E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১২শ সংখ্যা / ৬ নভেম্বর ২০২০ / ২০ কার্ত্তিক ১৪২৭

নভেম্বর বিপ্লব ও দেশে দেশে তার প্রভাব

প্রণব চট্টোপাধ্যায়


বর্তমান বছরটি মহান নভেম্বর বিপ্লবের ১০৩ তম বর্ষ। ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির পরিচালনায় জারশাসিত রাশিয়ায় মহান নভেম্বর বিপ্লব সংগঠিত হয়। এর পরের দিন অর্থাৎ ৮ নভেম্বর সোভিয়েত দ্বিতীয় কংগ্রেস শান্তি বিষয়ে আদেশনামা গ্রহণ করে। এই ঘোষণায় প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে তিনটি বৃহত্তম রাষ্ট্র - ব্রিটেন, জার্মানি এবং ফ্রান্সের - শ্রেণিসচেতন শ্রমিকদের কাছে আবেদন জানায়, তারা যেন ‘‘শান্তিকামীদের উদ্দেশ্য সাফল্যমণ্ডিত করতে এবং সর্বপ্রকার দাসত্ব ও শোষণ ব্যবস্থা থেকে শ্রমজীবী এবং বঞ্চিতদের মুক্তির প্রচেষ্টাতে’’ সাহায্য এবং সহযোগিতা করে।

এই কংগ্রেস একইসাথে ভূমি বিষয়ক আদেশনামা ঘোষণা করে। এই আদেশনামায় বলা হয়, এই মুহূর্ত থেকে জমির ওপর বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারদের অধিকার লোপ পেয়ে গেল। পরিবর্তে প্রতিষ্ঠিত হলো জমির ওপর সাধারণ বা রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানা।

সমগ্র রুশ বিপ্লবকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তরের সময়কাল হলো ১৯০৫ সাল থেকে ১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এই পর্বের মৌলিক স্লোগান ছিল জার এবং জমিদারদের বিরুদ্ধে বুর্জোয়াদের নিরপেক্ষ করে সমগ্র কৃষক সমাজকে সাথে নিয়ে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রসঙ্গত, এই মৌলিক স্লোগান সমকালীন রুশদেশের বাস্তব অবস্থায় এবং কৃষকদের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়েছিল। এই সময়ের বৈশিষ্ট্য হলো, কৃষকরা উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের প্রভাবমুক্ত হলো। একইসাথে শ্রমিকশ্রেণিও আকৃষ্ট হলো বলশেভিক পার্টির প্রতি । জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে জমি ও স্বাধীনতার দাবিতে ১৯০৫ সালে প্রথম বিপ্লব ঘোষিত হয়। এই বিপ্লবকে বলা হয় ‘রুশ বিপ্লবের প্রভাতী তারা’। ঐতিহাসিকদের মতে ১৯০৫-এর বিপ্লব ছিল ১৯১৭ সালের বিপ্লবের মহড়া। ১৯০৫ সালের বিপ্লবে জারতন্ত্রের ভিত্তি ধসে যায়। ১৯১৭ সালে তা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। এইদিক থেকে ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লবকে একটি হঠাৎ ঘটে যাওয়া বিপ্লব বলা চলে না।

