৫৯ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৬ মে, ২০২২ / ২২ বৈশাখ, ১৪২৯
রাজ্যব্যাপী পালিত ঐতিহাসিক মে দিবস
শহিদ মিনার ময়দানে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন সমূহের কেন্দ্রীয় সমাবেশ
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে শ্রমজীবী মানুষের বিভাজন ঘটানোর চেষ্টা হচ্ছে। এই বিভাজন রুখতে হবে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের মাধ্যমে। চাই আগামীর সকল আন্দোলনকে শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের পরিপূরক করে গড়ে তোলার অঙ্গীকার। দুনিয়ার শ্রমিক এক হও এটাই আমাদের শিক্ষা। ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস উপলক্ষে কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানের শ্রমিক সমাবেশে উচ্চারিত হয় এমনই শপথ। এই সমাবেশে এ বছরের পয়লা মে থেকেই ভারতে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস পালনের শতবর্ষ উদযাপন কর্মসূচির সূচনার ঘোষণা করা হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯২৩ সালের ১ মে ভারতে প্রথম মে দিবস উদ্যাপিত হয়েছিল।
সমাবেশে এদিন বক্তব্য রাখেন সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক শ্রমিক নেতা তপন সেন সহ বিভিন্ন বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ। এদিন সকালে কলকাতায় সিআইটিইউ রাজ্য দপ্তর শ্রমিক ভবনে সংগঠনের রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি সুভাষ মুখার্জি। এরপর শহিদ বেদিতে ফুল মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তপন সেন, অনাদি সাহু, বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং সিআইটিইউ’র রাজ্য নেতৃবৃন্দ।
শহিদ মিনার ময়দানে এদিনের শ্রমিক সমাবেশ পরিচালনা করেন এআইইউটিইউসি’র এ এল গুপ্তা, সিআইটিইউ’র সুভাষ মুখার্জি, এআইটিইউসি’র লীনা চ্যাটার্জি, ইউটিইউসি’র দীপক সাহা, টিইউসিসি’র দেবদাস চ্যাটার্জি, এআইসিসিটিইউ’র দিবাকর ভট্টাচার্য, ১২ই জুলাই কমিটির তপন দাশগুপ্ত, বিএসএনএল’র শিশির রায়কে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী। সভায় মূল প্রস্তাব পাঠ করেন সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু। প্রস্তাবটি সভায় সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়।
গৃহীত প্রস্তাবের মধ্যদিয়ে আহ্বান জানানো হয়েছে, আগামীর সকল আন্দোলনকে শ্রমিক মুক্তি আন্দোলনের পরিপূরক করে গড়ে তোলার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হতে।
ওই প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, গত দু’বছর আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস উপলক্ষে করোনা অতিমারীর স্বাস্থ্যবিধির জন্য শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত করা যায়নি, কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের ওপর এই অবসরে লগ্নিপুঁজির আক্রমণ আরও তীব্র হয়েছে। প্রস্তাবে এবারের মে দিবসেই আমাদের দেশে মে দিবস উদযাপনের শতবর্ষ শুরুর কর্মসূচির তাৎপর্য উল্লেখ করে স্মরণ করা হয়েছে ১৯২৩ সালের ১ মে পরাধীন ভারতের মাদ্রাজ শহরে কমরেড সিঙ্গারভেলু চেট্টিয়ারের শ্রমিক সমাবেশে লাল পতাকা উত্তোলন ও বক্তব্য রাখার কথা।
