৫৯ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৬ মে, ২০২২ / ২২ বৈশাখ, ১৪২৯
মার্কসের কাছে বার বার ফিরে যেতে হয়
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● কার্ল মার্কসের ২০৫তম জন্মদিবস এবছর ৫ মে। মানবসমাজের ইতিহাসে ‘সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ’ (ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের কথায়) কার্ল মার্কসকে স্মরণ করবেন বিশেষকরে মেহনতি জনগণ, সমাজবিপ্লবীরা। ফ্রেডরিক এঙ্গেলসকে সাথে নিয়ে কার্ল মার্কস বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন। যদিও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস কার্ল মার্কসকেই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্বের প্রতিষ্ঠাতা বলে বর্ণনা করেছেন, কৃতিত্ব দিয়েছেন। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদের পরিচিতি হোক কার্ল মার্কসের নামানুসারে ‘মার্কসবাদ’ হিসাবে - এটা ছিল এঙ্গেলসের দাবি।
● মার্কসবাদ হলো বৈজ্ঞানিক সমাজবীক্ষা। লেনিনের কথানুযায়ী ঊনবিংশ শতাব্দীর জ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ তিনটি ধারা যথাক্রমে জার্মান দর্শন, ইংল্যান্ডের অর্থনীতি ও ফরাসি সমাজতন্ত্রের মতবাদকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে মার্কসবাদ। মার্কসবাদ তিনটি উপাদানে গঠিত। যথাক্রমে মার্কসীয় দর্শন, মার্কসীয় অর্থনীতি ও মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব। বিকাশের সর্বাঙ্গীণ তত্ত্ব মার্কসবাদ। মার্কসীয় মতবাদ একদিকে বিপ্লবী, অপরদিকে বৈজ্ঞানিক।
সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সর্বহারা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের অবসান ঘটাবে, প্রতিষ্ঠিত হবে শোষণহীন সমাজের প্রথম স্তর সমাজতন্ত্র - এই বক্তব্য মার্কসবাদই প্রথম তুলে ধরল। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ কখনোই মার্কসীয় মতবাদকে মেনে নিতে পারেনি। তাই এই মতবাদ প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বারবার হাজারো আক্রমণের শিকার হয়েছে। মার্কসবাদকে বিকৃত করা, তার বিপ্লবী অন্তর্বস্তুকে খাটো করার ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং আজও হয়ে চলেছে। বিলম্বিত পুঁজিবাদের মতবাদ ‘উত্তর আধুনিকতা’কে মার্কসবাদকে নস্যাৎ করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। মহাব্যাখ্যামূলক মতবাদকে অপ্রাসঙ্গিক করার উদ্দেশ্যে মার্কসবাদকে আক্রমণ করা হয়েছে।
● মার্কসীয় মতবাদের প্রতিষ্ঠার প্রায় ১৭৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও (কমিউনিস্ট ইশ্তেহার প্রকাশ হয়েছিল ১৮৪৮ সালে) এই মতবাদ সমগ্র মানবসমাজের চিন্তা ভাবনার জগৎকে আজও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। কোনভাবেই একে খারিজ করা যায় না, বরং মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বার বার মার্কসের কাছে ফিরতে হয়, তাঁর কাছে ঋণের তো শেষ নেই। সমগ্র মানবসভ্যতা তাঁর কাছে ঋণী।
