৫৮ বর্ষ ১২শ সংখ্যা / ৬ নভেম্বর ২০২০ / ২০ কার্ত্তিক ১৪২৭
নভেম্বর বিপ্লব - একটি আলোকবর্তিকা
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
‘সোলজারস্ অব দ্য রেভোলিউশন’। শিল্পীঃ ভ্লাদিমির খোলুয়েভ
৭ নভেম্বর দিনটি ‘নভেম্বর বিপ্লব দিবস’ হিসাবে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত। মানবসভ্যতার ইতিহাসে দিকচিহ্নকারী ঘটনা হিসাবে নভেম্বর বিপ্লব পরিগণিত হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিপ্লব ইতিপর্বে বহুবার ঘটেছে। কোনো বিপ্লবের সাথেই নভেম্বর বিপ্লবের তুলনা হয় না। নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজব্যবস্থার যেমন পরিবর্তন ঘটল, সাথে সাথে শোষণব্যবস্থার পতন ঘটল। ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের মধ্য দিয়ে ফরাসি শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী প্রয়াস বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি। ১৯১৭ সালে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমগ্র রুশ দেশে পুঁজিবাদী সামন্ততান্ত্রিক শোষণের অবসান ঘটল। প্রতিষ্ঠিত হলো সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। প্রথম শোষণহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠল।
মার্কসীয় মতবাদের প্রয়োগ ঘটল
● ঊনবিংশ শতাব্দীতে মার্কসীয় মতবাদ অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদ প্রতিষ্ঠিত হলো। বিজ্ঞান, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব-এই ক্ষেত্রগুলিতে যে ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল তাকে অবলম্বন করেই মার্কসীয় মতবাদ গড়ে উঠেছিল। কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিক এঙ্গেলস এই বৈজ্ঞানিক ও বিপ্লবী মতবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন। মানবসমাজ নিরন্তর বিকাশের ধারার মধ্যে অবস্থান করছে। বিকাশের ধারাতেই মানবসমাজে শোষণব্যবস্থার আবির্ভাব ঘটেছে। বিকাশের ধারাতেই সমাজবিপ্লবের মধ্য দিয়ে শোষণহীন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই হলো শোষণহীন সমাজের প্রথম স্তর। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যে শ্রমিকশ্রেণির সৃষ্টি করল, যারা পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বাধিক শোষিত, বঞ্চিত - সেই শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়েই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে মানবসমাজ ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের কার্যধারা পরিচালনার মধ্য দিয়ে সাম্যবাদের স্তরে মানবসমাজের উত্তরণ ঘটবে। মার্কসবাদের এই মূল শিক্ষাকে অবলম্বন করেই কমরেড লেনিনের নেতৃত্বে রুশদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পরিচালনায় নভেম্বর বিপ্লব সফল হলো।
● নভেম্বর বিপ্লব সফল করার প্রক্রিয়ায় কমরেড লেনিন মার্কসবাদকে আরও সমৃদ্ধ করলেন। সাম্রাজ্যবাদের যুগে সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ক্রমান্বয়ে তীব্র হয়, যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। এই আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে বিপ্লবের সামনে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করে। এমনকি সেই বিপ্লবী সম্ভাবনা কোনো পশ্চাৎপদ পুঁজিবাদী দেশেও দেখা দিতে পারে। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের পরিস্থিতিতে সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খলের দুর্বলতম গ্রন্থি হিসাবে বিপ্লবের প্রাক্কালে রুশ দেশ চিহ্নিত হলো। সেই পরিস্থিতিকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার অসামান্য দক্ষতা কমরেড লেনিন প্রদর্শন করলেন। মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধে জারশাসিত রুশ দেশ একটা পক্ষ ছিল। পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করেই বলশেভিক পার্টির (রুশ দেশের কমিউনিস্ট পার্টি) নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণি রুশ দেশে গড়ে তুলল বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র - সোভিয়েত ইউনিয়ন। জাতির কারাগারের পরিবর্তে জাতিগুলির স্বেচ্ছা প্রণোদিত ইউনিয়ন।
