৫৮ বর্ষ ১২শ সংখ্যা / ৬ নভেম্বর ২০২০ / ২০ কার্ত্তিক ১৪২৭
নভেম্বর বিপ্লব এবং কমরেড লেনিন
শংকর মুখার্জি
২০১৭ সালে সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষ নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষ উদ্যাপন করেছে। এ বছরের ৭ নভেম্বর বিপ্লবের ১০৩তম বার্ষিকী। ভ্লাদিমির লেনিন ছিলেন এই বিপ্লবের পথিকৃৎ এবং রূপকার। নভেম্বর বিপ্লব এবং লেনিন অনেকটাই যেন সমার্থক। ২০২০ সাল এই মহান বিপ্লবীর জন্মের সার্ধশতবর্ষ। বিশ্বজুড়ে শ্রমিক-মেহনতি মানুষ বিভিন্নভাবে স্মরণ করছে লেনিনের সার্ধশতজন্মবর্ষকে। নতুনভাবে চর্চা ও অধ্যয়ন চলছে তাঁর বৈপ্লবিক জীবন ও আদর্শের নানা দিকের প্রতি। নভেম্বর বিপ্লবের রূপকার লেনিন কিন্তু বিপ্লবের আগে প্রায় দু’দশক রুশ দেশের মাটিতে থেকে রাজনীতি করতে পারেননি। এর মধ্যে তিন বছর সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত থেকেছেন, বাকি সতেরো বছর দেশান্তরী। কখনও থেকেছেন জার্মানিতে, কখনও ইতালি, বেলজিয়াম; লন্ডন, প্যারিস, জেনেভা কিংবা জুরিখে।
১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর (নতুন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী) রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হলো। রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির প্রথম কংগ্রেস নভেম্বর বিপ্লবের ইতিহাসে একটা মাইলফলক। ১৮৯৮-র মার্চে মিনস্কে এই কংগ্রেস হয়েছিল। লেনিন এই কংগ্রেসে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কারণ, কংগ্রেসের এক বছর আগে ১৮৯৭-র ফেব্রুয়ারি থেকেই তিনি সাইবেরিয়ার এক গণ্ডগ্রাম শুশেনস্কয়ে নির্বাসিত। বিপ্লবী কাজের জন্যই জার লেনিনকে এই শাস্তি দিয়েছিল। তিন বছর ছিল এই নির্বাসন। ১৯০০ সালের ২৯ জানুয়ারি লেনিনের নির্বাসনের মেয়াদ শেষ হয়। নির্বাসন থেকে মুক্তি পাবার পর মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস লেনিন রুশ দেশে ছিলেন। ১৬ জুলাই রুশ দেশের সীমানা পেরিয়ে জার্মানিতে আসেন। সেই থেকেই শুরু লেনিনের দেশান্তরী জীবন। এর পরের সতেরো বছর আর রুশ দেশে ফেরেননি লেনিন। মানে ফিরতে পারেননি। ফিরলে হয় গ্রেপ্তার হতেন; সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনা ছিল তিনি গুম খুন হয়ে যেতে পারতেন জারের পুলিশের হাতে।
যে মাত্র সাড়ে পাঁচ মাস লেনিন রুশ দেশে ছিলেন, সে সময়েও পুলিশ লেনিনকে একবার গ্রেপ্তার করে। গোপনে পিটার্সবুর্গে আসার সময়ে গ্রেপ্তার হন। সেটা ছিল ১৯০০ সালের মে মাস। যদিও সে যাত্রায় তিনি কয়েকদিনের মধ্যেই ছাড়া পেয়েছিলেন। গোপনে লেনিনকে পিটার্সবুর্গে যেতে হয়েছিল এই কারণেই যে, তাঁর মুক্তির শর্তই ছিল তিনি রাজধানী কিংবা শিল্পশহরগুলিতে থাকতে পারবেন না। এই নিষেধ সত্ত্বেও তিনি পিটার্সবুর্গ, রিগা, সামারা, সিজরান, নিজনি-নভগরোদ, উফা, স্মলেনস্ক সফর করেন। লেনিন হয়তো বুঝতে পেরেছিলেনঃ জারের প্রবলতম শত্রু হলেন তিনি, তাঁকে রুশ দেশে জার থাকতে দেবে না। তাই লেনিনের একটু তাড়াই ছিল। এমনকি শুশেনস্কয়ে গ্রাম থেকে তিনি যখন মুক্তি পেলেন, তখন সাইবেরিয়ায় প্রচণ্ড ঠান্ডা। পার্টির কাজে যোগ দিতে তিনি আর সময় নষ্ট করেননি। ওই শীতে প্রায় ৩২০ কিলোমিটার পথ ঘোড়ায় চেপে ফিরেছিলেন।
