E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০

ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মাতৃভূমি রক্ষার লড়াই (দ্বিতীয় পর্ব)

সুব্রত দাশগুপ্ত


(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পর্ব - ২

সাধারণভাবে জনমানসে একটি মনগড়া ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যে, মহম্মদ আলি জিন্নাহ দ্বি-জাতি তত্ত্বের উদ্ভাবক। এটি একটি ভুল তথ্য। ভারতভাগ নিয়ে আমরা এই পরিসরে আলোচনায় যাচ্ছিনা। কিন্তু দ্বি-জাতি তত্ত্বের উদ্ভাবক জিন্নাহ নন, বিনায়ক দামোদর সাভারকর। কারণ, ১৯২৩ সালে উল্লিখিত বইটিতেই তিনি এই ভাষ্যটি উপস্থিত করেছিলেন আর জিন্নাহ-র দ্বিজাতি তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৩৯ সালে। যদিও জিন্নাহ-র মনোভাব ভারতবর্ষকে একত্রিত রাখার ক্ষেত্রে মোটেই সহায়ক ছিলনা। একথা সমধিক সত্য যে, জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্ব শুধু ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করেনি, যে নতুন রাষ্ট্র তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তার ভবিষ্যৎকেও ধ্বংস করেছিল। আজ সেই প্রতিবেশী দেশটির আর্থ-সামাজিক- রাজনৈতিক চেহারার দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে ভারতভাগ সম্পর্কে, সঙ্ঘ পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারকে উদ্ধৃত করে বলা যায় - ‘‘যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাম্প্রদায়িক পথে ভারত বিভাগের ধারণাটির উদ্ভাবনের জন্য বিপুল পরিমাণে দায়ী সেটি হলো হিন্দু মহাসভা ...’’ (Struggle for Freedom, Bharatiya Bidya Bhaban, Bombay, 1969)। অপকর্মের দাগ গা থেকে মুছে ফেলা কি এতই সহজ!

যাইহোক, আবার মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। সাভারকর কর্তৃক উদ্ভাবিত এবং আরএসএস দ্বারা অনুশীলিত ও প্রচারিত ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর মূল নীতিসমূহ কী? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার বিপরীতে ফ্যাসিস্ট কায়দায় এককেন্দ্রিক ক্ষমতার প্রতিষ্ঠা, সহনশীলতা ও মানবিকতার বিপরীতে উগ্র জাত্যভিমান ও সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদ কায়েম, আঞ্চলিক সংস্কৃতির বিকাশকে অস্বীকার করে ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ প্রতিষ্ঠা এবং শেষ পর্যন্ত সেটাকে ‘সামরিক জাতীয়তাবাদ’-এ পরিণত করা, যুক্তিবোধ ও শান্তিপূর্ণ সামাজিক স্থিতির পরিবর্তে কুসংস্কারাশ্রিত ধর্মীয় মৌলবাদী সমাজ নির্মাণ। নীতিগতভাবেই এর লক্ষ্য ‘হিন্দু-হিন্দি হিন্দুস্থান’-কে প্রতিষ্ঠা দান করা। এবং এই সবকটি নীতি-ই শুধুমাত্র ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী নয়, প্রকৃত জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণারও একেবারে বিপরীতে অবস্থানকারী। এ এক ঘৃণ্য ফ্যাসিবাদী ধরনের চিন্তাধারা। সাভারকরের এই চিন্তাধারাকেই গলাধঃকরণ করে তাকে আরও জঙ্গি রূপ দেওয়ার কৃতিত্ব পর্যায়ক্রম আরএসএস-এর।

হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থানের পর্যায়ক্রম

আসুন, এবার আমরা ‘হিন্দুত্ববাদী’ শক্তির উত্থানের ক্রমপর্যায়টির দিকে দৃষ্টিপাত করি। হিন্দু মহাসভা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১৫-র ৯ এপ্রিল, হরিদ্বারে। আরএসএস-র প্রতিষ্ঠা ১৯২৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, নাগপুরে। গান্ধীজি-কে হত্যা করা হয় ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি। হত্যাকারী সাভারকরপন্থী নাথুরাম গডসে প্রথমে জীবনে আরএসএস কর্মী, পরে হিন্দু মহাসভার নেতা। সাভারকর হিন্দু মহাসভার সভাপতি। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার একনিষ্ঠ সাভারকর ভক্ত। হেডগেওয়ারের মন্ত্রগুরু হিন্দু মহাসভার নেতা বালকৃষ্ণ শিবরাম মুঞ্জে, যিনি ১৯২০ সালে বালগঙ্গাধর তিলকের মৃত্যুর পর জাতীয় কংগ্রেস ছাড়েন এবং গান্ধীজির অহিংস ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির প্রবল বিরোধী। এই মুঞ্জেই ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়ে বিডি সাভারকরকে সেই পদে অধিষ্ঠিত করেন। হেডগেওয়ারের উত্তরসূরি হিসেবে ১৯৪০ সালে আরএসএস’র সরসঙ্ঘচালকের (প্রধান) দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর (গুরুজি)। এই গোলওয়ালকরই “We or Our Nationhood Defined’’ (আমরা অথবা আমাদের সংজ্ঞায়িত জাতিসত্তা) পুস্তিকার লেখক, যা উগ্র জাতিবিদ্বেষী প্রচারের ক্ষেত্রে সাভারকরের থেকে দু’কদম এগিয়ে। এই পুস্তিকাতেই জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট হিটলারের ইহুদি উচ্ছেদকে সমর্থন জানিয়ে ‘হিন্দুস্তান’কেও মুসলমানদের ক্ষেত্রে অনুরূপ অবস্থান গ্রহণের নিদান দেওয়া হয়েছে। বিএস মুঞ্জে হিন্দু মহাসভার সভাপতি থাককালীন ১৯৩১ সালে, প্রথম হিন্দু-জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনির সঙ্গে দেখা করেন। তিনি এই একনায়কতন্ত্রী শাসনের আদব-কায়দা, সংগঠন, প্রশাসন পরিচালনা সব খুঁটিয়ে দেখে উচ্ছ্বসিত হন এবং তা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেন। হিন্দু সস্প্রদায়ের সামরিকীকরণের ভাবনা মুঞ্জেরই মস্তিষ্কপ্রসূত এবং আরএসএস সেই ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবেই গ্রহণ করে। এই ভাবনার অনুবর্তী হয়েই দেশের প্রথম কোনো সংগঠনের নিজস্ব ‘মিলিটারি স্কুল’ স্থাপনা। ১৯৩৭ সালে বি এস মুঞ্জে ‘ভোঁসলে মিলিটারি স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৯৬ সালে নাগপুরে এর একটি শাখা খোলা হয়। বর্তমানে এটি স্কুল থেকে কলেজে পরিণত হয়েছে। উপরে উপরে যাই বলা হোক না কেন,আসলে এই ‘স্কুলে’ অবসরপ্রাপ্ত মিলিটারি পারসোনেলদের দিয়ে হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২০০৮-এর ২৯ সেপ্টেম্বর মালেগাঁওতে যে বিস্ফোরণ হয়েছিল তার পর পরই মহারাষ্ট্রের ‘অ্যান্টি টেররিস্ট স্কোয়াড’-এর আতস কাচে ধরা পড়ে ভোঁসলে মিলিটারি স্কুলের ভূমিকা। এইসব ঘটনাক্রম থেকেই এটা পরিষ্কার যে হিন্দু-মহাসভা এবং আরএসএস-এর মধ্যে শুধু যোগসূত্র নয় নিকট আত্মীয়তাও ছিল। ইতালি থেকে ফিরে ‘দ্য মারাঠা’ পত্রিকাতে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে মুঞ্জে বলেছিলেন - ‘‘আমাদের নেতাদের জার্মানির যুব আন্দোলন এবং ইতালির Balilla (ফ্যাসিস্ট সঙ্ঘ) ও অন্য ফ্যাসিস্ট সংগঠনগুলোকে অনুকরণ করা উচিত। এগুলো ভারতে প্রয়োগ করার পক্ষে পুরোপুরি উপযোগী বলে আমার মনে হয়।’’ মারিয়া কাসোলরির পুস্তক ‘হিন্দুত্ববাদ-ফ্যাসিবাদ যোগসাজশ’-এ উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৩৩ সালের প্রকাশিত একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে (Note or Rastriya Swayam Sewak Sangha) জানা যাচ্ছে যে, ১৯২৭-এ মধ্যপ্রদেশ ও মারাঠি ভাষাভাষী অঞ্চলে মুঞ্জে আরএসএস-কে ঢেলে সাজানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এই নথিতে বলা হয় যে, ‘‘এটা বলা বোধহয় বাড়াবাড়ি হবেনা যে, আরএসএস ভারতে ভবিষ্যতে ঠিক সেই ভূমিকা নিতে চায়, যেমনটা ইতালিতে ‘ফ্যাসিস্ট’ এবং জার্মানিতে ‘নাৎসি’রা নিয়েছে (NAI, Home Pol. Department, 88/33, 1933)। সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ভারত এদের হাতে নিরাপদ থাকবে ?’’

