৬০ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২১ পৌষ, ১৪২৯
‘দুয়ারে সরকার’ জনগণের কাজে আসেনি
সুপ্রতীপ রায়
২০২০ সালের ডিসেম্বরে ‘দুয়ারে সরকার’ চালু করে তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার। বলা হয়েছিল, ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্পের মাধ্যমে জনসাধারণের সমস্যার কথা শুনে তার সমাধানের চেষ্টা করবেন সরকারি আধিকারিকরা। এছাড়া সরকারি প্রকল্পগুলিতে আবেদনের জন্য পাড়ায় পাড়ায় ক্যাম্প করা হবে। রাজ্য সরকার ঘোষণা করেছিল, সরকারি পরিষেবাকে প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই ‘দুয়ারে সরকার’। বলা হয়েছিল, অফলাইনের মাধ্যমে ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্প থেকেই প্রকল্পের জন্য আবেদন করা যাবে।
সরকারি ঘোষণা ছিল, এই প্রকল্পটির মাধ্যমে জনসাধারণের সমস্যার কথা শুনবেন সরকারি প্রতিনিধিরা এবং তার সমাধানের চেষ্টা করবেন। সরকারি প্রকল্পের সুবিধা দেওয়ার জন্য করা হবে রেজিস্টার এই রেজিস্ট্রি কীভাবে করা যাবে?
(ক) প্রকল্পটির রেজিস্ট্রেশন হবে সম্পূর্ণ অফলাইনে। প্রকল্পটির আবেদন করতে জনগণকে স্থানীয় ‘দুয়ারে সরকার’-এর ক্যাম্পে যেতে হবে।
(খ) ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্পে রেজিস্ট্রেশন করার জন্য যাবতীয় নথি প্রমাণপত্র থাকা বাধ্যতামূলক।
(গ) নথি দেখেই কম্পিউটার ডেটাবেসে নাম নথিভুক্তিকরণ হবে।
‘দুয়ারে সরকার’ সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রীর ছবিযুক্ত সরকারি বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ২৫ ধরনের সরকারি পরিষেবা দেওয়া হবে ‘দুয়ারে সরকার’-এর ক্যাম্প থেকে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, স্বাস্থ্যসাথী, কন্যাশ্রী, স্টুডেন্ট ক্রেডিট কার্ড, খাদ্য সাথী, জাতি শংসাপত্র, শিক্ষাশ্রী, রূপশ্রী, বার্ধক্য ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, বিধবাভাতা, তপশিলি বন্ধু জয় জোহার, ঐক্যশ্রী, মানবিক প্রকল্প, এম জি এন আর ই জি এস ১০০ দিনের কাজ, কৃষক বন্ধু, কিষান ক্রেডিট কার্ড, মৎসজীবী ক্রেডিট কার্ড সহ আরও অনান্য প্রকল্পের আবেদন এই ক্যাম্পের মাধ্যমে করা যাবে।
রাজ্য সরকার বলছে, ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প নাকি দারুণ সাফল্য পেয়েছে। তাই এবছর নভেম্বর মাসের ৩০ তারিখ যে ক্যাম্প শেষ হওয়ার কথা ছিল তার মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে এবং পাড়ায় সমাধান কর্মসূচিরও মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
কিন্তু বাস্তব চিত্র কী? আদৌ কি মানুষ সহায়তা পাচ্ছেন? সরকারি প্রচার যাই থাকুক না কেন মানুষ সহায়তার বদলে হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
প্রথমেই দেখা যাক ১০০ দিনের কাজের ক্ষেত্রে কি ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন গ্রামীণ মানুষ। নভেম্বর মাসের ‘দুয়ারে সরকার’ শিবিরে দলে দলে গরিব মানুষ রেগার টাকার খোঁজ করতে এসেছিলেন। মানুষ জানতে চেয়েছেন, কবে রেগার কাজ শুরু হবে। রাজ্যের কোনো ‘দুয়ারে সরকার’ শিবিরেই সরকারি আধিকারিকরা এর উত্তর দিতে পারেননি। কিন্তু মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য সাদা কাগজে দরখাস্ত করিয়ে নেওয়া হয়েছে। গত নয় মাস রেগার কাজ বন্ধ হয়ে আছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে রেগার কাজের মজুরি বকেয়া পড়ে আছে। অর্থাৎ গরিব মানুষ কাজ ফেলে ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্পে এসে ফাঁকা হাতে ফিরে গেছেন।
