৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা ও ‘পপুলিজম’
বাদল দত্ত
প্রায় তিন শতকের পুঁজিবাদে পৌনঃপুনিক সংকট মোচনে উদারবাদ ও সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থা এসেছে পালা করে। পুঁজিবাদের গভীরতর সংকটে আজকের পর্বটি হলো নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা। এর লক্ষ্য জনকল্যাণ নয়, আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির মুনাফা সর্বোচ্চকরণ সুনিশ্চিত করা। জনকল্যাণ সম্পর্কে চিরাচরিত ধারণা হলো পুঁজির বিকাশের মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ঘটলে ‘চুঁইয়ে পড়া নীতি’-র প্রভাবে জনকল্যাণ হবে। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, বৃদ্ধির সুফল সহজে চুঁইয়ে পড়ে না এবং জনসংখ্যার একটি বড়ো অংশ বৃদ্ধির পরিধির বাইরে চলে যায়। আমাদের দেশের অভিজ্ঞতাও তাই। তিন দশকের বেশি সময় ধরে নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সুফল পেয়েছে মুষ্টিমেয় বিত্তশালী গোষ্ঠী। ধনী আরও ধনী হয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বঞ্চিতই থেকে গেছে। ‘চুঁইয়ে-পড়া নীতি’ কোনো কাজই করেনি। ‘‘মহামারী চলাকালীন মুকেশ আম্বানির এক ঘণ্টার সম্পদ বৃদ্ধিকে ছুঁতে একজন অদক্ষ শ্রমিকের ১০ হাজার বছর সময় লাগবে (বর্তমান গড় মজুরি হিসাবে)। এমনকী প্রতি সেকেন্ডে তার যেটুকু সম্পদ বেড়েছে, সেটুকু রোজগার করতে লেগে যাবে তিন বছর (সীতারাম ইয়েচুরি, উদারিকরণ ও আজকের ভারত, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১/ cpimwb.org.in)।’’ আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে গৃহীত সব ধরনের মাপকাঠিতে দেশে ও দুনিয়াতে এই সত্য সুস্পষ্টভাবে প্রতিষ্ঠিত।
নয়া উদারবাদী অর্থনীতির সমস্ত মডেলগুলি অর্থনৈতিক বৃদ্ধির উপর জোর দেয়, সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যায়। ফলে অর্থনীতি চাহিদা-সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খায়। সংকট গভীর থেকে গভীরতর হয়। ক্রমবর্ধমান বেকারি, দারিদ্র্য, বৈষম্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের অভাব, নানা ধরনের বিভাজন সামাজিক অস্থিরতার ভিত্তিকে প্রসারিত করে।
এই অস্থিরতার চ্যালেঞ্জের মুখে নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের আবেগ ও মনকে ব্যবহার ক'রে তাদের মধ্যে এক ‘মিথ্যা চেতনা’ তৈরি ক'রে রাজনৈতিক লক্ষ্যে পৌঁছানোর নানা কৌশল গ্রহণ করে। এমনই এক কৌশলের অঙ্গ ‘উত্তর সত্য’। সত্যকে পিছনে ফেলে এক মিথ্যা নির্মাণের মধ্যে বেঁচে থাকার কথা বলে ‘উত্তর সত্য’। ‘কোনো পরিস্থিতিতে বা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে জনগণের মতকে এমন ভাবে তৈরি করা যাতে বস্তুগত ঘটনাগুলি অপেক্ষাকৃত কম প্রভাব বিস্তার করতে পারে বরং মানুষের ব্যক্তিগত আবেগ এবং বিশ্বাসের প্রতি আবেদন তাকে বেশি প্রভাবিত করে’। ‘উত্তর সত্য’ শব্দটিকে অক্সফোর্ড ডিকশনারি ২০১৬ সালে ‘বছরের সেরা শব্দ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। শব্দটি নতুন হলেও এই ধারণা নতুন নয়। ফ্যাসিবাদের বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে হিটলারের প্রচার মন্ত্রী গোয়েবলস ফতোয়া জারি করেছিলেন, ‘কোনও বড়ো মিথ্যাকে বারবার এমন ভাবে বলো, যাতে তা সত্যে পরিণত হয়।’ ‘উত্তর সত্য’ সে কাজটিই করছে। এর লক্ষ্য হলো ভ্রান্ত বিশ্বাসের এমন এক জগৎ তৈরি করা যার সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ কষ্টের কোনও সম্পর্ক নেই।
নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাকে ন্যায্যতা দিতে ‘উত্তর সত্য’ জীবন জীবিকার দৈনন্দিন যন্ত্রণা ও শ্রেণি বাস্তবতাকে আড়াল করছে, তৈরি করছে ভ্রান্ত বিশ্বাসের জগৎ। যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের ধারণাকে নস্যাৎ করে তার জায়গায় ‘হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদ’ বা ‘জনপ্রিয় জাতীয়তাবাদ’ স্থাপন করার অভিযান চালাচ্ছে। একটি ভ্রান্ত চেতনাকে আশ্রয় করে ভারতকে ধর্মাশ্রয়ী রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যেই এই অভিযান। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এখানে ‘পপুলিজম’ বা ‘লোকরঞ্জনবাদ’কে সুকৌশলে ব্যবহার করা হয়েছে।
