E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৬ জানুয়ারি, ২০২৩ / ২১ পৌষ, ১৪২৯

সাবিত্রীবাই ফুলের ১৯৩তম জন্মদিবসে শ্রদ্ধার্ঘ্য

যে আগুন অন্যায়-অধর্ম-বৈষম্যকে পুড়িয়ে দেয়

অলকেশ দাস


বাংলার ঘরে ঘরে বিদ্যাসাগর। হবে নাই বা কেন? ১৮৩০-৪০-এর নবজাগরণের ধাক্কার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র, দক্ষিণারঞ্জন, রাম গোপাল ঘোষ আর মদনমোহন তর্কালঙ্কাররা কোমর কষে হিন্দু সমাজের পুরুষতান্ত্রিক বাধার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সেদিন যদি না দাঁড়াতেন তাহলে আজকের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজ অবধি ছাত্রীদের গুনগুনানি শোনা যেত না। তখন যুদ্ধটা ছিল অসম। পুরনো হিন্দুশাস্ত্র থেকে উদাহরণ বের করে আনতে হয়েছিল তাদের। দেখাতে হয়েছিল অতীতে শাস্ত্রই মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। আর সেই সব উদাহরণ নিয়ে বিদ্যাসাগরদের দ্বৈরথ বেধেছিল অভিজাত হিন্দু ব্রাহ্মণদের সঙ্গে। ১৮৪৯ সালে কলকাতায় বৈঠকখানার মুখার্জিদের বাড়িতে প্রথম হিন্দু মেয়েদের স্কুল। এখন যার নাম বউবাজার। পড়ে অবশ্য সে স্কুলের নাম হয়েছিল বেথুন স্কুল। সেই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি বিদ্যাসাগর। জোগাড় করেছিলেন নারী শিক্ষা ভাণ্ডার। মেয়েদের স্কুল খোলার জন্য। ১৮৯১ সালের মধ্যে বিদ্যাসাগর ততদিনে ৩৫টা মেয়েদের স্কুল খুলে ফেলেছেন। সেখানে ১৩০০ মেয়ে সমাজের চোখ রাঙানিকে গণ্য না করে পড়াশোনা করছে।

বাংলা যেভাবে বিদ্যাসাগরকে মনে রেখেছে সাবিত্রীবাই-কে সেভাবে মনে রাখেনি। ৩ জানুয়ারি তাঁর জন্মদিন। বেঁচে থাকলে তাঁর বয়স হতো ১৯৩ বছর। জ্যোতিবা ফুলে সাবিত্রীবাই-কে লেখাপড়া শেখাতে শুরু করে দিয়েছিলেন। এই শুদ্র মহিলা দেশের মধ্যে প্রথম শুদ্র শিক্ষিকা মহিলা। তাঁরা শুরু করলেন প্রথম অস্পৃশ্যদের জন্য বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের কাজ। ১৮৪৮ সালে পুনে নগরীর মধ্যস্থ এলাকায় অস্পৃশ্য মেয়েদের এক বিদ্যালয় গড়ে তুললেন। কেবলমাত্র ছটি ছাত্রী। কঠিন ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে এই কাঠামোও গড়ে তোলা সহজ কাজ ছিল না। সমাজে তখন ব্রাহ্মণ্যবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে, যে গুষ্টি বা যে জাতিরই হোক না কেন মেয়ে মানে ‘নরকের দ্বার’। পাপের উৎস। মহিলারা বুদ্ধিহীন। কেন তাঁরা পড়বে? পড়াশোনা করলেই তো তাঁরা পাপের পথে পরিচালিত হবে। পুরুষকে মানবে না। দুর্বিনীত হবে। পরিবারের সুখ-শান্তির বারোটা বাজাবে। এক কথায় নারী ‘স্বাধীনতা’র যোগ্যই নয়। চিন্তায়, কাজে জ্যোতিবা ফুলে আর সাবিত্রীবাই ফুলে এই সব কুপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন।

গোল বাঁধলো যখন স্কুলে মেয়েদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে শুরু করল। ব্রাহ্মণরা ক্রমশ বুঝতে পারছিল যে, জ্ঞান বা শিক্ষা এখন শুধুমাত্র নিচের তলার মানুষের কাছে নয়, মেয়েদের কাছেও ক্রমশ উন্মুক্ত হচ্ছে। অথচ মনুসংহিতা তো নির্দেশ দিয়েছে এসব বন্ধ করতে। সেই জন্য সাবিত্রীবাই যখন স্কুলে আসত পড়ানোর জন্য,ব্রাহ্মণরা রাস্তার ধারে ওৎ পেতে থাকত। তাঁকে গালিগালাজ করত, ভয় দেখাত, শারীরিকভাবে আক্রমণ করত, শরীরে পাথর, পশু-পক্ষীর মল, গোবর ইত্যাদি ছুঁড়তো। সাবিত্রীবাই বুঝেছিলেন যে, তাঁকে নিরস্ত করাটাই ওদের লক্ষ্য। তাকে বানচাল করার জন্য সঙ্গে তিনি একটা অতিরিক্ত শাড়ি নিয়ে যেতেন। পথে নোংরা হয়ে যাওয়া শাড়িটা পালটে নিয়ে ক্লাসে গিয়ে পড়াতেন।

