৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
পশ্চিমবঙ্গ গৃহ সহায়িকা ইউনিয়নের প্রথম সম্মেলনে উঠে এলো শ্রমিকের মর্যাদা, ন্যূনতম বেতন সহ সরকারি স্বীকৃতির দাবি
পৃথা তা
পশ্চিমবঙ্গ গৃহ সহায়িকা ইউনিয়নের প্রথম রাজ্য সম্মেলনের পতাকা উত্তোলন।
এই সমাজে স্বাভাবিকভাবেই এমন অনেক পেশা রয়েছে যেখানে সামাজিক সম্মান ও রোজগার কম। আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সেখানে নিরাপত্তাও কম। এমনই একটি পেশা হলো গৃহ সহায়িকা- যা চলতি লব্জে ঝি, কাজের মেয়ে/মাসি, তারও আগে অমুকের মা... ইত্যাদি। বাংলায় লেখ্য ভাষায় আগে গৃহ পরিচারিকা শব্দে এঁদের চিহ্নিত করা হতো। কয়েক বছর ধরে অন্য ধরনের পেশার শ্রমিকদের একত্রিত করার কাজের চেষ্টা হচ্ছিল সিআইটিইউ’র তরফ থেকে। বর্তমানে তাঁরা গৃহ সহায়িকা হিসেবে পরিচিত। গত ২২ সেপ্টেম্বর, পশ্চিমবঙ্গ গৃহ সহায়িকা ইউনিয়নের প্রথম রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন থেকে সভাপতি হিসেবে ইন্দ্রজিৎ ঘোষ এবং সম্পাদক নির্বাচিত হন শিল্পী সরকার। সম্মেলনে যোগ দেন শতাধিক গৃহ সহায়িকা। শ্রমিক ভবনে কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী নগর ও কমরেড তরুণ ভরদ্বাজ মঞ্চে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সিআইটিইউ নেত্রী গার্গী চ্যাটার্জি।
এই অংশের মানুষ যাঁদের অবস্থান অর্থনৈতিক, সামাজিক, জাতি-ধর্ম সবদিক দিয়ে সমাজের একদম নিচের তলায়, রাজনৈতিকভাবে, সামাজিকভাবে সচেতন করে তাঁদের এক জায়গায় নিয়ে আসার কাজেও রয়েছে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা। এগুলি কাজ করতে করতে কিছু মিটেছে, কিছু মেটাতে হবে।
যেহেতু একটা সেক্টরে ন্যূন্যতম ৬০ থেকে ২০০ জন শ্রমিক কাজ করলে তাদের জন্য শ্রম কোডের আলাদা কিছু ব্যবস্থা বরাদ্দ, তাই এক্ষেত্রে বিষয়টি আলাদা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা প্রয়োজন। এখানে খুব বেশি হলে ৩ জনের সাধারণ পরিবারের ক্ষেত্রে গৃহস্থালি পিছু একজন, বাড়িতে অসুস্থ মানুষ বা বাচ্চা থাকলে বা উচ্চবিত্ত গৃহস্থালি হলে ৫/৬ জন বাবুর্চি, খানসামা পরিষেবা দেয়। তাই এই শ্রমিকদের ক্ষেত্রে অন্য ধারার আইন প্রযোজ্য। এর মধ্যে বেশ কিছু অধিকার ও আইন (এই ধরনের শ্রমিকদের জন্য বিশ্বে রয়েছে, ভারতেও কিছু আছে) প্রয়োজন মাফিক সেগুলো যথেষ্ট নয়। তবে যা আছে সে সম্পর্কে সচেতনতা, তালমিলের অভাব আর সরকারি অসহযোগিতায় প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি। ভারত সরকারের শ্রম মন্ত্রক ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৯ সালে এই ধরনের শ্রমিকদের অধিকার ও ওয়েলফেয়ার স্কিম নিয়ে কিছু নীতি ঘোষণা করে। তারপর ২০১১ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল লেবার কনফারেন্সের ৯৯ তম সেশনে কিছু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এই শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। তা ওই বছরেরই আগস্ট মাসে লাগু হওয়ার কথা ছিল।
