৫৯ বর্ষ ৩৮ সংখ্যা / ৬ মে, ২০২২ / ২২ বৈশাখ, ১৪২৯
ঈশ্বর যাঁর মানবলোকে
বনবাণী ভট্টাচার্য
বুঝেছি কি বুঝি নাই বা সে তর্কে কাজ নাই,
ভালো আমার লেগেছে যে রইল সেই কথাই।।
তিনি ধার্মিক? তিনি অহিন্দু ব্রাহ্ম? আস্তিক নাকি নাস্তিক? প্রাচ্য না পাশ্চাত্যের প্রবক্তা? প্রাচীনপন্থী অথবা আধুনিক? ভাববাদী না বস্তুবাদী? তিনি কি তবে সাম্যবাদী? ইত্যাদি গুচ্ছ গুচ্ছ প্রশ্ন নিয়ে তর্ক করা যেতে পারে বা হয়ে থাকে তাঁকে ঘিরে। নানান দিক থেকে তাঁকে দেখে, বিচার করে জ্ঞানী-গুণীরা তাঁর সত্তাকে চিহ্নিত করেন, একে অপরের বিপরীতেও হয়তো। জনসমাজে তাঁর প্রধান পরিচয়, তিনি পৃথিবীর কবি। এই কবি ব্রহ্মবাদী হতেও পারেন, নাও হতে পারেন, কিন্তু তিনি পরমধার্মিক। বিরুদ্ধ মতাবলম্বীর কানে প্রচণ্ড ধাক্কা মারলেও, এ সত্য নিশ্চল যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একান্তভাবেই ধার্মিক - আর তাঁর ধর্মের নাম ‘মানব ধর্ম’ - যে ধর্ম থেকে দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে তিনি মুহূর্তের জন্যও বিচ্যুৎ হননি। ধর্মাধর্মের জটাজাল থেকে মুক্ত করে, তর্কে নয়, অনুভবে পেয়েছে তাঁকে - আর তাতেই তাঁকে ভালো লাগার সত্য রয়েছে।
খবরে প্রকাশ, বর্তমান ভারতের রাষ্ট্র পরিচালকরা, মানবাধিকারের কর্মী-সংগঠকদের কারণে সন্ত্রাসবাদ দমন করতে পারছেন না। অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদ দমনে মানবাধিকার বাধা। আর রবীন্দ্রনাথের জীবন ও তাঁর লিখনবিশ্ব, মানুষের অধিকার রক্ষার সংগ্রামের মহা দলিল। যারা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল, কোনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দর্শনের ধার না ধেরে, কবি তাদেরই পক্ষপাতিত্ব করেছেন, তাদেরই জন্যে সিংহাসনের আসন থেকে তিনি বারে বারে নেমে এসেছেন পথের ধুলায়।
না হলে, কোন জমিদার কবে, স্বল্পবাস, শীর্ণ, অনাহার ক্লিষ্ট, নতনয়ন, সরলমনা মানুষের আত্মসম্মান ও অধিকারবোধ জাগিয়ে তুলতে নিজে মরিয়া হয়ে উঠেছেন - স্বশ্রেণির শত্রুর শক্তিবৃদ্ধি করেছেন? দেশের সেই নিরন্ন অন্নদাতাদের আর্থিক স্বাবলম্বনের জন্য বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের সাম্মানিক অর্থে আর কী পেরেছেন, আর কে পেরেছেন কৃষি সমবায় ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করতে? কে পেরেছেন পরের কল্যাণে নিজের সর্বস্ব উজার করে দিতে? শুধু কৃষি সমবায় ব্যাঙ্ক বা সমবায় আন্দোলন গড়া নয়, এই যে রবীন্দ্রনাথ, সারা জীবন বারে বারে ইয়োরোপ, আমেরিকা, এদেশ সে দেশ করেছেন, সেকি কেবলই বিপুলা পৃথিবীর অসংখ্য নগর ও রাজধানী, মানুষের অগণিত কীর্তি, নদী-গিরি-সিন্ধু-মরু কি অজানা জীব সব নিজের গোচরে আনার জন্যে, বিশাল বিশ্বের আয়োজনের ভাগ নিতে? পৃথিবীজুড়ে কবির সেই আনন্দ-ভোজে ছিল না কি ভিক্ষা ঝুলি কাঁধে এক যোগী ভিখারি, নিজের হাতে গড়া শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন-বিশ্বভারতীর চলৎশক্তি অটুট রাখার জন্যে? আর্থিক সাহায্য সংগ্রহটা সেদিন নিতান্ত গৌণ ছিল না।