রুশ বিপ্লবের দ্বিতীয় স্তর ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত। এই সময়ে বিপ্লবের মৌলিক স্লোগান ছিল, শহরে-গ্রামে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে মাঝারি কৃষকদের নিরপেক্ষ করে গরিব কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষমতা দখলের জন্য সর্বহারাদের অগ্রসর হওয়া। প্রথম পর্যায়ে বিপ্লবের সামনে প্রধান সমস্যা ছিল, জার ও জমিদারতন্ত্রের উচ্ছেদ। কিন্তু এই পর্যায়ের বিপ্লবের প্রধান সমস্যা ছিল যুদ্ধ বন্ধের সমস্যা। কারণ, অন্তহীন যুদ্ধের জন্য দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কৃষকরা হয়ে পড়ে সর্বস্বান্ত। এই যুদ্ধ থেকে সরে আসার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন ছিল অস্থায়ী সরকারের উচ্ছেদ। বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ করে সোশ্যাল রেভলিউশনারি আর মেনশেভিকদের উচ্ছেদ করা। কেরেনেস্কি সরকারের শাসনকালে শ্রমজীবীরা অভিজ্ঞতায় বুঝেছিল, সোশ্যাল রেভলিউশনারি আর মেনশেভিকরা ক্ষমতায় থাকলে যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। তারা উপলব্ধি করল একমাত্র সোভিয়েত শক্তি দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। কেরেনেস্কি সরকারের আমলের এই বাস্তব অভিজ্ঞতা শ্রমিকদের সংগঠিত হতে সাহায্য করে। রুশ বিপ্লবের তৃতীয় বা শেষ স্তর শুরু হয় ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাস থেকে। কমরেড লেনিনের সঠিক নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত করে এবং শ্রেণিসংগ্রামের মধ্য দিয়ে রুশ দেশে আসে সমাজতন্ত্র।

।।এক।।

রাশিয়ায় অপেক্ষাকৃত সহজে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পিছনে অনেকগুলি কারণ ছিল যা বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমত, জারশাসিত রাশিয়া ছিল আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের সবথেকে দুর্বলতম গ্রন্থি। এই কারণে রুশ দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সম্ভাবনাকে লক্ষ্য করে মার্কস-এঙ্গেলস ১৮৮২ সালে কমিউনিস্ট ইশ্‌তিহারের রুশ ভূমিকায় লিখেছিলেনঃ “কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর উদ্দেশ্য ছিল আধুনিক বুর্জোয়া সম্পত্তির আসন্ন ও অনিবার্য অবলুপ্তির কথা ঘোষণা করা। কিন্তু রাশিয়ায় আমরা দেখতে পাচ্ছি দ্রুত বিকাশশীল পুঁজিবাদী ধাপ্পাবাজি এবং সদ্য বিকাশমান বুর্জোয়া ভূসম্পত্তির পাশাপাশি অর্ধেকের বেশি জমির মালিকানা যৌথভাবে রয়েছে কৃষকদের। এখন প্রশ্ন হলো রুশ গ্রামীণ সমাজ অনেকটা ভেঙে পড়া সত্ত্বেও যা জমির আদিম মালিকানার আদিম যৌথ একটি রূপ বিশেষ, তা সরাসরি উচ্চতর কমিউনিস্ট মালিকানা পর্যায়ে উপনীত হতে পারবে কি? নাকি পক্ষান্তরে তাকে পশ্চিমী দুনিয়ার ধারার ন্যায় একই ধরনের পথ ধরে এগোতে হবে?

আজ এর একটি মাত্র উত্তরই সম্ভব, তা হলো যদি রুশ বিপ্লব পশ্চিম দুনিয়ার প্রলেতারিয় বিপ্লবের সংকেত হয় - ‘‘যাতে উভয় উভয়ের পরিপূরক হতে পারে, তবে রাশিয়ার জমিতে বর্তমান যৌথ মালিকানা কমিউনিস্ট বিকাশের পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে কাজ করতে পারে।’’

দ্বিতীয়ত, নভেম্বর বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিল রাশিয়ার সুসংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি। সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় এই শ্রেণি নিজেকে বিপ্লবী শ্রেণিতে পরিণত করেছিল। এর মধ্য দিয়ে তারা অর্জন করেছিল রুশ জনগণের বিপুল অংশের আস্থা।

তৃতীয়ত, এই সংগঠিত শ্রমিকশ্রেণি দৃঢ় মিত্র হিসাবে পেয়েছিল কৃষকসমাজকে। এই কৃষকসমাজ নিজস্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেছিল সোশ্যালিস্ট রেভলিউশনারি, মেনশেভিকদের দল বা ‘সংবিধান গণতন্ত্রী’রা কখনই জমিদারদের সঙ্গে সংঘর্ষ করবে না। কিন্তু ভিন্ন ধাতুতে গড়া বলশেভিকরা কৃষকসমাজের প্রকৃত মিত্র। এর মধ্য দিয়ে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী গড়ে উঠেছিল, যা বিপ্লবের সাফল্যের ক্ষেত্রে ছিল গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।

