E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২১ পৌষ, ১৪২৯

চরম দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে দ্বিমুখী লড়াইয়ে বামপন্থীদের নেতৃত্ব দিতে হবে

প্রকাশ কারাত


‘গণশক্তি’র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে বলছেন প্রকাশ কারাত। মঞ্চে নেতৃবৃন্দ।

[৩ জানুয়ারি ‘গণশক্তি’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণের সংক্ষিপ্ত রূপ।]

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চরম দক্ষিণপন্থার যে বিকাশ দেখা যাচ্ছে তা বিশেষ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের পার্টির ২২ ও ২৩ তম কংগ্রেসে এ বিষয়টি উল্লেখিত হয়েছিল যে, বিভিন্ন দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থীরা যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং তারা সরকার গঠন করছে। ইয়োরোপের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ ইতালিতে গত বছর চরম দক্ষিণপন্থী শক্তি সরকার গঠন করেছে। এদেশে যে তিনটি দলের জোট সরকার রয়েছে তাদের মধ্যে দুটি উগ্র দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে আগে থেকেই পরিচিত ছিল। আরেকটি নতুন দল আছে যারা মুসোলিনিপন্থী, নব্য ফ্যাসিবাদী। এরা ‘ব্রাদারস অফ ইটালি’ বলে পরিচিত। এই দলের নেতা মেলোনি বর্তমানে ইতালির প্রধানমন্ত্রী।

শুধু ইতালিতে নয় ফ্রান্সেও চরম দক্ষিণপন্থীদের একটি শক্তিশালী দল রয়েছে যা অতীতে ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে এবং এখন ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স নামে পরিচিত। এই দলের নেত্রী মারিন লা পেন গত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। জার্মানিতে চরম দক্ষিণপন্থী দল অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি ১৫ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। স্পেনে এহেন উগ্র দক্ষিণপন্থীরা এখন তৃতীয় বৃহত্তম শক্তি। সুইডেনে তিনমাস আগে একটি দক্ষিণপন্থী জোট তৈরি হয়েছে। এখানেও একটি চরম দক্ষিণপন্থী নিও ফ্যাসিস্ট দল রয়েছে যারা বৃহত্তম দল। এরা সরকারে না থাকলেও সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন করছে। এইরকম আরো উদাহরণ আছে।

ইয়োরোপের সব দেশে নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় যে সংকট চলছে তারই প্রেক্ষাপটে এই দেশগুলিতে চরম দক্ষিণপন্থার উত্থানের বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে হবে। ২০০৮ সালে যে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের সূত্রপাত হয় তা নয়া উদারবাদের সংকট। এই সময় একদিকে করপোরেট সংস্থা, ব্যাংক, বড়ো বড়ো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বিপুল পরিমাণ বেইল আউট প্যাকেজ দেওয়া হয় যাতে তারা এই সংকট থেকে মুক্ত হতে পারে। অন্যদিকে শ্রমিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী জনসাধারণের জন্য ব্যয় সংকোচের নীতি গৃহীত হয়। তাদের বেতন ছাঁটাই করা হয়, সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে অর্থ ব্যয় কমানো হয়, পেনশন কমিয়ে দেওয়া হয় ইত্যাদি। এছাড়া পুঁজিবাদের অভ্যন্তরে কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি থেকে শিল্প উন্নয়নশীল দেশ যেমন চীনে স্থানান্তরিত হচ্ছিল। এর ফলে ইয়োরোপের দেশে দেশে শ্রমিক শ্রেণির সংখ্যার দিক দিয়ে হ্রাস ঘটে, তাদের এক বিরাট অংশ জীবিকা হারায় এবং তাদের সামাজিক জীবন ছন্নছাড়া হয়ে যায়। এই সমস্ত কিছুর অভিঘাতে শ্রেণি হিসেবে শ্রমিক শ্রেণি দুর্বল হয়ে পড়ে। ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে এভাবে যে আর্থ-সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয় তা উগ্র দক্ষিণপন্থা বিকাশের উর্বর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়।

