E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১২শ সংখ্যা / ৬ নভেম্বর ২০২০ / ২০ কার্ত্তিক ১৪২৭

বিজ্ঞানীদের লড়াইঃ রাষ্ট্র ক্ষমতায় যখন অ্যান্টি-সায়েন্স ব্রিগেড

মিহিরলাল রায়


আমেরিকার প্রখ্যাত বিজ্ঞান জার্নাল ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’ সে দেশের আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সরাসরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরোধিতায় নেমেছে। সে দেশের, বিশেষ করে ওই জার্নালটির পৌনে দু’শ বছরের ইতিহাসে এই ভূমিকা অভূতপূর্ব। জার্নালটিরই ভাষায় - ‘‘আমরা তা করতে বাধ্য হয়েছি। আমরা তা হাল্কাভাবে করছি না।’’ কেন তাদের এমন দৃঢ় বিরোধিতা? ২০২০-র অক্টোবর সংখ্যার সম্পাদকীয়তে ওরা লিখেছেঃ ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং তার জনগণের মারাত্মক ক্ষতি করেছেন। কারণ, তিনি প্রমাণ এবং বিজ্ঞানকে প্রত্যাখান করেছেন। সবচেয়ে সর্বনাশা উদাহরণ হচ্ছে, কোভিড-১৯ অতিমারী মোকাবিলা প্রশ্নে তাঁর অসাধু আচরণ এবং অযোগ্যতা। ফলশ্রুতিতে, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রায় এক লক্ষ নব্বই হাজার মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে। পরিবেশ সুরক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং গবেষকদের ও জনপোষিত সরকারি বৈজ্ঞানিক সংস্থার উপর তিনি প্রবল আক্রমণ হেনেছেন। অথচ, তা না হলে কোভিড-১৯ অতিমারীজনিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এসব সংস্থা ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারত।

এই বিজ্ঞান জার্নালটি যে কেবল ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরোধিতাই করেছে, তা নয়। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনকে সমর্থনও জানিয়েছে। কেন? বাইডেনের প্রস্তাবিত নীতির জন্য। আমাদের দেশেও যেমন আওয়াজ এখন - ‘নেতা নয়, নীতির বদল চাই’। সম্পাদকীয়টি লিখেছেঃ ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপরীতে জো বাইডেন কোভিড-১৯ মোকাবিলা, স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়ন, কার্বন নিঃসরণ কমানো - এ সবের নীতি প্রণয়নে বিজ্ঞান নির্ভরতার উপর সওয়াল করেছেন। তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞদের মতামতকে। অবশ্য সম্পাদকীয়টি এ কথাও লিখেছেঃ হয়তো এখনই নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না, বাইডেন তাঁর মতামত বাস্তবায়নে কতটা সফল হবেন। তবে এটা স্পষ্টভাবেই দেখা যাচ্ছে, তিনি যথেষ্টই ওয়াকিবহাল যে, বর্তমান সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে গেলে এবং আগামী চ্যালেঞ্জগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবিলা করার জন্য নির্ভর করতে হবে গবেষণালব্ধ জ্ঞানের উপরই।

এ সময়ে বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য এবং আমাদের দেশ ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায় যখন অতি দক্ষিণপন্থী বিজ্ঞান বিরোধী শক্তি, যখন ওরা মানবজাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি এমনকি বেঁচেবর্তে থাকাটাকেই বিপজ্জনক পরিস্থিতির দোরগোড়ায় এনে দাঁড় করিয়েছে, তখন বিজ্ঞানীরাও বাধ্য হচ্ছেন প্রতিবাদে সোচ্চার হতে, এমনকি পথে নামতেও। ইতিমধ্যেই এমনকি আমরা দেখেছি, তাদের ‘গ্লোবাল মার্চ ফর সায়েন্স’ও। এসব প্রতিক্রিয়া, আয়োজন এবং ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’-এর সাম্প্রতিক ভূমিকার প্রেক্ষিতে মনে পড়ছে পরাধীন ভারতে প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের নেওয়া এমনতর এক ভুমিকার কথাও।

আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় তাঁর আত্মচরিতে লিখেছেনঃ ‘‘ইউরোপীয় মহাযুদ্ধ শেষ হইবার পর ভারতবাসীরা আশা করিয়াছিল ব্রিটেন তাহাদিগকে কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ একটা বড়রকমের শাসনসংস্কার দিবে। কেননা ব্রিটেনের সংকট সময়ে ভারত অর্থ ও সৈন্য দিয়া বিশেষরূপে সাহায্য করিয়াছিল। কিন্তু ভারতবাসীরা সশঙ্ক চিত্তে দেখিল যে তাহাদের রাজভক্তির পুরস্কারস্বরূপ ‘রাউলাট আইন’ পাইয়াছে। স্বভাবতই দেশব্যাপী আন্দোলন আরম্ভ হইল। টাউনহলে একটি সভা হইল, তাহার বক্তা ছিলেন সি আর দাস... ঘটনাচক্রেই আমি সভায় উপস্থিত হইলাম। আমি জনতার পশ্চাতে ছিলাম। এই সময়ে কেহ কেহ আমাকে দেখিতে পাইয়া সম্মুখের দিকে ঠেলিয়া দিল।’’ তারপর কী হয়েছিল তা পরদিনের ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বর্ণিত হলো। পত্রিকার ভাষ্য অনুসারেঃ ‘‘মি. সি আর দাশ ডঃ স্যার পি সি রায়কে আলোচ্য প্রস্তাব সম্বন্ধে বক্তৃতা করিবার জন্য বলিলেন। সেই সময়ে একটি দৃশ্যের সৃষ্টি হইল, যাহা ভুলিতে পারা যায় না। কয়েক মিনিট পর্যন্ত ডঃ রায় কোনো কথা বলিতে পারিলেন না। কেন না তাঁহাকে অভিনন্দন করিয়া চারিদিকে ঘন ঘন আনন্দোচ্ছ্বাস ও ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি হইতে লাগিল। ডক্টর রায় আরম্ভে বলিলেন যে, তাঁহাকে যে সভায় বক্তৃতা করিতে হইবে, ইহা তিনি পূর্বে কল্পনা করিতে পারেন নাই। তিনি মাত্র দর্শক হিসেবে আসিয়াছিলেন। বৈজ্ঞানিক গবেষণাগারেই তাঁহার কাজ। কিন্তু এমন সময় আসে, যখন বৈজ্ঞানিককেও... তাঁহার অবশিষ্ট কথাগুলি শ্রোতৃবর্গের আনন্দধ্বনির মধ্যে বিলুপ্ত হইয়া গেল। ডঃ রায় পুনরায় বলিলেন. ‘‘এমন সময় আসে যখন বৈজ্ঞানিককেও গবেষণা ছাড়িয়া দেশের আহ্বানে সাড়া দিতে হয়।’’ আমাদের জাতীয় জীবনের উপর এমন বিপদ ঘনাইয়া আসিয়াছে যে ডঃ পি সি রায় তাঁহার গবেষণাগার ছাড়িয়া এই ঘোর অনিষ্টকর আইনের প্রতিবাদ করিবার জন্য সভায় যোগ দিয়েছিলেন।

ঠিক এরকমই আজকের সময়েও এদেশের বিজ্ঞানী এবং তাদের সংগঠনগুলোকে আমরা দেখছি পথে নামতে বিজ্ঞান-বিমুখ, বিজ্ঞান-বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে। যেমন ধরুন নতুন শিক্ষানীতিরই কথা। এই দেশের তিন তিনটি বিজ্ঞান সংগঠন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমি (নতুন দিল্লি), ইন্ডিয়ান একাডেমি অব সায়েন্স (বেঙ্গালুরু) এবং ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স (এলাহাবাদ) শিক্ষানীতির খসড়া অবস্থা থেকেই তাদের উদ্বেগ ব্যক্ত করেছে, প্রতিবাদ জানিয়েছে। পরিবেশ প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি আইনকে শিথিল করা এবং সর্বশেষ সংযোজন ‘দ্য এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট নোটিফিকেশন-২০২০’ নিয়ে বিজ্ঞানীদের, বিজ্ঞানকর্মীদের, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রতিবাদের কথা জানি আমরা। নতুন শিক্ষানীতিতে চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষার ক্ষেত্রে ‘অ্যালোপ্যাথি-হোমিওপ্যাথি-ইউনানি-সিদ্ধা-ন্যাচারোপ্যাথি’র জগাখিচুড়ি মিশেলে হবু ডাক্তার তৈরির ভয়ংকর প্রকল্পের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে এদেশের চিকিৎসকদের সর্বভারতীয় সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’ (আইএমএ)। ‘ন্যাশনাল বিল ২০১৯’ প্রশ্নেও তাদের বিরোধিতা, এমনকি প্রতিবাদও প্রত্যক্ষ করেছি আমরা। সবকটি ক্ষেত্রেই জনস্বার্থের প্রশ্নে, বিজ্ঞান বিমুখতা এবং কখনো কখনো বিজ্ঞান বিরোধিতা তাদেরকে বাধ্য করেছে প্রতিবাদের পথে হাঁটতে।