কোন ধাতুতে সাবিত্রীবাই গড়া সেটা বোঝা গেল যখন তাঁকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করতে আসা উচ্চবর্ণের গুন্ডাকে তিনি সপাটে চড় বসিয়ে দিয়েছিলেন। এই দৃঢ়তাতেই পিছু হঠেছিল ব্রাহ্মণ সমাজ। শেষ অবধি তারা চাপ তৈরি করল জ্যোতিবা রাও ফুলের বাবার উপর। তাঁর বাবা তাদের শিক্ষা সম্প্রসারণের আন্দোলনের পক্ষেই ছিলেন। কিন্তু তিনি সহ্য করতে পারলেন না ব্রাহ্মণ সমাজ এবং তাঁর নিজের সম্প্রদায় ‘মালী’ সমাজের সম্মিলিত বিরোধিতাকে। ভগ্ন হৃদয়ে বাধ্য হয়ে পুত্র এবং পুত্রবধূকে বললেন বাড়ি ছেড়ে দিতে। বাড়ি ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দারিদ্র্য সঙ্গ দিতে শুরু করল। সেই অবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর এক মুসলমান বন্ধু ওসমান শেখ। ১৮৪৮-৫২-এর মধ্যে ‘ফুলে দম্পতি’ পুনে নগরের মধ্যে এবং তার চারপাশে মেয়েদের জন্য এবং সমাজের তথাকথিত নিম্ন জাতির শিশুদের জন্য ১৬ টি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন।

অবশ্যই স্কুলের সংখ্যা আর ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা দিয়ে সাবিত্রীবাই-কে মাপা যাবে না। পুনে নামে যে শহরে ফুলে দম্পতি বাস করতেন সেই পুনে ছিল সেই সময় ভারতের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শাসনব্যবস্থার অধীন। পুনেতে পেশোয়ার শাসন ছিল বাস্তবিক পক্ষে ব্রাহ্মণদের অত্যাচার ও দমনমূলক শাসনব্যবস্থা। ওই পেশোয়ারদের শেষ প্রতিনিধি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা সিংহাসনচ্যুত দ্বিতীয় বাজিরাও ছিল চরম দুর্নীতিপরায়ণ, নষ্ট চরিত্রের শাসক। অযোগ্য এবং অসভ্য। কৃষকেরা রাজকর দিতে না পারলে তাদের শিশুসন্তানদের ফুটন্ত গরম তেলে চুবিয়ে স্নান করানো হতো অথবা গরম প্লেটে বাচ্চাগুলোকে দাঁড় করিয়ে ঝলসানো হতো। সেই জন্য পুনেকে বলা হতো ‘অন্ধকারের জায়গা’। অস্পৃশ্য জাতিকে বলা হত দ্বিপদ পশু। তাদের পিছনে বেঁধে দেওয়া হতো ঝাড়ু বা ঝাঁটা। তাদের ছায়াকে মুছে দেওয়ার জন্য। এবং একটি মৃৎপাত্র তাদের গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হতো থুতু ফেলার জন্য যাতে তারা ব্রাহ্মণদের চলার পথকে দূষিত বা কলুষিত করতে না পারে। এই সামাজিক পটভূমিকাতেই সাবিত্রীবাই-কে মূল্যায়ন করতে হবে।

পুনেতে সেই সময় বিধবার পুনর্বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল। বহু তরুণী বিধবা গৃহের অভ্যন্তরে আত্মীয়-স্বজন বা প্রতিবেশী পুরুষের লালসার শিকার হতো। তাদের মধ্যে অনেকেই চাইতো তাদের নিজের জীবনকে শেষ করে দিতে। এইরকম ধরনের ব্রাহ্মণ বিধবারা তাদের নিজেদের শিশু হত্যা করত। একবার জ্যোতিবা ফুলে দেখেন যে, একটি অল্পবয়সি তরুণী শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা নদীটায় ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি যুবতীকে নিরস্ত করেন এবং তার বাড়িতে নিয়ে যান। মেয়েটি ছিল অন্তঃসত্ত্বা ব্রাহ্মণ বিধবা। নাম কাশীবাই। সাবিত্রীবাই-এর যত্ন এবং পরিচর্যায় মেয়েটি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। ফুলে দম্পতি তার নাম দেন যশবন্ত এবং সে ক্রমে ডাক্তার হয়। ফুলে দম্পতি তাকে দত্তক নেন। তাকে তাঁদের সন্তানরূপে সকলের কাছে পরিচিত করান।