বিগত বেশ কিছু বছর ধরে ইয়োরোপে ক্রমশ অভিবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া, ইরাক, লিবিয়ার মতো বিভিন্ন দেশে যে হিংসা ও গৃহযুদ্ধ চলেছে তার দরুণ বিপুল সংখ্যক মানুষ দেশত্যাগ করে ইয়োরোপে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। উগ্র দক্ষিণপন্থী দলগুলি, এদেরকে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করলেও নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় এরা সস্তার শ্রমিক হিসেবে কার্যকর ভূমিকা নিয়েছে, যেমন জার্মানিতে। এই অভিবাসীদেরকে ইয়োরোপীয়দের কর্মসংস্থানের পক্ষে এবং স্থানীয় সংস্কৃতির পক্ষে বিপদ হিসেবে চিহ্নিত করেছে উগ্র দক্ষিণপন্থী দলগুলি। এরা ফ্রান্স, স্পেন, ইতালির মতো বিভিন্ন দেশে ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম-আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সমস্ত উগ্র দক্ষিণপন্থী দলের এটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য যে তারা ‘অপর’ বা জনসাধারণের মধ্যে ভিন্ন রকম অংশকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে। এক্ষেত্রে ইয়োরোপে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে অভিবাসীরা। ভিনদেশ থেকে আসা এই সমস্ত মানুষের গায়ের বর্ণ, ধর্ম ও সংস্কৃতিকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে তোলা হয়েছে এবং ইয়োরোপীয়দের মনে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে। ইয়োরোপের শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার ওপর নয়া উদারবাদী আক্রমণ যে সংকট ডেকে এনেছে এবং তার দরুন যে ক্ষোভ জন্মেছে তাকে অসহায় অভিবাসীদের দিকে চালিত করা হয়েছে, যারা বিনা দোষে নিজেদের দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। ইয়োরোপের এই সমস্ত দেশে শ্রমিক শ্রেণির ছন্নছাড়া অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বামপন্থীরা কোনো কার্যকর ভূমিকা নেওয়ার অবস্থায় নেই। ইতালির কমিউনিস্ট পার্টি দুই দশক আগেও যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল, কিন্তু তার অস্তিত্ব এখন নেই বললেই চলে। এই শূন্যস্থান পূরণ করছে উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তি। এরা ফ্যাসিবাদীদের চিরাচরিত কায়দায় বিপ্লবী বুলি আউড়ে শ্রমিক শ্রেণি ও শ্রমজীবী জনগণকে আকর্ষিত করে। কিন্তু পুঁজিবাদকে কখনও চ্যালেঞ্জ করেনা। বর্তমানে এই উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি যুগের প্রয়োজনে তাদের কর্ম কৌশলে কিছু বদল এনেছে যদিও এদের মর্মবস্তু অপরিবর্তিত রয়েছে।

অন্য দিকে আমেরিকায় আমরা দেখেছি ট্রাম্পের উত্থান। বিগত নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হলেও ট্রাম্পের ভাবনা সেদেশে যথেষ্ট পরিমাণেই ক্রিয়াশীল আছে। রিপাবলিকান দল আরো উগ্র দক্ষিণপন্থী হয়ে উঠছে। ব্রাজিলে বলসোনারো সেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শাসক হিসেবে সরকার পরিচালনা করেছিলেন, যার মধ্যে সমস্ত ফ্যাসিবাদী প্রবণতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কোভিড সংক্রমণকে সাধারণ সর্দি কাশির সাথে তুলনা করা, প্রতিষেধকের ব্যবস্থা না করার জন্য সে দেশে ৭ লক্ষ মানুষ মারা যায়। আমাজনের বিপুল অরণ্যসম্পদকে ধ্বংস করার কাজে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে তিনি সহায়তা করেন। বলসোনারো বর্ণবৈষম্যবাদী এবং ব্রাজিলের আদি বাসিন্দাদের চরম বিরোধী। ব্রাজিলের সদ্য সমাপ্ত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রত্যাশা করা হয়েছিল যে মধ্য-বামপ্রার্থী লুলা ব্যাপকভাবে বলসোনারোকে পরাস্ত করবেন। কিন্তু মাত্র এক শতাংশেরও কম ভোটের ব্যবধানে লুলা জয়ী হয়েছেন। বলসোনারোর মতো উগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদের পেছনে বিপুল জনসমর্থনের ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছে ইভানজেলিকাল চার্চ - যাদের বিপুল সম্পদ, রেডিয়ো স্টেশন, টিভি চ্যানেল চরম দক্ষিণপন্থার প্রসারের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।

