুষ। ন্যায্য ঘরের দাবি জানাতে গিয়ে গরিব গৃহবধূ আরজুনা বিবিকে রাস্তায় ফেলে নির্মমভাবে পেটায় পুলিশ। গরিব শ্রমজীবী মানুষদের হকের আবাসের দাবি নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে গিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীদের সাথে আহত হন অগণিত পার্টিকর্মী। পুলিশি বর্বরতার এখানেই শেষ নয়, তৃণমূলী দুর্বৃত্তদের মতো মমতা সরকারের পুলিশ হিংস্র উষ্ণতায় নন্দকুমারে সিপিআই(এম) অফিসে ঢুকে চেয়ার টেবিল ভাঙচুর করে তাণ্ডব চালায় নন্দকুমার থানার ওসি মনোজ কুমার ঝাঁ সহ পুলিশবাহিনী। সেখান থেকে সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহিকে মারতে মারতে বের করে রাস্তা দিয়ে টানতে টানতে পুলিশ ভ্যানে তোলা হয়। আক্রান্ত হন সিপিআই(এম)’র জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পরিতোষ পট্টনায়েকসহ অসংখ্য পার্টিকমী সমর্থক।
আবাস যোজনায় ঘরের দাবিতে বিডিও-র কাছে স্মারকলিপি দেবার কর্মসূচিতে শামিল সিপিআই(এম) নেতা-কর্মী-সমর্থকদের পাশাপাশি গ্রামের গরিব মানুষদের ওপর পুলিশের এই হিংস্র অক্রমণের প্রতিববাদে এদিন রাত থেকেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রতিটি ব্লক এলাকায় প্রতিবাদ-বিক্ষোভে নামেন সিপিআই(এম)’র কর্মী-সমর্থকরা।
এই নৃশংস ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। এই ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি রাজ্যজুড়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করার ডাক দেন। পুলিশের এই নির্মম আচরণ জনগণের সামনে আবারও স্পষ্ট করে তুলে ধরার আহ্বান জানান।
ঘটনার পরদিন (৩১ ডিসেম্বর) কলকাতায় সিপিআই(এম) রাজ্য দপ্তরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, গণজমায়েতের পাশাপাশি আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে নন্দকুমারে বর্বর নির্যাতনকারী তৃণমূল সরকারের পুলিশকে। তিনি বলেছেন, নতুন বছরে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সম্পাদক হবে। মানুষ জাগছে, চোরদের চিনিয়ে দিয়ে জেলে পোরার দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে। আর পুলিশ চোরদের বাঁচাতে প্রতিবাদীদের ওপরে নৃশংস হিংসাশ্রয়ী আক্রমণ করেছে নন্দকুমারে। কার নির্দেশে পুলিশ ঘর না পাওয়া নিরীহ মহিলাকে বেইজ্জত করে নির্যাতন করেছে, কার নির্দেশে পুলিশ সিপিআই(এম) অফিসে ঢুকে ভাঙচুর করেছে? শাস্তির দাবিতে দোষী পুলিশকে আদালতে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে।
এই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, রাজ্যজুড়ে এই ঘটনার প্রতিবাদ হচ্ছে। আমরাও যাব নন্দকুমারে। পুলিশ মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের কত হিম্মত আছে বুঝে নিতে রাস্তায় এবং আদালতে মোকাবিলা করা হবে।
এই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত পার্টির পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি ৩ জানুয়ারি নন্দকুমারে ফের জমায়েত করার কথা ঘোষণা করেন।