দীর্ঘ দেশান্তরী জীবন শেষে লেনিন রুশ দেশে ফিরেছিলেন বিপ্লবের সাত মাস আগে, ১৯১৭ সালের ১৬ এপ্রিল। সেও এক ঐতিহাসিক যাত্রা। লেনিন তখন থাকতেন সুইৎজারল্যান্ডের জুরিখে। টানা আট দিন ট্রেন-ফেরি-ট্রেন যাত্রা শেষে তিনি পেত্রোগ্রাদের ফিনল্যান্ড স্টেশনে নামলেন। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স তাদের দেশের মধ্য দিয়ে লেনিনকে ফিরতে অনুমতি দেয়নি। তাই জার্মানি, বাল্টিক সাগর, সুইডেন, ফিনল্যান্ড হয়ে ১,৯৮১ কিমি পথ অতিক্রম করে তাঁকে রাশিয়ায় প্রবেশ করতে হয়।
●●●
বিপ্লবের আগের এই সাত মাস খুবই ঘটনাবহুল। ফেব্রুয়ারি মাসে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব জয়যুক্ত হয়। এরপরই শুরু হলো বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে উন্নীত করার সংগ্রাম। লেনিন দেশে ফিরেই এই বিপ্লবের কাজে সম্পূর্ণ নিমগ্ন হলেন। তৈরি করলেন ‘এপ্রিল সিদ্ধান্তসমূহ’। বলশেভিক পার্টির প্রথম প্রকাশ্য সম্মেলন হলো ওই এপ্রিলে। লেনিন প্রস্তাব দিলেন পার্টির নাম পরিবর্তন করে কমিউনিস্ট পার্টি হোক। এপ্রিল সিদ্ধান্তসমূহে লেনিন বললেনঃ ‘‘বিপ্লবের প্রথম স্তরে বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে ক্ষমতা আসে, সেখান থেকে দ্বিতীয় স্তরে নিশ্চিতভাবেই সর্বহারাশ্রেণি ও দরিদ্রতম কৃষকদের হাতে ক্ষমতা আসবে।’’ এই পরিস্থিতিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি চালানোই পার্টির কর্মনীতি। এপ্রিল সম্মেলন সেই কাজ করল। আর পার্টির সশস্ত্র অভিযানে নেতৃত্ব দিল রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস। লন্ডনে অনুষ্ঠিত পার্টির পঞ্চম কংগ্রেসের দশ বছর পর, আর বলশেভিকদের প্রাগ সম্মেলনের পাঁচ বছর পর এই কংগ্রেস। কংগ্রেস চলল ২৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত।
এই ট্রেনটি করেই লেনিন জুরিখ থেকে এসেছিলেন।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জারতন্ত্রের উচ্ছেদ ঘটেছিল, তবুও ষষ্ঠ কংগ্রেস করতে হলো গোপনে। সতেরো বছর পর দেশে ফিরেও লেনিন থাকতে পারলেন না এই কংগ্রেসে। তিনি তখন আত্মগোপনে। কেননা কংগ্রেসের কয়েকদিন আগেই ৭ জুলাই লেনিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। জারতন্ত্রের অবসান ঘটলেও বুর্জোয়া সরকারও তাদের মূল শত্রুকে চিনতে ভুল করেনি। পেট্রোগ্রাদ দায়রা আদালতে লেনিন ও অন্যান্য অনেক বলশেভিকের বিরুদ্ধে চরম দেশদ্রোহ ও সশস্ত্র অভ্যুত্থান সংগঠিত করার অভিযোগ আনা হলো। বলশেভিক পার্টির বহু নেতা গ্রেপ্তার হলেন। তবুও কংগ্রেস হলো। গোপন অধিবেশন চলল প্রথমে ভাইবর্গ জেলায়; পরে নার্ভাগেটের নিকট একটা স্কুল বাড়িতে। সাময়িক সরকারের গোয়েন্দারা নাগালই পেল না। আর লেনিন আত্মগোপন করে রইলেন নার্ভাগেটের কাছে একটি স্কুল বাড়িতে।
