৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
স্মার্ট মিটারিং ব্যবস্থা - সাধারণ মানুষের বিদ্যুতের অধিকার হরণের নয়া কৌশল
অরিন্দম রায়
বিদ্যুৎ আধুনিক মানব জীবনের ধারক ও বাহক। আধুনিক প্রযুক্তির বিরোধিতা করবার উদ্দেশ্যে নয়, স্মার্ট মিটারিং ব্যবস্থার মাধ্যমে জনগণের ক্রয়সাধ্য মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার - এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরোধিতাই মূল লক্ষ্য। স্বাধীনতার আগে বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পেতেন শহরাঞ্চলের মুষ্টিমেয় কিছু ধনী ব্যক্তি। স্বাধীনতার পরে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সর্বজনীন বিদ্যুতের পরিকাঠামো গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে, সংবিধানের যৌথতালিকাভুক্ত করে বিদ্যুতকে জনকল্যাণমুখী পরিষেবা হিসেবে ঘোষণা করে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়নের কাজ শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে বিশেষ করে নয়া উদারিকরণের পরে সকল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের মতো বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকেও খোলা বাজারের হাতে সঁপে দেওয়ার নীল নকশা তৈরির উদ্যোগ দেখা যায় এবং বিদ্যুতকে ধীরে ধীরে বাজারি পণ্যে পরিণত করা হয়। বিদ্যুতের মতো পুঁজি নিবিড় শিল্পে যখন কয়েক দশকের পরিকল্পনামাফিক রাষ্ট্রের বিনিয়োগের মাধ্যমে মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কাজ দ্রুততার সাথে চলছে, ঠিক সেই সময় ২০০৩ সালে কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থিত এনডিএ সরকার বিদ্যুৎ সরবরাহ আইন ১৯৪৮-এর অবলুপ্তি ঘটিয়ে বিদ্যুৎ আইন ২০০৩ লাগু করে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণের ব্যবস্থা পাকা করে দেওয়া হয়। এই আইনের মাধ্যমে গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলোর কাঁধে ঠেলে দেয় এবং পারস্পরিক ভরতুকির মধ্য দিয়ে কৃষক ও প্রান্তিক এলাকার মানুষের সুলভে বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকারকে খর্ব করার চেষ্টা হয়। ৬১ জন বামপন্থী সাংসদের একনিষ্ঠ লড়াই, ইউপিএ-১ সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থনের সাপেক্ষে তৈরি অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচির মাধ্যমে জনগণের হৃত অধিকার বেশ কিছুটা পুনরুদ্ধার করা সম্ভবপর হয়। ২০০৪ সাল থেকে বামপন্থীদের সঙ্গে দেশের বিদ্যুৎকর্মী, অফিসার ও ইঞ্জিনিয়ারদের সম্মিলিত ধারাবাহিক লড়াই এবং সাম্প্রতিককালে সংযুক্ত কিষান মোর্চার আন্দোলনের ফলে এখনও পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার অভিসন্ধি সফল হয়নি। ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার পর থেকে বিজেপি সরকার বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার নিরন্তর আগ্রাসী প্রয়াস চালালেও ভারতের বিদ্যুৎকর্মী ফেডারেশনের অদম্য আন্দোলন সংগ্রামের কাছে বারংবার তা প্রতিহত হয়। একদিকে দেশের ৪,১৮,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার অর্ধেকের বেশি আছে আদানি, টাটার মতো বেসরকারি সংস্থার হাতে। গতবছর সারা দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের বাজার মূল্য ছিল প্রায় ৯৭৫ হাজার কোটি টাকা। সেইজন্যে এই বিপুল বাজার দখল করতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ঘুরপথে নরেন্দ্র মোদির বন্ধু করপোরেটদের মুনাফা অর্জনের মৃগয়াক্ষেত্র করে দিতে আরডিএসএস প্রকল্পের নামে বিদ্যুৎ বণ্টন ক্ষেত্র পুনরুজ্জীবনের আকর্ষণীয় শব্দবন্ধ ব্যবহার করে প্রিপেড স্মার্ট মিটার ব্যবস্থা কার্যকর করতে চাইছে।