তৃণমূলী জমানায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি গোটা দেশে নজর কেড়েছে। বর্তমানে আবাস যোজনায় সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় রাজ্য। এর বিরুদ্ধে সমস্ত জেলাতেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ তীব্র আকার নিচ্ছে। আবাস যোজনায় দুর্নীতির প্রতিবাদে। প্রকৃত গরিব প্রাপকদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার দাবিতে এমনই একটি ডেপুটেশনের কর্মসূচি ছিল নন্দকুমার বিডিও অফিসে। এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ৩০ ডিসেম্বর বিকাল চারটে নাগাদ নন্দকুমারে সিপিআই(এম) অফিস থেকে একটি বের হয়। মিছিলে শামিল ছিলেন সিপিআই(এম)’র কর্মী, সদস্যসহ কয়েকশো গ্রামবাসী। নন্দকুমার বাজার ঘুরে মিছিলটি বিডিও অফিসে পৌঁছায়। মিছিলে নেতৃত্ব দেন নিরঞ্জন সিহি, পরিতোষ পট্টনায়েক, শান্তনু দাস, রীতা দত্ত সহ অন্যান্য পার্টি নেতৃত্ব।
সেখানে বিনা প্ররোচনায় পরিকল্পিতভাবে পুলিশ ডেপুটেশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের উপর বর্বরোচিত আক্রমণ নামিয়ে আনে। ‘দুয়ারে সরকার’ থেকে বিডিও অফিসে বারে বারে ঘুরেও ঘর না পাওয়া গরিব খেতমজুরের স্ত্রী মধ্যবয়সি আরজুনা বিবিকে বিবস্ত্র করে নির্বিচারে লাঠি দিয়ে আঘাত করে পুলিশ। মারধর করা হয় নিরঞ্জন সিহি সহ অন্যান্য পার্টিকর্মীদের মহিলাদের চুলের মুঠি ধরে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়। ছিঁড়ে দেওয়া হয় লাল পতাকা সেখান থেকে পার্টি নেতৃত্বকে কোনোমতে পার্টি অফিসে নিয়ে আসা হয়। এরপর নন্দকুমার থানার ওসি’র নেতৃত্বে বিরাট পুলিশ বাহিনী পার্টি দপ্তরে ভাঙচুর চালায়। নিরঞ্জন সিহি, শান্তনু দাস, চন্দন সহ পার্টি নেতা কর্মীদের টেনে বার করে মারতে মারতে গাড়িতে তোলে। পুলিশের আক্রমণে আহত হন শতাধিক অংশগ্রহণকারী। পুলিশের লাঠিতে অনেকেরই মাথা ফাটে। নন্দকুমারের খেজুরবেড়িয়া হাসপাতালে ভর্তি করতে হয় ২৫ জনকে। পার্টির জেলা সম্পাদকসহ ১৮ জনকে পুলিশ থানায় আটক করে। রাতে অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়। বাকিদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়। থানার লকআপেও আরজুনা বিবিকে নৃশংস অত্যাচার করে পুলিশ।
নন্দকুমারের এই বর্বরোচিত ঘটনার পরই চাঞ্চল্যকর খবর সংবাদমাধ্যমে উঠে এসেছে। জানা গেছে, সেদিন নন্দকুমারে থানার ওসি মনোজ ঝা’র সাথে যে পুলিশকর্মীরা নিরীহ মানুষদের ওপর নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছিল এবং তাণ্ডব চালিয়েছিল সিপিআই(এম) অফিসে, তাদের মধ্যে অন্যতম, নন্দকুমার থানার পুলিশকর্মী, থানার এএসআই সৈয়দ মিশাদ আহমেদ। থানার কাছাকাছি থাকা কুমোরআড়া পঞ্চায়েতে এলাকায় তিনি পরিচিত তৃণমূলের দাপুটে নেতা হিসেবেই!
অন্যদিকে জানা গেছে, নন্দকুমারের বিডিও ডব্লিউবিসিএস পরীক্ষায় মেইনস পরীক্ষায় চারটি কম্পালসরি পেপারে কম নম্বর পেয়েও নাকি মেধা তালিকায় এগিয়ে গিয়েছিলেন। সেই বিডিও-ই আবাস যোজনায় দুর্নীতি নিয়ে ডেপুটেশন নিতে অস্বীকার করেছেন।
দেখা যাচ্ছে এভাবেই তৃণমূলের রাজত্বে প্রশাসন সহ সর্বস্তরে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। এই দুর্নীতি-কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে যখন প্রতিবাদ-বিক্ষোভে শামিল হচ্ছেন মানুষ, তখনই ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে মমতা সরকারের পুলিশ প্রশাসন বর্বরোচিত আক্রমণ নামিয়ে আনছে। তবুও থেমে নেই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ। তা ক্রমান্বয়ে রাজ্যজুড়েই বিরাট আকার নিচ্ছে। বর্তমানে সেই চিত্রই ক্রমশই জোরালো হচ্ছে রাজ্যের বুকে।