E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২১ পৌষ, ১৪২৯

সত্যিই কি স্বাস্থ্যের প্রকৃত সাথী?

ডাঃ দীপ্তজিৎ দাস


‘ছেলেটা কাতরাতে কাতরাতে মরে গেল। হাসপাতালের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেও একটা বেড মিলল না।’ হাহাকার করে বলে উঠলেন বাদুড়িয়ার হালিমা বিবি। গত সেপ্টেম্বর মাসে, ডেঙ্গু হয়েছিল তাঁর একমাত্র সন্তান শাহানুর রহমানের। হঠাৎই মূত্রে রক্ত আসায় ও প্লেটলেট কমতে থাকায় হাসপাতালে ভরতির প্রয়োজন হয়েছিল। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডের ভরসায় বেসরকারি হাসপাতালে গেলেও সবাই বেডের অভাব বলে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সরকারি হাসপাতালেও মেলেনি বেডের সন্ধান। কার্যত বিনা চিকিৎসায় মৃত্যু হয় বছর ২৫ এর শাহানুরের।

‘প্রথম তিন বছর আমরা নিয়মিত স্বাস্থ্য সাথী কার্ডে চিকিৎসা করতাম রোগীর। সরকার একজনের খরচ মেটাতেই প্রায় ৭-৮ মাস সময় নেয়। কিছু ক্ষেত্রে সেই খরচ পাওয়া যায়নি। একজন রোগীর জন্য স্বাস্থ্য সাথীতে যা বরাদ্দ তাতে বেড ভাড়া আর রোগীর খাবারের বেশি কিছু হয় না। ধমক চমকের ভয়ে এখন কিছু সার্জিক্যাল কেস আমরা নিই। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে বেড নেই বলেই এড়িয়ে যাই। না হলে আমার নার্সিংহোমটা যে লাটে উঠবে।’ স্বাস্থ্যসাথীর প্রসঙ্গ শুনতেই এমনটাই মন্তব্য বোলপুরের এক বেসরকারি নার্সিংহোম মালিকের।

প্রায় একই সুরেই কথা বললেন হাওড়ার একজন বিশিষ্ট চিকিৎসক। এলাকায় মানবদরদী বলেই পরিচিত তিনি। স্বাস্থ্য সাথী নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা জিজ্ঞাসা করতেই বলে উঠলেন, ‘দু বছর আগে কিছু স্বাস্থ্য সাথীর অধীন পেশেন্ট দেখেছিলাম আজও তার বরাদ্দ আমি পাইনি। রোগীর সাহায্যর জন্য তাকে বিনা পয়সায় দেখতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সরকার বা বিমা কোম্পানির দ্বারা এভাবে অপদস্ত কেন হবো? এমনিতেই আমার যা ফিজ তার চার ভাগের এক ভাগ দেয় ওরা।’

মাননীয়ার স্বপ্নের ও গর্বের প্রকল্প বলে ঢাক ঢোল বাজিয়ে প্রচার করা স্বাস্থ্য সাথী নিয়ে এভাবেই উঠে এলো সমাজের বিভিন্ন অংশের হতাশার কথা।

২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যের প্রস্তাবিত বাজেটে প্রথমবারের জন্য স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ওই বছরই ডিসেম্বর মাসে ৩০ তারিখে স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন মাননীয়া। ২০১৭-র পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকে রোল আউট হওয়া শুরু করে এই প্রকল্প। তবে প্রাথমিকভাবে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্যই এই প্রকল্প বরাদ্দ ছিল। পরবর্তী সময়ে এই প্রকল্পের বিভিন্ন সংযোজন বিয়োজন হতে থাকে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজ্যের সমস্ত অধিবাসীকে এই প্রকল্পের অধীনে আনার কথা ঘোষণা করা হয়। তবে এক্ষেত্রে যারা সরকারি বিভিন্ন বিমা প্রকল্পের সাথে আগেই যুক্ত ছিলেন তারা এর সুবিধা পাননি। এই প্রকল্পের অধীনে পরিবার পিছু বছরে ৫ লক্ষ টাকা স্বাস্থ্য বিমা নিশ্চিত করা হয়। বিভিন্ন রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভরতি হলে দেড় লক্ষ টাকা বিমার মাধ্যমে ও বাকি টাকা আশ্বাসের মাধ্যমে দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। কিন্তু বাস্তবের সাথে সরকারি দাবির বিস্তর ফারাক খালি চোখেই ধরা পড়েছে।

