E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২১ পৌষ, ১৪২৯

ঘা মারতে হবে হৃদয় দুয়ারে

বনবাণী ভট্টাচার্য


‘‘লাল ঝান্ডা তুঝসে কহতা হায় পুকার
ভাইয়া মজদুরোঁ
দেশকে রক্ষা করো সবি হরবার ভাইয়া মজদুরোঁ।
’’


দেশপ্রেমের তুফান তোলা এই পংক্তি দুটি মোটেই কোনো বিখ্যাত হিন্দি কবি বা গীতিকারের কলম প্রসূত নয় - একেবারে কালি-ঝুলি মাখা, ঘামে ভেজা ইউনিফর্ম পরা ট্রামশ্রমিক দশরথ লাল এবং চতুর আলির ভাবনা এবং আবেগের আখর। হিন্দি-ভাষীদের অত্যন্ত প্রিয় ‘কাজরি’ গান সেদিন দেশপ্রেমের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। না, ১৯৪৫-এর সেই ঐতিহাসিক ট্রাম শ্রমিক ধর্মঘট, যেখানে একদিন বুকের রক্ত ঢেলে, ছাত্র রামেশ্বর শহিদ হলো, এ গান সে সময়ের নয় - এ গান তখনের নয় যেদিন কলকাতার রাজপথে হিন্দু-মুসলমান কংগ্রেস-কমিউনিস্ট লিগ মহাসভা-ছাত্রসমাজ একসাথে পা মিলিয়েছে ট্রাম শ্রমিকের সেই ধর্মঘটের প্রতি সংহতিতে। এই ‘কাজরি’ গান ১৯৪৩ সালেরও আগে রচিত হয়তো - ১৯৪৩ সালে যা একজন নিবন্ধকারের প্রবন্ধ রচনায় নিজের শক্তিতে জায়গা করে নিয়েছে।

হ্যাঁ, এই কাজরি গানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ পেয়েছে - এদেশের ধমনীতে ধমনীতে ১৯১৭ সালের পর থেকে যে বিদ্যুৎ প্রবাহ বইত, তারই। জারের শীতপ্রাসাদ তাক করে বিগত শতাব্দীর দু’ দশকেরও আগে অরোরা জাহাজের কামান গর্জন, স্তেপ তৃণভূমির উপর দিয়ে, ককেশাস পর্বতমালা ডিঙিয়ে, সমুদ্রের পর সমুদ্র সাঁতরে ঢেউ তুলেছিল বঙ্গোপসাগর-আরব সাগর তোলপাড় করে।

রাশিয়ান নভেম্বর বিপ্লব কেমন করে যেন জগতের সমস্ত বঞ্চিত নিপীড়িত তো বটেই, সমস্ত বিবেকবানের হৃদয়তন্ত্রীতে ঘা দিতে লাগল। বিদ্রোহী কবির কণ্ঠে রুশ বিপ্লবের জয়ধ্বনির আহ্বানে খেত খামার কলকারখানা মাঠ ময়দান বিপুল আগ্রহে সাড়া দিয়েছে - নতুনের বিজয় কেতন যেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত - গ্রাম-নগর মাঠ-পাথার বন্দরকে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উদ্বেল করে তুলল। একেবারে বিদেশ - সুদূর রাশিয়ার মাটি ওলট-‍পালট হলো, একেবারে উপরটা নিচে আর নিচটা উপরে উঠে এল। এই মাটি উথালপাতালের ধাক্কায় নড়ে উঠল ব্রিটিশ উপনিবেশ ভারতবর্ষ - কেঁপে উঠেছিল সারা পৃথিবীও। একটা নতুন পৃথিবী জন্ম নিয়েছে রাশিয়ায় - সমগ্র মানবজাতির নবজন্মের সূতিকাগার নির্মাণ হলো রাশিয়ায় ভি আই লেনিনের নেতৃত্বে।

