E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১২শ সংখ্যা / ৬ নভেম্বর ২০২০ / ২০ কার্ত্তিক ১৪২৭

সং‍‌বিধান, গণতন্ত্র ও জনজীবনের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে পার্টির প্রতিবাদ আন্দোলনের কর্মসূচি


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ গত ৩০-৩১ অক্টোবর সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনলাইনে অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে নভেম্বর, ডিসেম্বর এবং ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে বিভিন্ন প্রচার আন্দোলনের কর্মসূচির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বৈঠক শেষে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এই কর্মসূচিগুলি ঘোষণা করা হয়। কর্মসূচিগুলি হলোঃ
১। কৃষিআইন, শ্রমকোড, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বেসরকারিকরণ এবং জাতীয় সম্পদের লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে পার্টি স্বাধীনভাবে প্রচার এবং প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করবে। ক্রমবর্ধমান বেকারির বিরুদ্ধে, সর্বজনীন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দাবিতে ও লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধি যা মানুষের জীবনজীবিকাকে ধ্বংস করছে তার বিরুদ্ধে পার্টি প্রচার ও প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করবে।
২। আগামী ২৬ ও ২৭ নভেম্বর কৃষক সংগঠনগুলি যে প্রতিবাদ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে পার্টি তার প্রতি পূর্ণ সংহতি ও সমর্থন জানাচ্ছে।
৩। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির আহূত ২৬ নভেম্বরের দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের প্রতি পার্টি পূর্ণ সমর্থন ও সংহতি জানাচ্ছে।
৪। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের ২৬ জানুয়ারি - এই দু’মাসের মধ্যে মানবিক অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের সপক্ষে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দল, বিভিন্ন গণআন্দোলন, বুদ্ধিজীবী ও প্রখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে নিয়ে পার্টি বৃহত্তর মঞ্চ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাবে। এই প্রচেষ্টায় শ্রমিক ও কৃষক সংগঠনগুলিকেও যুক্ত করা হবে। ইউএপিএ, এনএসএ, রাষ্ট্রদ্রোহিতা ইত্যাদি দানবীয় আইনে আটক সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির দাবি পার্টি তুলে ধরবে। দলিত, আদিবাসী এবং মহিলাদের উপর ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাবে পার্টি। সংসদ, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি স্বাধীন সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষের অধিকারকে যেভাবে খর্ব করা হচ্ছে এবং জনগণের নির্বাচনী রায়কে বাতিল করতে বিজেপি যে প্রভূত পরিমাণ অর্থশক্তির ব্যবহার করছে তার বিরুদ্ধেও পার্টি আন্দোলন পরিচালনা করবে।

১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস এবং ১৮ ডিসেম্বর সংখ্যালঘু অধিকারের আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। ১০-১৮ ডিসেম্বর সপ্তাহটি অবশ্যই দেশব্যাপী মানবিক ও সংখ্যালঘু অধিকার সপ্তাহ হিসেবে পালন করার আহ্বান জানাচ্ছে পার্টি।

এই সমস্ত বিষয়কে নিয়ে বা কতগুলি বিষয়কে একসাথে নিয়ে রাজ্যস্তরে মোর্চা গড়ে তুলতে হবে; যতবেশি সম্ভব শক্তিসমূহকে সমবেত করতে হবে এবং আমাদের সংবিধানকে রক্ষা করার আহ্বান জানিয়ে ২০২১ সালের প্রজাতন্ত্র দিবসে এই দুই মাসব্যাপী কর্মসূচি সমাপ্ত হবে।


সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি

সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির ৩০ ও ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর প্রকাশিত এক বিবৃতিতে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়েছে -

কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি

কোভিড-১৯সংক্রমণ এবং মৃত্যুর সর্বোচ্চ ক্রমতালিকায় রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং ব্রাজিল। তবে ভারতে সংক্রমণ এবং মৃত্যু বৃদ্ধির হার খুবই উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে।

মহামারী নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কার্যত ছেড়েই দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সবচেয়ে খারাপ ঘটনা হলো, একদিকে মহামারী এবং অন্যদিকে গভীরতর অর্থনৈতিক মন্দা - একইসঙ্গে দ্বিমুখী আক্রমণের মুখে পড়েছেন এদেশের কোটি কোটি মানুষ। মানুষের এই চরম বিপর্যয়ের মধ্যেও নগদ হস্তান্তর এবং বিনামূল্যে খাদ্যশস্য বিতরণ করতে চাননি প্রধানমন্ত্রী মোদী। অথচ গত ২৫মার্চ দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণার সময় থেকেই এই দাবি জানিয়ে চলেছে সিপিআই(এম)। ক্রমবর্ধমান দুর্দশা, লাফিয়ে বেড়ে চলা বেকারত্ব ও অনাহার থেকে দেশবাসীকে রক্ষার জন্য বিন্দুমাত্র সুরাহার ব্যবস্থা নেই।