এই ষষ্ঠ কংগ্রেসের আগে নিখিল-রুশ সোভিয়েত কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন বসে। এখানে বলশেভিকরা খুবই সংখ্যালঘু ছিলেন। কিন্তু কারখানা কমিটিগুলিতে বলশেভিকরাই সংখ্যায় বেশি। সোভিয়েত কংগ্রেসে লেনিনের ঘোষণা ছিলঃ একমাত্র সোভিয়েত সরকারই শ্রমজীবী জনসাধারণকে খাদ্য দিতে পারে, কৃষকদের জমি দিতে পারে, শান্তিস্থাপন করতে পারে এবং বিশৃঙ্খলার কবল থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারে। রাজধানী সহ সর্বত্র সোভিয়েতগুলিতে বলশেভিকদের সমর্থন বাড়তে থাকে।
কিন্তু মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট-রেভলিউশনারিরা বলশেভিকদের প্রতি এই সমর্থনকে অনুধাবন করতে পারেনি। তাই তারা ১ জুলাই শ্রমিকদের একটা মিছিল ডেকে দিল। বলশেভিকরা এই মিছিলের বিরোধী না হলেও, চেয়েছিল আর একটু পরে হোক মিছিল। বলশেভিকরা এই মিছিলের বিরোধিতা তো করলই না, মিছিলকে সফল করতে পূর্ণোদ্যমে কাজ করল। মিছিল যেন বলশেভিক পার্টির শক্তি সমাবেশের ক্ষেত্র হয়ে উঠল। স্তালিন প্রাভদায় লিখলেনঃ ১৮ জুন (পুরনো ক্যালেন্ডার) পেত্রোগ্রাদের মিছিল বিপ্লবী আওয়াজের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহা নিশ্চিত করাই আমাদের কর্তব্য।’’
মিছিলে ঘটলও তাই। বলশেভিকদের বিপ্লবী স্লোগানে মিছিল মুখরিত হলোঃ ‘‘যুদ্ধ নিপাত যাক’’, ‘‘সোভিয়েতের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা চাই’’। বিপর্যস্ত হলো মেনশেভিক, সোশ্যাল রেভলিউশনারিরা। প্রায় বিপর্যয়ের দোরগোড়ায় রাজধানীর সাময়িক সরকার। সাময়িক সরকারের পুলিশ পাগলা কুকুরের মতো আচরণ করতে লাগল। তারা শুধু বলশেভিকদের গ্রেপ্তার করেই ক্ষান্ত হলো না, বলশেভিক পুস্তক - প্রাভদা যেখান থেকে ছাপা হতো সেই ‘ক্রুদ’ ছাপাখানা ধ্বংস করে দিল।
লেনিনের অনুপস্থিতিতে ষষ্ঠ কংগ্রেসে রাজনৈতিক রিপোর্ট ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিবরণ পেশ করলেন স্তালিন। বললেনঃ ‘‘বিপ্লবের শান্তিপূর্ণ পর্যায় শেষ হয়েছে, শান্তিহীন পর্যায় আরম্ভ হয়েছে। আরম্ভ হয়েছে সংঘাত ও বিস্ফোরণের পর্যায়।’’
সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথ থেকে পার্টিকে সরিয়ে আনতে তীব্র বিরোধিতার পথে গেল জিনোভিয়েভ, কামেনভ, রাইকভ, বুখারিন, ট্রটস্কি ও পিয়াটাকভের মতো নেতারা। এমনকি কংগ্রেসে এরা বলল লেনিন বিচারের জন্য আদালতে হাজির হোক। এই হাজির হওয়ার অর্থ লেনিনের খুন হয়ে যাওয়া। যাক কংগ্রেস এই মতকে খারিজ করেছিল।
বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী শক্তিশালী হলো; সৈনিক ও নাবিকদের সমর্থন লাভ করল পার্টি। এইসব কাজে নেতৃত্ব দিয়ে চলেছেন সেই লেনিনই, কিন্তু আত্মগোপনে থেকে।
২০ অক্টোবর লেনিন গোপনে ফিনল্যান্ড থেকে পেত্রোগ্রাদে এলেন। ২৩ তারিখে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ঐতিহাসিক অধিবেশন। লেনিন বললেনঃ ‘‘সশস্ত্র অভ্যুত্থান অনিবার্য এবং তাহার সময়ও সমুপস্থিত বুঝিয়া কেন্দ্রীয় কমিটি সমস্ত পার্টি সংগঠনকে তদনুযায়ী প্রস্তুত হবার নির্দেশ দিচ্ছে।’’ কেন্দ্রীয় কমিটির নির্দেশে পেত্রোগ্রাদে বিপ্লবী সামরিক কমিটি গঠন হলো। বিপ্লবের আগে আরেকবার কেন্দ্রীয় কমিটি বসেছিল ২৯ অক্টোবর। সশস্ত্র অভ্যুত্থান পরিচালনার জন্য স্তালিনের নেতৃত্বে একটা পার্টি কেন্দ্র তৈরি করা হয় ওই সভায়। বিপ্লবী সামরিক কমিটির প্রধান কর্মস্থল ছিল এই পার্টি কেন্দ্র। এই কেন্দ্রই সমস্ত অভ্যুত্থান পরিচালনা করল।
এখানেও কামেনভ, জিনোভিয়েভ, ট্রটস্কি অভ্যুত্থানের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশ করেদিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটি লেনিনের নেতৃত্বে ঠিক করল, পূর্ব নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই অভ্যুত্থান শুরু হবে এবং শেষ হবে। এরপর তো সবই ইতিহাস। বিপ্লবের আগেরদিন ৬ নভেম্বর (পুরনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৪ অক্টোবর) রাত্রে লেনিন ‘স্মোল্নি’তে উপস্থিত হলেন। অভ্যুত্থান পরিচালনার ভার গ্রহণ করলেন। ‘অরোরা’ যুদ্ধজাহাজ জারের উইন্টার প্যালেস লক্ষ্য করে কামান বসাল। পরের দিন ৭ নভেম্বর রেডগার্ড ও বিপ্লবী সৈন্যরা রেলস্টেশন, ডাকঘর, তার-অফিস, রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের বাড়ি দখল করল। প্রাক্-পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হলো। ‘অরোরা’ যুদ্ধজাহাজের কামানের গর্জনে নতুন যুগের সূচনা হলো। জয়যুক্ত হলো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব।
●●●
এই সাত মাসের বেশিরভাগ সময়ে আত্মগোপনে থেকে লেনিনকে বিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে হলেও, তিনি রুশ দেশে ছিলেন। কাজটা ছিল অবশ্যই কঠিন, প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে প্রতি মুহূর্তে ঠিক পদক্ষেপ ফেলতে হয়েছে। না হলেই চূর্ণ হয়ে যেতে পারত বিপ্লবের স্বপ্ন। কিন্তু তার আগের সতেরো বছর, যখন একটু একটু করে বিপ্লবের ভিত তৈরি হয়েছে রাশিয়ায়, তার প্রতিটা বাঁক-মোড়ে নীতি-পরিকল্পনা রচনায়, মতাদর্শগত সংগ্রামে বিদেশ থেকেই নেতৃত্ব দিয়েছেন লেনিন। আর নিরবচ্ছিন্নভাবে অধ্যয়ন করেছেন কখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্রিটিশ মিউজিয়মের লাইব্রেরিতে, যেখানে মার্কসের জীবনের একটা বড়ো সময় অতিবাহিত হয়েছে; আবার কখনো প্যারিসে, জুরিখে - নিজের ছোটো আস্তানাতে। এটা একেবারেই সহজ কাজ ছিল না। এ এক অকল্পনীয় সংগ্রাম।