মধ্যযুগের স্থবির ভারতবর্ষ - তবু রাশিয়াকে জানা বোঝার একটা আগ্রহ ছিলই। পলাশীর যুদ্ধের পর থেকে সংবাদপত্রগুলোতে রাশিয়ার বহু খবর প্রকাশ হতে থাকে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন পাহাড়ে। একটা গুজব রটেছিল যে, ইংরেজদের কারণে, রাশিয়া ভারত আক্রমণ করতে উদ্যত। স্ত্রী সারদাদেবী পরিবারের কারোর কাছ থেকে কোনো সমর্থন না পেয়ে শেষপর্যন্ত ছোট্ট রবিকে বলেন, মহর্ষিকে সাবধান করে চিঠি লিখতে। তাঁর উদ্বেগ‍‌ ছিল যে, তিব্বতের কোনো একটি পথ ধরে রাশিয়ানরা ভারতে ঢুকে পড়বে, আর মহর্ষির বিপদ ঘটবে। রাশিয়া সেই সময়ে মানুষের এতটাই আলোচনার মধ্যে এসে গিয়েছিল যে, তা নিয়ে গুজবও তৈরি হতো এবং একেবারে অন্দরমহলের নিরক্ষর কর্ত্রীর চিন্তা-দুশ্চিন্তায় রাশিয়া ভাগ বসাতে পে‍‌রেছিল। যদিও বাঙালির জীবনে ‘সমাজতন্ত্র’-সাম্যবাদ চর্চার শুরু বেশ কিছুকাল আগের থেকেই - এমনকী প্রথম আন্তর্জাতিকের দপ্তরে ১৮৭১ সালে, কলকাতায় তাদের একটি শাখা স্থাপন করার উদ্দেশে একটি আবেদনপত্র জমা হয়েছিল কোনো এক বঙ্গবাসী বা ভারতবাসীর পক্ষ থেকে। ১৮৭৬ সালেই অবশ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর বাংলা অনুবাদও বাঙালির হাতে এসেছে এবং শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘শ্রমজীবী’ নামের বিস্ময়কর কবিতাটিও প্রকাশিত হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর বিশ দশক থেকে কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে সাম্যবাদ, নভেম্বর বিপ্লব ও সোভিয়েত সমাজতন্ত্র। স্বাধীনতা পাবার পর সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে ভারতবাসীর যোগাযোগ হলো আরও নিবিড়।

শিক্ষিত-অশি‍ক্ষিত, বিশেষত দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত ও বঞ্চিত মানুষ এই ভারতজুড়ে না হলেও বাংলার কোণায় কোণায় যেন সোভিয়েতের বীর জনগণ, যারা বলশেভিক, যারা লালফৌজ, যারা কোনো না কোনোভাবে সমাজ বদলের রূপকার তাদের সাথে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক-অনুভূতিতে বাঁধা পড়ে - যেন ওই সোভিয়েত দেশটা, যেখানে গরিব-বড়োলোক নেই, যেখানে সমস্ত মানুষের সম্মান আছে, খেয়ে পরে বাঁচার ব্যবস্থা আছে, সে দেশটা, এখানকার শোষিত-নিপীড়িত-পদানত মানুষের খুবই আপন। ওদেশের মতোই তাদেরও একটা সুসম সমাজ চাই - চাই মানুষের মুক্তি। নভেম্বর বিপ্লব বিশ্ব-মুক্তির অগ্রদূত হয়ে উঠল তাদের কাছে।

তাই, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ফ্যাসিজমের বল্গাহীন আগ্রাসন যখন চলছে, তখন ১৯৪৩ সালে, বাংলা ভয়ঙ্কর মন্বন্তরের কবলে। রাস্তার ধারে ধারে লাশ অথবা কঙ্কাল - কণ্ঠে একটু ফ্যান দেওয়ার আকুতি কান পাতলেই শোনা যেত - লঙ্গরখানা খুলেছে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও জনরক্ষা সমিতি কলকাতায় - তাদেরই আহ্বানে বহুবাজার অঞ্চলে এক অভূতপূর্ব মিছিল। কলকাতায় মিছিল মিটিং তো মুড়িমুড়কির মতনই হয়ে থাকে - এ এক অভিনব মিছিল। স্লোগান-পোস্টার ম্লান করে মিছিল এগিয়েছে সুরে সুরে, গানে গানে - ‘চাইরে অর্থ, চাইরে বস্ত্র, চাইরে অন্নজল’। দোকানদার থেকে বাড়ির মহিলারা এক আনা-দু আনা-চাল ডাল- জামাকাপড় সাধ্যমতো দান করল - এমনকী ইংরেজ সেনাও এই হৃদয়স্পর্শী আওয়াজে সাড়া না দিয়ে পারেনি। মিছিল, গানে শুধু মানুষের জৈবিক চাহিদার কথাই ছড়ায়নি - ছড়িয়েছে দেশপ্রেমের কথা। পরাধীন দেশের নৈতিক চাহিদায় এই মিছিল ছিল সোচ্চার -
শোন ওরে ও শহরবাসী, শোন ক্ষুধিতের হাহাকার
দেশবাসী না এগিয়ে এলে দেশ বাঁচানো বিষম ভার।