কবির জীবনে দুটো বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত। তাঁর মহাপ্রয়াণের আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীভৎসা শুরু হয়ে গেছে। শুরু হয়ে গেছে ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর তাণ্ডব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেই কবিকে ‘‘একতারা ফেলে দিয়ে কখনো বা নিতে হল ভেরী।’’ রোগশয্যায় শায়িত কবি, আক্রান্ত সোভিয়েত ভূমির বিজয়ের আকাঙ্ক্ষায় প্রহর গুণছেন, এই জন্যে নয় যে তিনি সোভিয়েতপন্থী ছিলেন। আসলে তিনি যে মানবপন্থী। তিনি কখনও মানুষের মধ্যে জেগে ওঠা ‘অসুর’কেই চরম সত্য বলে মানতে পারেননি।
তাই, এখনও মুক্ত মন পাখা মেলে। পাখা মেলে বলে, গোবিন্দ পানসারে, নরেন্দ্র দাভোলকার, গৌরী লঙ্কেশদের দেহ ছিন্নভিন্ন হয় গুলিতে - আশি পেরোনো কবি ভারভারার জামিনটুকু অনুমোদনের মানবিক সৌজন্যটুকু থাকে না সরকারের। চরম অমানবিকতার শিকার হয়েছেন ফাদার স্ট্যানলি স্বামী, দৃষ্টিপথ খোলার চশমা এমনকি গ্লাস ছাড়া যিনি জলটুকু খেতে পারেন না নিয়ন্ত্রণহীন স্নায়ুর কারণে। তাঁর আকণ্ঠ পিপাসার জল কেড়ে নিয়েছে প্রতিক্রিয়াশীলদের দাসানুদাসরা। যারা কুসংস্কারের জাল, ধর্মের ধোঁয়াশা এবং ধর্মান্ধতার কারাগার থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে, কেউ ভীমা কোরেগাঁওয়ের অত্যাচারিত রক্তাক্ত দলিতের অধিকারের লড়াইয়ের পক্ষে থেকে আরবান নকশালের তক্মা অর্জন করেছেন, দেশদ্রোহিতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন, কেউ হয়তো বা সন্ত্রাসবাদী বলে রাষ্ট্র দ্বারা চিহ্নিত হয়েছেন। ভীমা কোরেগাঁওয়ের দলিত নির্যাতন, কাশ্মীরে জিপের সামনে মানুষ বেঁধে সন্ত্রাস মোকাবিলার পৈশাচিক নিষ্ঠুরতা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নয়? রাষ্ট্র নিজে যখন সন্ত্রাসের পথে, তখন সন্ত্রাস দমনে অবশ্যই মানবাধিকারের প্রশ্নটা রাষ্ট্রকে বিব্রত করে - তার পীড়নের রাস্তায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর তারই অপর নাম প্রতিবাদ।