● শিশু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির প্রত্যক্ষ মদতে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির আক্রমণ সংঘটিত হলো। একদিকে লাল ফৌজ ও অপরদিকে রুশ শ্রমিক-কৃষক সহ জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধ সমস্ত ষড়যন্ত্রকে পরাস্ত করল। ‘শান্তি, রুটি ও জমি’র দাবিকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে ‘ব্রেস্ট-লিটভস্ক’ চুক্তির মাধ্যমে বিপ্লবী সরকার শুধুমাত্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে সরেই এল না, বিশ্বশান্তির সপক্ষে বলিষ্ঠ প্রবক্তা হয়ে উঠল সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন।
কঠিন সংগ্রামের মধ্যেই সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ
● এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রুশ কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পশ্চাৎপদ দেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়েছে। অর্থনীতির বিজ্ঞানকে অনুসরণ করেই ‘নয়া অর্থনৈতিক নীতি’ অবলম্বন করেই সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের ভিত্তি গড়ে তোলা হয়েছে। বিপ্লব সফল করা ও সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ প্রক্রিয়ার শুরুতে কমরেড লেনিন নেতৃত্ব দিয়েছেন। জনগণের জন্য খাদ্য, কাজ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের ব্যবস্থা করে সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন এক নজিরবিহীন উদাহরণ স্থাপন করল। কৃষি, শিল্প, সামরিক শক্তি সহ সর্বক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতি ঘটল। বিপ্লব-পূর্ব পশ্চাৎপদ দেশটি বিপ্লবের কয়েক বছরের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ হিসাবে গড়ে উঠল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা
● বিশ্ব পুঁজিবাদী সঙ্কটের এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। হিটলার-মুসোলিনির নেতৃত্বে ফ্যাসিস্তরা সমগ্র মানবসভ্যতাকে গ্রাস করতে উদ্যত হলো। ফ্যাসিবিরোধী সংগ্রামে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েতের জনগণ ও লাল ফৌজের বীরত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সংগ্রাম ফ্যাসিস্ত বাহিনীর পরাজয় ঘটাল। চরম আগ্রাসী হিটলার বাহিনী পরাজয় বরণ করেছিল রুশ রণাঙ্গনে। স্তালিনগ্রাড থেকেই জার্মান বাহিনী পরাজয়ের স্বাদ পেল। বার্লিনের পতন ঘটল লালফৌজের শৌর্যে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিবাদ পরাস্ত হলো, সাম্রাজ্যবাদও কোণঠাসা হলো। বিশ্বের দেশে দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামগুলি জয়লাভ করতে শুরু করে। ভারতও এই সময়েই স্বাধীনতা অর্জন করে ১৯৪৭ সালে।
● শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লড়াইতেই নয়, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা চীন বিপ্লব, ভিয়েতনাম বিপ্লব, কিউবা বিপ্লব সহ বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ-বিরোধী লড়াইগুলিতে প্রত্যক্ষ করা যায়। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে ভারতে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার প্রয়াসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সহায়।
● শুধুমাত্র সামরিক ক্ষেত্রেই নয়, শিল্প-কৃষি-বিজ্ঞান প্রযুক্তি-শিক্ষা-কর্মসংস্থান সহ সমস্তক্ষেত্রেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ সাম্রাজ্যবাদী দুনিয়াকে টেক্কা দিতে সমর্থ হয়। জনগণের জীবনমানের উন্নতিতে চমকপ্রদ সাফল্য অর্জিত হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় নভেম্বর বিপ্লবের প্রাসঙ্গিকতাকে হ্রাস করতে পারেনি