টিকাঃ দেশের সব মানুষের কাছে বিনামূল্যে প্রতিষেধক টিকা পৌঁছে দেওয়ার পক্ষেই সবসময় অবস্থান নেয় সিপিআই(এম)। গুটিবসন্ত মোকাবিলার প্রচার থেকে সাম্প্রতিক পোলিও নির্মূল অভিযান - স্বাধীন ভারতের শুরু থেকেই এমন ব্যবস্থাই চলছে। দেশবাসীর টিকাকরণ এবং প্রচার অভিযানে প্রাথমিক দায়িত্ব থাকে কেন্দ্রীয় সরকারেরই।

কোভিড-১৯’র টিকাকরণের ক্ষেত্রেও দেশে একই ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। করোনা ভাইরাসের টিকা শীঘ্রই আবিষ্কৃত হবে বলে আশা করা যায়। তবে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার দায় এড়ানোর লক্ষ্যে কোভিড টিকাকরণের দায়িত্ব রাজ্যগুলির ঘাড়ে ঠেলতে চাইছে। কেন্দ্র বলছে, টিকাকরণের ব্যাপারে রাজ্যগুলিই সিদ্ধান্ত নেবে। এটা আদৌ মেনে নেওয়া যায় না। সর্বভারতীয় স্তরে কোভিড টিকাকরণের প্রচার চালানো এবং দেশের সব মানুষকে বিনামূল্যে টিকাকরণের দায়িত্ব কেন্দ্রকেই নিতে হবে।

কোয়াড

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটকে শক্তিশালী করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ভারতের সময়-পরীক্ষিত বিদেশনীতিকে পুরোপুরি নস্যাৎ করে এই পদক্ষেপ নিয়েছে কেন্দ্র। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে কোনও সামরিক বা স্ট্রাটেজিক জোটে না গিয়ে আমাদের দেশের স্বার্থে স্বাধীনভাবে নীতি গ্রহণই ছিল ভারতের বিদেশনীতির মূল মর্মবস্তু। অথচ এই প্রথমবার, কোয়াডের সঙ্গে যৌথ নৌমহড়া হতে চলেছে মালাবারে।

অর্থনৈতিক মন্দা

২০২০-২১আর্থিক বছরে (-) ৯.৫শতাংশ সঙ্কোচনের পূর্বাভাস দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। আইএমএফ’র মতে, এই সঙ্কোচন দাঁড়াবে (-) ১০.৩শতাংশে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, জিডিপি’র ধারাবাহিক পতনের পথ বেয়েই এই সঙ্কোচন আসছে। ২০১৬-১৭সালে ভারতের জিডিপি ছিলো ৮.৩শতাংশ। সেখানে ২০১৭-১৮’তে জিডিপি নেমে হয়েছে ৭শতাংশ, ২০১৮-১৯’এ ৬.১শতাংশ, ২০১৯-২০’তে ৪.২শতাংশ। এবার ২০২০-২১’এ তা হবে (-) ৯.৫শতাংশ। গত পাঁচ বছরে অর্থনীতির ধারাবাহিক পতন এই তথ্যেই স্পষ্ট।

মানুষের আরও দুরবস্থাঃ অর্থনীতির এহেন অধোগতির জেরে দেশে কর্মহীনতা মারাত্মক বেড়ে গিয়েছে। শ্রমিকের অংশগ্রহণের হার নেমেছে ভয়াবহভাবে। পুরোপুরি জীবিকা হারিয়েছেন প্রায় ১৫ কোটি মানুষ।

ক্রমবর্ধমান অনাহারঃ বিশ্ব ক্ষুধা তালিকায় ১০৭টি দেশের মধ্যে ভারত এখন ৯৪তম স্থানটিতে নেমেছে। বিজেপি সরকারের নীতির করুণ পরিণতি এটি। শ্রীলঙ্কা, নেপাল, বাংলাদেশ, বার্মা, পাকিস্তানের মতো প্রতিবেশী দেশগুলির স্থানও এই তালিকায় ভারতের ওপরে রয়েছে।

খাদ্যের জন্য ভারতবাসীর এক বিশাল অংশের এই হাহাকার কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। অথচ কেন্দ্রের গোডাউনগুলিতে কোটি কোটি টন খাদ্যশস্য পচে নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হওয়ার আগে এই মজুতভাণ্ডার থেকে বিনামূল্যে মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দিতে হবে।