এরকমই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন তরুণের স্বপ্ন চোখে সেদিনের সুভাষচন্দ্র বসু। সুভাষচন্দ্র তো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। রবীন্দ্রনাথ কোনোভাবেই সে গোত্রের নন। কিন্তু যাঁর ধর্ম আক্রান্ত বিপন্নের সহায় হয়ে ওঠা, তাকে কে বাঁধবে? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের হিংস্রতার বিরুদ্ধে নিজেই যিনি ‘‘এবার সকল অঙ্গ ভরি পরাও রণসজ্জা’’ বলে মনে মনে প্রস্তুত হয়েছেন, তিনিই ১৯৩১ সালে মেদিনীপুরের হিজলি জেলে ইংরেজ শাসকের বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে ঝলসে উঠেছিলেন। জীবনে বারে বারে নিজের পরিচয় দিয়েছেন ‘কবি আমি’, মনুমেন্টের নিচে দাঁড়িয়ে সেই দুঃসাহসই প্রয়োজনে রক্ত মাখা পায়ে একলা চলার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়েই তো বিদেশি শাসকের ঔদ্ধত্য ও নিরস্ত্র বন্দীদের ২৯ বার ফায়ারিং করে হত্যার অসভ্যতার জবাব দিয়েছেন। আপসমুখী, দোদুল্যমান দেশ নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ‘শক্তের অপরাধে’র তিনি হয়েছিলেন চিরক্ষমাহীন - যেমন তিনি ক্ষমা করেননি নজরুলের লাঙল পত্রিকার সরকারি বিরুদ্ধাচারণ, যেমন করেননি ১৯১৯-এর জালিয়ানওয়ালাবাগের পৈশাচিক হত্যা। রবীন্দ্রনাথ ঘরে বাইরে, চার অধ্যায়ে, স্বাধীনতা আন্দোলনে সন্ত্রাসবাদী ধারার কঠোর সমালোচনা করেছেন, কিন্তু যারা -
মরিতে ছুটিছে শত শত
প্রভাত আলোর পানে নক্ষত্রের মতো -
সেই সব নিঃশেষে প্রাণ দেওয়া দুঃসাহসী বীরদের তিনি শ্রদ্ধার আসনে রেখেছেন। আজকের বিজেপি শাসকদের মতো, বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রদের অধিকারের দাবি তোলা, উমর খালিদ-কান্হাইয়াদের দেশদ্রোহী বা সন্ত্রাসবাদী তক্মা দিয়ে, খলনায়ক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি।
আজকের ভারতের নিরুদ্ধ বাতাসে কবি শেষ অক্সিজেনটুকুতেও দেশজুড়ে এবং বাংলায় মানুষের অধিকার নস্যাৎ করার বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী শাসকের দর্পচূর্ণ করার আহ্বান জানাতেন প্রস্তুত হতে সকলকে। একটা প্রকাণ্ড মহামারীর অভিঘাতে সারা বিশ্ব যখন বিপন্ন, বিপন্ন রাষ্ট্র ও তার অঙ্গরাজ্যগুলি, তখন শাসকের প্রয়োজন ছিল বিপর্যস্ত অর্থনীতিতেও দেশের মানুষের মুখে ক্ষুধার অন্নটুকু জোগানো। প্রয়োজন ছিল কোটি কোটি কাজ হারানো পরিযায়ী থেকে শুরু করে স্থানীয় সমস্ত শ্রমিক-কৃষক-বেকারের উপোসী চোখে, আহত মনের শুশ্রূষা করা ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। বিজেপি পরিচালিত রাষ্ট্রে কাজ হারানো মানুষ আর বেকারের বোঝা বাড়ছে - বাড়ছে দমনপীড়ন আর বাজার আগুন হয়ে পুড়িয়ে দিচ্ছে সকল সংসার অসহায় মানুষের। আচ্ছে দিন, স্বনির্ভর ভারতের শ্মশান জ্বালিয়ে - মনভোলানো অগ্রগতির মোহন বাঁশি বাজিয়ে চলেছে মোদি সরকার। ভারত শ্মশানে জ্বলছে গণতন্ত্র - বাঁচার অধিকারের গণতন্ত্র। একই সুর