‘পপুলিজম’ বা ‘লোকরঞ্জনবাদ’ শব্দটি নতুন নয়। ১৯৬০-এর দশকে শব্দটি সমাজ বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে অনেক লেখা প্রকাশিত হয়েছে, আলোচনা হয়েছে, সম্মেলন হয়েছে; কিন্তু এর সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি। সময়ের সাথে সাথে এর অর্থ বদলেছে। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ডান, বাম এর মতো শব্দগুলির উপসর্গ হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে বহু ব্যঞ্জনায় বহু ভাষ্যে আজ মুখরিত। ২০১৭ সালে কেমব্রিজ অভিধানে ‘বছরের সেরা শব্দ’ হিসাবে ঘোষিত। একটি সাধারণ স্বার্থে একীভূত বলে ধরে নেওয়া সংখ্যালঘুদের বিপরীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টির প্রতিনিধিত্বকারী ধারণাই ‘লোকরঞ্জনবাদ’-এর সবচেয়ে ব্যবহৃত ধারণা। ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জাত, শ্রেণি নানা পরিচিতিতে এই একীভূত হওয়ার বিষয়টি বিবেচিত হতে পারে। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা সংযোগে শব্দটি জনসমক্ষে হাজির হয়েছে।
নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা নয়া ফ্যাসিবাদের অভিমুখে যে অভিযাত্রা শুরু করেছে তার ফলশ্রুতিতে শ্রমজীবী মানুষের জীবনে নেমে এসেছে অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশা। মানুষের ক্ষোভ ও অসন্তোষ থেকে উদ্ভূত সামাজিক অস্থিরতার ভিত্তি ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। তাকে সামাল দিতে একদিকে দমন পীড়নের নতুন নতুন ব্যবস্থা গ্রহণ, অর্জিত অধিকার কেড়ে নেওয়া ও মানুষের মনে ভ্রান্ত চেতনা গড়ে তোলা, অন্যদিকে শ্রমজীবী মানুষের কাছে কিছু অর্থ স্থানান্তরের প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে।
অর্থ স্থানান্তরের প্রকল্পগুলি প্রশাসনিক দুর্বলতা, আমলাতান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা ও দুর্নীতিমূলক কার্যকলাপের ঘেরাটোপ অতিক্রম করে শ্রমজীবী মানুষের কাছে কতটা সুফল পৌঁছে দিতে পারে তা নিয়ে সংশয় থাকার যথেষ্ট কারণ আছে। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থা অর্থ স্থানান্তরকে উৎপাদন ব্যবস্থায় আয় বণ্টনের নীতির অন্তর্ভুক্ত করে না, কিংবা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হিসাবে দেখে না। পরিস্থিতির চাপে ও কিছুটা রাজনৈতিক সুবিধা লাভের প্রয়োজনে ‘বাজে খরচ’ হিসাবেই দেখে। এই অর্থ স্থানান্তরের কর্মসূচিকে ‘পপুলিজম’ বা ‘লোকরঞ্জনবাদ’ বলে বিদ্রুপ করতেও দ্বিধা করে না। আবার বিপরীতক্রমে মুনাফার উদগ্র লালসাকে চরিতার্থ করতে নির্বিচারে প্রকৃতি ধ্বংসের কাজ চালিয়ে যেতে ‘পপুলিজম’ বা‘লোকরঞ্জনবাদ’কে ব্যবহারে সংকোচহীন। শ্রমজীবী মানুষের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে পেছনে ঠেলে দেওয়ার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে আড়ালে রেখে স্বল্পমেয়াদি ও আশু স্বার্থে কর্মসূচি গ্রহণে ‘পপুলিজম’ বা ‘লোকরঞ্জনবাদ’কেই কাজে লাগানো হয়। অধিকার বোধ গড়ে তোলার পরিবর্তে দাক্ষিণ্য গ্রহণের মানসিকতা গড়ে তোলার চেষ্টা হয়। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অধিকার বোধে সচেতন মানুষ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে।