প্রস্তাবে দেশে দেশে মালিকদের মুনাফার স্বার্থে শ্রমিকদের ১২ থেকে কুড়ি ঘণ্টা কাজ করার বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির লাগাতার সংগ্রামের ঐতিহাসিক পরম্পরার কথা তুলে ধরে উল্লেখ করা হয়েছে ১৮৮৬ সালের ৪ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিক বিক্ষোভের বিখ্যাত আন্দোলনের প্রসঙ্গটির। এর পাশাপাশি ধারাবাহিক আন্দোলন ও সংগ্রাম এবং দেশে দেশে আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের দাবির তীব্র রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে অধিকার অর্জনের বিজয় প্রাপ্তির উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ১৮৮৯ সালে এঙ্গেলসের নেতৃত্বে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী পয়লা মে তারিখটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে পালন করার পরম্পরা শুরুর কথা। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৮৯০ সাল থেকেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সামাজিক পরিস্থিতির আলোকে শ্রমজীবী মানুষের উপর মালিক শ্রেণির নতুন নতুন আক্রমণের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের শপথ নেওয়ার দিন হিসেবে পয়লা মে দিনটিকে পালন করার গুরুত্বের কথা।
প্রস্তাবে উঠে এসেছে শাসক দলগুলি এবং রাষ্ট্রশক্তির প্রতিবন্ধকতাকে নস্যাৎ করে দেশের শ্রমজীবী মানুষের গত ২৮ এবং ২৯ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের নতুন ইতিহাস রচনার কথা। এদিনের সমাবেশ থেকে ওই ধর্মঘটের কর্মসূচিকে সফল করার জন্য রাজ্যের ছাত্র-যুব মহিলাসহ কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনকে অভিনন্দন জানানো হয়।
একই সঙ্গে দেশের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের শরিক কৃষক এবং তাদের সংগঠনগুলিকে অভিনন্দন জানিয়েছে এই প্রস্তাব। উদারনীতি ও কর্পোরেট পুঁজির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শ্রমজীবী মানুষ, যারা লড়াই সংগ্রাম করছেন তাদের সকলকে অভিনন্দন জানানো হয়।
প্রস্তাবে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি উল্লেখ করে বলা হয়েছে সরকারি দলগুলির নেতা-নেত্রীরা নানা কেলেঙ্কারিতে যুক্ত রয়েছেন। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হচ্ছেন রাজ্যের মন্ত্রীরা। সরকারি সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে শ্রমিকের অধিকার। গণতান্ত্রিক ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন দমন করতে পুলিশি হামলা এবং গ্রেফতার করা হচ্ছে নির্বিচারে। বিগত নির্বাচনগুলিতে রাজ্য ভোট জালিয়াতির সাক্ষী থেকেছে। দুর্বৃত্ত এবং তোলাবাজির দাপট এবং গণতন্ত্রের হত্যার কথাও উঠে এসেছে। প্রস্তাবে উদ্বেগের সঙ্গে মহিলাদের এরাজ্যে একেবারে নিরাপত্তাহীনতার কথা, বিকৃত লালসার শিকার হওয়ার কথা উঠে এসেছে। শাসক দলের লোকদের হাতে দলীয় কর্মীদের লাগাতার খুন এবং সিন্ডিকেটের মধ্যে অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ের প্রতি ধিক্কার জানানো হয়েছে এই প্রস্তাবে।
দেশ এবং রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতির প্রাসঙ্গিকতার বিশ্লেষণের ভিত্তিতে প্রস্তাবে ডাক দেওয়া হয়েছে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী লগ্নিপুঁজি ও বৃহত্তর স্বার্থে পরিচালিত নয়া উদারনীতির বিরুদ্ধে, শাসকের আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির শক্তি সংহত করে শ্রমিকদের অর্জিত অধিকার রক্ষা এবং শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা রক্ষার আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তীব্রতর করার শপথ নেবার কথা বলা হয়েছে।
শহিদ মিনারের সমাবেশে তপন সেন মে দিবস উদযাপনের শতবর্ষ উপলক্ষে বলেন, শ্রমজীবীদের শত্রু কারা চিনিয়ে দিতে হবে মানুষকে। তবেই শত্রুর বিরুদ্ধে আন্দোলন আরও শক্তিশালী হবে। আজকের পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে এগোতে হবে। মোদি সরকার এবং পুঁজিপতিদের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক গুন্ডামি চলছে। অর্থনৈতিক গুন্ডামি অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক প্রশাসনিক গুন্ডামির স্বৈরতন্ত্র চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিক আন্দোলনের পথেই এদের থামানো সম্ভব।