জাতিগত শংসাপত্র নিতে গিয়ে চরম হয়রানির মধ্যে মানুষ পড়ছেন। নদীয়ার বাদকুল্লা ২নং গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা স্বপন মল্লিক তিনবার ‘দুয়ারে সরকার’-এ আবেদনপত্র জমা দিয়েও শংসাপত্র পাননি। বেশিরভাগ মানুষ সমস্ত নথিপত্র দিয়েও শংসাপত্র পাচ্ছেন না। সরকারি আধিকারিকদের এবিষয়ে জিঞ্জাসা করলে বলেন, ‘‘প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে।’’ এ প্রক্রিয়া কবে শেষ হবে কেউ জানে না।
‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্পে যাঁরা আবেদন জমা দিচ্ছেন তাঁদের জমা দেওয়ার কোনো রসিদ দেওয়া হচ্ছে না। ফলে অনেক সময় আবেদনপত্র জমা দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করা হচ্ছে।
বার্ধক্যভাতা, বিধবা পেনশনের ক্ষেত্রে চিত্র খুবই খারাপ। নদীয়া জেলার হাঁসখালির মণ্ডপঘাট-২নং বুথের সুরধনি মজুমদার, বিমল সরকার কিংবা বাপুজিনগর গ্রামের সুবীর মিত্ররা ‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্পে বারংবার আবেদন করেও বার্ধক্যভাতা পাননি। আবার রানাঘাট ১নং ব্লকের বারাসতের পরিতোষ কর্মকারের অনেক কষ্টে বার্ধক্যভাতা চালু হলেও তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার কোনো উত্তর মেলেনি।
‘দুয়ারে সরকার’ ছাড়া ‘দুয়ারে রেশন’ চালু হয়েছে। সেখানে তো গ্রাহকের অসুবিধা আরও বেড়েছে। কখন কোন গ্রামে রেশন দেওয়া হবে তা অনেক মানুষ জানতেই পারছেন না।ফলে সুবিধা হচ্ছে একদল অসাধু ডিলারের।
‘দুয়ারে সরকার’ ক্যাম্প যে সব বিদ্যালয় বা সরকারি অফিসে সেগুলি অনেক মানুষের বাসস্থান থেকে অনেক দূরে বলে অভিযোগ আসছে। অভিযোগকারী মানুষদের কাছে পঞ্চায়েত অফিস ছিল অনেক নিকটে। ফলে ট্রেকার, অটো, টোটো ভাড়া গুনতে হচ্ছে।
কিন্তু বড়ো প্রশ্ন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বা পৌরসভা থাকতে ‘দুয়ারে সরকার’ কেন চালু করতে হলো। বামফ্রন্ট সরকার নির্বাচিত পঞ্চায়েত, নির্বাচিত পৌরসভার মধ্যে দিয়ে রাইটার্সকে মানুষের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যে দিয়ে মানুষের কাছে সরকারি পরিষেবা অতিদ্রুত মানুষের কাছে পৌঁছেছিল তা বামফ্রন্ট সরকারের অতি বড়ো নিন্দুকেরাও অস্বীকার করতে পারেন নি। সরকারি আধিকারিকরা যাতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা তৈরি করে জনগণের পরিষেবা পেতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করেন তা জনপ্রতিনিধিরা দেখতেন।
আমলাতন্ত্রের হাত থেকে জনপ্রতিনিধিদের হাতে কাজ করার দায়িত্ব বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গিয়েছিল। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর পুনঃআমলাতন্ত্রীকরণ ঘটেছে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরপরই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, পঞ্চায়েতকে আমলাতন্ত্রের অধীনস্ত হয়ে কাজ করতে হবে। বোঝা গিয়েছিল মমতার নীতিই হলো, পুনঃআমলাতন্ত্রীকরণ। এই পুনঃআমলাতন্ত্রীকরণের কুফল গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাওয়া গিয়েছে। তৃণমূল দলের কর্মীদের বড়ো অংশ ও আমলাতন্ত্রের বড়ো অংশ আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত।
আমাদের দেশের সংবিধান পঞ্চায়েতকেই স্থানীয় সরকার বলে অভিহিত করেছে। পঞ্চায়েত হলো স্থানীয় স্তরের সরকার এবং তা রাষ্ট্রের অংশ। তার স্বাধিকার আছে। পঞ্চায়েতের দু’ধরনের স্বাধিকার আছে - শাসনতান্ত্রিক এবং আর্থিক। শাসনতান্ত্রিক স্বাধিকার অনুযায়ী পঞ্চায়েতের নিজস্ব কিছু কর্মক্ষেত্র থাকবে, শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব থাকবে, যেখানে উচ্চতর সরকার হস্তক্ষেপ করবে না। শাসনতান্ত্রিক স্বাধিকার থাকলে আর্থিক স্বাধিকারও সুনিশ্চিত করতে হয়। পঞ্চায়েতের স্বাধিকারের প্রশ্নে রাজনৈতিক যুক্তিটির মূল্য যে অপরিসীম ,তা মমতা ব্যানার্জি কতটুকু উপলব্ধি করেছেন?