চরম দক্ষিণপন্থী শাসনের আরেক উদাহরণ তুরস্ক। এই দেশের শাসক এরদোগান, যিনি অতীতে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং দীর্ঘ ১৬-১৭ বছর যাবত রাষ্ট্রপতি, তিনি ইসলাম ধর্ম ও তুর্কী জাতীয়তাবাদকে ব্যবহার করে বারে বারে নির্বাচনে জিতছেন। অতীতে তুরস্ক ছিল একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ, কিন্তু পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে তুরস্কের ইসলামিকরণ হয় এবং এর সাথে তুর্কি জাতীয়তাবাদের প্রচার করা হতে থাকে যা কিনা সংখ্যালঘু কুর্দদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। এদেশে হিংসা, গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে চলেছে সংখ্যালঘু কুর্দদের বিরুদ্ধে এবং ক্রমশ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের পতাকাতলে সংখ্যাগরিষ্ঠ তুর্কি জনগণকে শামিল করা হয়েছে। তুরস্কের বিরোধীদের দমন করবার জন্য যথেচ্ছ বল প্রয়োগ করে সে দেশের উগ্র দক্ষিণপন্থী শাসক দল। বিগত নির্বাচনে যিনি এর্দোগানের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছিলেন তিনি পাঁচ বছর ধরে জেল বন্দি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু অধ্যাপক, অনেক সাংবাদিক কারারুদ্ধ। সেনাবাহিনীর ৪০ জন জেনারেলকে কারাবন্দি করে রাখা হয়েছে কেননা তারা ধর্মনিরপেক্ষ। এই তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগী। তুরস্কের বিচারব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বত্র একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিজের শাসনকে দীর্ঘায়িত করছেন এরদোগান। আমাদের দেশে মোদি এক অর্থে এই এরদোগান মডেলকে অনুসরণ করছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উগ্র দক্ষিণপন্থীশক্তির উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে আরএসএস এবং বিজেপি পরিচালিত সরকারের কার্যধারা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, সমস্ত দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলোর মধ্যে কিছু অভিন্ন বিষয় রয়েছে। ইয়োরোপে যেমন অভিবাসীদের, তুরস্ককে যেমন কুর্দদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে সেই রকম ভারতে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে মুসলমানরা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খ্রিস্টানদেরকেও মুসলমানদের সাথে অভ্যন্তরীণ শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ইয়োরোপ এবং অন্যান্য দেশের উগ্র দক্ষিণপন্থীশক্তিগুলির মতোই আমাদের দেশের উগ্র দক্ষিণপন্থীশক্তি আরএসএস-বিজেপি কখনোই পুঁজিবাদকে চ্যালেঞ্জ করে না, বরং তারা শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চায় অন্য একটি ধর্মের মানুষকে। আমাদের দেশের শাসক দল বিজেপি আরএসএস’র রাজনৈতিক শাখা। এরা প্রচার করে যে, ভারতে হিন্দুরা আর্য গোষ্ঠীভুক্ত এবং এই আর্যরাই ভারতের আদি বাসিন্দা। তাদের মতে এই দেশ কেবল হিন্দুদেরই নিজস্ব ভূমি, অন্যরা সকলে বিদেশি। আমাদের দেশে এই উগ্র দক্ষিণপন্থীশক্তি এখন রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত করছে এবং দেশের প্রধানতম রাজনৈতিক শক্তি হয়ে গিয়েছে। এদেশের বৃহৎ পুঁজিপতি বা করপোরেট সংস্থাগুলি আরএসএস-বিজেপির বক্তব্য, মতাদর্শ ও ঘৃণার রাজনীতি প্রতিনিয়ত প্রচার করছে। কেবল আম্বানি-আদানির মতো দু'একজন পুঁজিপতি নয়, সামগ্রিকভাবে সমস্ত বৃহৎ পুঁজির মালিকরা এই উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে মদত জোগাচ্ছে। হিন্দুত্ব নিয়ে করপোরেটের কোনো সমস্যা নেই, কেননা হিন্দুত্ববাদীরা যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করেছে তা করপোরেটদের স্বার্থসিদ্ধি করছে। করপোরেটের কাছ থেকে বিপুল অর্থ সাহায্য পেয়ে নির্বাচনের সময় ব্যপক অর্থ ব্যয় করছে বিজেপি। নিজেদের সংগঠন বৃদ্ধির কাজে এবং মতাদর্শগত প্রভাব বাড়াতে এই অর্থ ব্যবহৃত হচ্ছে।

