E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১২শ সংখ্যা / ৬ নভেম্বর ২০২০ / ২০ কার্ত্তিক ১৪২৭

২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি রাজ্যজুড়ে


২৬ নভেম্বরের ধর্মঘটের সমর্থনে কলকাতায় বামপন্থী ও সহযোগী দলগুলির মিছিল।

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ কেন্দ্রীয় সরকারের জনবিরোধী ও দেশবিরোধী নীতির প্রতিবাদে ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট সফল করতে প্রচার আন্দোলনে এখন উত্তাল সারা বাংলা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এখন কলকাতা সহ রাজ্যের প্রতিটি জেলায়, শহর-গ্রামাঞ্চল-শিল্পাঞ্চল জুড়ে চলছে মিছিল পথসভা গ্রামবৈঠক ইত্যাদি। এছাড়া রাজ্য, জেলা, মহকুমা ও ব্লকস্তরে কনভেনশন এবং বিক্ষোভ, ডেপুটেশন কর্মসূচি সংগঠিত হচ্ছে। এই কর্মসূচিগুলির মধ্য দিয়ে শ্রমিক-কৃষক সহ বিভিন্ন গণসংগঠন ধর্মঘটের দাবিগুলি পৌঁছে দিচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে।

বিভিন্ন কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠন ও শিল্পভিত্তিক ফেডারেশনের ডাকে যে ৭ দফা গুরুত্বপূর্ণ দাবির ভিত্তিতে ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়েছে, সেই ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছে বিভিন্ন কৃষক ও খেতমজুর সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গের সিপিআই(এম) সহ ১৬ টি বামপন্থী ও সহযোগী দল ইতিমধ্যেই এই ধর্মঘটকে সর্বতোভাবে সফল করতে আহ্বান জানিয়েছে। এই দলগুলির আহ্বানেই ৩ নভেম্বর কলকাতার পার্ক সার্কাসে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের সামনে থেকে একটি বিশাল মিছিল শুরু হয়ে ধর্মতলায় শেষ হয়। এই মিছিল শুরুর আগে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এক সংক্ষিপ্ত সভায় বলেন, শুধু কলকাতায় নয়, জেলায় জেলায় সর্বত্র ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত ধর্মঘটের দাবি ও স্থানীয় দাবিগুলি নিয়ে প্রচার চলবে। মাস্ক পরে শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনেই এই সব কর্মসূচি হবে। তিনি বলেছেন, মোদী সরকার আত্মনির্ভরতার নামে দেশকে সাম্রাজ্যবাদের কাছে নির্ভরশীল করে তুলছে। দেশবাসীর দুরবস্থা তৈরি করছে। তার প্রতিবাদে সারাদেশের সঙ্গে এরাজ্যেও ধর্মঘট সর্বাত্মক সফল করতে হবে।

সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেন, সাধারণ ধর্মঘটকে শুধু সমর্থন করাই নয়, আমরা এই ধর্মঘটে শামিল হব এবং ধর্মঘটকে সফল করার জন্য ময়দানে থাকব। কৃষিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া অথবা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে জলের দরে বিক্রি করার বিরুদ্ধে লড়াই হবে। কিন্তু শুধুমাত্র জনবিরোধী কাজ বা কালা-কানুন বাতিলের দাবিতে আমাদের লড়াই নয়, আমরা তার সঙ্গে বিকল্পের জন্যও লড়াই করছি। যে বিকল্প বর্তমান সংকট থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে পারে।

লাল পতাকা, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ডে সুসজ্জিত ও স্লোগানে মুখরিত এই সুবিশাল মিছিলে বিমান বসু, সূর্য মিশ্র ছাড়াও শামিল ছিলেন সিপিআই’র রাজ্য সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, ফরওয়ার্ড ব্লকের বাংলা কমিটির সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি সহ পার্থ ঘোষ ও কার্তিক পাল (সিপিআই-এমএল) লিবারেশন, সমীর পূততুণ্ড (পিডিএস), মিহির বাইন (আরসিপিআই), জয় হিন্দ সিং (এমএফবি), ইন্দ্র ঘোষ দস্তিদার (সিপিআইএমএল), নজরুল ইসলাম (এনসিপি), প্রবীর ঘোষ (বলশেভিক পার্টি), বর্ণালী মুখার্জি (সিপিবি), অভীক সাহা (স্বরাজ ইন্ডিয়া) প্রমুখ।

২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করতে সারা ভারত কিষান সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি (এআইকেএসসিসি)-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার আহ্বানে ৪ নভেম্বর কলকাতার মৌলালি সংলগ্ন রামলীলা ময়দানে কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কৃষক ও কৃষক বিরোধী কেন্দ্রীয় কৃষি আইন বাতিল করার দাবিতে এবং ২৬ নভেম্বর সারাবাংলা গ্রামীণ ধর্মঘট সফল করে তোলার আহ্বানে এদিনের গণ-কনভেনশনে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত হন।