তারপর থেকে কলকাতা, বিশেষকরে মধ্য কলকাতায় লোকের মুখে মুখে এই গান। কেউ কেউ তো গান গাইতে গাইতে মিছিলেই পা মেলাল। কেউ মিছিলকারীদের কাছ থেকে গানের কাগজ সংগ্রহ করল। মহানগরীর আকাশে বাতাসে তখন স্বদেশপ্রেমের গন্ধ।

শুধু তো শহর উদ্বেল হয়নি - ঢেউ লেগেছে গ্রামে গ্রামে - এখনকার এপার-ওপার সব পারে। জারি ও গাজির পটের গানে এরা একেবারে রূঢ় বাস্তব। শিয়াল-কুকুরের মতো এই অনাহারে মানুষের অসহায় মৃত্যু-ক্ষুধার জ্বালায় আত্মহত্যা বা সেই জ্বালা থেকে সন্তানকে মুক্তি দিতে জলে ভাসিয়ে দেওয়া আবার হয়তো মাটিতে পুঁতে দেবার মতো নিষ্ঠুর করুণ অধ্যায়ের অবসানে, দেশকে রক্ষা করতে কৃষকের ফসল বৃদ্ধির উদ্দীপনা। নিদারুণ অভাব-অনটনের কথা - চাল ডাল উধাও হয়েছে বাজার থেকে ঠিকই - কিন্তু মানুষ তো এখানেই থেমে থাকতে পারে না - তাকে বাঁচ‍‌তে হবে জোট বেঁধে - গ্রাম্য কবি, কৃষক নিবারণ পণ্ডিত - এ কথাই সুরে বেঁধে বেঁধে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন -
গেলে হাটবাজারে
গেলে হাট বাজারে, ঘুরে ঘুরে, জিনিস পাওয়া দায়
চাল মিলে তো ডাল মিলে না প্রায় সব জায়গায়।


জারি গানে সুর তুললেন - আবার বাঁচার পথও দেখালেন -
হারে ও কৃষকভাই,
চল সবে মিলে জোট বাঁধিয়ে সবারে জানাই
নইলে তো আর বাঁচবার উপায় নাই।


বাংলার প্রাণের গান কীর্তন - হুগলির নামকরা কীর্তনিয়া দুলাল রায়, সেই মনমাতানো-প্রাণ ভোলানো কীর্তনে বাঁধলেন ফসল বাড়ানোর আহ্বান। লাঙল চালানো কৃষক দুলাল রায় দেশের দুর্দিনে, দেশের উৎপাদন বৃদ্ধি করেই দেশকে ভালোবাসার শ্রেষ্ঠ উপায় বলে কৃষক জনতাকে সচেতন করার চেষ্টায় ফিরলেন পথে পথে। রাশিয়ার কথা শুনেছেন, কেমন করে ওই নবগঠিত প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শ্রমিক-কৃষক নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে। সে দেশের মানুষগুলো নিজের দেশকে একটা অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে, নিজের ভিতর‍‌ থেকে এক তাগিদে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের জন্য কৃষি থেকে শিল্পের উৎপাদন বাড়াতে দিন রাত এক করে কাজ পাগল হয়ে উঠেছে এবং তারা এই নতুন সমাজের ক্রমাগত শ্রীবৃদ্ধি করে চলেছে নিজের পিতৃভূমিকে ভালোবেসে। কীর্তনিয়া দুলাল রায়, রাশিয়ার দৃষ্টান্ত চোখের সামনে রেখে, নিপীড়িতের আশা-আকাঙ্ক্ষায় লক্ষ করেছেন জোয়ার, নিজের সমস্ত সাধ্য দিয়ে আশা পূরণ শুধু নয়, দুয়ারে শত্রু জাপানের বিরুদ্ধেও লড়াইয়ের আহ্বান কীর্তন গানে গানে -
আজ রাশিয়া নগরে প্রতি ঘরে ঘরে সকলে সাজিছে রণে
সারা দুনিয়ার মুক্তি আনিতে সকলে সাজিছে রণে।