কোনো কোনো অবাম রাজনৈতিক দল মনে করে যে নির্বাচনের সময় বুদ্ধিদীপ্ত ও কৌশলী নির্বাচনী জোট গড়লেই বিজেপিকে ঠেকিয়ে দেওয়া যাবে। নির্বাচনী সমঝোতা, জোট জরুরি, কিন্তু নিরবিচ্ছিন্নভাবে উগ্র দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক প্রচার না চালাতে পারলে এগুলি কোনো কাজেই আসবেনা। আরএসএস সারা বছর নানা রকম সামাজিক, শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করে। সরস্বতী শিশু মন্দিরের মতো অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তাদের রয়েছে। বিশেষ করে উত্তর ও পশ্চিম ভারতের এক বিরাট সংখ্যক মানুষ ইতিমধ্যেই এই হিন্দুত্বের মতাদর্শের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েছে। উত্তর প্রদেশ ও গুজরাটে নির্বাচনের সময় দেখা গেল যে মানুষের আর্থিক সমস্যা থাকলেও বিজেপি'র ভোটের শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। জনগণের ব্যাপক অংশের মধ্যে হিন্দুত্বের মতাদর্শগত প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ার ফলেই এটা সম্ভবপর হয়েছে। একে প্রতিহত করতে হলে দুই দিক দিয়ে লড়াই করতে হবে। একদিকে নয়া উদারবাদের নীতিসমূহ, মূল্যবৃদ্ধি,বেকারি, শ্রমজীবী জনগণের জীবনমানের অবনতি ইত্যাদি ইস্যুতে জনগণকে সংঘটিত করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই কোভিড অতিমারী চলাকালীন কৃষক আন্দোলন দেখেছি। এই সময়কালে ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক সংগঠন ও খেতমজুর সংগঠনগুলির মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংহতি লক্ষ করা গিয়েছে। সমাজের অপরাপর অংশকেও এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করার কাজ চলেছে। বঞ্চিত মানুষের বৃহত্তর ঐক্য গড়ার এই কাজকে ত্বরান্বিত করতে হবে। বেসরকারিকরণ, মূল্যবৃদ্ধি, বেকারি ইত্যাদির বিরুদ্ধে লাগাতার লড়াই চালাতে হবে। কিন্তু এই সমস্ত লড়াই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক প্রভাব ফেলতে পারবে না যদি হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক লড়াই সংগঠিত না করা যায়। করপোরেট মিডিয়া এদেশে সর্বক্ষণ হিন্দুত্বের মতাদর্শগত প্রচার করে চলেছে। দুর্ভাগ্যের হলেও একথা সত্য যে কিছু বুর্জোয়া দল হিন্দুত্বের মতাদর্শকে সরাসরি মোকাবিলা না করে নরম হিন্দুত্বের নীতি অনুসরণ করছে। যেমন কেজরিওয়াল গুজরাটে নির্বাচনের সময় এই চেষ্টা করেছেন এবং যথারীতি ব্যর্থ হয়েছেন। কেননা এই ধরণের প্রচেষ্টার ফলে উগ্র দক্ষিণপন্থী শক্তি ও হিন্দুত্বের মতাদর্শ আরো বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। এখানেই বামপন্থীদের গুরুত্ব, কেননা বামপন্থীরা ছাড়া কেউই উগ্র দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্বের রাজনীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সমবেত করে মতাদর্শগত এবং রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম নয়। একমাত্র বামপন্থীরাই হিন্দুত্বের নেতিবাচক দিকগুলিকে তুলে ধরতে এবং বিকল্প হাজির করতে সক্ষম। তাই জাতীয় ক্ষেত্রে বামপন্থীদের শক্তি অনেক অবাম দলের থেকে কম হলেও হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত লড়াইয়ে বামপন্থীদেরই পথ দেখাতে হবে যাতে বাকিরা তা অনুসরণ করতে পারে।