দীর্ঘদিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদী অর্থনীতির দ্বারা পরিচালিত বিমা কেন্দ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। কিন্তু তার গভীর সংকট করোনা অতিমারী আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছে।। সেই ধাঁচের অনুসরণে আমাদের দেশের সরকার আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পটি নিয়ে আসে। দাবি করা হয় দেশের ১০ কোটি পরিবারের পঞ্চাশ কোটি মানুষ এই প্রকল্পের সুবিধা পাবেন। তবে এই প্রকল্প ঘিরে মানুষের বিভিন্ন অসন্তোষ বিভিন্ন সময় পরিলক্ষিত হয়েছে। কেবলমাত্র এনএবিএল দ্বারা স্বীকৃত হাসপাতালে চিকিৎসার ক্ষেত্রে এই কার্ড স্বীকৃত হয়। স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিসংখ্যান আমাদেরকে বলছে, করোনা অতিমারীর সময় এদেশের মাত্র বারো শতাংশ মানুষ এই প্রকল্পের সুবিধা পেয়েছিলেন। ঠিক একই প্রক্রিয়ায় আমাদের রাজ্য সরকার স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প নিয়ে আসে ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনের আগে। যদিও ছদ্ম প্রতিযোগিতার আড়ালে জনস্বাস্থ্যকে পঙ্গু করে বেসরকারি বিমা কোম্পানির মুনাফাই ছিল প্রধান লক্ষ্য।

শুরু থেকে জনদরদি বলে বিপণন করা আয়ুষ্মান ভারতের সাথে ছদ্ম প্রতিযোগিতার কারণ দর্শানো হলেও আসলে এই প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনের আগে সাধারণ মানুষের মন কাড়ার চেষ্টা। মোদির জুমলার মতোই দিদির ভোট যুদ্ধের নির্লজ্জ কৌশল। সাধারণ মানুষকে সুরাহা দেওয়ার নূন্যতম প্রচেষ্টাও সরকারের ছিল না। পরিসংখ্যান খতিয়ে দেখলে আমাদের সামনে তা পরিষ্কার হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ২০২১ সালে রাজ্যের স্বাস্থ্য বাজেটে বরাদ্দ ছিল ১২ হাজার কোটি টাকা। স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের খাতে বরাদ্দ ছিল ২০০০ কোটি টাকা। অথচ এই প্রকল্পে দাবি করা হচ্ছে দুকোটি পরিবারের দশ কোটি মানুষকে পরিবার পিছু পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিমার। দশ কোটি মানুষের এক শতাংশ মানুষও যদি বছরে পাঁচ লাখ টাকার চিকিৎসা করার সুযোগ পায় তাহলে খরচ দাঁড়ায় পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা। যে সরকার প্রত্যেকদিন ঋণের জালে নিমজ্জিত হয়, যাদের আমলে গত ১১ বছরে রাজ্যের ঋণের পরিমাণ ১ লক্ষ ৯১ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৫ লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকা হয়েছে, তারা কোনভাবেই স্বাস্থ্য বিমার খাতে এই বিপুল অংকের টাকা ব্যয় করতে পারবে না।

এ রাজ্যে আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্প চালু হতে না দিয়ে মমতা ব্যানার্জি যতই নিজেকে বিজেপি বিরোধী প্রমাণ করার চেষ্টা করুন আসলে এই ছদ্ম বিরোধিতার আড়ালে লুকিয়ে আছে বিভিন্ন বেসরকারি করপোরেট সংস্থার মধ্যেকার দ্বন্দ্ব। ২০১৮ সাল অবধি স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের বিমা সংক্রান্ত বিষয় সরকারি সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্যুরেন্সের অধীনস্ত থাকলেও পরবর্তী সময় তা বেসরকারি সংস্থা বাজাজ আলিয়াঞ্জের হাতে হস্তান্তরিত হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য বেসরকারি সংস্থা কি তবে নিজেদের মুনাফা ছেড়ে মানুষের জন্য কাজ করবে? পৃথিবীর ইতিহাসে তা কখনো হয়নি। বরং করপোরেটরা বিমার বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে নিজেদের মুনাফা বৃদ্ধি করার জন্য। তার নির্লজ্জ পৃষ্ঠপোষকতার আরেক উদাহরণ এই স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পটি।