এটা দুঃখজনক, তা সত্ত্বেও আমরা দেখছি এ সময়ে এদেশের রাষ্ট্রক্ষমতাতে আসীন ব্যক্তিবর্গরা বিজ্ঞান বিমুখতার পথ, বিজ্ঞান বিরোধিতার পথ ছাড়ছেন না। বরং ভ্রান্তবিশ্বাস, কুসংস্কার, কু-আচার, অপবিজ্ঞান চর্চাকে উৎসাহিত করছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী করোনা মোকাবিলায় নিদান দিলেন থালা বাজানোর আর অকাল দীপাবলির। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী, যিনি একজন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসকও, সংসদে দাঁড়িয়েই সম্প্রতি বলে দিলেন - ‘গো মূত্রে নেই কোনো শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি!’ ‘পঞ্চগব্য’ প্রশ্নে এক সওয়াল জবাবে এমন ভাষ্য তাঁর। অথচ, বৈজ্ঞানিক সত্য এটাই - গো-মূত্র কিংবা গোবর মূলত বর্জ্য পদার্থই, গোরুর দেহাভ্যন্তরে পাচকতন্ত্রে থাকা বহু অণুজীবের বাহক। গোরু রোগগ্রস্ত থাকলে, গোবর সেই রোগবাহক অণুজীবে পূর্ণ থাকবে। অতএব ক্ষতিকারকই।

আরএসএস পরিচালনায় নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েই গো-বর্জ্য নিয়ে যে সব কাণ্ডকারখানা শুরু করেছে তার অন্যতম হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগ (আরকেএ)। এর চেয়ারম্যান বল্লভভাই কাঠোরিয়া এক সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে সগর্বেই ঘোষণা করলেন - গোবর আমাদের যেমন রোগব্যাধি থেকে নিরাপদ রাখবে, বিকিরণ প্রতিরোধকারী হিসেবেও তা কার্যকর। তাই মোবাইল ফোনের বিকিরণজনিত সমস্যা থেকেও রেহাই পাওয়া সম্ভব। কী বলবেন এমন স্টুপিডিটিকে? দেশব্যাপী ‘কামধেনু দীপাবলি অভিযান’-এর সূচনা করছিলেন তিনি। সে সময়েই ‘গৌস্বত্ব কবচ’ নামীয় একটি চিপ দেখিয়ে তার গোবরের এমন মাহাত্ম্য বর্ণন। ২০১৯ সালে রাজকোটে ওরা একটা গোশালা স্থাপন করেছে। নাম তার শ্রীজি গোশালা। সেখান থেকেই গোবরের তৈরি চিপ উৎপাদন হয়েছে। বলছেন তিনি - গোবরের তৈরি এই চিপটি নাকি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র ভাবনাকেই তুলে ধরেছে।

সম্প্রতি বৈশ্বিক ভারতীয় বৈজ্ঞানিক (বৈভব) সম্মেলনের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী। ভার্চুয়াল উদ্বোধন মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিনে। দেশ-বিদেশের ভারতীয় গবেষক ও শিক্ষাবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টার নেতৃত্বে ‍‌ওয়েবনারে ৮০টি বিষয়ের উপর ২১৩টি অধিবেশনের এই সম্মেলন চলে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের জন্মদিন ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত। কী বললেন তিনি ওই সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে? ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের আহ্বান জানালেন। তরুণদের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তোলার কথা বললেন। এও বললেনঃ ‘‘আমাদের ভারতীয় বিজ্ঞানের সমৃদ্ধ ইতিহাসকে আরও বিস্তারিত অধ্যয়ন করা দরকার।’’ তরুণদের ‘ইতিহাসের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ইতিহাস’-এ ভালো জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তাও ফুটে উঠল তাঁর বক্তব্যেঃ ‘‘নবীন প্রজন্মের মানুষকে এই ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের যুবকদের অবশ্যই বৌধায়ন, ভাস্কর, বরাহমিহির, নাগার্জুন, শুশ্রুত - এরকম অসংখ্য, প্রাচীন ভারতীয় বৈজ্ঞানিকের সম্পর্কে জানতে হবে। আর, আধুনিক যুগে ভারতে সত্যেন্দ্রনাথ বোস এবং স্যার সি ভি রামনকে দিয়ে শুরু করে বৈজ্ঞানিকদের দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। তাঁদেরকেও জানতে হবে।’’ তিনি মনে করেনঃ ‘‘আমাদের গৌরবময় অতীত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বর্তমানে আমাদের সাফল্য আমাদের মনে ভবিষ্যতের জন্য আশা তৈরি করেছে।’’ সে আশা থেকেই এখন তাঁরই ভাষায় ‘স্বনির্ভর ভারতের স্বপ্ন’, যাতে ‘বিশ্বকল্যাণের স্বপ্নও’ অন্তর্ভুক্ত। বিজ্ঞানীদের কাছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে তাঁর আহ্বান - এই স্বপ্নকে অনুভব করতে হবে, সমর্থন ও সহযোগিতা করতে হবে।

