E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৬ মে, ২০২২ / ২২ বৈশাখ, ১৪২৯

চটশিল্পের সামগ্রিক সংকট সমাধানের লক্ষ্যে ২৩ মে শ্রমিক কনভেনশনের ডাক


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্যের বন্ধ চটকলগুলি অবিলম্বে খোলা এবং চটশিল্পের সামগ্রিক সংকট সমাধানের লক্ষ্যে শ্রমিক কনভেনশনের ডাক দিল বিসিএমইউ সহ চটকল শ্রমিকদের একুশটি ইউনিয়ন। আগামী ২৩ মে কলকাতায় শ্রমিক ভবনে এই কনভেনশন অনুষ্ঠিত হবে। দাবি দাওয়া ভিত্তিক এই কনভেনশন সফল করতে রাজ্যের সমস্ত চটকলের গেটে এবং শ্রমিক মহল্লায় অনুষ্ঠিত হবে সভা। ২ মে কলকাতার শ্রমিক ভবনে চটকল শ্রমিকদের ২১টি ইউনিয়নের এক সভা থেকে এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

রাজ্যে এই মুহূর্তে ছোটো-বড়ো মিলিয়ে চটকলের সংখ্যা ১০০। তার মধ্যে বন্ধ রয়েছে ১৮টি। চটশিল্পের অন্যান্য সমস্যাগুলির মধ্যে রাজ্যে এই মুহূর্তে ন্যায্য দামে কাঁচা পাটের অভাব রয়েছে এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি চটকল মালিকরা সাসপেনশন অব ওয়ার্ক-এর নোটিশ ঝুলিয়ে দিয়েছেন ওই জুটমিলগুলিতে।

ওয়াকিবহাল মহলের এবং শ্রমিক ইউনিয়নগুলির গরিষ্ঠ অংশের বক্তব্য, কাঁচা পাটের এই অভাব কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে এই রাজ্যে। কারণ স্বাধীনতার আগে থেকেই দেশে চটকল রয়েছে। সেগুলির কোনটি সাধারণভাবে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে পাটের জোগানের অভাবে বন্ধ হয়নি বা হয়না। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসেই কাঁচাপাট সবে বাজারে এসেছে। স্বাভাবিকভাবে এই সময় কাঁচা পাট পাওয়া যাচ্ছে না এবং তার জন্য চটকল বন্ধ হবার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়নি। কাঁচা পাটের অভাব মূলত মে-জুন মাসের দিকে হয়। ওই সময় পাট উৎপাদনের মরসুমের শেষ পর্ব চলে। সে সময় কাঁচা পাটের অভাব হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয় তাই কাঁচা পাট অমিল হওয়াটা সেসময় অস্বাভাবিক নয়। অভিযোগ, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে খোলা বাজারে আসা কাঁচা পাট কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেআইনি মজুদ করেছে, হোর্ডিং করেছে। সব মিলিয়ে চলছে কালোবাজারি। সিআইটিইউ অনুমোদিত চটকল শ্রমিকদের বৃহত্তম সংগঠন বিসিএমইউ এবং অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকে আরও অভিযোগ উঠেছে, এরাজ্যের বেশকিছু চটকল মালিক কাঁচা পাট মজুদ করে এই কৃত্রিম সংকট চালু রাখতে মদত দিচ্ছে।

কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে জুট কমিশনার আগেই কুইন্টাল পিছু পাটের দর ৬,৫০০ টাকা ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বেআইনি মজুদের দরুন কৃত্রিম অভাবের সুযোগ নিচ্ছে বেশ কিছু ব্যবসায়ী। তার ফলে খোলাবাজারে এখন কুইন্টাল পিছু কাঁচা পাটের দর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭হাজার ২০০ টাকায়। এখন মিলমালিকরা সাত হাজারের বেশি টাকা দরে চটকলের জন্য কাঁচামাল কিনে উৎপাদন ব্যয় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে না এই কারণ দেখিয়ে সাসপেনশন অফ ওয়ার্ক-এর নোটিশ ঝুলিয়ে দিচ্ছে।

১৮টি চটকল বন্ধ থাকায় এই মুহূর্তে আমাদের রাজ্যে ৭০ থেকে ৮০হাজার শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ২টি চটকল বন্ধ ছিল আগে থেকেই। নতুন করে ১৫-১৬ টি জুট মিল বন্ধ হওয়ায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। অভুক্ত অবস্থায় অনিশ্চয়তার মধ্যে শ্রমিকরা দিন কাটাচ্ছেন।