এই গণকনভেনশন থেকে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে -
(১) কৃষি ও কৃষকবিরোধী তিনটি আইন অবিলম্বে কেন্দ্রীয় সরকারকে বাতিল করতে হবে;
(২) রাজ্য সরকারকেও বিশেষ অধিবেশন ডেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করতে হবে;
(৩) নতুন বিদ্যুৎ বিল দুই হাজার কুড়ি অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে;
(৪) গরিব মানুষের ২০০ দিনের কাজ ও ৬০০ টাকা মজুরি সুনিশ্চিত করতে হবে;
(৫) ৪৪ টি শ্রমআইন সংশোধন করে মাত্র চারটি শ্রমকোডের মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার খর্বকারী কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ২৬ নভেম্বর কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকা সাধারণ ধর্মঘটকে সক্রিয়ভাবে এই কনভেনশন সমর্থন জানাচ্ছে;
(৬) এআইকেএসসিসি-র কৃষি আইন বাতিল এবং কৃষক, কৃষিমজুর, খেতমজুর, গ্রামীণমজুর (মহিলাসহ) আদিবাসী জনগণের বিভিন্ন দাবিতে এই কনভেনশন ২৬ নভেম্বর সারা বাংলা গ্রামীণ ধর্মঘট আহ্বান করছে।

এদিনের গণকনভেনশনে মূল প্রস্তাব উত্থাপন করে সারা ভারত কৃষক সভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার বলেন, কেন্দ্রের তিনটি কৃষি আইন কৃষি ও কৃষকের যে ভয়ঙ্কর বিপদ তৈরি করেছে তা আমরা প্রতিটি কৃষকের চেতনার মধ্যে নিয়ে যেতে চাই। ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করতে গ্রাম বাংলার কৃষক-খেতমজুররা বড়ো ভূমিকা নেবে।

এআইকেএসসিসি’র জাতীয় কমিটির সদস্য অভীক সাহা বলেছেন, আমাদের এই সংগ্রাম মঞ্চে দেশের কৃষির সাথে জড়িত পাঁচশোর বেশি সংগঠন শামিল হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তিনটি কৃষি আইনের দ্বারা কৃষকের ভালো হবে বলে প্রচার করছেন। কিন্তু এই আইন করার আগে নিজের মন্ত্রীসভাকেও জানাননি। তাইতো মন্ত্রিসভার সদস্য পদত্যাগ করেছেন। আমরা এই আইন বাতিলের দাবিতে লড়াই করছি।

সংগঠনের রাজ্য শাখার সম্পাদক কার্তিক পাল বলেছেন, আজ দেশের সরকারের সামনাসামনি দেশের কৃষক ও শ্রমিকরা। পাঞ্জাব, হরিয়ানায় কেন্দ্রের কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করা হয়েছে। এরাজ্যে সরকারের লোকদেখানো বিরোধিতা ছেড়ে কেন্দ্রের নীতির বিরুদ্ধে পাল্টা আইন আনতে হবে।

সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের রাজ্য সম্পাদক তুষার ঘোষ বলেন, কেন্দ্রের কৃষি আইন গরিব মানুষের বিরুদ্ধে, দেশের কৃষক খেতমজুরদের বিরুদ্ধে। কেন্দ্রীয় সরকার পুঁজিপতি-কর্পোরেটদের স্বার্থে দেশের কৃষিক্ষেত্রকে তুলে দিচ্ছে। এই আইনের বিরুদ্ধে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান সর্বত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ছে। এই আইন রুখতে শক্তিশালী কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কৃষক খেতমজুর আন্দোলনকে শক্তিশালী করেই সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিহত করতে হবে। এই লক্ষ্যেই ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করতে সর্বশক্তি দিয়ে প্রচার আন্দোলন সংগঠিত করার আহ্বান জানান তিনি।

এছাড়াও এদিনের গনকনভেনশনে বক্তব্য রাখেন অগ্রগামী কিষান সভার নেতা হাফিজ আলম সইরানি, সংযুক্ত কিষান সভার নেতা মিহির পাল, পশ্চিমবঙ্গ কৃষক খেতমজুর সমিতির নেতা সমীর পূততুণ্ড, এআইকেএমএস নেতা সুশান্ত ঝা, এআইকেকেএমএস নেতা প্রভঞ্জন জানা প্রমুখ।

এদিনের গণকনভেনশনে বক্তারা কেন্দ্রের মোদী সরকারের পাশাপাশি এ রাজ্যের তৃণমূল সরকারও যেভাবে কৃষক স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনকে তীব্র করার আহ্বান জানান।