এটা দুঃখজনক, প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি অর্ধসত্য বললেন। সত্য কিছু তথ্য অনুক্ত রাখলেন। নিন্দুকেরা মনে করেন, এটা নির্দোষ নয়, ইচ্ছাকৃত। ইতিহাসের বিকৃতিকরণ - বিজ্ঞানের ইতিহাসও। এটা ঠিক, অতীতে এক সময়ে, সে সময় বিচারে আমাদের বেশ কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য ছিল। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানে পশ্চিমের তুলনায় আমরা পিছিয়ে গেলাম। কেন? পশ্চিমে ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীতে সেখানকার আলোর পথযাত্রীরা অকুতোভয়ে যেখানে চার্চের বাঁধা ডিঙোবার সাহস দেখালেন - আমাদের দেশের গুণীজনেরা এ দেশে এরকম বাঁধা ডিঙোবার সাহস দেখাতে পারলেন না। তাঁরা প্রতাপশালী কর্তৃত্বের কাছে জ্ঞানস্পৃহাকে, বস্তুবাদকে, যুক্তিবাদকে বিসর্জন দিলেন। মেরুদণ্ড ঋজু রাখতে পারলেন না। মাথা উঁচু রাখতে পারলেন না। ফলত, ওরা যেখানে আধুনিক বিজ্ঞানে পৌঁছাল, আমরা পৌঁছালাম ‘সিউডো-সায়েন্স’ বা ‘ছদ্ম বিজ্ঞান’-এর দোরগোড়ায়। জ্যোতির্বিজ্ঞানের বদলে পেলাম জ্যোতিষশাস্ত্র। ইতিহাস - বিজ্ঞান চেতনা নয়, মিথ মরীচিকার পশ্চাৎধাবন।

যাই হোক, এই পশ্চাৎধাবন এবং পরাধীনতার নাগপাশ অতিক্রম করে অনেক পথ আমাদের অতিক্রম করতে হয়েছে আধুনিক বিজ্ঞানচর্চাতে যুক্ত হতে। নবজাগরণের দিনগুলোতে আর স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে তার সলতে পাকানো।

