৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
ইন্ডিয়া, না ভারত? - কিছু প্রশ্ন, কিছু ভয়
দেবী চ্যাটার্জি
সম্প্রতি জি২০ সন্মেলনে আমন্ত্রিতদের রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে যে আমন্ত্রণপত্র পাঠানো হয় তাতে রাষ্ট্রপতিকে ‘ইন্ডিয়া’ নয়, ‘ভারত’-এর রাষ্ট্রপতি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এটাকে ঘিরে তুমুল শোরগোল শুরু হয়। প্রশ্ন ওঠে, যে দেশের রাষ্ট্রপতি ‘ইন্ডিয়া’র রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত করেন, সেখানে ‘ভারত’-এর রাষ্ট্রপতির পদ কোথা থেকে আসে? পদ না থাকলে সে পদের ভিত্তিতে আমন্ত্রণই বা হয় কীভাবে? এই ধরনের নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। রাজনৈতিক মহলে উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে, রাস্তায় রাস্তায় বাড়িতে বাড়িতে চায়ের কাপে ঝড় ওঠে, বিশেষজ্ঞরা মোটা মোটা বইয়ের পাতা ওলটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন...।
সব কিছু কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। নিজের পরিচয় দিতে গিয়েই একটু যেন থমকে যাচ্ছি। এটা আমার একেবারেই নতুন ব্যাধি। নিজের যে পরিচয় দিতে চলেছি সেটা রাজনৈতিকভাবে সঠিক হবে তো? অর্থাৎ সেটা , যাকে বলে, ‘পলিটিক্যালি কারেক্ট’ তো? আমি নিজেকে কী বলবো, ‘ভারতীয়’ নাকি ‘ইন্ডিয়ান’? অনেক যেন ভেবেচিন্তে বলতে হবে। ভুল বললে, পিঠে ছাপ দিয়ে দেওয়া হতে পারে, ঠিক যেমন জবাই-চিহ্নিত পশুদের দেওয়া হয়। আমার বিপদটা বাড়ে কারণ আমি রাজনৈতিক ব্যক্তি নই, রাজনীতি বুঝি না। আমি এই দেশের (দেশের নাম বললাম না, কারণ আগেই বলেছি সব গুলিয়ে গেছে!) অতি সাধারণ একজন নাগরিক। কাজ থাকলে টাকা আসে, টাকা এলে খেতে পাই, আর না এলে উপোসের খাঁড়া মাথার উপর ঝোলে। মাথার, বা কলম-ধরা হাতের ঘাম পায়ে ফেলে নানা চিন্তায় দিন কাটে - দেশের ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, অতিমারী-মহামারীর ত্রাস, ঝড়-বৃষ্টি সহ নানা দুশ্চিন্তা লেগেই থাকে। তার উপর এই বিপদ - পরিচিতি সংকট! তবে একটাই সান্ত্বনা, এ বিপদে আমি একা নই, আমার মতো আরও অনেকেই বোধ হয় আজ একই সংকট অনুভব করছে। দেশটা ভারত না ইন্ডিয়া, আমরা ভারতীয় না ইন্ডিয়ান? স্বাধীনতার সত্তর বছরেরও পরে আজ হঠাৎ করে জেগে ওঠা এই পুরোনো বিতর্ক কিছুটা কৌতুকের উদ্রেক করলেও, কৌতুকের চেয়ে দুশ্চিন্তার সঞ্চারই যেন বেশি করছে। তবে, বিতর্কে জড়ানোর ইচ্ছা না থাকলেও জড়াতে হয়। তাই , বিষয়টিকে আরেকটু নেড়েচেড়ে দেখা যাক।
(দুই)
আমাদের সংবিধান একটি সুদীর্ঘ লিখিত দলিল। সংবিধানের গোড়াতেই একটা প্রস্তাবনা দেওয়া আছে। এই প্রস্তাবনার গুরুত্ব অপরিসীম। এটি দেশের সাংবিধানিক নীতি, দর্শন নির্ধারণের দিশারি। এই প্রস্তাবনাতে বলা হয় যে - ‘‘WE, THE PEOPLE OF INDIA... HEREBY ADOPT, ENACT AND GIVE TO OURSELVES THIS CONSTITUTION’’ অর্থাৎ “আমরা, ‘ইন্ডিয়া’র জনগণ ...এই সংবিধান গ্রহণ, বিধিবদ্ধ ও নিজেদের প্রদান করি”। এখানে, লক্ষণীয়, ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, ‘ভারত’ শব্দের কোনো উল্লেখ নেই।