বাংলায়। কেন্দ্র-রাজ্য দুইয়ের বোঝাপড়ায় একের পর এক নির্বাচনী প্রহসন বাংলায়। অন্যদিকে, ক্ষমতার লালসায় প্রতিদিনের রক্তখরচ। আর্থিক অনিয়ম, ক্ষমতার পক্ষছায়ে দুর্নীতি আর প্রতারণার পাঁকে রবীন্দ্রনাথ-সুভাষচন্দ্রের বাংলাকে ডুবিয়ে রাখা। আজ আর নাগরিক জীবন বিপন্ন করতে পররাজ্যগ্রাসীদের অস্ত্রের সংঘাতের প্রশ্ন নয়, শাসকদলের অভ্যন্তরের স্বার্থে স্বার্থে বেঁধেছে সংঘাত - লোভে লোভে ঘটেছে সংঘর্ষ। তাই মানুষের প্রাণই আজ বিপন্ন বোমা-গুলির ছড়াছড়িতে। কবির শান্তিনিকেতনে, বীরভূমে আজ আর ঘাস জন্মায় না - মাটি বারুদ হয়ে যাচ্ছে, জন্মাচ্ছে অস্ত্র পুঁতে ধান গড়ার ইচ্ছেকে যেন ব্যঙ্গ করে। আসলে বাংলার মানুষকে ব্যঙ্গ করছে রাজ্যের শাসকরা। ব্যঙ্গ করছে কবির সোনার বাংলার অস্তিত্বকে। ‘আমরা চাষ করি আনন্দে’ বলে রাজ্যের যে অন্নদাতাদের রাজ্যটাকে ফুলে ফলে সাজিয়ে তোলার ইচ্ছে ছিল, দুটো শক্ত হাতে কাজ করে সভ্যতার চাকাকে ঘুরিয়ে দেবার স্বপ্ন দেখত যে বেকাররা, যে শ্রমিকরা, তারা আজ পেটের খিদেয় শ্মশানে বা কবরে নিজেদের শেষ ঠিকানা খুঁজে নিতে বাধ্য হচ্ছে, নয়তো বছর বছর বাণিজ্য মহাসম্মেলনের ফল যখন কোনো দৃশ্যমান কল-কারখানা-অফিস-আদালতের চেহারা নেয় না, শূন্যে মিলিয়ে যায়, তখন প্রশাসনের ছত্রছায়ায়, শাসকদলের নানান স্তরের ব্রতীদের তৈরি করা দুষ্কৃতী আর নৈরাজ্য গড়ার কারখানায় নাম লিখিয়ে নরকের কীটে রূপান্তরিত হয়। বালিখাদান-কয়লাখাদান, সোনাপাচার-গোরুপাচার-নারী-শিশু পাচারের স্বর্গরাজ্য তৈরি করা তাদের কাজ। প্রশাসনের সস্নেহ শাসনে আইন-শৃঙ্খলায় তালা ঝুলিয়ে, একটা দুটো জ্বালিয়ে দেওয়া বগটুই, নিজেদের নিরাপদ স্বার্থের খাতিরে এখানে ওখানে তপন কান্দুদের নিকেশ করা, প্রতিবাদী আনিস খানদের সাথে সাথেই দুর্বৃত্তায়নে তাদের শিল্পকলা। শিল্পায়ন নয়, নারীর ক্ষমতায়ন নয়, রাজ্য এগিয়ে ‘ধর্ষণায়নে’।
পুঁজিবাদী আগ্রাসনে ঐশ্বর্য্যশালী ভারত এখন প্রাকৃতিক সম্পদে রিক্ত হতে বসেছে অন্যান্য দেশের মতোই, এই গ্রহের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে। তাই আছে কিছু বনসৃজনের উদ্যোগ। যত না বনস্পতির ব্যবহার, তার অনেক বেশি লোভ আর হিংস্র হিংসার বিষ বৃক্ষ রোপণ চলছে, চাষ চলছে অনৈতিকতা আর মনুষ্যত্বহীনতার। রাজ্যবাসীকে মনুষ্যত্ব নিয়ে বাঁচতে দেবার অবকাশ নেই শাসকদের। তাই, তাদের কুসংস্কার-যুক্তিহীনতা আর অদৃষ্টবাদিতার মায়াজালে আটকে রাখা - ধর্মভীরুতা-অলৌকিকতা আর ধর্মীয় বিদ্বেষের কারাগারে কয়েদ করা। ধর্মতন্ত্রীদের আজ ফ্রি হ্যান্ড - যাতে আধুনিকতা-বিজ্ঞানমনস্কতা তাদের ছুঁতে না পারে - মানুষকে আচার-বিচার, রীতি-বন্ধনের ঘেরাটোপে জাপটে রেখে দেওয়া।