২০২১-এর নভেম্বরের শেষে করপোরেটের দাসত্বের আরও অভিনব নিদর্শন রাখে রাজ্য সরকার। ঘোষণা করা হয়, রাজ্যের সমস্ত সরকারি হাসপাতালে ভরতি হওয়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য সাথী কার্ড বাধ্যতামূলক করা হবে। এখানেই উঠছে বিভিন্ন প্রশ্ন? সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, যা বিপুল অংশের মানুষের কাছে একমাত্র ভরসার আশ্রয় কেবলমাত্র প্রকল্পভিত্তিক তাকে করে দেওয়া যায় কি? মুমূর্ষু রোগীকেও সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে হলে স্বাস্থ্য সাথী কার্ড সঙ্গে রাখতে হবে কি? যদিও বিভিন্ন মহলের প্রতিবাদ এবং দপ্তরের টালবাহানায় এখনো অবধি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত করা যায়নি। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সর্বনাশের পথই ঘুরিয়ে প্রশস্ত করতে চেয়েছে রাজ্য সরকার। এই কার্ডের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতালে উন্নত কোনো পরিষেবা মিলবে তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু স্বাস্থ্য যখন মানুষের মৌলিক অধিকার, সরকারি হাসপাতাল যেখানে বিনামূল্যে উন্নত মানের চিকিৎসা দিতে দায়বদ্ধ সেখানে বিমার প্রবেশের প্রয়োজনীয়তা কোথায়? সরকারি হাসপাতালের কাশি সর্দি বা অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় বিমা কার্ডের ব্যবহার মানুষের স্বাস্থ্য সাথী কার্ডের ব্যালেন্সে কতটা প্রভাব ফেলবে তাও যথেষ্ট আশঙ্কার। জনগণের করের টাকায় পরিচালিত সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা আবারও একইরকম জনগণের টাকায় সরকারি কোষাগার থেকে দেওয়া প্রিমায়ামের টাকায় বিমা কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে হবে কেন তার কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর মেলেনি।

তবে নির্বাচন কাটার পর থেকেই স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের পিছনে সরকারের ফাটকাখেলা উন্মোচিত হতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য দপ্তরের তরফ থেকে বারবার নির্দেশিকা জারি করে এই বিষয়ে গাইডলাইন বদলানো হয়েছে। অর্থোপেডিকের বিভিন্ন অস্ত্রোপচার ইতিমধ্যেই আওতার বাইরে করা হয়েছে। হার্নিয়া, হাইড্রোসিল, দাঁতের বিভিন্ন শল্য চিকিৎসাও সরকারি হাসপাতালের বাইরে করানো হলে স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের অধীনে আসবে না বলে সরকার জানিয়েছে। পাশাপাশি নার্সিংহোমগুলির ক্ষেত্রে শল্য চিকিৎসায় তার ফলাফলের ভিত্তিতে বরাদ্দের কাটছাঁটের লম্বা নোটিশ ধরিয়েছে রাজ্য সরকার। মুখে সকলের কাছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে যাওয়ার কথা বললেও কার্যত দিনে দিনে তার ক্ষেত্র সংকুচিত করার পথ প্রশস্ত করেছে এই স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প, তাকে কেন্দ্র করে সরকারের সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে।