তবে, সংবিধানের প্রথম ধারাতেই , যেখানে দেশটির পরিচয় স্পষ্টভাবে দেওয়া আছে, সেখানে ভারত শব্দটি আসে। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯-এ সংবিধান রচনার খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান, বি আর আম্বেদকরের উত্থাপিত প্রস্তাবের আলোচনার পর সংবিধানের এই ধারাটি গণপরিষদে গৃহীত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘India, that is Bharat, shall be a union of states’.।
গণ-পরিষদের সদস্যদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর তর্ক বিতর্কের পর এই সংজ্ঞাটি গৃহীত হয়েছিল। আম্বেদকর উত্থাপিত ৪ নভেম্বর ১৯৪৮-এর প্রথম খসড়ায় ‘ভারত’ শব্দটি স্থান পায় নি। আম্বেদকর নিজে সেটির অন্তর্ভুক্তির পক্ষে ছিলেন না। তবে অন্যান্য কিছু সদস্যের দাবির মুখে তিনি একটি সংশোধিত প্রস্তাব পরে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ তারিখে উত্থাপন করেন, তাতে ‘ভারত’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করেন। এর পরের দিন এর উপর কিছু সংশোধনী প্রস্তাব ওঠে। সেগুলির মধ্যে ছিল “Bharat, that is India” আনার প্রস্তাবের পাশাপাশি, ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি পুরোপুরি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব। কমলাপতি ত্রিপাঠি “Bharat, that is India” আনার প্রস্তাব দেন, গোবিন্দবল্লভ পন্থের প্রস্তাব ছিল “Bharat Varsha’ and nothing else”। তবে গণপরিষদে এই সব সংশোধনী প্রস্তাবগুলির কোনোটাই গৃহীত হয় নি। আম্বেদকরের প্রস্তাবটাই শেষ পর্যন্ত গৃহীত হয়।
ফলে, স্পষ্টতই বোঝা যায়, অনেক আলাপ আলোচনার পর, সুচিন্তিতভাবেই সংবিধান প্রণেতারা দেশটির নাম স্থির করেন। দেশটির পরিচয়, সংবিধান স্বীকৃতভাবে ইন্ডিয়া, অর্থাৎ ভারত দাঁড়ায়। সাংবিধানিকভাবে দুটো নামই বৈধ থাকে। তবে, লক্ষণীয়, সংবিধানে ‘Bharat, that is India...’ বলা হয় নি, বলা হয়েছে ‘India, that is Bharat,। এমনকী গণপরিষদে ‘Bharat, that is India’ করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েও বাতিল হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, ‘India’ শব্দটির আইনি ব্যবহারিক ক্ষেত্রে যে প্রাধান্য থাকা উচিত তা প্রতিষ্ঠিত হয়। এত বছর ধরে তাই-ই হয়ে এসেছে। সেটাই ছিল স্বাভাবিক, সাংবিধানিক মর্ম ভিত্তিক। সেটা নিয়ে বিশেষ কোনো সমস্যাও দেখা দেয়নি।
পৃথিবীর মানচিত্রে ‘ইন্ডিয়া’র স্থান চিহ্নিত থাকে, বিভিন্ন নথিতে তার অস্তিত্ব উজ্জ্বল হয়ে দেশের এবং মানুষের পরিচয় বহন করে। বিষয়টি যে আদৌ এতখানি বিতর্কিত হয়ে উঠতে পারে, সে নিয়ে কারো তেমন মাথাব্যথাও ছিল না। তবে আজ হঠাৎ করে কী এমন হলো?
দুটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে। প্রথমত, সাংবিধানিকভাবে দুটি নামই গ্রাহ্য হলে, যে কোনো একটাই তো ব্যবহার করা যেতে পারে। বাংলা বা হিন্দিতে কথা বললে বা লিখলে তো আমরা প্রায়শই ‘ভারত’ শব্দটা ব্যবহার করে থাকি, ঠিক যেমন ইংরাজিতে ‘ইন্ডিয়া’ ব্যবহারের চল আছে। তাতে তো বিশেষ কোনো সমস্যা চোখে পড়ে না। তা হলে সমস্যা কোথায়?
দ্বিতীয় প্রশ্ন, যেটা আমাদের ভাবায় সেটা হলো, আজ কি ‘ইন্ডিয়া’ পরিচয়টা পুরপুরি বাতিল করে ‘ভারত’ পরিচয়টা সামনে আনার প্রচেষ্টা চলছে? তা যদি হয়, তবে এতদিন পরে কেন ‘ইন্ডিয়া’কে বাদ দিয়ে ‘ভারত’ পরিচয়টি সামনে আনার প্রচেষ্টা? তাও আবার বিষয়টিকে নিয়ে সংসদে কোনো বিস্তারিত আলোচনা না করে, বা সেই স্তরের সিদ্ধান্ত ছাড়াই, অনেকটা সরকারি প্রশাসনিক স্তরের কাজের মাধ্যমে এই পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে। বিষয়টি কি নেহাতই তুচ্ছ, তাই সংসদে তার বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন পড়ে নি, না কি ক্ষমতাসীন দলের কোনো গোপন অ্যাজেন্ডা থাকায় এইভাবে এগোনো? সময়ের নির্বাচন ও একরকম হঠাৎ করেই এই পরিবর্তন আনার তৎপরতার পিছনে অন্তর্নিহিত কোনো উদ্দেশ্য আছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দাঁনা বাধে। তবে হতে পারে নিন্দুকের মন সন্দেহপ্রবণ, তাই আমরা সন্দেহ করি। দেখা যাক্...।
(তিন)
২০২৪-এ সংসদীয় নির্বাচন আসন্ন। সব প্রধান রাজনৈতিক দলই সেদিকে পাখির চোখ রেখেছে। প্রস্তুতি ও তরজা দুই-ই তুঙ্গে। বিরোধী দলেরা হিন্দুত্ববাদী বিজেপি’র বিরোধিতায় ঐক্যবদ্ধ জোট গড়ে নির্বাচনী লড়াইয়ের ময়দানে নামতে উঠে পড়ে লেগেছে। সে জোটের নাম স্থির হয়েছে - Indian National Developmental Inclusive Alliance অর্থাৎ সংক্ষেপে, INDIA.
দেশ এবং জোটের নামের মিল থাকায় জনগণের মধ্যে এক অন্য আবেগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। হয়ত একদিকে যেমন জোটভুক্ত দলগুলি সেটি হবে আশা করে, অন্য দিকে বিজেপি সেটি ঘটার আশঙ্কা রাখে। অনেকেই মনে করছেন , তড়িঘড়ি দেশের নাম পরিবর্তনের প্রচেষ্টা কিছুটা হলেও তার প্রতিফলন। ইন্ডিয়া জোট যাতে ইন্ডিয়া দেশের নামের আবেগ ব্যবহার করে মাইলেজ পেতে না পারে সেই দিকে চোখ রেখে ক্ষমতাসীন বিজেপি নির্বাচনের আগে দেশের নামটাই পালটে নিতে চাইছে!