তৃণমূল সরকারে আসার আগে যে ইশ্তেহার প্রকাশ করেছিল সেখানে পঞ্চায়েত বা পৌরসভা সম্পর্কে তাদের নীতি কি হবে, সে বিষয়ে কোনো স্পষ্ট বক্তব্য ছিল না। একদশকের উপর সরকার চালাচ্ছে তৃণমূল। আজও তাদের বক্তব্যে বা কাজে স্থানীয় সরকার সম্পর্কে কোনো সদর্থক ভাবনা-চিন্তার পরিচয় মেলেনি। গত ১১ বছরে তৃণমূল সরকারের কাজকর্ম, আচরণে এটা প্রমাণ হয়েছে স্থানীয় উন্নয়নে পঞ্চায়েত বা পুরসভা এবং জনপ্রতিনিধিদের থেকে আমলাদের উপর বেশি নির্ভরশীল।
সরকারে আসার অল্পদিন পরেই তৃণমূল নেত্রী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি জেলাশাসক, বিডিও ইত্যাদি আমলাদের উপর বেশি নির্ভরশীল হবেন, পঞ্চায়েতকে খুব বেশি গুরুত্ব দেবেন না। মুখ্যমন্ত্রীর জেলাসফরে দেখা গেছে জনপ্রতিনিধি অপেক্ষা আমলাদের তিনি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ২০১১ সালে পরিবর্তনের আগে পর্যন্ত দেখা গেছে, জেলার বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়সাধন জেলা পরিষদ করত। কিন্তু তৃণমূল সরকারে আসার পর সে জায়গা অধিকার করলেন জেলাশাসক। সরকারে আসার পরেই সরকারি আদেশনামা বের করে গঠিত হয়েছিল ব্লক, মহকুমা এবং জেলাস্তরে ডেভেলপমেন্ট কমিটি। এই সব কমিটিতে নির্বাচিত পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের স্থান হয়নি।
বামফ্রন্ট সরকার গ্রামসভা, গ্রাম সংসদ বা শহরে ওয়ার্ড কমিটি গঠন করে মানুষের বাড়ির উঠানে সরকারকে পৌঁছে দিয়েছিল। সংবিধানের গ্রামসভা ভাবনার থেকে অনেক এগিয়ে বামফ্রন্ট সরকার তৈরি করেছিল গ্রাম সংসদ গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচনী ক্ষেত্রে। বাম আমলে গ্রাম সংসদ সভা নিয়মিত হতো। রাজ্যের গ্রাম সংসদের কাজকর্ম পঞ্চায়েত আইনে পরিষ্কার ভাষাতে বলা আছে। আইনে বলা আছে - গ্রাম পঞ্চায়েতের বিগত বছরের বাজেট, বিগত দুমাসের হিসাব, উপকৃতদের তালিকা এবং বিগত বছরের কাজ ও চলতি বছরে কি কাজ হবে তা বিবেচিত হবে বাৎসরিক সভায়। সভার কার্যবিবরণি লিপিবদ্ধ করা এবং পাঠ করা বাধ্যতামূলক।
১৯৭৩ সালের পঞ্চায়েত আইনের ২২তম সংশোধনের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবাংলার গ্রাম সংসদ স্তরে গঠন করা হয় গ্রাম উন্নয়ন সমিতি। গ্রাম উন্নয়ন সমিতির প্রধান কাজ এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা।
অর্থাৎ পঞ্চায়েত আইনকে মান্যতা দিলে গ্রামাঞ্চলে ‘দুয়ারে সরকার’-এর প্রয়োজন ছিল না। নির্বাচিত পঞ্চায়েত, জনগণের পঞ্চায়েত পরিণত হয়েছে লুটের পঞ্চায়েতে। মানুষকে ভাঁওতা দেওয়া আর দুর্ভোগে ফেলা তৃণমূলের নীতি। কোনো স্থায়ী কাজ বর্তমান সরকার করেনি। শুধুই মিথ্যাচার আর প্রকল্পের নামে ভণ্ডামি। ‘দুয়ারে সরকার’ প্রকল্প ভণ্ডামিতে পরিপূর্ণ। মানুষের কাজে লাগেনি। তাই গ্রামে গ্রামে স্লোগান উঠেছে - ফিরিয়ে দাও বাম আমলের পঞ্চায়েত।