বিধান-বাঁধা মানুষ তাঁকে মানে না মনে প্রাণে, তাঁকে ব্যবহার করে মাত্র তাদের বিষ-জিহ্বার উচ্চারণে। যারা মানুষের মধ্যে হিন্দুকে দেখে, মুসলমানকে দেখে, গৌরবর্ণ-কৃষ্ণবর্ণ খোঁজে, দেখে ব্রাহ্মণ-চণ্ডালকে-দেখে নারী-পুরুষকে, যারা মানুষের অপরিমেয় শক্তিকে বিশ্বাস না করে বিশ্ববিধাতার দোহাই পারে, তারা জীবশ্রেষ্ঠ মানুষকে ভয় করে। সেই ভয় থেকেই তাদের বোধ-বুদ্ধি এবং মনুষ্যত্বের বিনাশে বিভেদের ছুরিতে খণ্ডখণ্ড করা আর ধর্মীয় মাদকতায় মত্ত করতে ধর্মের কারাগারে আবদ্ধ রাখা ধর্মতন্ত্রীদের বদান্যতায়। কাজে-কর্মে, চিন্তা-ভাবনায়, মন্ত্রহীন-পঙ্ক্তিহীন রবীন্দ্রনাথকে তারা ভক্তির ছলনায় ব্রাত্য করে রাখে।
কিন্তু সূর্য-রশ্মি পাঁচিলের ফাটল দিয়ে ঢুকে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ, যিনি মানুষ আর তার মনুষ্যত্বকেই নিজের একমাত্র ধর্ম বলে মেনে এসেছেন, তিনি প্রজন্মের পর প্রজন্মের উত্তরাধিকার। যারা আজ অসম্মান আর অনুগ্রহের মোহরে গড়াগড়ি খায়, তাদের মানুষের পঙ্ক্তিতে তুলে আনাও সুস্থ জীবনযাপনের অন্যতম শর্ত - আগাগোড়া সমস্ত মানুষকে জাগিয়ে তোলাই আজকের নরকের বাংলার সোনার বাংলায় উত্তরণের চাবিকাঠি। গণআন্দোলন-রবীন্দ্রচর্চার প্রসারে এই চাবিকাঠি উঠবে গড়ে - ‘‘ভেদ চিহ্নের তিলক-পরা সংকীর্ণতার ঔদ্ধত্য থেকে’’ দেশ পরিত্রাণ পাবে। কবি বিশ্বাস করেছেন ‘‘তুমি অশ্রদ্ধেয়, বিনিপাত বলবার জন্য পণ করতে পাবে প্রাণ, এমন লোকও দুর্দিনের মধ্যে দেখা দেয়।’’ অচেতনতা অধর্ম-পরার্থপরতাই জগতের ধর্ম। গণমানসমুক্তির সাধনা সফল হলে এই দুর্দিনেই সম্মিলিত মানুষ, জড়তা মুক্ত হয়ে ক্ষমতার চোখে চোখ রেখে বলবে সাবধান বাণী -
ভাবছ হবে তুমিই যা চাও, জগৎটাকে তুমিই নাচাও -
দেখবে হঠাৎ নয়ন খুলে হয় না যেটা সেটাও হবে।
সেদিন স্বার্থ-মুক্ত মানুষ এগিয়ে যাবে মানবধর্মের পথে - সাফল্যের মুকুট পরবে রবীন্দ্র-চিন্তা, রবীন্দ্র-উত্তরাধিকার।
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সম্প্রীতির সপক্ষে রবীন্দ্রনাথ
● ‘‘বহুর মধ্যে ঐক্য উপলদ্ধি, বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য স্থাপন - ইহাই ভারতবর্ষের অন্তর্নিহিত ধর্ম।’’ (‘স্বদেশী সমাজ’, ‘আত্মশক্তি ও সমূহ’)
● ‘‘এই দুর্ভাগা ভারতবর্ষে আচার ও ধর্ম এক সিংহাসনের শরিক হয়ে মানুষের বুদ্ধিকে আবিল করে রেখেছে।’’ (‘কন্গ্রেস’/‘কালান্তর’)
● ‘‘ধর্মকে কবরের মতো তৈরি করে তারই মধ্যে সমস্ত জাতিকে ভূতকালের মধ্যে সর্বতোভাবে নিহিত করে রাখলে উন্নতির পথে চলবার উপায় নেই, কারও সঙ্গে কারও মেলবার উপায় নেই।’’ (‘হিন্দু মুসলমান’ (১)/‘কালান্তর’)