শ্রমিক ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে এই সমস্যা নিরসনে কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রী পীযূষ গোয়েলকে চিঠি দিয়ে পাট মজুদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের আরজি জানানো হয়েছিল। গত ১১ জানুয়ারি পীযূষ গোয়েলকে চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকেও শ্রমিকদের দুর্দশার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে চটকল খোলার উদ্যোগ নেবার জন্য চিঠি দেওয়া হয় ১৩ জানুয়ারি। আইজেএমএ কাঁচা পাটের দাম ঘোষণার বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা করার বিষয়টি বিচারাধীন হওয়ায় প্রায় ৪ মাস কেটে গেলেও এখনও পর্যন্ত রাজ্য সরকারের তরফে মজুদ উদ্ধারের প্রশ্নেও কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের বস্ত্রমন্ত্রী বা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দুজনের কেউই চিঠির কোনো প্রত্যুত্তর বা কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।

শ্রমিক ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের একাধিক দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয়েছে। রাজ্যের শ্রমমন্ত্রীকেও চিঠি দেওয়া হয়। এই ডেপুটেশন দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জুট কর্পোরেশন-এর ডিরেক্টর এবং জুট কমিশনার আলোচনায় উপস্থিত থাকলেও এবং শ্রমিকদের উপস্থিতিতে বেআইনি মজুদের বিরুদ্ধে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট আলোচনায় অংশ নিলেও ফল হয়নি। কাঁচা পাটের কালোবাজারি রুখতে বা কাঁচাপাট যা মজুদ করে রেখেছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা তা উদ্ধার করার ক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ না করে হাত গুটিয়ে বসে থেকেছে রাজ্য সরকার। শ্রমদপ্তর সহ রাজ্যের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলি সামগ্রিকভাবে উদ্যোগ না নেওয়ায় কয়েক লক্ষ চটকল শ্রমিক ও তাদের পরিবার সহ তাদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল জীবিকানির্বাহী পরিবারগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রাজ্যের অর্থনীতিও যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সে সম্পর্কেও উদাসীন রাজ্য সরকার।

২ মে’র সভা থেকে শ্রমিক নেতৃত্ব অভিযোগ করেছেন, কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগহীনতার পেছনে রয়েছে দেশের প্লাস্টিক লবি। খাদ্যশস্য প্যাকেজিং-এর ক্ষেত্রে পাটের ব্যাগ ব্যবহার আবশ্যিক আইন অনুযায়ী। কিন্তু বলা হচ্ছে, পাটের ব্যাগ বা বস্তা সাপ্লাই না হলে তার পরিপূরক হিসেবে প্লাস্টিকের বস্তা সরবরাহ করে ঘাটতি পূরণ করা হবে - এটাই চক্রান্তের লক্ষ্য। শ্রমিকদের আরও অভিযোগ, এর সঙ্গে যুক্ত কেন্দ্রীয় সরকারের একটি অংশ যারা পাট চাষি এবং চট শিল্পের শ্রমিক - কোনো অংশেরই স্বার্থ দেখছে না। সমস্ত শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে এই যাবতীয় চক্রান্তের তীব্র বিরোধিতা করা হয়। তারা প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দাবি করছেন এ বিষয়ে।

অন্যদিকে, চটশিল্পে এই মুহূর্তে রয়েছে শ্রমিকের জোগানের সংকট। চটকল শ্রমিকদের মজুরি এখন মাত্র ৩৭০ টাকা। যেখানে একজন রাজমিস্ত্রি দিন পিছু ৭০০ টাকা মজুরি পেতে পারে। তাই চটকলে শ্রমিকরা আসতে চাইছেন না। এর সঙ্গে পাওনা গণ্ডা না পাওয়ার সমস্যা তো রয়েইছে। অবসরকালীন প্রাপ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিকরা বঞ্চিত হচ্ছেন। যেখানে দুই থেকে আড়াই মাসের মধ্যে বকেয়া পাওয়ার কথা সেখানে ৮ থেকে ১০ বছর পরে শ্রমিকরা বকেয়া পাচ্ছেন। গ্র্যাচুয়িটির টাকা মালিকরা আত্মসাৎ করেছেন। এমনকী পিএফ-এর টাকা সঠিকভাবে জমা দেয় না, নিজেদের দেয় টুকু নিয়মিত দেয় না এরকম অভিযোগ মালিকদের বিরুদ্ধে রয়েছে ভুরি ভুরি। আবার শ্রমিকদের লকডাউন পিরিয়ডের যে বকেয়া রয়েছে তা সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলার দরুন আটকে গেছে। এর পাশাপাশি কিছুদিন আগে যে দাবি সনদ চট শ্রমিকরা পেশ করেছেন সে সম্পর্কেও এদিনের সভা থেকে মালিকপক্ষকে তা অবিলম্বে পূরণের দাবি তোলা হয়। একদিকে যেমন মেশিন পিছু শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে শ্রমিকদের ওপর কাজের বোঝা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তেমনি সামগ্রিকভাবেই চটশিল্পের শ্রমিকদের ওপর জুলুম বাড়ছে অভিজ্ঞতা চট শ্রমিকদের বড়ো অংশের।