স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের একাধিক ত্রুটি আমাদের চোখের সামনে এসেছে। সাধারণ মানুষের সুরাহার পরিবর্তে আরও বেশি করে ভোগান্তির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের মাধ্যমে। সরকারি হাসপাতালে এর বিনিময়ে কোনো অতিরিক্ত সুবিধা মেলেনি। উপরন্ত অভিযোগ, প্রকল্পের আওতায় হাসপাতাল থেকে ছুটির পরবর্তী পাঁচ দিনের ওষুধ এবং ফেরার যানবাহনের কথা হাসপাতালের তরফ থেকে দেওয়ার কথা বলা হলেও তা বহু ক্ষেত্রেই অমিল থাকছে। এমনকী হাসপাতালে জোগানের অভাবে বাইরে থেকে কেনা ওষুধের ক্ষেত্রেও এই কার্ড কোনরকম সহায়ক হচ্ছে না। বেসরকারি হাসপাতালের দ্বারা বারবার রোগীরা প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাসই সার। কার্যত কিছু শল্য চিকিৎসার বিষয় ছাড়া চিকিৎসা মিলছে না এই প্রকল্পের অধীনে। কোভিড অতিমারী সাম্প্রতিককালে ডেঙ্গুর বীভৎসতা এই সীমাবদ্ধতাকে আরও বেআব্রু করেছে আমাদের সামনে। চিকিৎসার আশায় নাকাল হতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে। তবে সম্পূর্ণ দোষ বেসরকারি হাসপাতালকে দেওয়াও অমূলক। বিগত সময়ের প্রায় কোটি কোটি টাকা সরকারের কাছে প্রাপ্য রয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের। এমনকী সরকারের দেওয়া কম বাজেটে কাজ করতে গিয়ে রোগীর ক্ষতিও হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। এমনকী সরকারি উদাসীনতা এবং গাফিলতির জন্য এই প্রকল্পের প্রতি তীব্র অনীহা তৈরি হয়েছে চিকিৎসক মহলেও। চিকিৎসকের নিজের সিদ্ধান্তে প্রয়োজনীয় টেস্ট করানো বা প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়াতেও বাধা সৃষ্টি করেছে এই প্রকল্পের কার্যকর্তারা। কার্যত সাধারণ মানুষ ও চিকিৎসক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে যুযুধান প্রতিপন্ন করে নিজের পিঠ বাঁচাতে চাইছে রাজ্য সরকার। যা এ রাজ্যের ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নির্দেশক।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করা। স্বচ্ছ পানীয় জলের ব্যবস্থা, মা শিশুদের পর্যাপ্ত পুষ্টির ব্যবস্থা করা, দূষণ প্রতিরোধ, নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা - এই বিষয়গুলির অগ্রাধিকার পাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের দেশ এবং রাজ্যের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে দেশের স্বাস্থ্য বাজেটের ৭০ শতাংশই ব্যবহার করা উচিত প্রাথমিক স্বাস্থ্য খাতে। কিন্তু দেশ এবং রাজ্যের সরকার সে বিষয়ে সম্পূর্ণ উদাসীন। দেশের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ জিডিপি'র ১.২ শতাংশ, রাজ্যের ক্ষেত্রে তা মাত্র ০.৯ শতাংশ । বিশ্বের সবচেয়ে বেশি যক্ষা আক্রান্ত রোগীর ঠিকানা আমাদের ভারত, সবচেয়ে বেশি অপুষ্ট শিশু এ দেশেই বাস করে। তাই আমাদের প্রয়োজন প্রাথমিক স্বাস্থ্য খাতে আরও আরও বেশি ব্যয়বৃদ্ধি এবং পরিকাঠামোর পর্যাপ্ত উন্নয়ন। কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো পথের পথিক আমাদের শাসকরা। সকলের স্বাস্থ্য নয় সকলের বিমা; মানুষের সুরক্ষা নয় করপোরেটের উদরপূর্তি লক্ষ্য তাদের।