চতুর্থত, রাজনৈতিক সংগ্রামে বারেবারে পরীক্ষিত ও পরিশোধিত বলশেভিক পার্টির মতো পার্টি ছিল শ্রমিকশ্রেণির নেতা। চূড়ান্ত আক্রমণে শ্রমিকশ্রেণিকে নেতৃত্বপ্রদানের ক্ষমতা বলশেভিক পার্টির ছিল।

পঞ্চমত, প্রথম মহাযুদ্ধ চলাকালীনই রুশ বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিল। তখন বিশ্বের প্রধান প্রধান সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলি পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে রুশ বিপ্লবে তারা হস্তক্ষেপ করতে পারে নি। নভেম্বর বিপ্লবের বিজয়ের ক্ষেত্রে এটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল, যা অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে। প্রসঙ্গত, ১৯২২ সালে ডিসেম্বর মাসে ‘সোভিয়েত সমূহের প্রথম নিখিল রুশ কংগ্রেস’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই অধিবেশনে কমরেড লেনিন ও কমরেড স্তালিনের প্রস্তাবক্রমে সোভিয়েতগুলি স্বেচ্ছায় এক রাষ্ট্রসঙ্ঘে সম্মিলিত হয়। এর নামকরণ হয় ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক (ইউএসএসআর) বা সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রসমূহের যুক্তরাষ্ট্র। প্রাথমিক পর্বে এখানে রাশিয়া, ককেশাস, ইউক্রেন, বেলারুশ এবং পরবর্তীকালে উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজাকিস্তান যুক্ত হয়। এইসব প্রজাতন্ত্র স্বেচ্ছায় ইউএসএসআর’র অন্তর্ভুক্ত হয়। এদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার অধিকারও ছিল সংবিধান স্বীকৃত।

।। দুই ।।

মহান নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব জাতীয় ও আন্তর্জাতিকস্তরে ছিল ব্যাপক। একথা সর্বজনবিদিত, জারশাসিত রাশিয়া ছিল একটি পশ্চাৎপদ দেশ। যোগাযোগব্যবস্থা ছিল সপ্তদশ শতাব্দীর ব্রিটেনের মতো। সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। বেকারি, অনাহার, দারিদ্র্য ছিল রুশ জনগণের নিত্য সঙ্গী। এহেন পশ্চাৎপদ একটি দেশ সমাজতন্ত্রের জীয়নকাঠির স্পর্শে একটি আধুনিক শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে প্রধানত তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্রথমত, জারশাসিত রাশিয়ায় কলকারখানাগুলি ছিল অত্যন্ত পুরনো, যন্ত্রপাতিগুলি ছিল জরাজীর্ণ। ফলে আধুনিক যন্ত্র স্থাপন করে কলকারখানাগুলির আধুনিকীকরণ ছিল অত্যন্ত জরুরি। দ্বিতীয়ত, প্রাক্‌বিপ্লব রাশিয়ায় শিল্প ভিত্তি ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ, ভারি শিল্প ছিল না। ফলে সমাজতান্ত্রিক সরকারের কাছে যন্ত্র নির্মাণের কারখানা গড়ে তোলা ছিল বিশেষ অগ্রাধিকার। এছাড়া রাসায়নিক দ্রব্য, সিমেন্ট, লৌহ-ইস্পাত, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম, কৃষি উৎপাদনের যন্ত্রপাতির কারখানা নির্মাণেরও প্রয়োজন ছিল। দেশের শিল্পায়ন ও সামগ্রিক অগ্রগতির স্বার্থেই সমাজতান্ত্রিক সরকার পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়।