এই মুক্তির জন্য চাই দেশের মাটিতে উৎপাদন বাড়ানো। হাওড়ার শ্রমিক ক‍‌বি আলি হোসেন গাইলেন - ‘‘কুরবানে বতন, তনমন-ধন হ্যায়/হম পৈদাবার বঢ়ায়েঙ্গে।’’ লালফৌজের জীবনপণ লড়াইকে কুর্নিশ জানিয়ে নিজেরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে গান বেঁধেছে শ্রমিক মহঃ এরশাদ - ‘‘স্তালিনগ্রাদ কি কহানি, সব কো ইয়াদ হ্যায় জো বাণী/খানা মিলে ন হরগিস পানি, দেশ কি রক্ষা করনা থা।’’ কলকাতা করপোরেশনের কর্মীরা কলকাতা সচল রাখার লক্ষ্যে ঝাড়ু-বুরুশ নিয়ে নাচ গান নামিয়েছেন - বহু জায়গায় ফসল বাড়ানো নিয়ে নাটক লেখা ও অভিনীত হয়েছে - নাটক হয়েছে হিন্দু-মুস‍‌লিম সম্পর্কের উপরে। দেশের বিচিত্র লোকশিল্প রাঙিয়ে উঠল দেশপ্রেম আর মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় - পরবর্তীকালে ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংঘ, হিংস্র ফ্যাসিস্ত শক্তি চুরমার করতে বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতি এক অপরিমেয় শক্তি দান করেছে।

সোভিয়েত রাষ্ট্রভ্রমণকারী, এক বাঙালির বয়ান - ‘‘ককেশাস পর্বতশ্রেণির অন্তরালে সান্ধ্যসূর্য অস্ত গেছে। পল্লীতে পল্লীতে ফিরে এসেছে কর্মক্লান্ত কৃষকেরা। পাইপ ধরিয়ে পুরুষেরা বসল মজলিশ জমিয়ে। মেয়েরা দলে দলে বিভক্ত হয়ে শুরু করল নৃত্যগীত। তাদের উচ্ছ্বল আনন্দে দিনান্তের শ্রা‍ন্তির অবসাদ কোথায় মিলিয়ে গেল। রাষ্ট্রবিপ্লবের পর শ্রমিক-কৃষকের জীবনের বদল সহ রাশিয়ার রূপ পাল্টে গেছে।’’ নতুন সৃষ্টির আনন্দে জনসাধারণের মন উঠেছে চঞ্চল হয়ে। নতুন যুগের সঙ্গে প্রাচীন কৃষ্টি সংস্কৃতির এক অনন্য মেলবন্ধন ঘটিয়ে ফেলল তারা। এই জনসঙ্গীত গ্রামীণ জীবনেই সীমাবদ্ধ হয়ে রইল না - রাষ্ট্রের কাব্যজগতে লাভ করল স্বমর্যাদায় একটি নির্দিষ্ট স্থান।