এ রাজ্যের মাটিতে ৩৪বছরের বামপন্থী সরকার মানুষকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেই লক্ষ্য করেছিল। ৩৪ বছরে রাজ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের সংখ্যা ১৩২৬ থেকে বেড়ে হয়েছিল ১২০০০। শিক্ষা এবং সাক্ষরতার প্রসারের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা সম্ভব হয়েছিল স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়। কমেছিল জন্মহার, মৃত্যুহার, প্রসূতি মৃত্যুহার, শিশু মৃত্যুহার। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালগুলোতে চালু হয়েছিল উন্নত রোগ নির্ণয় পদ্ধতি। সরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত পরিমাণে জোগান দেওয়া হয়েছিল জীবনদায়ী ওষুধের। তাই ২০১১ সালে জাতীয় গড় আয়ু যখন পুরুষদের ক্ষেত্রে ছিল ৬৫.৮ বছর, রাজ্যের ক্ষেত্রে তা ছিল ৬৮.২৫ বছর। একইভাবে মহিলাদের ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে ৬৮.১ ও ৭০.৯ বছর ছিল।

করোনা অতিমারী সারা বিশ্বের সামনে পুঁজিবাদের নির্লজ্জ চেহারা তুলে ধরেছে। স্লোগান উঠেছে ‘corona is the virus capitalism is the pandemic.’ দক্ষিণপন্থী মিডিয়া হাউজও বলতে বাধ্য হয়েছে বামপন্থার জয়গানের কথা। বিশ্বের পুঁজিবাদী উন্নত দেশগুলো যখন ভাইরাসের মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে তখন ভিয়েতনাম কম্বোডিয়ার মতো সমাজতান্ত্রিক দেশ মাথা তুলে লড়াই করতে পেরেছে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের উন্নতির কারণে। বিশ্বজুড়ে ছুটে গেছে কিউবার হোয়াইট কোট ভলান্টিয়াররা। আমাদের দেশেও বামপন্থী অঙ্গরাজ্য কেরালার ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে গোটা বিশ্বে। বাংলার মাটিতে অতিমারীর ইতিহাসে রেড ভলান্টিয়ারের নাম চিরস্মরণীয় হয়েছে। কারণ এটাই বামপন্থার শিক্ষা। তখনই এ রাজ্যের সরকার কোমর্বিডিটির আড়ালে করোনায় প্রকৃত মৃত্যুর তথ্য আড়াল করেছে। মেডিকেল কলেজে শাসকদলের নেতার মদতে চলেছে মূল্যবান ওষুধের কারচুপি। শাসকের আড়ালে জাল ভ্যাকসিন বিতরণ করেছেন চোরাকারবারিরা। সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে শয্যার ব্যবস্থায় অক্ষম হয়েছে স্বাস্থ্য সাথীর কার্ড।

বিগত ১১ বছরে এরাজ্যের সরকার রেকর্ড করেছে ভাঁওতার। তারই অন্যতম প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প। চমকে মোড়া স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড প্রকল্পের তলায় লুকিয়ে থাকে তিথি দলুইয়ের আর্তনাদ। গত দুবছরে স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড বাবদ আবেদন মঞ্জুর হয়েছে মাত্র ১৯ শতাংশ পড়ুয়ার। একই অবস্থায় আর্টিজেন এবং উইভার ক্রেডিট কার্ড। রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের স্বপ্নভঙ্গের হাতিয়ার হয়েছে ফাঁকা ওএমআর শিট। সেই প্রতারণার রাজ্যে ছলনার আরেক নাম স্বাস্থ্য সাথী। বিমার খাতে খরচার এই বিপুল টাকা করপোরেটের হাতে তুলে দেওয়ার বদলে সরকারি চিকিৎসা পরিকাঠামো উন্নত করাই ছিল সরকারের প্রকৃত কাজ। কিন্তু বিমার নামে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করল সরকার। নিজেদের কাছ থেকে চিকিৎসার দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে, বাজারের হাতে তা সঁপে দেওয়ার নির্লজ্জ দুঃসাহসিক কাজ করার দৃষ্টান্ত রাখল তারা। সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থার ভেঙে পড়া অবয়ব আড়াল করার উদ্দেশে নতুন মোড়কে এই স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের উদ্ভাবনা। সকলের জন্য স্বাস্থ্য বামপন্থার বুনিয়াদি দাবি। সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখার কারিগররা চায় সরকারি তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। তৃণমূল সরকারের ভাঁওতাবাজির বিরুদ্ধে বামপন্থীদের লড়াই জারি থাকবে প্রতিনিয়ত।