দ্বিতীয়ত, আরও বৃহত্তর পরিসরে প্রশ্ন ওঠে, এটা কতটা বিজেপি’র জাতীয়তাবাদী হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডার পরিপূরক হিসাবে পরিকল্পিত। ‘ভারত’ শব্দের ব্যবহার প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলি থেকে আরব্ধ। বিষ্ণু পুরাণ ও মহাভারতে এর উল্লেখ আছে। অর্থাৎ তার হিন্দু যোগ সুস্পষ্ট। দেশের নাম ‘ভারত’ হলে তা হিন্দু রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিপন্ন করা সহজতর হবে , এমনটা মনে করা হতে পারে। এমনকী এই সঙ্গে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বহিরাগত চিহ্নিত করার পথও প্রশস্ত হবে। পক্ষান্তরে, ‘ইন্ডিয়া’ শব্দটি অনেক বেশি ইনক্লুসিভ। দেশটি যে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর বাসস্থান তা সহজেই মানা যায়। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক ইতিহাসে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়, সুপ্রিম কোর্ট দেশকে ইন্ডিয়ার বদলে ভারত বলে নামাঙ্কিত করার আরজি বাতিল করে। একবার ২০১৬-তে, একবার ২০২০-তে।
অর্থাৎ আজকের এই নাম বদলের তৎপরতা যে নিছক দেশের নাম মাধুর্য বিবেচনা করে ঘটছে না তা বোধ হয় স্পষ্ট। এর পিছনে সুচারুভাবে কষা গভীর রাজনৈতিক হিসাবনিকাশ যে আছে তা ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বোঝা যায়, নাম শুধু নাম নয়। বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক শেকসপিয়র তাঁর লেখা রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট-এ বলেছিলেন ‘What's in a name?’, কিন্তু সত্যি কি তাই? একটা নামের মধ্যে কী অনেক কিছু নাই? বরং দেখা যায় তাতে নিহিত আছে মানুষের অতীতের সত্য, বর্তমানের লড়াই আর ভবিষ্যতের দিশা।
এর সঙ্গে আরও কতকগুলি অতি নিরীহ প্রশ্ন থাকে। এক, সংবিধান পরিবর্তন না করে কি সরকারি কাগজপত্রে ‘ইন্ডিয়া’ শব্দের ব্যবহার পুরোপুরি বাদ দিয়ে শুধু ‘ভারত’ লেখা যায়? সেটা কি আইনি এবং নৈতিকভাবে সঠিক হবে? দ্বিতীয়ত, সংবিধান সংশোধন করলেও সেই সংশোধনীকে কি পূর্ব-সংগঠিত কাজের ক্ষেত্রে আইনি করা যেতে পারে? তৃতীয়ত, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সহ সব মন্ত্রী ‘ইন্ডিয়া’র সংবিধানের প্রতি আনুগত্যে শপথ নিয়ে ক্ষমতাসীন হন। ‘ভারত’ ‘ইন্ডিয়া’কে সাংবিধানিক সংশোধন ছাড়া প্রতিস্থাপন করলে কি সেই শপথ-গ্রহণ বৈধ থাকবে? চতুর্থত, আমাদের যে সব দলিল-দস্তাবেজে ‘ইন্ডিয়া’র বা ‘ইন্ডিয়ান’এর উল্লেখ আছে, যথা আমাদের বহুবিধ ও ক্রমবর্ধমান সংখ্যক আইডি কার্ড , তা কি বৈধ থাকবে , না কি সব বাতিল বলে গণ্য হবে? সেগুলি বাতিল হলে, দীর্ঘ লাইন দিয়ে , দরখাস্ত করে, প্রয়োজনে উৎকোচ দিয়ে, ‘ইন্ডিয়া’র ‘ইন্ডিয়ান’দের নিজেদের বিপুল অর্থ ব্যয়ে, পরিচয়ের সন্ধানে, ‘ভারত’-এর নাগরিক হিসাবে নিজেদের ‘ভারতীয়’ প্রতিপন্ন করার দৌড়ে আগামীদিনে নামতে হবে। কারো কাছে তা সহজ হবে, কারো কাছে কঠিন। বলা বাহুল্য, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না যদি কাঠিন্যের পরিমাণ নির্ভর করে আবেদনকারীর জাতি ও ধর্ম পরিচয়ের উপর।