এই যে রাষ্ট্রীয় কাব্যের অংশীদার হয়ে উঠল জনসঙ্গীত-লোকশিল্প সাহিত্য, এই যে লেনিনের অসাধারণ ক্ষমতায় ককেশাস অধিবাসীরা মুগ্ধ - তাঁকে তাঁরা পুরনো রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা থেকে মুক্তিদাতা বলে প্রণত হলো এবং তাঁদের জাতীয় সঙ্গীতে, লেনিনের অসামান্যতা ঘুরেফিরে নানা রঙে বিচ্ছুরিত করল। এই যাদুকাঠিটা কী ও কোথায়? আসলে সোভিয়েত রাষ্ট্রের যে বিপুল পরিবর্তন লাঙলের বদলে যন্ত্রচালিত লাঙল, যার নাম ট্রাক্টর। এর সাথে প্রত্যক্ষ কোনো কৃষক জীবনের কুলাকদের বিরুদ্ধে স্তা‍‌লিনের সময়ের যুদ্ধ সে তো জনসাধারণের ইচ্ছেরই প্রতিরূপ। ফলে সব যুদ্ধ সব বদলই তাদের জীবনের-তাদের স্বপ্ন-তাদের কল্পনা-তাদের ইচ্ছের বাস্তবায়ন ঘটেছে। তাই তাদের আবেগের ভাস্য হ‍‌য়েছে নাচ-গান-কবিতা-নাটকে, ঠিক যেমন দুলাল রায়ের কীর্তন, মুকুন্দ দাসের স্বদেশি গান ভাষা পেয়েছিল। ৪৩-এর মন্বন্তর, নভেম্বর বিপ্ল‍‍বের পর মুক্ত সমাজ গড়ার আকাঙ্ক্ষা।

এমনি জোয়ার এসেছিল বঙ্গভঙ্গ বি‍রোধী আন্দোলনে, ফ্যাসিবিরোধী যুদ্ধে। এই বাংলায়। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গান্ধীজির অসহযোগ-সত্যাগ্রহ অবিচ্ছেদ্য। কিন্তু তা এদেশের সাহিত্য সংস্কৃতিতে তেমন দাগ কাটল কোথায়? অথচ স্বদেশি আন্দোলন বাংলায় তো সোনার ফসল ফলিয়েছে। ‘‘স্বদেশি যুগে রবীন্দ্রনাথের যে বীণা রুদ্রস্বরে‍‌ বেজেছিল, অসহযোগের ঝো‍‌ড়ো হাওয়ায় তার তারগুলি একবার কেঁপেও উঠল না এর কি কোনো কারণ নেই?’’ - প্রশ্ন তুলেছেন বিদগ্ধ সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু। ‘‘স্বদেশি আন্দোলনের মূলে ছিল বাংলাদেশের হৃদয় শতদলের উন্মীলন। তার মধ্যে শুধু স্বায়ত্তশাসনের, শুধু অখণ্ড বঙ্গভূমির কথা ছিল না, শিল্পে-কর্মে-জ্ঞানে-বাণিজ্যে সমস্ত দেশে তা নবজীবন এনেছিল।’’ ‘‘...তখনকার দিনের দিশি কাপড়, দিশি জিনিস ব্যবহারের সঙ্গে আমাদের হৃদয়ের যোগের কথাটাই বড়ো ছিল, অসহযোগে তা হয়েছিল ল্যাঙ্কাশিয়রের ভাতমারার পলিসি।’’ অসহযোগ আন্দোলনে ছিল বিলেতি কাপড় পরোনা - ইংরেজের স্কুলে যেও না প্রভৃতি না-এর মেলা, অন্যদিকে স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে ছিল দেশের সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের ইতিবৃত্ত। স্বদেশপ্রেম স্বাভাবিক মানুষের স্বাভাবিক আবেগ। নিজের মায়ের মতোই দেশ-মাকেও ভালোবাসে। সেই ভালোবাসারই উচ্ছ্বাস বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন; সেই আবেগই কখনও রবীন্দ্রনাথের কলমে ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলার আগুন ঝরিয়ে, কখনও বাংলার মাটি, বাংলার জলের মতো শীতল স্নিগ্ধতায় বাংলার স্বদেশি গানের ভাণ্ডার ভরিয়ে বিশ্বমানবকে কৃত কৃতার্থ করেছে। নিজের দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারে যে, অন্য দেশের বিপন্নতায়ও সে কাঁদে - তার সুখ-আনন্দে সে হাসে - আমার-তোমার-ওর সঙ্কীর্ণতার পাঁ‍‌কে সে ডুবে যায় না। এই দেশপ্রেমের সংস্কৃতি ব্যাপকতায় আন্তর্জাতিক। স্বদেশি আন্দোলন আবেগমথিত করেছিল - দেশপ্রেমের এই সৎ আবেগের প্রাবল্যই রবীন্দ্রনাথ‍‌‍‌ থেকে শুরু করে ওই নিবারণ পণ্ডিত-দুলাল রায়-শরৎ চ্যাটার্জী প্রমুখকে দিয়ে সাহিত্যে সোনা ফলিয়েছে - রঙ তুলিতে চিত্তপ্রসাদ-জয়নুল আবেদিনদের দিয়ে আকালের বিভীষিকা তুলে ধরেছে।