এই সিদ্ধান্ত গুলির মধ্যে ছিল -
● এই পেশার সঙ্গে যুক্তদের ওয়েলফেয়ার স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে, রোগ হলে সরকারি হাসপাতালে বিশেষ চিকিৎসা, মাতৃত্বকালীন ছুটি, বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন সমস্যায় বিশেষ সুবিধা ও ন্যূনতম পেনশন, মৃত্যু ঘটলে বা শারীরিক প্রতিবন্ধকতা থাকলে সেই পরিবারে বিশেষ সুবিধা প্রদান ইত্যাদি।
● মিনিমাম ওয়েজ অ্যাক্ট ১৯৪৮-এর আওতায় আনা।
● কিছু বিষয়ে মান উন্নয়নের ট্রেনিং দেওয়া।
● গৃহ সহায়িকা বা ডোমেস্টিক ওয়ার্কারদের দেশব্যাপী একটা পলিসি ঠিক করা।
● গৃহ সহায়িকাদের জন্য কিছু সাংবিধানিক অধিকার ঠিক করা।
আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনে ২০১১-তে ১৮৯-তম কনভেনশনে অধিগ্রহণ করা সিদ্ধান্ত, ২০১৩ সালে লাগু হওয়ার কথা হয়। সেটাও হয়নি। শেষমেষ ১০ অক্টোবর, ২০১৭ জনসাধারণের জানার জন্য ভারত সরকার কিছু তথ্য দিয়ে একটা ১০ দফা অধিকারপত্র দেয়।
৩রা এপ্রিল, ২০১৭ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শ্রম দপ্তরের তরফ থেকে ২০০৭-এ পাশ হওয়া ওয়েস্ট বেঙ্গল আনঅর্গানাইজড সেক্টর ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার আইনের পার্ট বি-এর আওতায় এই ধরনের শ্রমিকদের অধিকার দেওয়ার কথা জানায় রাজ্য সরকার।
১ সেপ্টেম্বর ২০২১, শুরু হয় ই-শ্রম পোর্টাল। কোভিড-পরবর্তী সময়ে শ্রমিকদের, বিশেষত পরিযায়ী শ্রমিকদের হাল, মৃত্যু নিয়ে সুপ্রিমকোর্টে দায়ের হওয়া মামলায় কোর্ট সরকারের কাছে জানতে চায় দেশের শ্রমিকদের সংখ্যা। উত্তর না দিতে পারায় ই-শ্রমের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়। এর মধ্যেও থেকে যাচ্ছে বিরাট সমস্যা। তথ্য সংক্রান্ত কার্ডের অভাব, বার্থ সাটিফিকেট ইত্যাদির সমস্যার কারণে এর বাইরে থাকছে নানা ধরনের লাখ লাখ শ্রমিক। ব্যাঙ্ক মার্জ হয়ে যাওয়ায় কোড পালটাচ্ছে। তথ্য দিতে বারবার ব্যাঙ্কে ছুটে যেতে হচ্ছে তাঁদের। পোস্ট অফিসে আধার কার্ড ফোনের সাথে লিংক না হওয়ায় হচ্ছে না কাজ। রয়েছে সার্ভার সমস্যা। কাজ করে, জল লেগে আঙুল ক্ষয়ে যাওয়ায় মিলছে না ফিংগারপ্রিন্ট, মোবাইলের সমস্যা, আর কাজের শ্রেণি বিভাগের যে অপশন দেওয়া আছে তাও সঠিক ভাবে নথিভুক্ত হচ্ছে না। ফলে এভাবে সঠিক তথ্য আসা কখনোই সম্ভব না, তবুও শ্রমিক উদাসীন করপোরেট প্রেমী সরকারের এ একটা উদ্যোগ বটে।
ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আইন মোতাবেক কিছু দাবি করা হয়েছে -
