৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
ডক্টর এম এস স্বামীনাথনঃ ভারতে আধুনিক কৃষিব্যবস্থার দিক্নির্দেশক
শান্তনু ঝা
ডঃ এম এস স্বামীনাথন প্রয়াত হয়েছেন গত ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৮ বছর। স্বাধীন ভারতে সবুজ বিপ্লবের পথ ধরে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনে ডঃ স্বামীনাথনের ভূমিকা ছিল পথ-নির্ধারকের। মানকম্বু সম্বাশিবান স্বামীনাথনের মৃত্যুতে ভারত এমন একজন মানুষকে হারালো, যাঁর হাত ধরে এদেশে কৃষি উৎপাদনে বৈপ্লবিক পরিবর্তনই শুধু ঘটেনি, এই পরিবর্তনের পথ ধরে চলার ছয় দশক পরেও তাঁর নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশই ভারতের কৃষিসংকটের মোকাবিলায় কৃষক আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ডঃ স্বামীনাথনের জন্ম হয়েছিল ৭ আগস্ট, ১৯২৫-এ মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির কুম্বাকোনামে। বাবা এম কে সম্বাশিবান ছিলেন একজন শল্য চিকিৎসক। মায়ের নাম ছিলো পার্বতী থাঙ্গাম্মাল। ডঃ স্বামীনাথনের বাবা ছিলেন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী। মহাত্মা গান্ধীর স্বদেশ চিন্তার প্রভাবেই কৃষিবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণে তিনি উৎসাহিত হন। ১৯৪৪ সালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক হন। ১৯৪৯ সালে ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট থেকে সাইটো জেনেটিক্স-এ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং কেমব্রিজ থেকে পিএইচডি করেন। পরে পোস্ট ডক্টরেট করেন ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন থেকে। এরপর তিনি সেন্ট্রাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কটক এবং আইএআরআই-এ বিজ্ঞানী হিসাবে যুক্ত হন। এই সময়েই সবুজ বিপ্লব সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তির জনক ডক্টর নরম্যান বোরলগের সাথে গবেষণার কাজে তিনি যুক্ত হন এবং ভারতের বুকে এই প্রযুক্তি প্রয়োগের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। ১৯৬৬-১৯৭২ পর্যন্ত তিনি আইএআরআই-এর অধিকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি ভারতীয় কৃষি অনুসন্ধান পর্ষদের মহা-নির্দেশকের দায়িত্বও পালন করেছেন। ১৯৭৯-৮০ সালে ভারত সরকারের কৃষিমন্ত্রকের প্রধান সচিব এবং পরে তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং সহ-সভাপতির দায়িত্ব পান। ১৯৮২ সালে তিনি ফিলিপিন্সে অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইন্সস্টিটিউটের মহা-নির্দেশকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে পদ্মশ্রী এবং ১৯৭২ সালে তিনি পদ্মবিভূষণ সম্মান পান। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রাইজের প্রথম প্রাপক ডক্টর স্বামীনাথন। ১৯৮৭ সালে তিনি এই পুরস্কার পেয়েছিলেন। এই পুরস্কার থেকে প্রাপ্ত অর্থ এম এস স্বামীনাথন রিসার্চ ফাউন্ডেশন স্থাপনায় ব্যবহার করা হয়। ২০০৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে ভারতে কৃষক কমিশন তৈরি হয়। সেই কমিশনের সুপারিশ, ভারতের কৃষিসংকট নিয়ন্ত্রণে আজও সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। ২০০৭-২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারতের রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য।