● দুনিয়াটাকে যেভাবে দেখছি সেটাই শেষ কথা নয়, এই দুনিয়াটাকে পরিবর্তন করা যায়, শোষণভিত্তিক মানবসমাজকে শোষণহীন স্তরে উন্নীত করা সম্ভব - এটাই তো মার্কসের শিক্ষা। ‘এতকাল দার্শনিকরা দুনিয়াটাকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, কিন্তু মূল কথা হলো একে পরিবর্তিত করা’। নয়া-উদারবাদের আগ্রাসনে ভারতসহ সমগ্র বিশ্বে বিপর্যস্ত মেহনতি মানুষ। পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ অতীব শক্তিশালী। অর্থ, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, প্রচারমাধ্যম, সামরিক শক্তি - সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে। অমিত শক্তির অধিকারী পুঁজিবাদের অবসান ঘটানো সম্ভব শ্রমিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। সমগ্র শ্রমজীবী মানুষকে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করে সংগ্রামের ধারায় টেনে আনার মতবাদ মার্কসবাদ। শক্তির উৎস যে মতবাদ সেই তত্ত্ব তো মার্কসই উপস্থিত করেছেন।
● মানব ইতিহাসের ধারায় শ্রেণিসংগ্রামই চালিকাশক্তি। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক ও পুঁজিপতি - প্রধান দুই পরস্পর বিরোধী শ্রেণি। এই দুই শ্রেণির মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে শুধু না, তীব্রতার হ্রাস বৃদ্ধিও ঘটছে। এই শ্রেণিসংগ্রামই পুঁজিবাদী সমাজকে বিধ্বস্ত করছে, শেষ পর্যন্ত অবসানও ঘটাবে। বিকাশের ধারায়, শ্রেণিসংগ্রামের তীব্রতায় সর্বহারা বিপ্লবের মাধ্যমে শোষণভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজের পতন অবশ্যম্ভাবী। পুঁজিবাদই হলো শোষণভিত্তিক সমাজের সর্বশেষ রূপ। পুঁজিবাদের অবসানে শ্রমিকশ্রেণির রাষ্ট্রব্যবস্থা অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা ঘটবে। শ্রমিক বিপ্লবের অনিবার্যতা ও সমাজতন্ত্রের অবশ্যম্ভাবিতা তুলে ধরেছে মার্কসবাদ। তাই তো শোষিত, বঞ্চিত, মেহনতি মানুষের জীবনে মার্কসবাদ যেন সেই সর্বরোগহর বৃক্ষ - বিশল্যকরণী।
● শ্রমিকের সাথে পুঁজিপতি মালিকের সম্পর্ক চরম বৈরিতামূলক। পুঁজিপতি তার উৎপাদন ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য শ্রমিক নিয়োগ করে। শ্রমিক তার কাজের বিনিময়ে মজুরি পায়। কিন্তু মজুরি শ্রমের মূল্য নয়। ‘শ্রমশক্তি’র মূল্য। পুঁজিপতি শ্রমিকের শ্রমশক্তি ক্রয় করে তাকে দিয়ে যে পণ্য উৎপাদন করায় তার মূল্যই হলো শ্রমের মূল্য। মজুরি সেই মূল্যের তুলনায় কম। শ্রমের মূল্য থেকে মজুরি মূল্য বাদ দিলে থাকে উদ্বৃত্ত মূল্য। পুঁজিপতি মালিক এই উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ করে। উদ্বৃত্ত মূল্য থেকেই মুনাফা। মুনাফা লালসাই পুঁজিপতিকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মুনাফার সর্বোচ্চকরণই পুঁজিপতির লক্ষ্য। শ্রমজীবী সহ সাধারণ জনগণের দুর্বিষহ অবস্থা নিয়ে পুঁজিপতির চিন্তা নেই। বর্তমান পৃথিবীতে নয়া উদারীকরণের যুগে মুনাফার সর্বোচ্চকরণের লক্ষ্যে পুঁজিপতিদের কার্যধারার পরিণতিতে বেকারি, বৈষম্য, অভাব-দারিদ্র্য, খাদ্য-স্বাস্থ্য সংকট, পরিবেশ সহ সর্ববিধ সংকট। লড়াই-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাময়িকভাবে কোনো সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব হলেও পুঁজিবাদের অবসান ব্যতিরেকে এই সংকটগুলি থেকে চিরতরে মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়। চরম সংকটগ্রস্ত মানুষের মধ্যে মুক্তির দিশা অর্থাৎ পুঁজিবাদের অবসান ও সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা - এটা হাজির করাই মার্কসবাদের শ্রেষ্ঠত্ব।