আরএসএস-এর কাজের ধারা

আরএসএস দেশব্যাপী কাজ পরিচালিত করে অসংখ্য শাখা সংগঠনের মধ্য দিয়ে। এই সমস্ত শাখাকে নিয়েই সংঘ পরিবার, যার কেন্দ্রে রয়েছে আরএসএস। আর পেশাগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষাক্ষেত্রিক, নারী ও শিশুকেন্দ্রিক, ধর্মীয় প্রভৃতি নানা ধরনের শাখা সংগঠনগুলির মধ্যে রয়েছে বেশ কিছু পরিচিত নাম, যেমন ভারতীয় কিষান সংঘ, ভারতীয় মজদুর সংঘ, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, অখিল ভারতীয় শিক্ষক মহাসঙ্ঘ, দুর্গা বাহিনী, বালগোকুলম, বিশ্বহিন্দু পরিষদ, বজরং দল, সরস্বতী শিশু মন্দির, ভারতীয় বিকাশ পরিষদ প্রভৃতি। এছাড়াও রয়েছে আরও প্রায় ৫০টি শাখা সংগঠন। এমনকী অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে যেমন এদের শাখা আছে তেমনি অহিন্দুদের হিন্দু ধর্মে দীক্ষা দেওয়ার সংগঠনও রয়েছে। দেশের বাইরে রয়েছে হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘ, হিন্দু স্টুডেন্টস কাউন্সিল-এর মতো শাখা। একেবারে ছোটো বয়সের ছেলেমেয়েদের থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপ্ত এই শাখাগুলি অবিরাম কাজ করে চলেছে ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর ধারণা মনে গেঁথে দেওয়ার জন্য।

আরএসএস-এ সকলেই কেবলমাত্র ‘স্বয়ংসেবক’ নয়। দেশের নানাপ্রান্তে সংঘের ভাবধারা বিস্তারের জন্য একটি বিশেষভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত অংশ রয়েছে, যারা ‘প্রচারক’। এরা স্বয়ংসেবকদের প্রশিক্ষণ দেয়। সাধারণভাবে এরা সংঘের সর্বক্ষণের এবং সারাজীবনের কর্মী। এদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যকের শিক্ষাগত যোগ্যতা উচ্চমানের এবং মোটা মাইনের চাকুরি ছেড়ে সংঘের কাজে আত্মনিয়োগ করে। এদের ভাবনার জগৎটাকে আরএসএস তার তত্ত্বগত ভিত্তি দিয়ে পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে। আলোকবৃত্তে থাকা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের মধ্যে প্রয়াত অটল বিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি প্রমুখ ‘স্বয়ংসেবক’, আর নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি হলেন ‘প্রচারক’।

মতাদর্শগত শিক্ষাদানের জন্য আরএসএস নিয়মিত তার প্রশিক্ষণ শিবিরগুলি পরিচালনা করে। ইনস্ট্রাকটরদের প্রশিক্ষণ শিবিরে তাদের বয়স্ক সদস্যরা অংশ নেয়, স্কুল-কলেজের ছাত্রদের জন্য আছে গ্রুপ প্রশিক্ষণ শিবির, আর প্রায় মাসাধিককাল ধরে চলে উচ্চপর্যায়ের প্রশিক্ষণ শিবির বা ‘অফিসার্স ট্রেনিং ক্যাম্প’ যেখানে প্রচারকরা এবং ওদের শিক্ষক এবং পদাধিকারীরা অংশ নেয়। এই প্রশিক্ষণ শিবিরগুলিতে শারীরিক কসরতের পাশাপাশি ‌‌‌‌‌‌‌বৌদ্ধিক প্রশিক্ষণও চলে। চলে আরএসএস-এর‌‌‌‌‌‌‌ ভাবধারায় একনিষ্ঠ ‘সৈনিক’ তৈরির প্রশিক্ষণ। ‘হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র তৈরি’ করা, ‌‌‌‌‌‌‌‌‌অহিন্দুদের হিন্দুত্ববাদী ধ্যান ধারণার মধ্যে টেনে আনা, যুক্তিবাদী আলাপ-আলোচনাকে অস্বীকার করা এবং মানুষের সঙ্গে মিশে গিয়ে ঠান্ডা মাথায়, তর্ক এড়িয়ে তাঁর চিন্তাজগতকে দখল করার প্রশিক্ষণ। এইসবের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে এর বিপরীত মতাদর্শ আত্মস্থ করা ও তাকে প্রয়োগ করা ছাড়া কোনো বিকল্প পথ নেই। অর্থাৎ আরএসএস-এর বিরুদ্ধে লড়াই মানে মতাদর্শগত লড়াই। আর এটাকেই ওরা সবচেয়ে বেশি ভয় পায় বলে একে পাশকাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সঙ্ঘের প্রতি প্রশ্নহীন আনুগত্যই আরএসএস-এর মন্ত্র।

(পরবর্তী সংখ্যায় সমাপ্য)