এই প্রিপেড স্মার্ট মিটারিং ব্যবস্থা লাগু হলে প্রথমেই জনগণের বিদ্যুতের অধিকার খর্ব হবে। এই ব্যবস্থায় গ্রাহককে আগে টাকা দিতে হবে এবং পরে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারবেন। বর্তমানে গ্রাহক আগে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এবং পরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে টাকা দেওয়ার সুযোগ পায়, যা বণ্টন কোম্পানির সাথে গ্রাহকের চুক্তি। সেই সুযোগ কেড়ে নিয়ে গ্রাহকের থেকে টাকা নিয়ে জোর করে প্রিপেড স্মার্ট মিটারিং করবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুতের মাশুল লাগামছাড়া হারে বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে গত এক বছরে কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে রেলের রেক নিয়ন্ত্রণ করে কৃত্রিমভাবে কয়লার সংকট তৈরি করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলোকে বাধ্য করা হয় বিদেশ থেকে আদানির কয়লা আমদানি করে ব্যবহার করতে। ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। আবার বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রক কমিশনের নির্দেশ অনুযায়ী খোলা বাজারে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম ২০২৩ সালের গোড়ায় সর্বোচ্চ ১২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা করে দিয়েছে। এখনই কৃত্রিম বাজার থেকে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থাকে ২০-৩০-৫০ টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ কিনতে হয়। আগামীদিনে বিদ্যুৎ বেচা-কেনার মূল্য নির্ধারণের পূর্ণ ক্ষমতা চলে যাবে পাওয়ার এক্সচেঞ্জ নামক ফাটকা বাজারের হাতে। নতুন প্রকল্পের নিয়ম অনুযায়ী কস্ট রিফ্লেকটিং ট্যারিফ-এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা যে দামে বিদ্যুৎ কিনবে সেই একই দামে গ্রাহককেও বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য করা হবে।
প্রিপেড স্মার্ট মিটারিং ব্যবস্থায় ভরতুকি প্রথা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চালু নিয়মে পারস্পরিক ভরতুকির মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল গ্রাহক, যারা বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, তাদের থেকে বেশি মাশুল আদায় করে কম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী অস্বচ্ছল প্রান্তিক গরিব অংশের মানুষ ও কৃষকদের স্বল্পমূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। নতুন পরিকল্পনায় রান্নার গ্যাসের মতো ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফারের মাধ্যমে ভরতুকির টাকা গ্রাহকদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে দেওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে আগামীর পরিস্থিতি অনুধাবন করা খুব সহজ। ফলে আগামীদিনে নিম্নবিত্ত মানুষের কাছে বিদ্যুৎ হবে মহার্ঘ এবং ব্যাপক অবিদ্যুতায়ন হবে গ্রামীণ এলাকায়, ফলে গ্রামীণ ভারত অন্ধকারে চলে যাবে। একইসাথে কৃষি উৎপাদনের খরচ বাড়বে, ফলে খাদ্যদ্রব্যের মুদ্রাস্ফীতি অবশ্যম্ভাবী।
এই প্রকল্পের নিয়মানুযায়ী রাজ্যকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে ১৫ শতাংশ অনুদান পেতে হলে রাজ্যের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের চালু মিটারগুলি পালটে প্রিপেড স্মার্ট মিটার বসাতে হবে। চালু মিটারগুলির দাম ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা এবং চলে ১৫ থেকে ২০ বছর। স্মার্ট মিটারগুলির বাজারমূল্য আনুমানিক ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা এবং চলবে ৭ থেকে ৮ বছর। এই নতুন মিটারের দাম বাবদ প্রতিমাসে আনুমানিক ৮০ থেকে ১০০ টাকা করে অতিরিক্ত গ্রাহকদের বহন করতে হবে, যা এখন প্রতিমাসে ১০ টাকা করে বহন করতে হয়। এই পদ্ধতি বেআইনি কারণ, বর্তমানে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থার সাথে গ্রাহকের যে চুক্তি আছে সেই অনুযায়ী গ্রাহকের ত্রুটি ছাড়া অন্য কোনো কারণে মিটার খারাপ হলে অথবা বদলানোর প্রয়োজন হলে সেই ব্যয়ভার বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থাকেই বহন করতে হবে। আইনকেও লঙ্ঘন করা হবে এই নতুন পরিকল্পনার মাধ্যমে।