ভারতে সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তি প্রয়োগে ডঃ স্বামীনাথন কর্ণধারের ভূমিকা পালন করেছিলেন। ভারতীয় কৃষিতে এই প্রযুক্তির ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব বহুল আলোচিত। ডঃ স্বামীনাথনের ভূমিকাও এই প্রযুক্তি প্রয়োগের ক্ষেত্রে বহু বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পড়েছে। কিন্তু গত অর্ধ-শতকের বেশি সময়কাল ধরে ভারতের কৃষির অগ্রগতি, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পরিকল্পনার রচনা, সমস্যা ও সংকটে পরামর্শ প্রদানে তাঁর অভিভাবকসম ভূমিকা তর্কাতীত।
ভারতের খাদ্য সংকটঃ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির চাহিদা
ভারতে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি ত্রিশের দশক থেকেই ক্রমাগত জটিল চেহারা পাচ্ছিল। ১৯৩৭-এ বর্মা (বর্তমানে মায়ানমার) ব্রিটিশ ভারত থেকে আলাদা হয়ে যায়। স্বাধীন ভারত গঠনের সময় পশ্চিম পাঞ্জাব এবং পূর্ববঙ্গ আলাদা হয়ে গিয়ে পাকিস্তানে যুক্ত হয়। সংযুক্ত ভারতে ডাল উৎপাদনে বর্মা, ধান উৎপাদনে পূর্ববঙ্গ এবং উন্নত সেচ ব্যবস্থার কারণে পশ্চিম পাঞ্জাব গম উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই তিনটি অংশই স্বাধীন ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় ভারতে খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা জটিল চেহারা পায়। ১৯৪৩-১৯৫০ সাল পর্যন্ত ভারতে খাদ্য ঘাটতি ক্রমাগত জটিল চেহারা পেতে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নির্দেশে ভারতের পূর্বাঞ্চলের জন্য নির্দিষ্ট খাদ্যশস্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলশ্রুতিতে খাদ্য ঘাটতি এমন ভয়ংকর চেহারা পায় যে, বাংলায় মহামারী দেখা দেয়। না খেতে পেয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ যায়। ষাটের দশকের প্রাক্কালে পর পর খরার কারণে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। ১৯৫৭-৫৮ সালে মাত্র ৬২ মিলিয়ন টন খাদ্য উৎপাদন হয়। এর ফলশ্রুতিতে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিল্পের পরিবর্তে কৃষিতে প্রধান গুরুত্ব আরোপ করা হয়। সেই সময়ে ভারত খাদ্যে আমদানি-নির্ভর। Public Law (PL) 480 চুক্তি সই করে আমেরিকা থেকে খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছিল। সেই দানা-শস্যের, বিশেষত গমের গুণমান নিয়ে দেশের ঘরে-বাইরে বিতর্কের ঝড় ওঠে। খাদ্যে পরনির্ভরতা দেশের সার্বভৌমত্বের পক্ষে ছিল বিপদ। সেই সময়ে সংসদে বিশেষত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরা এই প্রশ্নে সোচ্চার হন।
সবুজ বিপ্লবের পথে ডঃ স্বামীনাথনের ভূমিকা
এই পর্বে লালবাহাদুর শাস্ত্রী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মন্ত্রীসভার ইস্পাতমন্ত্রক থেকে সরিয়ে এনে সি সুব্রহ্মণ্যমকে কৃষিমন্ত্রকের দায়িত্ব দিলেন। এই সময়ে ভারতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ব্যবহারে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার করে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই জৈব-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগই ‘সবুজ বিপ্লব’ হিসাবে পরিচিতি পায়। ডক্টর এম এস স্বামীনাথন সবুজ বিপ্লব প্রযুক্তির জনক ডক্টর নরম্যান বোরলগের সহযোগিতায় ভারতে কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থার এই পরিবর্তনের সূচনালগ্ন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থায় এই বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে মূলত খর্বাকৃতির ধান এবং গমের জাত ব্যবহারকে কেন্দ্র করে। এই উচ্চফলনশীল বীজের সাথে বিপুল পরিমাণে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার, সেচের এবং যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হয়। তবে সমগ্র ব্যবস্থাটির জিয়নকাঠি ছিল ফসলের উৎপাদনের বিপুল বৃদ্ধি ঘটানোর জন্য, খর্বাকৃতির জাত তৈরির লক্ষ্যে নির্বাচিত প্রজনন এবং জিনগত পরিবর্তন ঘটানো। কিন্তু খর্বাকায় উদ্ভিদ তৈরির জন্য সীমিত জিন (dee-gee-wo-gen) নির্ভরতা পরবর্তীতে আনুষঙ্গিক বহু সমস্যা আমদানি করে। উদাহরণ হিসাবে আইআর-৮ ধানের জাত-এ বিপুল পরিমাণে ব্যাকটিরিয়াল ব্লাইট বা ধসা রোগের সংক্রমণ এবং টুংরো রোগের আক্রমণ, আইআর-২০-তে বাদামি শোষক পোকা এবং গ্রাসি স্টান্ট ভাইরাসের সংক্রমণের মতো সমস্যা বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি এমন জটিল চেহারা নেয় যে, ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইন্সস্টিটিউট বিভিন্ন কীটপতঙ্গ সহনশীল জিনের সন্ধান করতে থাকে। ভারতের মতো দেশে, দেশজ জাতের ধানগুলিই এজাতীয় জিন সম্ভার সরবরাহ করতে পারে। এই পর্বে ১৯৮২ সালে আইএআরআই ডঃ স্বামীনাথনকে তাদের মহা-নির্দেশক হিসাবে নিযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট সমস্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে গুরুত্ব আরোপ করে। ডঃ স্বামীনাথনের সাহায্যে ভারতের ধানের জাম প্লাজম সম্পদ আইএআরআই ব্যবহার করে সংকটমুক্তির রাস্তা খোঁজে বলে কোনো কোনো মহল থেকে অভিযোগ করা হয়।
ভারতে সবুজ বিপ্লবের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গৃহীত একটি সাক্ষাৎকারে ডঃ স্বামীনাথন এ সময়ের কৃষিতে দুটি চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করেনঃ প্রথমত, তা বাস্তুতন্ত্রগত, দ্বিতীয়ত তা অর্থনৈতিক। জমি, জল এবং জীব-বৈচিত্র্যগত সংকটের মধ্যেও শস্য উৎপাদনে ধারাবাহিকতার ওপর তিনি জোর দেন। তিনি মনে করিয়ে দেন সবুজ বিপ্লবের সময়ে ভারতে ৪০-৫০ কোটি মানুষের কাছে খাবার জোগান দেওয়াটা ছিলো চ্যালেঞ্জ, আগামী ২০৩০ সালে আমাদের ১৫০ কোটি মানুষের খাবারের জোগানের ব্যবস্থা করতে হবে। করপোরেট স্বার্থরক্ষাকারী নীতি পরিবর্তন করে কৃষক-স্বার্থরক্ষাকারী নীতি রচনার পক্ষে ডক্টর স্বামীনাথন গুরুত্ব আরোপ করেন।
ভারতে কৃষক কমিশনের প্রধান হিসাবে ভূমিকা
নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির পথ ধরে ভারতের কৃষি সংকটদীর্ণ চেহারায়। ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, কৃষিতে ব্যবহৃত উপাদানগুলির বিপুল মূল্যবৃদ্ধি এবং উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার কারণেই কৃষক ঋণের ফাঁদে জর্জরিত হচ্ছেন। এমনকী কৃষককে আত্মহত্যা করতেও হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ২০০৪ সালে ভারতের ইউপিএ সরকার ডঃ স্বামীনাথনের নেতৃত্বে জাতীয় কৃষক কমিশন তৈরি করে। এই কমিশন যে রিপোর্ট তৈরি করে, তা এই সময়ে ভারতের কৃষির অগ্রগতির পথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসাবে বিবেচিত হয়। বিশেষ করে কৃষি-ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্য নির্ধারণের সূচক, কৃষিঋণ এবং বিমা সংক্রান্ত নীতি, খাদ্যসুরক্ষা বিষয়ে প্রস্তাবনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনেও এই কমিশনের সুপারিশ শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে কাজ করেছে।
ভারতের আধুনিক কৃষিব্যবস্থার নির্মাণে ডঃ এম এস স্বামীনাথনের অবদান সবসময়ই আমাদের স্মরণে থাকবে।