৫৯ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৬ মে, ২০২২ / ২২ বৈশাখ, ১৪২৯
সত্যজিৎ রায়ের সমগ্র শিল্প সৃষ্টিই ছিল সত্যে আধারিত
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
সত্যজিৎ স্মরণ সন্ধ্যায় বক্তা আদুর গোপালকৃষ্ণান।
শিল্প মানুষের জীবনে রূপান্তরমূলক প্রভাব তৈরি করে। তাকে অভিযোজিত করে উন্নত মানসে। তবে সেটা তখনই সম্ভব যদি সেই শিল্প সত্যে আধারিত হয়। সত্যের জয় যে অমোঘ সত্যজিৎ রায় তাঁর সামগ্রিক সৃষ্টিশীলতার সম্ভারের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে দিয়েছেন। ২ মে কলকাতার কলামন্দির প্রেক্ষাগৃহে তাঁর ১০১তম জন্মদিনে উপস্থিত বিশিষ্টদের আলোচনায় উঠে এলো এমনই নির্যাস। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই একমত, সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতাই তাঁকে বাস্তববাদী কালোত্তীর্ণ স্রষ্টা হিসেবে অতুলনীয় পরিসর এবং উচ্চতা দিয়েছে।
অনুষ্ঠানের সূচনায় তাই মুখ্য সঞ্চালিকা মধুমন্তী মৈত্র উল্লেখ করেন সত্যজিৎ রায়ের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের পরিসরে আলোকপাত করার মধ্যদিয়ে ‘সত্যের জিত’ অভিধাকে বিকশিত করতেই এই অনুষ্ঠানের আয়োজন।
২ মে সকালে বিশফ লেফ্রয় রোডের বাসভবনের সামনে এক অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায়ের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণান, সব্যসাচী চক্রবর্তী, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। সেখানে সংক্ষিপ্ত ভাষণে সকলেই এই অজেয় শিল্পীর জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে দু’চার কথা বলেন। বিশ্বনাথ চক্রবর্তীর আঁকা সত্যজিৎ রায়ের প্রতিকৃতি সন্দীপ রায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক আদুর গোপালকৃষ্ণান তাঁর বক্তব্যে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের সম্পর্কে বলেন, তিনি ছিলেন সর্বোত্তম বাস্তববাদী। পথের পাঁচালি ছবি দেখে তাঁর মুগ্ধতার কবুলতির পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেন, তাঁর ছবির চিত্রনাট্য, সঙ্গীত ভাবনা, চরিত্র চিত্রণ, সমাজ ভাবনা এবং সত্যকে ছোঁয়ার যে মনন, সেই মননের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে চলচ্চিত্রের একজন শিক্ষার্থী হিসাবে। তিনি জানান সত্যজিৎ রায় তাঁকে সবসময়ই উৎসাহিত করতেন নতুন সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করার জন্য। তিনি এই কালজয়ী স্রষ্টার সিনেমার সম্ভারকে আমাদের ঐতিহ্যের মহান সম্পদ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, তাঁর সৃষ্টি মানেই জীবন এবং সংস্কৃতির উজ্জীবন। আমরা ভাগ্যবান সেই ঐতিহ্যের ধারা আমরা বহন করছি। শারীরিক উচ্চতার দিক থেকে নয়, বুদ্ধিগত দিক থেকেও তিনি ছিলেন আমাদের সময়ের সবচেয়ে উচ্চতম, মহত্তম চলচ্চিত্রকার।
কলামন্দিরে এদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের আয়োজনের অনিবার্যতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক পবিত্র সরকার বলেন, বস্তুতপক্ষে এখনকার প্রজন্ম খানিকটা আমাদের ঈর্ষা করতে পারে এই কারণে যে, আমাদের যৌবনকাল, যখন আমরা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন একটা অন্য ধরনের নবজাগরণ এই বাংলার বুকে তৈরি হয়েছিল। শম্ভু মিত্র নাটক করছেন, তার সঙ্গে উৎপল দত্ত প্রমুখ আসছেন, সলিল চৌধুরী গান রচনা করছেন, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আসছেন। রবীন্দ্র শতবার্ষিকী আসছে এবং সত্যজিৎ রায় সমস্ত দিক থেকেই বিস্ফোরণের মতো এসে পড়লেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এলেন ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ, তরুণ মজুমদার। এই সবই যৌবনকালে আমাদের নির্মাণে অনেকটা সাহায্য করেছে। ফলে এই মানুষগুলোর কাছে সংকীর্ণ একভাষী বাঙালি হিসেবে, ভারতীয় হিসেবে এবং পৃথিবীর নাগরিক হিসেবে ঋণ রয়েছে আমাদের। এ ঋণ স্বীকার করার দায় আছে আমাদের। সেই জন্য এই ১০১ বছরের আয়োজন।
তিনি বলেন, সত্যজিতের মতো মানুষের জন্ম যে কোনো সমাজের পক্ষে গৌরবের। এই মানুষগুলো রোল মডেল হিসেবে তৈরি হন নিজেদের কৃতিত্বে, নিজেদের শ্রমে, নিজেদের নিষ্ঠায়, নিজেদের যন্ত্রণায়। কিন্তু একটা সমাজকে এরাই কয়েক ধাপ ওপরে তুলে দেন এই কারণেই যে, তার দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে পরের সময়কার মানুষেরা, আমাদের সন্তানেরা তাদের আকাঙ্ক্ষা, তাদের স্বপ্নের একটা মানচিত্র তৈরি করে। ভবিষ্যতের একটা পথরেখা আমাদের ছেলেমেয়েরা আমাদের অগোচরে নির্মাণ করছে, স্বপ্ন দেখছে এই ধরনের মানুষগুলোর কাজ এবং স্মৃতি ঘিরে। তাঁরা ভাবেন আমাদের কাছাকাছি মানুষগুলোই দিগন্ত ছুঁয়েছেন, দিগন্ত পার হয়ে গেছেন। আমরা হয়তো চেষ্টা করলে কোথাও একটা পৌঁছাতে পারি।