কাশীবাই শুধু একা ছিল না। কাশীবাই-এর মতো অসংখ্য অসহায় মহিলা চারিদিকে ছিল। তাদের বাঁচানোর জন্য ১৮৫৩ সালে জ্যোতিবা ‘শিশু হত্যার বিরুদ্ধে আশ্রয় বা রক্ষা গৃহ’ প্রতিষ্ঠা করেন। পুনে শহরের সর্বত্র ‘ফুলে’রা বিজ্ঞাপন সেঁটে দিয়েছিল এই বলে - ‘যে সকল মহিলা দুর্ভাগ্যবশত এবং অজ্ঞানতাবশত গর্ভবতী হয়েছেন তারা গোপনে তাঁদের বাড়িতে আসুন এবং তাদের সন্তান প্রসব করান’। জাত চিনিয়েছিলেন জ্যোতিবা এবং সাবিত্রী। দেখিয়েছিলেন শিরদাঁড়া কাকে বলে। রক্ষণশীল জাতপাত-দীর্ণ সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে ওই ধরনের বিজ্ঞাপন প্রচার করেছিলেন।

ব্রাহ্মণরা অনেকবার জ্যোতিরাও ও সাবিত্রীবাই-কে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছে। ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করেছে। আবার যাতে ঘটনাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় তার জন্য নিযুক্ত খুনিদের বাছাই করেছে অস্পৃশ্য শ্রেণির মানুষের মধ্যে থেকে। রাতে ওই দুই খুনি যখন ফুলে দম্পতিকে হত্যা করতে যান তখন তাঁরা উভয়ে বলে ওঠেন যে, তুমি হত্যা করতেই পার এবং এতে যদি তোমার স্বাধীনতা ও শিক্ষালাভ হতে পারে তাহলে তুমি সেটা অবশ্যই করবে। খুন করতে এসেছিল যারা তারা জ্যোতিবা রাও-এর কথায় আবেগাপ্লুত হয়, তাঁর অনুগামী হয়ে যায়। এবং তাদের মধ্যে একজন লিখতে পড়তে শিখেছিল। এমনকী তাদের একজন একখানি গ্রন্থও লিখেছিল।

ফুলে দম্পতি তাঁদের নিজেদের জীবনকে শুধু সমাজের জন্য উৎসর্গ করেছিলেন তাই নয়। নিজের পরিবারকে উৎসর্গ করেছিলেন এই কাজে। তাঁর পুত্র যশবন্ত ঝাঁপিয়ে পড়েন প্লেগে আক্রান্ত রোগীদের সেবায়। প্লেগে আক্রান্ত এক অস্পৃশ্য বালককে নিজের কাঁধের উপর চাপিয়ে হাসপাতালে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই প্লেগ তাকে ধরে। ওই রোগেই তার মৃত্যু হয়। সাবিত্রীকে যখন জ্যোতিবা বিয়ে করেন তখন তার বয়স কেবলমাত্র ৯ বছর। জ্যোতিবা’র মৃত্যুর পর তাঁর লক্ষ্য পূরণের সমস্ত দায়িত্ব সাবিত্রী তাঁর নিজের কাঁধে তুলে নেন। অসাম্য এবং শোষণের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা প্রচলিত সামাজিক পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। পুনে নগরীতে পানীয় জল পান করার অধিকার অস্পৃশ্যদের ছিল না। সাবিত্রীবাই তাদের নিজস্ব সেই পানীয় জলের ট্যাঙ্ক উন্মুক্ত করে দেন। ব্রিটিশরা অতিরিক্ত কর চাপাতো কৃষকদের উপরে। ফুলেরা তার বিরুদ্ধে লড়াই করেন। খরার প্রাদুর্ভাব হলে খরাপীড়িত গ্রামগুলিকে পরিষ্কার করার কাজ সাবিত্রীবাই গ্রহণ করেছিলেন। খরাক্লিষ্ট কৃষকদের জন্য আশ্রয় শিবির করেন। সংস্কৃত ও মারাঠি ভাষায় জ্যোতি শব্দের অর্থ অগ্নিশিখা। আক্ষরিক অর্থে সেই অগ্নিশিখাকে সাবিত্রীবাই বহন করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন সেই আগুন যা অন্যায়-অধর্ম-বৈষম্যকে পুড়িয়ে দেয়, অন্ধকারকে আলোকিত করে। রাষ্ট্রের উৎপত্তির পূর্ব পর্যন্ত নারী পরিবার ও সমাজের সম্মান, অধিকার ভোগ করতো। মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বস্তুগত উৎপাদনে নারীর ভূমিকার উপরে সমাজে নারীর স্থান নির্ধারিত হয়। পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি রচনাটিতে এঙ্গেলস বলেছেন, মাতৃ অধিকারের উচ্ছেদ হচ্ছে স্ত্রী জাতির এক বিশ্ব ঐতিহাসিক পরাজয়। পুরুষ গৃহস্থালির কর্তৃত্ব দখল করল। স্ত্রীলোক হলো পদানত। শৃঙ্খলিত পুরুষের লালসার দাসী। সন্তান সৃষ্টির যন্ত্রমাত্র। সাবিত্রীবাই সারা জীবন ধরে জীবনের প্রতিটি আঁকেবাঁকে এর বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। আম্বেদকর বলেছিলেন যুগপৎ ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে, ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। সাবিত্রীবাই-কে স্মরণ করে আমরা সেই পথে এগোতে পারি।