কেন্দ্রের মোদী সরকারের শ্রমিকবিরোধী, কৃষকবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশন সহ কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনগুলির আহ্বানে ২৬ নভেম্বর দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে রাজ্যজুড়ে এখন ব্যাপক প্রচার চলছে। সর্বভারতীয় স্তরে ৭ দফা দাবির সঙ্গে স্থানীয় দাবি যুক্ত করে রাজ্যের ষোলটি বামপন্থী ও সহযোগী দল ধর্মঘট সফল করার আহ্বান জানিয়েছে। ২৮ অক্টোবর ১৬ টি বামপন্থী ও সহযোগী দলের বৈঠকের পর এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, দশটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং ফেডারেশনের আহ্বানে ২৬ নভেম্বর সর্বভারতীয় ধর্মঘটের দিন কৃষক খেতমজুর সংগঠনগুলিও তাদের দাবি-দাওয়া সমেত এই ধর্মঘটে শামিল হবার কথা ঘোষণা করেছে। ১৬ টি বামপন্থী ও সহযোগী দল কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনগুলির দাবিকে সমর্থন করছে এবং সর্বভারতীয় দাবির সঙ্গে স্থানীয় দাবি যুক্ত করে গ্রাম বাংলা সহ পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র ধর্মঘটকে সর্বাত্মক সফল করার আহ্বান জানাচ্ছে।

ওই বিবৃতিতে ধর্মঘটের সমর্থনে বিভিন্ন কর্মসূচি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ১৮ নভেম্বর থেকে ২১ নভেম্বর রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে ব্লকে ব্লকে এবং পৌর এলাকায় ওয়ার্ড ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় দাবি ও স্থানীয় দাবি নিয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি হবে। ২৩ এবং ২৪ নভেম্বর সব জেলায় জেলাশাসকের দপ্তরের সামনে জমায়েত ও বিক্ষোভ এবং জেলাশাসকদের কাছে ধর্মঘটের সাতটি দাবি সহ জেলাগত দাবিগুলি নিয়ে স্মারকলিপি পেশ করা হবে। ধর্মঘটের সমর্থনে ২৫ নভেম্বর এলাকায় এলাকায় হবে স্কোয়াড মিছিল।

ওই বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, স্বৈরাচারী কেন্দ্রীয় সরকারের জনস্বার্থবিরোধী শ্রমিক স্বার্থবিরোধী জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতি এবং রাজ্য সরকারের জনবিরোধী কাজকর্মের বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেস সহ বিজেপিবিরোধী ও তৃণমূল কংগ্রেসবিরোধী সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম জনস্বার্থে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে।

সিআইটিইউ শিল্প-কারখানায়, চা বাগানে নিবিড় প্রচারের পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন প্রান্তে শিল্পাঞ্চলে মিছিল পথসভা সংগঠিত করছে। এ রাজ্যের সমস্ত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে নিয়ে ধর্মঘট পরিচালনায় অনাদি সাহুকে আহ্বায়ক করে রাজ্যস্তরে গঠিত হয়েছে স্টিয়ারিং কমিটি। এছাড়া জেলায় জেলায় গড়ে উঠেছে স্ট্রাইক কমিটি।

রাজ্যের সর্বত্র ধর্মঘটের ৭ দফা দাবি নিয়ে পৌঁছাচ্ছেন ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা। যারা কোনো অনুমোদিত ইউনিয়ন বা সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত নন তাঁদের সবাইকে সরকারের যাবতীয় জনবিরোধী, শ্রমিকবিরোধী, কৃষকবিরোধী এবং দেশবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে সাধারণ ধর্মঘটে শামিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা।

সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে ১২ নভেম্বর রাজ্যের সর্বত্র ব্লক ও মহকুমা স্তরে শ্রমিক-কৃষক সহ সবাইকে জমায়েত করে সাত দফা কেন্দ্রীয় দাবির সাথে স্থানীয় দাবি যুক্ত করে ডেপুটেশন কর্মসূচি সংগঠিত হবে। ২২ থেকে ২৫ নভেম্বর রাজ্যের সর্বত্র সাইকেল মিছিল, বাইক মিছিল, কুশপুত্তলিকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ সংঘটিত হবে। ২৩-২৪ নভেম্বর রাজ্যের সমস্ত কলকারখানার গেটে ৭ দফা দাবির সাথে নিজস্ব দাবিকে যুক্ত করে শ্রমিকদের অবস্থান-বিক্ষোভ সভা সংগঠিত হবে। ২৪ ও ২৫ নভেম্বর জেলায় জেলায় হবে মশাল মিছিল। ২৩ নভেম্বর কলকাতায় ধর্মঘটের সমর্থনে বিকেল পাঁচটায় ধর্মতলার লেনিন মূর্তির কাছে জমায়েত ও সেখান থেকে কেন্দ্রীয় মিছিল সংগঠিত হবে। এভাবেই ২৬ নভেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে বামপন্থী শ্রমিক ও কৃষক সংগঠন প্রভৃতির প্রচার আন্দোলন ক্রমশ জোরালো হয়ে উঠছে বাংলায়।