● প্রায় ৩০ বছর পূর্বে নভেম্বর বিপ্লবের প্রায় ৭৪ বছর পর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয় ঘটে। এই বিপর্যয়ে বিশ্ব পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী শিবির প্রবল উল্লাস ব্যক্ত করে। বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবিরে প্রাথমিক বিহ্বলতা লক্ষিত হয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র চতুর্দশ কংগ্রেসে এই বিপর্যয়ের কারণগুলি মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হয়। ওই বিপর্যয় প্রকৃতপক্ষে মার্কসীয় মতবাদ থেকে বিচ্যুতির পরিণামে বিপর্যয়। ১৯৫৬ সালে বিংশতিতম পার্টি কংগ্রেস থেকে যে সংশোধনবাদী বিচ্যুতি সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিকে গ্রাস করে তারই পরিণতিতে একদিকে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টি মতাদর্শগতভাবে দুর্বল হয়, অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ প্রক্রিয়া গুরুতরভাবে ব্যাহত হয়। প্রতিবিপ্লব সফল হয়। এই বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে দেশে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে সংগ্রাম জোরদার করার শপথ কমিউনিস্ট আন্দোলন গ্রহণ করে।
নভেম্বর বিপ্লবের অমলিন প্রভাব ও শিক্ষা
● মহান নভেম্বর বিপ্লব মার্কসীয় মতবাদের বার্তাকে সমগ্র বিশ্বের সমস্ত অংশে পৌঁছে দিল। কমরেড মাও জে দঙ বলেছেন যে, অরোরা যুদ্ধজাহাজের কামান গর্জনের মধ্য দিয়ে সমগ্র প্রাচ্যের জনগণ মার্কসীয় মতবাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন। এই বিপ্লবের ফলে বিশ্বের দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টি গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া জোরদার হলো। শোষণবিরোধী সংগ্রাম, মুক্তিঅর্জনের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, গণতন্ত্রের সপক্ষে, নারী অধিকার, পশ্চাৎপদ ও সংখ্যালঘু মানুষদের অধিকারের সপক্ষে সংগ্রামগুলি জোরদার হলো।
● এই সময়ে বিশ্বজুড়ে মার্কিন নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সমাজতান্ত্রিক চীনকে ঘিরে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র চলছে। অতিমারীর সঙ্কটে জর্জরিত সমগ্র পুঁজিবাদী দুনিয়া। আক্রান্ত ও মৃত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শীতকালে পরিস্থিতি আরও সঙ্কটজনক হবে - এই শঙ্কাও প্রকাশিত হয়েছে। অথচ এই সময়কালে চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, উত্তর কোরিয়া - এই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে অতিমারীর মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য লক্ষিত হয়েছে। সমাজতন্ত্রে স্বাস্থ্য-শিক্ষার মতো ক্ষেত্রগুলি সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকার ফলে এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় (ভারত সহ) স্বাস্থ্যক্ষেত্র পুঁজিপতিদের মুনাফা অর্জনের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। যার ভয়ঙ্কর পরিণতি আমরা প্রত্যক্ষ করছি।
● সমগ্র বিশ্ব পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গুরুতর সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। বিগত প্রায় ৩২ বছর ধরে এই সঙ্কটের আবর্তে রয়েছে গোটা বিশ্ব। বহু প্রয়াস নিয়েও কিছুতেই এই সঙ্কট থেকে তারা বেরিয়ে আসতে সমর্থ হচ্ছে না। সমকালীন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি সমগ্র উৎপাদনব্যবস্থার সামাজিক চরিত্রকে শক্তিশালী করছে। অপরদিকে পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত মালিকানার সাথে দ্বন্দ্ব সমগ্র পুঁজিবাদীব্যবস্থাকে ক্রমাগত অস্থায়ী করে তুলছে। সামাজিক মালিকানার লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ব্যতিরেকে, এই গুরুতর সঙ্কট থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। নভেম্বর বিপ্লবের আলোকবর্তিকাকে সামনে রেখে শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের পৃথিবীটাকে এক উন্নত, সমৃদ্ধ, শোষণ বঞ্চনাহীন বিশ্বে রূপান্তরিত করার সংগ্রামে আমাদের আরও বেশি করে শামিল হতে হবে। এর আর কোনো বিকল্প নেই।