এ রাজ্যের বর্তমান রাজ্য সরকার গত ১১ বছর ধরে মালিকদের সমস্ত ধরনের দুর্নীতি ও শ্রমিকবিরোধী কার্যকলাপে মদত দেওয়া এবং শ্রমিকবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করায় চট শিল্পে এই সংকট আরও তীব্রতর হয়েছে। বারবার বলা সত্ত্বেও ২০১৯ সালের মার্চ মাসে সম্পন্ন হওয়া ত্রিপাক্ষিক চুক্তি কার্যকর হয়নি। গত দু’বছর কোভিড পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের ওপর মালিকদের অত্যাচার, কাজের বোঝা ও জুলুম বেড়েছে। লকডাউন পিরিয়ডের বকেয়া আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েও রাজ্য সরকার এ বিষয়ে মালিকদের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যায়নি এবং শ্রমিকদের সঙ্গে তঞ্চকতা করেছে বলে অভিযোগ শ্রমিকদের।

গত ডিসেম্বর মাসে রাজ্য সরকার আহুত ত্রিপাক্ষিক সভায় চটশিল্পের বর্তমান সমস্যাগুলি নিয়ে মালিক সংগঠন এবং রাজ্য সরকারের নেতিবাচক ভূমিকার ট্রেড ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে তীব্রভাবে সমালোচনা করা হয় এবং শ্রমিক সংগঠনগুলির সমালোচনার চাপে পড়ে রাজ্য সরকার ৬টি শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি, আইজেএমএ এবং রাজ্য সরকারের অফিসারদের নিয়ে চটশিল্পের একটি এক্সপার্ট কমিটি গঠন করে। এক্সপার্ট কমিটিতে আলোচনা করে ওয়াজার অ্যাডভাইসর নামে একটি বেসরকারি সংস্থাকে চটশিল্পের সার্ভে করে মূল সমস্যাগুলি সম্পর্কে রিপোর্ট দেওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়। ৪টি জেলায় (হাওড়া, হুগলি, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা) বিভিন্ন চটকলের শ্রমিকদের সাথে কথা বলার পরে তারা একটি রিপোর্ট পেশ করে এবং চটশিল্পের ইউনিয়নগুলির প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে এই রিপোর্ট নিরপেক্ষ নয়, প্রকৃত চিত্র নেই। অনেকটাই মালিকদের স্বার্থকে সুরক্ষিত রেখেই ওই সংস্থা রিপোর্ট জমা করেছে। এর পূর্বে রাজ্য সরকার একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তিন সদস্যের কমিটি গঠন করেছিল ৯০:২০ কার্যকর করার প্রশ্নে, এই ৩ সদস্যের কমিটি মিলভিত্তিক সার্ভে করে শ্রমিকদের কম্পোজিশন কি, কিভাবে সমস্যার সমাধান হবে সে সম্পর্কে একটি রিপোর্ট তৈরি করে। ওই রিপোর্ট থেকেও কোনো সুপারিশ আসেনি।

ইতিমধ্যে ২০১৯ এর ত্রিপাক্ষিক চুক্তির মেয়াদ গত ১৩ মার্চ ২০২২ শেষ হয়েছে। তার আগেই চটশিল্পের ২১টি ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আলোচনা করে ২৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবি সহ নতুন দাবি সনদ চূড়ান্ত করে ১ ফেব্রুয়ারি রাজ্য সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে এখনও ত্রিপাক্ষিক আলোচনা শুরু হয়নি। এই দাবি সংক্রান্ত আলোচনা অবিলম্বে শুরু করার দাবি জানিয়েছেন শ্রমিক নেতৃত্ব।

এদিন সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু। এছাড়াও ছিলেন গণেশ সরকার, দীপক সাহা, শান্তি ঘোষ, কীর্তিমান ঘোষ, রাম সুরত সিং, চন্দ্রমা রায়, অশোক খান, রাধেশ্যাম সাউ, দীনেশ গিরি, বিনোদ সিং সহ শ্রমিক নেতৃবৃন্দ।