১) ‘‘ট্রেড ইউনিয়ন আইন ১৯২৬’’ এই আইনে পশ্চিমবঙ্গ গৃহসহায়িকা ইউনিয়ন-এর রেজিস্ট্রেশন দিতে হবে।
২) ভারত সরকারকে অবিলম্বে আইএলও ১৮৯ নং (গৃহসহায়িকা সংক্রান্ত) কনভেনশন কার্যকর করতে হবে।
৩) রাজ্য সরকারকে অবিলম্বে গৃহ সহায়িকাদের ন্যূনতম বেতন কাঠামো ঘোষণা করতে হবে ৭৫ টাকা ঘণ্টা পিছু হারে।
৪) রাজ্য সরকারকে ওয়েলফেয়ার বোর্ড তৈরি করতে হবে।
৫) সকল গৃহ সহায়িকাদের পরিচয় পত্র দিতে হবে, এবং সামাজিক সুরক্ষা আইন ২০০৮-এর অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পেনশন, পিএফ, চিকিৎসা, সন্তানের পড়াশোনার সমস্ত সুবিধা দিতে হবে।
৬) গৃহ সহায়িকাদের সপ্তাহে একদিন ছুটি, অসুস্থতার ছুটি, মাতৃত্বকালীন ছুটি, এছাড়াও বছরে বিশেষ ছুটির জন্য সরকারি সার্কুলার জারি করতে হবে।
৭) গৃহ সহায়িকাদের জন্য সরকারকে স্পেশাল সামাজিক সুরক্ষা আইন কার্যকর করতে হবে। ৫৫ বছর বয়স হয়ে গেলে ন্যূনতম ৩,০০০ টাকা পেনশন চালু করতে হবে।
৮) শ্রমিক বিরোধী ৪টি শ্রমকোড বাতিল করতে হবে।
৯) কাজের বাড়িতে খাবারদাবার, বাথরুম ব্যবহার বা বাসনপত্রের ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না।
১০) রাজ্য জুড়ে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন আয়া সেন্টার। এরা একটা বড়ো অংশের কমিশন কেটে নিচ্ছে। আর বাড়িতে যিনি আয়ার কাজ করেন তাঁদের উৎসব বোনাস থাকছে না। এই বিষয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ চাই।
১১) ১৮ বছরের নিচে কাউকে এই কাজে রাখা যাবে না।
এবার কথা হলো, এই দাবিগুলি কার কাছে। সহজকথায় যদি ভেবে নেওয়া হয়, যে বাড়িতে কাজ করছে সেখানের বিরুদ্ধে এ এক যুদ্ধ ঘোষণা তাহলে বড়ো ভুল হবে। ধনীদের বাইরেও রয়ে গেছে বড়ো অংশের মানুষ, যারা গৃহসহায়িকাদের সাহায্য নেন ঘরের কাজে। কারা এঁরা? এঁরাও কোনো না কোনোভাবে শ্রমিক। যদি সরকারি কর্মচারীও হন তাহলেও নানা প্রাপ্য অধিকার থেকে তাঁরা বঞ্চিত। নিয়মিত আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে মানুষকে ও সমাজের বাকি অংশকে সচেতন করে এবং সরকারের কাছে প্রয়োজন মতো দাবি জানিয়ে তা আদায় করতে হবে গৃহ সহায়িকাদের। কেউ কেউ যেমন এগুলো নিয়ে গাজোয়ারি করতে যান, কেউ কেউ আবার না জানার কারণেও অসচেতন থাকেন এই বিষয়ে। ক্রমাগত দাবি জানাতে থাকলে শ্রমিকের মর্যাদা, বেতন, অধিকার এদেরও প্রাপ্য - এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়বে।