কেন্দ্রের সরকারের নিয়ম অনুযায়ী প্রিপেড স্মার্ট মিটার চালু হওয়ার সাথে সাথেই চালু হবে দিনের বিভিন্ন সময়ে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন মাশুলের পদ্ধতি। এই পদ্ধতি রেলের ডাইনামিক ভাড়ার পদ্ধতির সমতুল্য। এর ফলে সন্ধাবেলা যখন বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকবে তখন ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের মাশুল সর্বোচ্চ হবে। কেন্দ্রের সরকার বলেছে যে, যখন মাশুল বেশি হবে তখন বিদ্যুৎ কম ব্যবহার করলেই হয়ে যাবে। আসলে বিদ্যুতের মাশুল এতটাই মহার্ঘ হবে যে সাধারণ মানুষকে সন্ধেবেলা, অর্থাৎ যখন আপনার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সেই সময় আলো-পাখা বন্ধ করে রাখতে হবে। প্রিপেড স্মার্ট মিটারে টাকা ফুরিয়ে গেলে বিদ্যুৎ সংযোগ নিজে থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। এমনকী মিটারের কোনোরকম কারিগরি ত্রুটির জন্যে যদি টাকা শেষ হয়ে যায় সেক্ষেত্রেও গ্রাহককে অসহায় অবস্থাতেই থাকতে হবে। প্রযুক্তিগত এবং কারিগরি নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে বেসরকারি সংস্থার হাতে থাকার ফলে তাদের মুখাপেক্ষী হয়েই থাকতে হবে গ্রাহককে। সরকারি বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার সমস্যার নিরসন ব্যবস্থার সুবিধে থেকে গ্রাহকরা বঞ্চিত হবেন। ২০২০ সালে আমফানের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়ে পশ্চিমবঙ্গে বেসরকারি সংস্থার তুলনায় সরকারি বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা পরিষেবা প্রদানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, যা জনমানসে অত্যন্ত প্রশংসা আদায় করেছিল।
প্রিপেড স্মার্ট মিটরিংয়ের মাধ্যমে সমগ্র এলাকার বিদ্যুতের চাহিদা ও জোগানের তথ্য থাকবে বেসরকারি সংস্থার হাতে। যে এলাকায় বিদ্যুতের ব্যবহার বেশি এবং রাজস্ব বেশি আদায় হয়, কেন্দ্রের সরকারের নিয়মানুযায়ী সেই এলাকায় আবেদনের ভিত্তিতে বেসরকারি সংস্থা কোনোরকম পরিকাঠামোগত খরচ না করেও সরকারি বিদ্যুৎ বণ্টন ব্যবস্থার পরিকাঠামো ব্যবহার করে বিদ্যুৎ পরিষেবা প্রদানের ব্যবসা করতে পারবে এবং এইভাবে সরকারি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে রুগ্ণ করে দেওয়ার যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে কেন্দ্রের সরকার, তাকে বাস্তবায়ন করতে আমাদের রাজ্যের সরকার নিন্দনীয় ভূমিকা পালন করছে।
প্রিপেড স্মার্ট মিটার প্রকল্পে ব্যাপক কর্মী সংকোচন হবে। প্রাথমিক পর্বে সরাসরি অস্থায়ী ও ঠিকা প্রথায় নিযুক্ত কর্মীরা কাজ হারাবে এবং আগামীদিনে সরকারি বিদ্যুৎক্ষেত্র রুগ্ণ হয়ে পড়লে স্থায়ী কর্মীরাও চাকরির নিশ্চয়তা হারাতে পারে। ভবিষ্যতে নতুন কর্মসংস্থানের আর কোনও সম্ভাবনা থাকবে না।
সাইবার হামলা হলে সারা দেশের গ্রিড ব্যবস্থা বসে যেতে পারে। যে বিশ্ব ব্যাঙ্কের নির্দেশে এই স্মার্ট মিটার ব্যবস্থা লাগু করার চেষ্টা চলছে তারা তাদের লিখিত রিপোর্টে বলেছে যে, এই প্রযুক্তি বিপজ্জনক এবং কেন্দ্রের সরকার কোনো রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে এই কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে।
এই ব্যবস্থা কার্যকর হলে আমাদের দেশ আর্থ-সামাজিক উন্নতির পরিবর্তে অবনতির দিকে এগিয়ে যাবে। গ্রামীণ ভারতে স্বাধীনতার আগের অন্ধকার যুগ ফিরে আসবে এবং সাধারণ মানুষ তার বিদ্যুৎ ব্যবহারের অধিকার হারাবে। তাই অবিলম্বে গণ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে, বিভিন্ন প্রচারাভিযানের মাধ্যমে জনগণকে আগামীর বিপদ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। অতি দ্রুত সকল গ্রাহককে এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত করে রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে বাঁচাতে হবে, বিদ্যুতের অধিকার রক্ষা করতে হবে, নয়া কৌশলের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের বিদ্যুতের অধিকার হরণ করা চলবে না - এটাই হোক আমাদের আজকের শপথ।