ভিড়ে ঠাসা কলামন্দিরে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সত্যজিৎ রায়ের ছবির শক্তির দিক হলো বাস্তবতা। যেখানে কোনো ফাঁক নেই। শুধু বহিরঙ্গে নয়, তার গভীর বিশ্লেষণে একটা ইতিহাসকে তিনি প্রত্যক্ষ করে চলেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর তৈরি হওয়া ছবির সমৃদ্ধি নিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, চেয়েছেন এগিয়ে যেতে, চেয়েছেন বাঁক নিতে। তিনি চেয়েছেন ভারতীয় ছবি সেই পথেই চলুক। সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, একটা গভীর সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আজ আমাদের সংকল্পবদ্ধ হবার দিন - সত্যের সন্ধানে তাঁর দেখানো পথে আরও ছবি আমরা করতে পারব, করে যাব। শত প্রতিবন্ধকতা, শত বাধা, শত রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় হলেও তাকে পেরিয়ে যেতে হবে।
বিশিষ্ট পরিচালক তরুণ মজুমদার বলেন, সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন পর্দায় কখনো মিছে কথা বোলোনা। পর্দায় মিছে কথা বলার অর্থ হলো সমস্ত সমাজকে কলুষিত করা। কেননা লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া হয়। যদি কোনো জিনিস লুকোনোর হয় যেটা উচিত নয় অথবা প্রকাশ করা হয় যা প্রকাশ করা উচিত নয়, তাহলে শুধু ভুল করছ না সমাজের প্রতি পাপ করছ।
সন্ধ্যায় স্বাগত ভাষণে জন্মশতবর্ষ কমিটির সভাপতি বিশিষ্ট অভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী উপস্থিত বিশিষ্টজন সহ দর্শকদের স্বাগত জানিয়ে বলেন, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের অসামান্য অবদানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে আমরা স্মরণ করতে চেয়েছি একটু ভিন্নভাবে। তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টির বিশ্বে অসাধারণ কাজের দর্পণে আমরা খুঁজতে চেয়েছি এই প্রজন্মের প্রতিভা। সত্যজিৎ রায়ের ভাবনা নিয়ে মানুষের মনের কাছে যেতে চেয়েছি। তরুণ প্রজন্মের চিন্তা-চেতনায় সত্যজিৎ রায়ের সৃজনশীলতাকে প্রজ্বলিত করতে চেয়েছি। বৈষম্য, সুবিধাবাদ, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ বার্তাকে আমরাও ছুঁতে চেয়েছি এই উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে। আমাদের বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত সত্যের জয় হবে। সত্যের জিত নিশ্চিত।
জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটির সম্পাদক বিশিষ্ট পরিচালক কমলেশ্বর মুখার্জি ধন্যবাদ সূচক বক্তব্যে তুলে ধরেন সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে ফরাসি চলচ্চিত্রের মন্ত্রমুগ্ধকর নির্মাণের প্রভাব, সোভিয়েত রাশিয়ার চলচ্চিত্রের বৈশিষ্ট্য সামাজিক ও রাজনৈতিক মন্তব্য করার প্রবণতা, ইতালীয় চলচ্চিত্রের গল্প বলার ঢঙে সিনেমা বুননে দর্শককে গেঁথে সত্যপরতার সরণিতে হাত ধরে এগিয়ে নেওয়ার কথা। তিনি বলেন, সত্যজিৎ রায় আমাদের একটি দীর্ঘ অন্ধকারাচ্ছন্ন করিডর ধরে এগনোর যাত্রায় পৌছে দেন আলোক উদ্ভাসিত জানলায় - যেখান থেকে আকাশ দেখা যায়। দেখা যায় মানুষের জীবনের, সমাজের সবকটি রঙয়ের পরত সুবিন্যস্তভাবে।
অনুষ্ঠান মঞ্চে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্টজন অশোক মুখোপাধ্যায়, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়, শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়কে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করা হয়। উপস্থিত ছিলেন সায়েরা শাহ হালিম সহ অনেকে। সত্যজিৎ রায়ের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার সহ বেশকিছু মূল্যবান লেখার সংকলন সত্যজিৎ সন্দেশ এদিন মঞ্চে প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় জনবাদী লেখক সঙ্ঘের সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা।
কলামন্দিরে এই উদ্যাপন সন্ধ্যায় সত্যজিৎ রায় জন্মশতবর্ষ উদ্যাপন কমিটি আয়োজিত চলচ্চিত্র, প্রবন্ধ সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় সফল প্রতিযোগীদের পুরস্কার ও শংসাপত্র দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানের সূচনায় মনীষ ঘোষ কৃত ‘রে ইন দ্য ট্রুথ’ তথ্যচিত্রটি প্রদর্শিত হয়। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্বে মঞ্চজুড়ে শুরু হয় কল্যাণ সেন বরাটের পরিচালনায় ক্যালকাটা কয়্যারের বৃন্দগান ও দৃশ্যায়ন। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে ব্যবহৃত সঙ্গীতের এবং নৃত্যের কোলাজ দর্শকদের মনোরঞ্জন করে। শেষে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গর নৃত্যনাটক ‘এখনও গুপী বাঘা’ অনুষ্ঠিত হয়।