ইতিহাসের শুরু থেকেই মানবসভ্যতায় আলো ছায়ার খেলা। পৃথিবীর এক প্রান্ত অন্ধকার তো অন্য প্রান্তে আলো জ্বলছে। ১৯১৭ সালে সোভিয়েত নতুন সভ্যতার জন্মভূমি হয়ে উঠল - অন্যদিকে জার্মানি ১৯৩৩ সাল থেকে ক্রমশ অন্ধকারে ঢেকে যেতে লাগল। উত্থান হলো বর্বর ফ্যাসিবাদের। ফ্যাসিবাদ তার সমস্ত বর্বর শক্তি নিয়ে সভ্যতাকে গ্রাস করে ফেলতে চাইল। পশুত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন রমাঁ রল্যাঁ থেকে রবীন্দ্রনাথ, লরা থেকে সুধীন দত্ত।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সু্কান্ত ভট্টাচার্য, বিষ্ণু দে, জ্যোতিরীন্দ্র নন্দী, গ্রামগঞ্জের চারণরা বাংলা সাহিত্যের রাজদরবার থেকে আমদরবারকে পরিপূর্ণ সতেজ শস্য ভাণ্ডারে পরিণত করলেন - বাংলা সাহিত্য একইসময়ে অনেকের কলমে সম্ভবত এত সমৃদ্ধ আগে কখনও হয়নি।

শিল্পসংস্কৃতি যেমন সংগ্রামের ফসল, তেমনি শিল্প সাহিত্য বিপ্লবের জন্য মানসভূমি প্রস্তুত করে। ইতিহাস সাক্ষী বর্বরতার বিরুদ্ধাচারণ মানুষের ধর্ম - না হলে হিটলারের পায়ের তলায় মানবসভ্যতা ধ্বংস হয়ে যেত। আজকেও ভারতকে বর্বরতা গিলে খেতে উদ্যত। ধর্মান্ধতা ও বিদ্বেষ, ক্ষমতার প্রতাপ-স্বৈরাচার জনগণের প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে নিচ্ছে বর্বরতার ভীষণতায় - অন্য দিকে আর্থিক দুর্নীতি-অনৈতিকতা, লোভ ও স্বার্থপরতা বিবেক কিনে নিচ্ছে। এই বিভীষিকাময় সময় দাবি করছে - আরও প্রতিবাদ আরও প্রতিরোধ, চাইছে প্রাণে প্রাণে সেতু বন্ধন। চাইছে প্রাণ আকুল করা জনসঙ্গীত-কবিতা-নাটক-চিত্র - উদ্দীপনাময় শিল্প-সাহিত্য। নিজের আকাঙ্ক্ষা কল্পনা আর স্বপ্নের যদি সংযোগ ঘটে তাহলে আবারও তিরিশ-চল্লিশ দশকের সেই উদ্দাম প্রাণমাতানো শিল্প-সাহিত্য মহীরুহ হয়ে আত্মপ্রকাশ করবে। বর্তমানের লড়াইয়ের সাথে জীবনের সংযোগটাই হলো প্রধান কথা। এই সংযোগ তৈরি করার দায়িত্বই মাঠ-ময়দানের যোদ্ধাদের। আর এই সংযোগ আজ নয় কাল তো সৃষ্টি হবেই - মানুষ পশুত্বের বিরুদ্ধে অদম্য সাহসে, একসাথে শিরদাঁড়া টান করে দাঁড়াবেই - কারণ সভ্যতার সুষমা ধ্বংস হলে জঠর শান্ত-শীতল থাকলেও জীবনের কোনো মানে থাকে না। আর ক্ষমতার এই বর্বরতা লোভী মানুষের বেঁকে যাওয়া মেরুদণ্ড মনুষ্যত্বের এই ক্ষয় সমস্ত দেশপ্রেমীর হৃদয়ে আঘাত করছে - মানুষ এ আঘাত চিরকাল সহ্য করবে না - রুখে সে দাঁড়াবেই - দাঁড়াবে বুক বেঁধে।