এখানে বামপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি সুস্পষ্টভাবেই আলাদা। মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণ, জাতি কর্তৃক জাতির শোষণ, শ্রেণি কর্তৃক শ্রেণির শোষণের পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান ঘটানোর লক্ষ্যে অবিচল থেকে এই ব্যবস্থার মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের জীবন জীবিকার উন্নতির জন্য অর্থ স্থানান্তর সহ অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বামপন্থীরা সদা সচেষ্ট। উন্নয়নের বাইরে ছিটকে যাওয়া মানুষকে রক্ষা করতে সরকারি পদক্ষেপ জরুরি বলেই বামপন্থীরা মনে করে। দেশের কয়েকটি রাজ্যে বামপন্থীদের নেতৃত্বে পরিচালিত সরকার শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে অর্থ স্থানান্তরের যে কর্মসূচি নিয়েছিল, তার সাথে সচেতনভাবে যুক্ত করেছিল অধিকারের প্রশ্নটি। অর্থ স্থানান্তরের পাশাপাশি শ্রমজীবী মানুষকে আত্মমর্যাদা ও অধিকার বোধে জাগ্রত করাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
নয়া উদারবাদী অর্থনীতির পরিসরে ইউপিএ আমলে খাদ্যের অধিকার আইন, এম এন রেগা, বনাঞ্চল অধিকার আইন, শিক্ষার অধিকার আইন, তথ্যের অধিকার আইন প্রভৃতি যে আইন তৈরি হয়েছিল তা শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের অনুকূলে। আর এটা মানতে কারও অসুবিধা থাকার কথা নয় যে, সরকারে না থেকেও ইউপিএ সরকারকে সম্মত করাতে চাপ তৈরি করার মতো পরিস্থিতি ও শক্তি বামপন্থীদের ছিল বলেই এই গুরুত্বপূর্ণ আইন তৈরি হয়েছিল। ‘পপুলিজম’ বা ‘লোকরঞ্জনবাদ’ বলে চিহ্নিত করে বামপন্থীদের উদ্যোগকে সে সময় আটকানো যায়নি ঠিক। কিন্তু নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার পক্ষে এটা মেনে নেওয়াও কঠিন ছিল। তাই বামপন্থীদের নির্মূল করা বা কোনঠাসা করা নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার পক্ষে জরুরি হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি বদলায়। নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার পক্ষে আরও আগ্রাসী শক্তি আজ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। বামপন্থীদের দুর্বল উপস্থিতির সুযোগে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার হরণ চলছে বেপরোয়া ভাবে।
বামপন্থীরা মনে করে শ্রেণি সমাজে জনগণ হলো শ্রমজীবী মানুষ। জনগণের বিপরীতে শাসকশ্রেণি।
শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে গৃহীত প্রকল্পকে শাসকশ্রেণি ‘পপুলিজম’ বা ‘লোকরঞ্জনবাদ’ বলে যেমন উপেক্ষা করতে পারে, নয়া উদারবাদী ব্যবস্থার পক্ষে ‘পপুলিজম’ বা ‘লোকরঞ্জনবাদ’কেই তেমন কাজে লাগাতে পারে। ‘পপুলিজম’ বা ‘লোকরঞ্জনবাদ’ একটি পরিবর্তনশীল ধারণা বিচিত্র সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে যা ভিন্ন ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে ব্যবহৃত হতে পারে। যুক্তিবোধের এলাকাটা সংকুচিত হলে শাসকশ্রেণি তা নিজের অনুকূলে ব্যবহার করতে পারে। পেশির জোরে, গলার জোরে কিংবা বিজ্ঞাপনের জোরে কোনো ধারণাকে জনপ্রিয় করে তোলা যায়। তবে দীর্ঘমেয়াদে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে যুক্তিতর্ককে অবলম্বন করতে হবে। বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হবে। ফাঁকি দিয়ে, চালাকি করে, মিথ্যাকে অবলম্বন করে সমাজ ও সভ্যতার প্রগতিকে আটকানোর চেষ্টা করলে খেসারত দিতে হবে।
বামপন্থীরা চায় শাসকশ্রেণির বিভ্রান্তির জাল ছিন্ন করতে, যুক্তিবোধের এলাকাটা প্রসারিত করতে, জনগণের অর্থাৎ শ্রমজীবী মানুষের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের লড়াইকে শক্তিশালী করতে। তাই সব সময় তারা এটা মনে রাখে - ‘‘কমিউনিস্টদের আশু লক্ষ্য অন্যান্য সব সর্বহারা পার্টির মতোই। সর্বহারাদের একটা শ্রেণিতে গঠন করা, বুর্জোয়া-আধিপত্যের উচ্ছেদ করা, সর্বহারা কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা জয়।...
আশু লক্ষ্য অর্জনের জন্য, শ্রমিকশ্রেণির ক্ষণস্থায়ী স্বার্থ আদায়ের জন্য কমিউনিস্টরা সংগ্রাম করে থাকে। কিন্তু বর্তমানের আন্দোলনের মধ্যে তারা সেই আন্দোলনের ভবিষ্যতের প্রতিনিধিত্ব করে, সেই ভবিষ্যৎ আন্দোলনেরও যত্ন নেয় (মার্কস-এঙ্গেলস)।’’