তিনি বলেন, আমাদের দেশকে বেচে দেওয়ার নীতি নিয়েছে মোদী সরকার। মূল্যবৃদ্ধি সংগঠিত করা হচ্ছে। বাজার সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে বেকারি ও দারিদ্র্য বাড়ায়। তারমধ্যে মুনাফা নিশ্চিত করতে মূল্যবৃদ্ধি করা হচ্ছে। এছাড়া পেট্রোপণ্যের দাম বৃদ্ধির কোনো যুক্তিসম্মত অর্থনৈতিক কারণ নেই এই ভারতে।
রাজ্য প্রশাসনগুলির শ্রমিক বিরোধী মনোভাব সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বলেন, কর্ণাটক, উত্তর প্রদেশ সহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় মে দিবস পালনে বাধা দেওয়া হচ্ছে। কলকাতায় সমাবেশ করার অনুমতি দিতে চাইছিল না পুলিশ। গত রাত পর্যন্ত তারা দেয়নি। ট্রেড ইউনিয়নগুলো সমাবেশ করবোই বলায় বাধ্য হয়ে অনুমতি দিয়েছে। আগামীদিনে ওরা আরও বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবে।
তিনি ট্রেড ইউনিয়নগুলোর দু’দিনের ধর্মঘট প্রসঙ্গে বলেন, সারাদেশে ট্রেড ইউনিয়নগুলি দুদিনের ধর্মঘট করে দেখিয়ে দিয়েছে আক্রমণাত্মক প্রতিরোধের পথে এগোতে হবে। ধর্মঘট আমাদের সাহস জুগিয়েছে। এই সাহসে ভর করে আমাদের সংগ্রাম তীব্র করতে হবে।
কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কৃষি আইন প্রত্যাহার সম্পর্কে তিনি বলেন, এভাবেই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শ্রমকোড চালু ঠেকিয়ে দিতে পারে। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন সারা দেশের শ্রমজীবী মানুষের সমর্থন পেলে এবং যদি শ্রমিক এবং কৃষক একজোট হয়ে রাস্তায় নামে কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা নেই যে আক্রমণ চালিয়ে যাবে! শ্রমজীবী মানুষের বিভাজনের জন্য সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ দরকার শ্রমজীবীদের। দুনিয়ার শ্রমিক এক হও-এটাই আমাদের শিক্ষা।
সকালে সিআইটিইউ দপ্তরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে এদিন বিমান বসু বলেন, কেন্দ্রের বিজেপি আর রাজ্যের তৃণমূল সরকার সর্বস্তরের মেহনতি মানুষের অধিকারগুলি খর্ব করে দিতে চাইছে। তার জন্য নানা কালাকানুন হচ্ছে। দুর্নীতি আকাশছোঁয়া। এই রাজ্যে এখন শাসকদলের বিধায়কের আপ্ত সহায়ক চাকরি দেওয়ার নাম করে টাকা আদায় করছে। এই সর্বনাশ মানুষকেই রুখতে হবে।
সভায় অনাদি সাহু বলেন, পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল ও সরকার মুখে বলে তারা বিজেপি বিরোধী। প্রকাশ্যে প্রধানমন্ত্রীকে গালমন্দ করেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু আড়ালে আরএসএস-এর নির্দেশে কেন্দ্রের সরকার এবং বিজেপি’র সঙ্গে বোঝাপড়া করে চলে। এরাজ্যে বামপন্থী ও গণতান্ত্রিক সব গণআন্দোলনকে স্তব্ধ করতে তৃণমূল সরকারের প্রশাসন মরিয়া আক্রমণ চালাচ্ছে। আক্রান্ত মহিলা আদিবাসীসহ সমাজের প্রান্তিক মানুষেরা।
এদিনের শ্রমিক সমাবেশে এছাড়াও ভাষণ দেন ইউটিইউসি’র সাধারণ সম্পাদক অশোক ঘোষ, এআইটিইউসি’র বিপ্লব ভট্ট, এআইইউটিসি’র স্বপন ঘোষ, টিইউসিসি’র প্রবীর ব্যানার্জি, এআইসিসিটিইউ’র রতন চক্রবর্তী প্রমুখ।
সভার শেষ পর্বে সুভাষ মুখার্জি আগামীদিনে মোদি সরকার এবং একইসঙ্গে এই রাজ্যের তৃণমূল সরকারের শ্রমিক বিরোধী অপশাসন রুখতে বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক দেন। জোর দেন শ্রমিক ঐক্যের ভিত আরও শক্ত করার ওপর।
এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রাজ্যের সর্বত্র ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা মে দিবস উদযাপন করেছেন। শহিদ বেদিতে মাল্যদান, সভা-সেমিনার, রক্তদান ইত্যাদি কর্মসূচির মধ্যদিয়ে এই দিনটি উদযাপন করা হয়। প্রতিটি জেলায় পাড়ায় বামপন্থী কর্মীরা রক্ত পতাকা ঊড্ডীন করে জনগণের সামনে মে দিবসের বর্তমান তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন।