৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
ভগৎ সিং-এর আদর্শের মৃত্যু নেই
সুপ্রতীপ রায়
ভগৎ সিং ছিলেন একজন বিপ্লবী। ভগৎ সিং-এর বিপ্লবী জীবন ও কর্মকাণ্ড দেশপ্রেমিক ও সমাজ পরিবর্তনের স্বপ্ন যারা দেখেন তাঁদের কাছে অনুপ্রেরণা। ভগৎ সিং ১৯০৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাবের লায়ালপুর জেলার নিকটে খাতকর কালান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভগৎ সিং জন্মেছিলেন এক স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারে। তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছেন তখন তাঁর বাবা কিষান সিং ও কাকা শরণ সিং দুজনেই স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের কারণে জেলে ছিলেন। ভগৎ সিং-এর পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক কাজ ও সমসাময়িক পরিস্থিতি তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল। ভগৎ সিং ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগেই তাঁর কাকা অজিত সিংকে ব্রিটিশরা দেশান্তরে পাঠিয়েছিল। ছাত্রাবস্থাতেই ভগৎ সিং অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে আসার ডাক এসেছিল। সে ডাকে সাড়া দিয়ে ভগৎ সিং সরকারি বিদ্যালয় পরিত্যাগ করে ভরতি হয়েছিলেন জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ড ভগৎ সিং-এর উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
১৯২২ সালে চৌরিচৌরার ঘটনার সূত্র ধরে গান্ধীজি অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেন। এই ঘটনা ভগৎ সিং-কে হতাশ করেছিল। অনেক যুবক সশস্ত্র বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ, শুকদেব, সূর্য সেন, যতীন দাস সহ বাংলা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, বিহারের অনেক যুবক চরমপন্থী বিপ্লবী হয়েছিলেন। গদর পার্টির আন্দোলন ভগৎ সিং-এর উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। গদর বিপ্লবী তরুণ কার্তার সিং-এর স্বাধীনতার জন্য আত্মবলিদান ভগৎ সিং-কে প্রভাবিত করেছিল। ১৯২৩ সালে ভগৎ সিং কয়েকদিনের জন্য উত্তরপ্রদেশের কানপুরে আসেন এবং চন্দ্রশেখর আজাদ, বিজয় কুমার সিং, বটুকেশ্বর দত্ত প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। কানপুরে কারাবাস করার সময় হিন্দুস্তান রেভেলিউশনারি অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে ভগৎ সিং পাঞ্জাবে ফিরে আসেন।
কাকোরি ডাকাতি মামলায় অনেক বিপ্লবীকে ব্রিটিশরা গ্রেপ্তার করে। মামলার বিচারে রোশন সিং, রাজেন্দ্র লাহিড়ী, রামপ্রসাদ বিসমিল, আসফাকুল্লাকে ফাঁসি দেওয়া হয়। আরও অনেকের শাস্তি হয়। ১৯২৬ সালে গড়ে ওঠে ‘নওজোয়ান ভারত সভা’। ১৯২৮ সালে গড়ে উঠল লাহোর স্টুডেন্ট ইউনিয়ন। এটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ভগৎ সিং ও শুকদেব।
১৯২০ সালের পর থেকেই ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। কারণ রুশ বিপ্লব এবং তার সাথে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতাকামী মানুষের মধ্যে নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছিল। শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনও গড়ে উঠতে থাকে। ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন ভারতে আসে। জাতীয় কংগ্রেস এই কমিশন বয়কটের আহ্বান জানাল। ভগৎ সিং এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। সাইমন কমিশন বিরোধী এক বিশাল মিছিলে লালা লাজপত রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। মিছিলের ওপর ব্রিটিশ পুলিশ বেপরোয়া আক্রমণ করে। গুরুতর আহত হন লালা লাজপত রায় এবং তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এই মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেন ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ প্রমুখ। পুলিশ অফিসার স্কটকে হত্যার পরিকল্পনা করলেও ভুলক্রমে আর এক পুলিশ অফিসার স্যান্ডার্স নিহত হন।
সমসাময়িক সময়ে সারাদেশে শ্রমিক আন্দোলন জঙ্গিরূপ গ্রহণ করতে থাকে। শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সাম্যবাদী চেতনা বাড়তে থাকে। এই শ্রমিক আন্দোলনকে দমনের জন্য ব্রিটিশ সরকার কেন্দ্রীয় আইনসভায় দুটি দানবীয় বিল আনার উদ্যোগ নেয় - ‘পাবলিক সেফটি বিল’, ‘ট্রেড ডিসপিউটস বিল’।
এই বিল দুটি যাতে পাশ না হতে পারে তার জন্য ভগৎ সিং এবং তাঁর সহযোগী বিপ্লবীরা বদ্ধপরিকর ছিলেন। ইতিমধ্যে ভাইসরয়ের বক্তৃতাতে এটা বেরিয়ে এসেছিল, আইনসভাতে বিল দুটি পাশ না হলে ভাইসরয় তাঁর বিশেষ ক্ষমতা বলে অর্ডিন্যান্স দুটি চালু করে দেবেন। ভগৎ সিং-এর প্রস্তাব অনুযায়ী স্থির হয় কেন্দ্রীয় আইনসভায় ট্রেড ডিসপিউটস বিলের ওপর ভোটাভুটির পর ফল ঘোষণার আগে সরকারি পক্ষকে লক্ষ করে দর্শক গ্যালারি থেকে বোমা নিক্ষেপ করা হবে।
১৯২৯ সালের ৮ এপ্রিল ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত কেন্দ্রীয় আইন সভায় দর্শক গ্যালারিতে হাজির হন এবং তাঁরা আইনসভায় বোমা নিক্ষেপ করেন। ভগৎ সিং ও বটুকেশ্বর দত্ত বোমা মারার পর পালিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তাঁরা পালাননি। আইনসভার মধ্যে প্রচারপত্র ছড়িয়ে দেন। স্লোগান দিতে থাকেন ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’, ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’ প্রভৃতি। তাঁরা গ্রেফতারও বরণ করেন।
বিচারের সময় বিচারক ভগৎ সিং-কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এর অর্থ কী? বিপ্লব বলতে কী বোঝায়? এর উত্তরে ভগৎ সিং বলেছিলেন - বিপ্লব বলতে সবসময়ই রক্তক্ষয়ী সংঘাত বোঝায় না। ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা মেটানোর জন্য বিপ্লব সম্পন্ন হয় না। বিপ্লব বোমা পিস্তলের সাধনা নয়। ‘বিপ্লব’ বলতে আমরা বুঝি অন্যায় অবিচারে পূর্ণ প্রচলিত ব্যবস্থার পরিবর্তন। ঘোরতর অসাম্য, সামাজিক সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে জোর করে তৈরি করা বিভাজন সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে বাধ্য। এরকম অবস্থা বেশি দিন চলতে পারে না। ‘বিপ্লব’ বলতে আমরা বুঝি সমাজের এক চূড়ান্ত কাঠামো যা ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় কাঁপতে থাকে না, যেখানে স্বীকৃত হয় সর্বহারার সার্বভৌমত্ব। মুক্তি দেয় পুঁজিবাদের শৃংখল আর সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের দুর্ভোগ থেকে।
কেন্দ্রীয় আইন সভায় বোমা মামলার রায়ে ভগৎ সিং এবং বটুকেশ্বর দত্ত’র যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর হয়। ইতিমধ্যে বিপ্লবীদের কয়েকজন ধরা পড়েন। এদের কয়েকজন বিশ্বাসঘাতকতা করেন। ফলে স্যান্ডার্স হত্যার সঙ্গে যে ভগৎ সিং যুক্ত তা ব্রিটিশ গোয়েন্দারা বুঝতে পারে। ভগৎ সিং-কে মিয়ানওয়ালি জেল থেকে লাহোর জেলে স্থানান্তরিত করা হয়। এখানে ভগৎ সিং রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। ১৯৩১ সালের ২৩ মার্চ ভগৎ সিং-এর ফাঁসি হয়।
১৯১৭-র রুশ বিপ্লব পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছিল। ভগৎ সিং-এর উপর রুশ বিপ্লবের প্রভাব ছিল। লাহোরে দ্বারকা লাইব্রেরি থেকে ভগৎ সিং রুশ বিপ্লবের ইতিহাস, মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিনের বিভিন্ন পুস্তক পাঠ করেছিলেন। যার ভিত্তিতে সমাজতন্ত্রকেই ভগৎ সিং আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯২৮ সালের আগস্ট মাসে সপ্তাহ ব্যাপী ‘রুশ বান্ধব সপ্তাহ’ পালন করেছিলেন। জেলের মধ্যে থাকাকালীন ‘লেনিন দিবস’ পালন করেছিলেন। রাশিয়ার জনগণকে জেলের মধ্যে থেকেই অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ১৯২৭ সালের পর থেকেই ভগৎ সিং ও তাঁর সহযোগীদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৩১ সালে তিনি বলেছিলেন - আমি যেভাবে ভাবছি, আমার বিপ্লবী জীবনের শুরুতে সেভাবে ভাবিনি। আমি মনে করি সন্ত্রাসবাদী পথে হেঁটে আমাদের কোনো লাভ হবে না। যদিও কেন্দ্রীয় আইনসভায় বোমা ছোঁড়ার ঘটনাটিকে অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর মনে করেননি।