সমাজতান্ত্রিক সরকারের এইসব সিদ্ধান্ত কার্যকর করে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৯২৯-৩৩ সালে মহামন্দায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়। ১৯৩৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদন ১৯২৯ সালের উৎপাদনের শতকরা ৬৫ ভাগে নেমে আসে। ওই সময়ে ব্রিটেনে শতকরা ৮৬ ভাগে, জার্মানিতে শতকরা ৬৬ ভাগে এবং ফ্রান্সে শতকরা ৭৭ভাগে নেমে আসে শিল্পোৎপাদন। তখন কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন মন্দায় আক্রান্ত হয়ে পড়েনি। বরং দেশটির শিল্পোৎপাদন ১৯২৯ সালের তুলনায় ২০১ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মহান নভেম্বর বিপ্লবের ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল। এই কারণেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ে হিটলারের জার্মানির আক্রমণের সামনে বীরের মতো লড়াই করে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু নিজেকেই রক্ষা করেনি সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করেছিল।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির ওপর নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব ছিল ব্যাপক। নভেম্বর বিপ্লবের পরবর্তীকালে এর প্রভাবে একদিকে যেমন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি গড়ে ওঠে, তেমন ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে যে কমিউনিস্ট পার্টিগুলি গড়ে উঠেছিল সেগুলি নতুন দিশা অর্জন করে। বিশ্বের দুই জনবহুল দেশ ভারতে ১৯২০ সালে এবং চীনে ১৯২১ সালে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পূর্ব ইয়োরোপের একাধিক দেশে এবং চীনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এইভাবে গড়ে ওঠে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক শিবির।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদ দুর্বল হয়ে যায়। এশিয়া-আফ্রিকায় তাদের ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে শতাধিক দেশে ঔপনিবেশিকতা বিরোধী লড়াই গতিশীল হয় এবং এর পরিণতিতে ভারত সহ শতাধিক দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম জয়লাভ করে। দেশগুলি অর্জন করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা।

এইসব সদ্য স্বাধীন দেশগুলির অর্থনৈতিক পুনর্নির্মাণে প্রভূত সাহায্য করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। এছাড়া আন্তর্জাতিক মঞ্চে এইসব দেশে সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপের এবং নয়া-ঔপনিবেশিক শোষণের বিরুদ্ধে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন দৃঢ়ভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত গভীর। আমাদের দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে ইস্পাত উৎপাদন কেন্দ্র, তৈল শোধনাগার কেন্দ্র, বিদ্যুৎ উৎপাদন শিল্প প্রভৃতি গড়ে তোলার পিছনে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাশ্মীর প্রশ্নে বরাবরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে।

বর্তমানে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের অস্তিত্ব নেই। পূর্ব ইয়োরোপের দেশগুলি থেকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদায় নিয়েছে। ফলে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের অস্তিত্ব কার্যত নেই। কিন্তু কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের অর্থ এই নয় যে, সমাজতন্ত্র অলীক কল্পনা বা পুঁজিবাদই মানবসভ্যতার শেষস্তর। ওইসব দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয় সমাজতান্ত্রিক নীতির কারণে নয়। বরং সমাজতান্ত্রিক নীতি থেকে বিচ্যুতির কারণেই ঘটেছে। সমাজতন্ত্র গঠনে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতির প্রয়োগে বিপুল বিকৃতি, সংশোধনবাদী বিচ্যুতি এবং সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্রের বিকৃতি এক্ষেত্রে প্রধান। অতীতের নেতিবাচক অভিজ্ঞতাগুলির তাত্ত্বিক মূল্যায়নে ভুলত্রুটি এবং কিছু কিছু পার্টির ও দেশের ভ্রান্ত অবস্থানের জন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে দায়ী করা যায় না।