কৃষক আন্দোলনের সফলতার পর অনেকের ধারণা হয়েছিল যে, অন্ততপক্ষে উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে বিজেপি হেরে যাবে। কিন্তু ভোটের ফল প্রকাশের পর দেখা গেল উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে বিজেপি'র কিছু সিট কমলেও তারা কিন্তু সেখানেও বিজয়ী হয়েছে। এই অঞ্চলে হিন্দু ও মুসলমান কৃষিজীবীদের মধ্যে যে বিভেদ সৃষ্টি করেছিল সঙ্ঘ পরিবার তা এই কৃষক আন্দোলনের জন্য কিছুটা প্রশমিত হলেও পুরোপুরি ঘুচে যায়নি। তাই বিজেপি-কে খাটো করে দেখা কখনোই উচিত নয়। আমাদের সময়োপযোগী পার্টি কর্মসূচিতে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, বিজেপি অন্য বুর্জোয়া দলগুলির চেয়ে আলাদা ধরনের দল যা ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা আর এস এস এর দ্বারা পরিচালিত। তাই বিজেপি-কে পরাস্ত করতে হলে বামপন্থীদের এই মতাদর্শগত সংগ্রামের দিকটিকে অবশ্যই শক্তিশালী করতে হবে। নরেন্দ্র মোদি এই বিষয়টি জানেন। সে কারণে ত্রিপুরায় বামপন্থীদের হারিয়ে বিজেপি'র সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন যে, এই জয় আমাদের মতাদর্শগত জয়। গতবছর একটি সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছেন যে, কমিউনিস্টরা দেশের একটি কোনে অর্থাৎ কেরালায় রয়েছে, কিন্তু এখনো তারা মতাদর্শগতভাবে বিপদ। অর্থাৎ বিজেপি-আরএসএস এ কথা অনুভব করে যে কমিউনিস্টরা এবং বামপন্থীরাই তাদের মতাদর্শগতভাবে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আমাদের আগামী দিনে এই উগ্র দক্ষিণপন্থার বিরুদ্ধে দ্বিমুখী লড়াই পরিচালনা করার কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাদের দেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে ঐক্যবদ্ধ লড়াই আন্দোলনের ঐতিহ্য রয়েছে। এই ঐতিহ্য এত সহজে মুছে ফেলা যাবে না। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের দিনগুলি থেকে এই ঐতিহ্য ভারতের সমাজে রয়েছে। এই সময়কালে কৃষক আন্দোলনের দিনগুলিতে এই ধরনের ঐক্য দেখা গিয়েছে। আমরা যদি জনগণের মধ্যে গিয়ে ধৈর্য ধরে কাজ করি তাহলে হিন্দুত্বের এই বিভেদ মূলক রাজনীতি পরাস্ত হবে। স্বাধীনতার পর আমরা যে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সাধারণতন্ত্র গড়ে তুলেছিলাম তাকে রক্ষা করতে এই দায়িত্ব আমাদের পালন করতে হবে।