● ‘রাষ্ট্র’ ব্যবস্থা হলো শ্রেণিশোষণের যন্ত্র। দাসব্যবস্থা থেকে মানবসমাজে যে রাষ্ট্রগুলি বিগত কয়েক হাজার বছর ধরে প্রত্যক্ষ করা যায়, সেগুলি সবই সেই যুগের শোষকদের দমন ও শোষণের হাতিয়ার। যতদিন রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকবে তা কোনো না কোনো শ্রেণির শোষণের ও দমনের যন্ত্র। শোষণ তথা শ্রেণি বিভাজনের চিরতরে অবসান ঘটাতে হলে রাষ্ট্রব্যবস্থার অবসান ঘটাতে হবে। একমাত্র সর্বহারা রাষ্ট্রব্যবস্থা অর্থাৎ সমাজতন্ত্রের মধ্য দিয়ে সাম্যবাদ বা কমিউনিজমের স্তরে মানবসমাজের উত্তরণ প্রকৃত রাষ্ট্রহীন ও শ্রেণিহীন স্তরে মানবসমাজের উত্তরণ সম্ভব করবে। মার্কসবাদ মানবসমাজের বিকাশের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ দিশা উপস্থিত করল।
● বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, শিক্ষা ও জ্ঞান - এদের অভাবনীয় অগ্রগতি আমরা প্রত্যক্ষ করছি। পারমাণবিক অস্ত্র সম্ভার সহ ভয়াবহ মারণক্ষমতা সম্পন্ন অস্ত্রভাণ্ডার ও যুদ্ধ - তাও আমরা প্রত্যক্ষ করছি। বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও জ্ঞানের সুবিপুল অগ্রগতি সম্পূর্ণভাবে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ কুক্ষিগত করেছে, নিজের চাহিদা মেটাতে তারা তা ব্যবহার করছে। বুভুক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা, নিরক্ষরতা, সবই মানবসমাজে বিরাজ করছে। মুষ্টিমেয় পুঁজিপতি বিলিওনেয়ার, ট্রিলিওনেয়ার অর্থাৎ হাজার কোটি, লক্ষ কোটি টাকার মালিকে রূপান্তরিত হয়েছে। সমগ্র মানবসমাজের স্বার্থে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহার একমাত্র নিশ্চিত করা যেতে পারে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে সর্বহারার রাষ্ট্রব্যবস্থার কায়েমের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবীর চেহারাও পালটে যাবে। শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বের পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হবে। সর্বহারার নেতৃত্বে সমাজবিপ্লবই সেই পথের চাবিকাঠি। মার্কস ও মার্কসবাদই কাণ্ডারী।
● বর্তমান সময়ে নানাভাবে শোষণহীন সমাজ গড়ার সংগ্রামকে দুর্বল করা, বিপথগামী করা তথা হতোদ্যম করার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলছে। দুনিয়াজুড়ে সাম্রাজ্যবাদের পক্ষ থেকে মার্কসীয় মতবাদকে দুর্বল ও অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়ার প্রয়াস চলছে। পুঁজিবাদের সংকট যেমন বৃদ্ধি পাচ্ছে, মার্কসবাদের প্রতি আকর্ষণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংকট সমাধানের পথ খোঁজার তাগিদে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহকদের অনেকেই মার্কসবাদ অনুশীলন করতে বাধ্য হচ্ছেন।
● মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা ক্রমান্বয়ের বৃদ্ধি পাচ্ছে। মার্কসের দিকে মুখ ঘোরাও - সংকট জর্জরিত শ্রমজীবী মানুষরে কাছে অনতিক্রম্য আহ্বানের রূপ নিচ্ছে।
মার্কসবাদের শিক্ষাকে আত্মস্থ করে তার প্রয়োগের মধ্য দিয়ে শোষণহীন মানবসমাজ ও সকলের সমানাধিকারের পৃথিবী প্রতিষ্ঠার লড়াইকে আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব - কার্ল মার্কসের ২০৫তম জন্মদিবসে এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।