কর্মক্ষেত্র নিয়ে প্রাথমিক চর্চা হলেও, গৃহ সহায়িকাদের সামাজিক সম্মান নিয়েও সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিযায়ী শ্রমিকের স্ত্রী হিসেবে তাঁরাও লোকের বাড়ি বাড়ি বাসন মেজে, রান্না করেও বাচ্চা ও সংসার প্রতিপালন করেন অন্য রাজ্যে অন্য শহরে থেকে। সেখানে সুরক্ষিত পরিবেশ তাঁদেরও প্রাপ্য। এই পেশায় যুক্ত বহু মেয়ে অল্প বয়সে বিয়ে সহ নানা কারণে পরবর্তীকালে বাবা-মার বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হয়, তাদের পড়তে হয় নানা সামাজিক লাঞ্ছনার মুখে। বাচ্চাদের পড়াশোনা নিয়ে থাকে সমস্যা, এব্যাপারে প্রশাসন ও সমাজকে সচেতন করার কাজ রোজ সৎভাবে করে যেতে হবে। পারিবারিক ও গার্হস্থ্য - নানাধরনের হিংসা খুবই প্রচলিত এই পেশায়। স্বামী বা যিনি এই অপরাধে যুক্ত, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনিও খুবই শোষিত দরিদ্র শ্রমিক। তাকে সচেতন করা, সচেতন না হলে কঠোর ব্যবস্থা, আইনি সাহায্য নিয়ে এই অন্যায় বন্ধ করতে হবে। তিন রকম শোষণ সম্পর্কে সচেতন করেই শ্রমিকদের একছাতার নিচে আনার কাজ করতে হবে। তিন ক্ষেত্রেই তাঁরা সংগঠনকে পাশে পাবে এটা হাতে কলমে জানানো দরকার। সংগঠন, ব্যক্তি মালিকানা ও সম্পত্তির হিসাবের বাইরে গিয়ে একটা বড়ো পরিবার - এটা এই তিন ক্ষেত্রে সংগঠনকে পাশে পেলেই শ্রমিকরা বুঝতে শুরু করবেন। তাদের জীবনের মান উন্নত হবে।
তাদের সামনে পুঁজিবাদ অনেক সমস্যাও নিয়ে আসছে। ডিসওয়াশার, ওয়াশিং মেশিন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ফ্লোর ক্লিনার, মাইক্রোওভেন কাজ কেড়ে নিচ্ছে শহরতলিতে অনেকের। এগুলি ওয়ান টাইম ইনভেস্টমেন্ট হিসেবে দেখে অনেক অর্থনৈতিকভাবে পোক্ত মানুষ আরেকটা মানুষের সাহায্য নিতে চাইছেন না।
গ্রাম অঞ্চলেও বহু ক্ষেত্রে পেশাগত বদল হচ্ছে। রোজ প্রতি হিসাব বেশি থাকায় সুপারি কাটা, জরি শিল্প, বিড়ি বাঁধা, চাষের জন হিসেবে খাটার দিকে চলে যাচ্ছেন অনেক শ্রমিক। বন্ধন ব্যাঙ্কের মতো নানা সংস্থা যারা মাইক্রো ফিনান্স-এর ব্যবসা করে, তারা টাকা আদায়ের জন্য জুলুম করে। এছাড়াও নানা লটারি ব্যবস্থা জেরবার করে দিচ্ছে অনেক শ্রমিককে অর্থনৈতিকভাবে। এর ফলে আত্মহত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে পরিবারগুলিতে। আয়া সেন্টার সহ কাজ দেখে দেওয়া দালালদের হাতে চলে যাচ্ছে মাইনের বড়ো অংশ।
গৃহ সহায়িকাদের অপর একটি বড়ো প্রতিবন্ধকতা হলো রাজ্য সরকার রেজিস্ট্রেশন দিচ্ছে না। বারংবার সব তথ্য জমা দিলেও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এই সংগঠনের রেজিস্ট্রেশন দিতে রাজি নয় সরকার। শুধু ভাতা দিতে রাজি। শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নয়। রেজিস্ট্রেশনের দাবিতে লড়াই জারি থাকবে।
এমন নানাবিধ সমস্যা নিয়ে যাত্রা শুরু হলো লড়াইয়ের পথে। রাজ্যের কিছু জেলায় সংগঠনের আংশিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। কিছু জেলায় হচ্ছে। রাজ্যস্তরে একটা কাঠামো তৈরির কাজ হলো এই সম্মেলনে। রাজ্যজুড়ে এই শ্রমিকদের একতাবদ্ধ করে অধিকার আদায় করার সংগ্রামের পাশাপাশি ব্যাপক অংশের অসংগঠিত শ্রমিকদের সচেতন করে সংগঠিত করার কাজ চলবে।