● ‘‘হিন্দু-মুসলমান চিরকাল পাশাপাশি থাকিবেই, তারা ভারতভাগ্যের শরিক - অবিবেচক দণ্ডধারী তাদের সম্বন্ধের মধ্যে যদি গভীর করে কাঁটা বিঁধিয়ে দেয় তবে তার রক্তস্রাবী ক্ষত শীঘ্র নিরাময় হবে না।’’ (কন্গ্রেস’/‘কালান্তর’)
● ‘‘ধর্ম আমাদের মেলাতে পারেনি, বরঞ্চ হাজারখানা বেড়া গড়ে তুলে সেই বাধাগুলোকে ইতিহাসের অতীত শাশ্বত বলেই পাকা করে নিয়েছে।’’ (‘হিন্দু-মুসলমান’/‘কালান্তর’)
● ‘‘আমার ধর্ম নেই, আমি যাকে ভালোবাসি সেই ভাগ্যবানই আমার ধর্ম। যে ধর্ম চিরদিন আমাকে জীবনের সব ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করেছে, অবজ্ঞার আঁস্তাকুড়ের পাশে আমাকে ফেলে রেখে দিয়েছে, সে ধর্মের মধ্যে আমি ত দেবতার প্রসন্নতা কোনদিন দেখতে পেলুম না। সেখানকার দেবতা আমাকে প্রতিদিন অপমানিত করেছে সে কথা আজো আমি ভুলতে পারিনে।... যে দেবতা আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন সেই ভালোবাসার সম্মানের মধ্যে তাঁকেই আমি পুজো করি, তিনিই আমার দেবতা; তিনি হিন্দুও নন, মুসলমানও নন।’’ (‘মুসলমানীর গল্প’/‘গল্পগুচ্ছ’/৪)
● ‘‘যে দেশে দিন রাত্রি ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি সে দেশে সব ধর্মকে মেলাবার পুণ্যব্রত আমার মতো নাস্তিকেরই।’’ (‘রবিবার/তিন সঙ্গী’)
● ‘‘আমাকে আজ সেই দেবতার মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু মুসলমান খৃষ্টান ব্রাহ্ম সকলেরই - যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনো ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না - যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।’’ (‘গোরা’/৭৫ অধ্যায়)
● ‘‘নিজে ধর্মের নামে পশুহত্যা করিব অথচ অন্যে ধর্মের নামে পশু হত্যা করিলেই নরহত্যার আয়োজন করিতে থাকিব, ইহাকে অত্যাচার ছাড়া অন্য নাম দেওয়া যায় না।’’ (‘ছোটো ও বড়ো’/‘কালান্তর’)
● ‘‘ধর্ম যদি অন্তরের জিনিস না হইয়া শাস্ত্রমত ও বাহ্য আচারকেই মুখ্য করিয়া তোলে তবে সেই ধর্ম যত বড়ো অশান্তির কারণ হয় এময়ন আর কিছুই না।’’ (‘ছোটো ও বড়ো’/‘কালান্তর’)
● ‘‘হিন্দু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলে পরিচয় দেয়, মুসলমানও তাই দেয়। অর্থাৎ ধর্মের বাহিরে উভয়ের জীবনের অতি অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকে। এই কারণে এরা নিজ নিজ ধর্ম দ্বারাই পরস্পরকে ও জগতের অন্য সকলকে যথাসম্ভব দূরে ঠেলিয়া রাখে। এই যে দূরত্বের ভেদ এরা নিজেদের চারিদিকে অত্যন্ত মজবুত করে গেঁথে রেখেছে, এতে করে সকল মানুষের সঙ্গে সত্যযোগে মনুষ্যত্বের যে প্রসার হয়, তা এদের মধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।’’ (‘সমস্যা’)
● ‘‘দেবতার নামে মনুষ্যত্ব হারায় মানুষ।’’ (‘বিসর্জন’/২য় অঙ্ক/৪র্থ দৃশ্য)