এহেন ক্রমবর্ধমান ক্ষুধার বিপরীতে দৃষ্টিকটুভাবে ভারতের ধনীতম ২০জন শিল্পপতি ২০২০সালে আরও ১৪শতাংশ বেশি সম্পদশালী হয়েছে।

শ্রমিকশ্রেণি এবং শ্রমজীবীর ওপর আক্রমণ

চলতি ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করা হয়েছে। এর বদলে ৪টি শ্রম কোড চালু করা হয়েছে। এর মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার ও সুরক্ষার ব্যাপারে এবং মালিকপক্ষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রায় সব সংস্থানই হয় উল্লেখযোগ্যভাবে লঘু করে দেওয়া হয়েছে, নতুবা একসঙ্গে তুলে দেওয়া হয়েছে। এদেশের শ্রমিকদের দাসে পরিণত করতে এসব কোড চালু করা হয়েছে।

বিপর্যয়কারী কৃষি বিল

আত্মনির্ভরতার নামে প্রধানমন্ত্রী মোদী অর্থনৈতিক সংস্কারের যে প্যাকেজ এনেছেন, তার পুরোটাই আসলে আমাদের দেশের অর্থনীতিকে বেসরকারি মুনাফার হাতে তুলে দেওয়ার পদক্ষেপ। ভারতীয় সংসদের অধিকার কেড়ে নিয়ে নির্লজ্জভাবে সর্বনাশা কৃষি বিল পাশ করিয়েছে কেন্দ্র। নতুন আইনের মাধ্যমে আমাদের কৃষিক্ষেত্র, আমাদের ফসল, আমাদের বাজার সবই দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চাওয়া হয়েছে। এর পরিণতিতে আমাদের কৃষক এবং দেশবাসী, উভয়েরই দুর্দশা আরও বাড়বে এবং ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে।

‘হিন্দুত্ব’ কর্মসূচির অবিরাম প্রয়োগ

ভারতকে দ্রুত একটি অসহিষ্ণু ফ্যাসিবাদী ‘হিন্দু রাষ্ট্র’-এ পরিণত করতে আরএসএসের মূল কর্মসূচি রূপায়ণে মহামারীর চলতি সময়কে কাজে লাগাচ্ছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। লকডাউনে সাধারণ জনজীবন বিঘ্নিত থাকার সুযোগেই নিজেদের লক্ষ্যপূরণে পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে তারা। একইসঙ্গে দলিত, মহিলা, মুসলিম সংখ্যালঘু, বুদ্ধিজীবী এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের ওপরেও আক্রমণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

জম্মু ও কাশ্মীর

জম্মু-কাশ্মীরের জমি ও সম্পত্তি কিনে নিতে বাইরের লোককে অনুমতি দিয়ে নতুন আইনের আসল লক্ষ্য হলো জম্মু-কাশ্মীরের জনবিন্যাসের চরিত্র বদলে দেওয়া এবং সেখানকার সম্পদ ও জনগণের ওপর লুট চালানো।

কেরালা

কেরালার এলডিএফ সরকারের ওপর আক্রমণ চালাতে যেভাবে সিবিআই’র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির অপব্যবহার হচ্ছে, তার তীব্র নিন্দা করেছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি। এই ষড়যন্ত্রের মুখের মতো জবাব দেবেন কেরালার জনগণই।



আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনগুলিতে পার্টির নির্বাচনী কৌশল

কেরালা, তামিলনাডু, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গ - এই চারটি রাজ্যের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের জন্য পার্টির সংশ্লিষ্ট রাজ্য কমিটিগুলির প্রস্তাব পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি অনুমোদন করেছে।

৩০-৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর প্রকাশিত এক বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় কমিটি জানিয়েছেঃ ‘‘কেরালায় বাম গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের অংশ হিসেবেই পার্টি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। তামিলনাডুতে সিপিআই(এম) ডিএমকে’র নেতৃত্বাধীন মোর্চার অংশ হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। আসামে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার - যারা সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীক্ষ্ণ করে চলেছে, সামাজিক সম্প্রীতিকে অস্থির করে চলেছে এবং জনগণের ওপর দুর্দশার বোঝা চাপাচ্ছে সেই বিজেপি সরকারকে পরাস্ত করার জন্য কংগ্রেস সহ সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির সাথে সহযোগিতা করে সিপিআই(এম) নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে।

পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস সহ সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ দল যারা বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস দলকে পরাস্ত করতে চায় সিপিআই(এম) এবং বামফ্রন্ট তাদের সাথে নির্বাচনী বোঝাপড়া করবে।’’