১৯০০ সালে দেশ ছাড়ার সময় থেকেই শুরু লেনিনের সেই সংগ্রাম। একদম শুরুতে অর্থনীতিবাদের বিরুদ্ধে তাঁকে লড়াই চালাতে তিনি বিদেশ থেকেই প্রকাশ করেন ‘ইস্ক্রা’। রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির প্রথম এবং ষষ্ঠ কংগ্রেস বাদ দিলে বাকি চারটি কংগ্রেস হয়েছে বিদেশে। এমনকি দ্বিতীয় কংগ্রেস বেলজিয়ামের ব্রুসেলসসে শুরু হয়েছিল, কিন্তু পুরো কংগ্রেস সেখানে চলতে পারেনি; কংগ্রেস শেষ হয় লন্ডনে। বিদেশেও এইরকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে কংগ্রেসগুলি অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি কংগ্রেসেই উপস্থিত থেকেছেন লেনিন।
দ্বিতীয় কংগ্রেস থেকেই মেনশেভিকদের সঙ্গে মতাদর্শগত লড়াই শুরু হয়। শুরু হয় বলশেভিক পার্টি গড়ার কাজ। ১৯০৫ সালের বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর বলশেভিক পার্টির সংগঠন প্রায় ভেঙে পড়েছিল। তাকে পুনর্গঠন করার কাজে দেশের বাইরে থেকেই নেতৃত্ব দিলেন লেনিন। বিপ্লবের দু’তিন বছরের মধ্যেই রাশিয়ার শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণি প্রচুর শিক্ষা পেল। শান্তিপূর্ণ অবস্থায় যা ত্রিশ বছরেও সম্ভব হতো না। মেনশেভিকরা আপসের পঙ্কে ডুবে গেল। পার্টিতে এবং সারা দেশে বলশেভিকরাই একমাত্র বিপ্লবী শক্তি হিসেবে পরিগণিত হলো।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যেই রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয়। মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভলিউশনারিদের বুর্জোয়া পিতৃভূমি রক্ষার নীতির বিরুদ্ধে লেনিন হাজির করলেন ‘‘সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে নিজ দেশের সরকারকে পরাস্ত করার’’ নীতি। লেনিন আরও বললেন, এ নীতি শুধু বলশেভিকদের জন্য নয়। সমস্ত যুযুধান দেশের শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী পার্টিগুলির অবশ্য করণীয়। তিনি আরও দেখালেনঃ সমস্ত দেশের পুঁজিবাদের বিকাশ সমানভাবে ঘটেনি। তাই সব দেশে একসাথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। প্রথমে একটি বা কয়েকটি দেশে সমাজতন্ত্র বিজয়ী হবে। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের সময়ে সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থিতে যদি আঘাত করা যায় তাহলে বিপ্লবের বিজয় সম্ভব। সে সময়ে সাম্রাজ্যবাদের দুর্বলতম গ্রন্থি রাশিয়ায় বিরাজ করছিল। লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি এই তত্ত্ব ও কৌশলের সফল রূপায়ণ ঘটাল নভেম্বর বিপ্লবে।
লেনিন দেশে কিংবা বিদেশে যেখানে থাকুন তাঁর লক্ষ্য সবসময় থেকেছে দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য বিপ্লব সফল করা। এবং সেই কাজটা তিনি অসম্ভব মেধা এবং সুনিপুণ দক্ষতায় করে গেছেন। এখানেই লেনিনের শ্রেষ্ঠত্ব। তাই তিনি নভেম্বর বিপ্লবের পথিকৃৎ রূপকার।