।। তিন ।।

সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ও পূর্ব ইয়োরোপের কয়েকটি দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপর্যয়কে সামনে রেখে পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরা নিদান হেঁকেছিল, পুঁজিবাদই মানবসভ্যতার শেষ স্তর, সমাজতন্ত্র নয়। ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ছিল ইতিহাসের ভ্রান্তি। ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ‘ইতিহাসের অবসান’ শীর্ষক একটি পুস্তক রচনা করেছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি পুঁজিবাদের বর্তমান চেহারা দেখে তিনি উদারনীতিবাদকে গণতন্ত্রের সামনে সবচেয়ে বিপদ বলে হাজির করছেন। সোভিয়েত পতনের পর বিগত তিন দশকের অভিজ্ঞতা কী? সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের পরিণতিতে সমাজে আয় ও সম্পদের বৈষম্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। অক্সফামের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় , আগামী বছরের মধ্যে বিশ্বের অর্ধেকের বেশি সম্পদের অধিকারী হবে বিশ্বের সবথেকে ধনী ১ শতাংশ মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১ শতাংশ ধনী মানুষের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে দেশের ৪০ শতাংশের বেশি সম্পদের ওপর। মার্কিন মুলুকে এই বৈষম্যর হার ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশের থেকেও বেশি।

ভারতেও গত দশ বছরে শতকোটি ডলারের অধিকারীর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এই সংখ্যা বর্তমানে ১০০ অতিক্রম করে গেছে। অপরদিকে ভারতে অধিকাংশ লোক পেটপুরে খেতে পায়না, ৮ ভাগের ১ ভাগ মানুষ চরম ক্ষুধার্ত, ৪৮ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার। ভারতে বিগত তিন দশক ধরে নব্য-উদারনীতির প্রয়োগের ফলে জনগণের দুঃখ-দুর্দশা বাড়ছে। বিগত সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী সরকারের জয়ের পর নব্য-উদারনীতির প্রয়োগ অর্জন করেছে এক নতুন মাত্রা। এর পাশাপাশি হিন্দুত্ববাদীদের সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে আক্রান্ত করে চলেছে। এরই সূত্র ধরে বাড়ছে গণতন্ত্রের বিপদও। এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনও গড়ে উঠেছে। ১৯৯১ সাল থেকে ১৯টি সাধারণ ধর্মঘটের পর ২০তম ধর্মঘটটি অনুষ্ঠিত হতে চলেছে আগামী ২৬ নভেম্বর।

বিগত প্রায় একদশক ধরে এই রাজ্যে চলতে থাকা তৃণমূল সরকারের শাসনে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার, জীবন ও জীবিকা ব্যাপকভাবে আক্রান্ত। শিক্ষাক্ষেত্রে চলছে ব্যাপক নৈরাজ্য। নারীদের নিরাপত্তা নজিরবিহীনভাবে বিপন্ন। রাজ্য সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, বোর্ড, কর্পোরেশন, ত্রিস্তর পঞ্চায়েতের কর্মচারীদের দাবিদাওয়া বিপন্ন। এর বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছে।

বর্তমানে সারা বিশ্ব কোভিড ১৯ অতিমারীতে আক্রান্ত। আমাদের দেশ বা রাজ্য এর বাইরে নয়। এর পাশাপাশি প্রাক্‌-অতিমারী পর্ব থেকে শুরু হওয়া ভয়ঙ্কর আর্থিক মন্দায় এই অতিমারী এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। দারিদ্র্য, বেকারি, মূল্যবৃদ্ধি, ছাঁটাই, কর্মসংকোচন প্রভৃতি পুঁজিবাদী ব্যাধিতে সমগ্র সমাজ আজ আক্রান্ত। আবার এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন কালাকানুন সংসদে অনুমোদন করিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে কৃষি সংক্রান্ত আইন। এছাড়া চারটি শ্রমকোডের প্রণয়ন। ভারতে কৃষিপণ্যের বাজারকে দেশি-বিদেশি কর্পোরেট হাউসের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে, তেমনই শ্রমকোডগুলির মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণির ধর্মঘটের অধিকার, ট্রেডইউনিয়ন অধিকার ও চাকরির নিরাপত্তা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে আগামীদিনে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে উঠবে। পূর্বোক্ত প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিকস্তরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াই, জাতীয়স্তরে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতন্ত্র ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি রক্ষার সংগ্রাম, এবং রাজ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইগুলিতে নভেম্বর বিপ্লবের মহান আদর্শ মূর্ত হয়ে উঠবে।

মহান নভেম্বর বিপ্লব জিন্দাবাদ।