ভগৎ সিং সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ভাবনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। তিনি মনে করতেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করতে রাজনৈতিক বিপ্লব করা প্রয়োজন। তিনি আরও মনে করতেন, রাজনৈতিক বিপ্লব মানে শুধুমাত্র ব্রিটিশের হাত থেকে ভারতীয়দের হাতে রাষ্ট্র হস্তান্তর বোঝায় না। তিনি বিশ্বাস করতেন - জনগণের সমর্থনের ভিত্তিতে বিপ্লবী দলের রাষ্ট্র ক্ষমতা চাই এবং সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিত্তিতে গোটা সমাজকে পুনর্গঠিত করার পথে সংগঠিতভাবে অগ্রসর হতে হবে। তিনি মনে করতেন রাষ্ট্র ও সরকারি প্রশাসন শাসক শ্রেণির একটা হাতিয়ার - যা দিয়ে সে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করে। ভগৎ সিং মার্কসবাদের চিন্তা অনুযায়ী নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান সম্পর্কে ভগৎ সিং-এর স্পষ্ট ধারণা ছিল। ১৯২৯-এর ডিসেম্বর মাসে ‘মর্ডান রিভিউ’ পত্রিকায় রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর রচনা প্রকাশ করেন। এর জবাব দিয়েছিলেন ভগৎ সিং। যা প্রকাশিত হয় ১৯২৯-এর ২৪ ডিসেম্বর ‘দ্য ট্রিবিয়ন’ পত্রিকায়। ভগৎ সিং লিখেছিলেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ - স্লোগানটি আমাদের কাছে কী তাৎপর্য বহন করে, তার একটা ব্যাখ্যা দেওয়া আমাদের কর্তব্য বিশেষ করে যখন বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশ ও জাতির কাছে এই স্লোগানটিকে জনপ্রিয় করে তোলার মহান দায়িত্ব আমাদের উপর ন্যস্ত হয়েছে। তিনি লিখেছিলেন, এই স্লোগানটি আমাদের সৃষ্টি নয়। রাশিয়ায় বিপ্লবী আন্দোলনে এই স্লোগান ব্যবহৃত হয়েছে। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ কখনোই এই অর্থ বহন করে না যে, রক্তাক্ত যুদ্ধ চিরকালই চলবে। আবার এটাও বোঝায় না যে, কোনো কিছু স্বল্পকালের জন্য হলেও অনড় বা অচল হয়ে থাকবে। আদর্শ থেকে এই স্লোগানের জন্ম। তার থেকে একে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যায় না - এটাই এই স্লোগানের তাৎপর্য। বন্দি থাকার সময়ে (১৯২৯-৩১) তিনি এঙ্গেলসের ‘পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ বইটি পড়েছিলেন। এই বই তাঁকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক সত্যে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল।
ভগৎ সিং যে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি দৃঢ় ছিলেন বলেই লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার বিচারে গঠিত ট্রাইবুনালে তিনি ও তাঁর সাথিরা আত্মপক্ষ সমর্থন করবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সংক্রান্ত বিবৃতিতে তাঁরা স্পষ্টভাবে জানিয়েছিলেন - আমরা পরিবর্তন চাই। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সমস্ত ক্ষেত্রে বর্তমানে যে ব্যবস্থা চলছে তাকে আমূল বদলে ফেলে এমন এক নবীন সমাজ আমরা প্রতিষ্ঠা করতে চাই, যেখানে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণের সম্ভাবনা থাকবে না এবং সর্বক্ষেত্রে মানুষের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যাবে। আমরা মনে করি গোটা সমাজব্যবস্থাকে বদলে ফেলে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যদি না যায় তবে মানব সভ্যতার পরিণতি ভয়ানক।
ভগৎ সিং ফাঁসি হবে জেনেও কারান্তরালে বসে নিবিড় অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই বন্ধু জয়দেবকে তিনি জেলখানায় ‘সোভিয়েত অ্যাটওয়ার্ক’, লেনিনের ‘লেফট উইং কমিউনিজম’, কার্ল লিবনেখটের ‘মিলিটারিজম’, ‘ল্যান্ড রেভেলিউশন ইন এশিয়া’, ‘ফিল্ড ফ্যাক্টরিজ অ্যান্ড ওয়ার্কশপ’, মার্কসের ‘সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স’ প্রভৃতি বইগুলি এনে দিতে বলেছিলেন। তাঁর জেল নোটবুকে মোট ৪৩টি পুস্তকের ১০৭ জন লেখকের উদ্ধৃতি আছে। তবে তিনি আরও বই পড়েছিলেন। এই উদ্ধৃতিগুলি থেকে বোঝা যায় ভগৎ সিং-এর জানার কত আগ্রহ ছিল। ১৯৩০ সালের অক্টোবর মাসে লাহোর জেলে বন্দি থাকার সময় ভগৎ সিং লিখেছিলেন ‘কেন আমি নাস্তিক’।
১৯৩১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলে বসে বিপ্লবী কর্মসূচির খসড়া লিখেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “আমি আগেই বলেছি যে কোনো বিপ্লবী পার্টির একটি সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকা জরুরি - কর্মসূচি তৈরি করতে হলে কয়েকটি বিষয় অধ্যয়ন জরুরি। ক) লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য, খ) আধার, যেখান থেকে শুরু করছি অর্থাৎ বর্তমান পরিস্থিতি, গ) কার্যক্রম অর্থাৎ উপায় বা কৌশল। যতক্ষণ না এই তাত্ত্বিক বিষয়গুলি সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট সংকল্প তৈরি হচ্ছে ততক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে কোনো আলোচনা সম্ভব নয়”।
ভগৎ সিং পরিষ্কারভাবেই লিখেছিলেন, আমরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব চাই যার জন্য মৌলিক, রাজনৈতিক বিপ্লব প্রয়োজন।... রাজনৈতিক বিপ্লবের অর্থ হলো রাষ্ট্রশক্তি ইংরেজদের হাত থেকেই ভারতীয়দের হাতে আসা এবং এমন ভারতীয়দের হাতে, যাদের লক্ষ্যের সাথে আমাদের লক্ষ্য মেলে। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে জনগণের প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রশক্তি বিপ্লবী পার্টির হাতে আসা।
এরপর গুরুত্ব সহকারে গোটা সমাজকে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে নিয়ে যেতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যদি বিপ্লবের এই অর্থের সঙ্গে আপনার মত না মেলে, তবে দয়া করে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়া বন্ধ করুন। অন্তত আমাদের কাছে বিপ্লব শব্দটির সঙ্গে অনেক উচ্চ চিন্তা নিহিত এবং গুরুত্ব ছাড়া তার প্রয়োগ করা উচিত নয়। নয়ত এর অপপ্রয়োগ হবে।
১৯৩০ সালের ২৪ জানুয়ারি লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় বিচার চলাকালীন বিচারাধীন বন্দিরা গলায় লাল স্কার্ফ পড়ে আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর আসনে বসলে তাঁরা স্লোগান দিয়েছিলেন ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’, ‘দীর্ঘজীবী হোক কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক’ প্রভৃতি। ভগৎ সিং আদালতে একটি টেলিগ্রাম পাঠ করেন ও ম্যাজিস্ট্রেটকে তা তৃতীয় আন্তর্জাতিকে পাঠাতে বলেন। টেলিগ্রামে বলা ছিল -
লেনিন দিবসে আমরা মহান লেনিনের চিন্তাধারাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যাঁরা কিছু করছেন তাঁদের সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। রাশিয়া যে মহান পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে আমরা তাদের সাফল্য কামনা করি। আমরা আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলনের সাথে আমাদের কণ্ঠ মেলাই। সর্বহারার জয়। পুঁজিবাদ পরাজিত হবে।
আমরা যারা সমাজ পরিবর্তনের জন্য লড়ছি তাদের কাছে ভগৎ সিং অনুপ্রেরণা। ভগৎ সিং-এর আদর্শের মৃত্যু নেই।