এ পথ বেয়েই ঊনবিংশ শতকের প্রথম দশকে আমরা পেয়েছি আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সি ভি রামন, মেঘনাথ সাহা, গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস রামানুজমের মতো বিশ্বমানের বিজ্ঞানীদের। কী লক্ষ্য আর আদর্শকে সামনে রেখে তাদের পথচলা? বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথেরই ভাষায়ঃ ‘‘যখন আমরা ছাত্র ছিলাম তখন আমাদের মধ্যে একটা উন্মাদনা ছিল যে, বিজ্ঞানের চর্চা করে পশ্চিম এত উন্নতি করেছে, আমাদের দেশে তা শীঘ্র চালু হবে এবং আমরা জীবন উৎসর্গ করব সে সব জিনিস দেশের মধ্যে আনতে।’’ তারপর স্বাধীনোত্তরকালে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর প্রধানমন্ত্রিত্বে মেঘনাথ সাহা, হোমী জাহাঙ্গীর ভাবা, ভি এ সারাভাই, সাহিব সিং সোকে, সৈয়দ হুসেইন জাহির প্রমুখের অবদানে রাষ্ট্রীয় বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানিক আয়োজন। সেক্ষেত্রে নিশ্চিতই কার্যকরী ছিল নেহরু কথিত ‘সায়েন্টিফিক টেম্পার’ বা ‘বৈজ্ঞানিক মেজাজ’ আর পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এ পি জে আব্দুল কালাম তাঁর ‘অ্যান ভিশনিং অ্যান এমপাওয়ার্ড নেশন’-এ এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফলশ্রুতিতে দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিচর্চার বিপুল মানবসম্পদ তৈরি, বিজ্ঞানচর্চার অবকাঠামো নির্মাণ ও বিজ্ঞানচর্চার অগ্রগতির কথা উল্লেখ করেছেন। এটা কী করে অস্বীকার করা যাবে যে, অনেক দুর্বলতা থাকলেও, অনেক সম্ভাবনা অপূর্ণ থাকলেও, বিজ্ঞানের চর্চার ক্ষেত্রে অর্জিত যে বৈশ্বিক সমীহ এখনও রয়েছে তা এ সবেরই অবদান। কিন্তু এটাও অস্বীকার করা যাবে না, আজকের আবহ তাকে পিছনেই টানছে। চ্যালেঞ্জের সামনাসামনি দাঁড় করিয়েছে। কপালে তাই চিন্তার ভাঁজ অনেকেরই।

কীরকম সে আবহ? কেউ কেউ বলছেন, ‘অ্যাটমোস্ফিয়ার অব অ্যান্টি রিজনস’। এজন্য পরিকল্পিত এবং ‘উইলফুল ইগনোরেন্স’কে ‘ডেসপারেট প্রোপাগেশনস’। যে হিন্দুত্ববাদের স্বর্ণযুগ এ দেশের সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানচর্চাকে একদিন গলা টিপে হত্যা করেছিল, আজকের ভারতেও সে আবহ নির্মাণের প্রয়াস। বৈভব সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তরুণ প্রজন্মকে ‘ইতিহাসের বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের ইতিহাস’-এ ভা‍‌লো জ্ঞান অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন। তিনি কী সত্যি সত্যিই ইতিহাস থেকে মিথের অবৈজ্ঞানিক অংশকে মুক্তি দিতে রাজি হবেন? কাজকর্ম অন্তত তা বলছে না। ওদের কাছে এই মিথ, অর্থাৎ পুরাণ কথাই ইতিহাস। ঈশ্বর বিদ্যাই দর্শন। ব্রাহ্মণ্যবাদী, হিন্দুত্ব - ওদের কাম্য ‘মনুর ভারত’ নির্মাণে একমাত্র পথ। আর এজন্যই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসে দেশের জাতীয় গবেষণাগারগুলোতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণাগারগুলোতেও অবিজ্ঞান আর অপবিজ্ঞানের চাষ করতে মরিয়া। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী পুষ্প ভার্গবের ভাষায় ‘বিজ্ঞানমনস্কতা বর্জিত বিজ্ঞানী সমাজ নির্মাণ’- এর রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ।

স্বাভাবিকভাবেই এ দেশের বিজ্ঞানীরা তাদের সংগঠনগুলো এসব সর্বনাশা নীতির পরিবর্তন চাইছেন। প্রতিবাদে শামিল হচ্ছেন। কেউ কেউ মিথ্যা অতীত গরিমার প্রচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন না, তা নয়। এমনও আছেন - রাজ আনুকূল্যের আশায় যারা ‘রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’- এ আক্রান্ত। আবার ভয়েও ভীত কেউ কেউ। মেরুদণ্ড ঋজু রাখছেন না। আমরা আশাবাদী - এখনও এই প্রতিবাদ অপ্রতুল হলেও বিজ্ঞানের নিয়মেই আরও ব্যাপক হবে, শানিত হবে। তবে শুধু বৈজ্ঞানিক সমাজই নয়, বিজ্ঞানীদের বাইরে যে বৃহত্তর নাগরিক সমাজ তার দায়িত্ব বিরাট। এই সম্মিলিত শক্তিকেই দায়িত্ব নিতে হবে এই অপশক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে এবং সমাজ থেকেও বিতাড়নের। আজকের সময়ে দেশের বিজ্ঞানী সমাজসহ সকল অংশের মানুষের কাছে এটাই সবচেয়ে বড়ো এবং জরুরি কাজ।


(‘ডেইলি দেশের কথা’র সৌজন্যে)