৬১ বর্ষ ৪ সংখ্যা / ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১৪ ভাদ্র, ১৪৩০
দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে চলে গেলেন সেলুলয়েডের চিত্রকর সৌমেন্দু রায়
আবীর মজুমদার
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, মধ্যরাতে ঘুমের দেশে চলে গেলেন বাংলা তথা ভারতীয় চলচ্চিত্রে কিংবদন্তি আলোক চিত্রশিল্পী সৌমেন্দু রায়। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্র জীবনের প্রথম পর্বে ক্যামেরার যাদুকর যদি সুব্রত মিত্র হন তাহলে ১৯৬১ সাল থেকে সেই ঐতিহ্যের যোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন সৌমেন্দু রায়। ১৯৩২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কনক কুমার রায় ও গার্গী রায়ের তৃতীয় সন্তান সৌমেন্দুর জন্ম হয়। জীবনের প্রথম দশটা বছর কেটেছিল তৎকালীন মধ্যপ্ৰদেশ অধুনা ছত্তিশগড়ের ধরমজয়গড়ে।
পরবর্তীকালে স্থায়ী ঠিকানা হলো কলকাতা। তীর্থপতি ইনস্টিটিউটে স্কুল শিক্ষা শেষ করে ভরতি হলেন আশুতোষ কলেজের বিজ্ঞান বিভাগে। স্কুলেই অগ্রজ ও অসিত রানার সাহচর্যে প্রথম ক্যামেরার সাথে পরিচয়। ১৯৪৬ থেকে ৪৭ বিমল রায়ের ‘উদয়ের পথে” ছবির শুটিং দেখতে দেখতে জন্ম নিল ক্যামেরার প্রতি অমোঘ আকর্ষণ৷ সেই আকর্ষণের স্ফুলিঙ্গ ক্রমেই দাবানল হয়ে উঠল সৌমেন্দুর জীবনে। কলেজ পড়ুয়া থাকাকালীনই শিক্ষানবিশি শুরু টালিগঞ্জ টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োতে। সেখানেই সান্নিধ্যে এলেন পরিচালক হিরন্ময় সেন, প্রখ্যাত সিনেমাটোগ্রাফার রামানন্দ সেনগুপ্ত এবং দীনেন গুপ্তের সঙ্গে।
কয়েক বছর পরেই এলো সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। ভারতীয় চলচ্চিত্রে শিল্পের গতানুগতিক প্রথা ভেঙে সিনেমার নতুন ভাষার সন্ধানে এগিয়ে এলেন সত্যজিৎ রায়, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, সুব্রত মিত্রের মতো কালজয়ী শিল্পীরা। পথের পাঁচালী নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলো ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পে ‘তুমুল শ্রাবণের চাষবাস’। টেকনিশিয়ান স্টুডিয়োর কর্মী হিসেবে সৌমেন্দুর ভার পড়লো মিচেল ক্যামেরা রক্ষণাবেক্ষণের। শুরু হলো এক নতুন পথচলা। আউটডোর শুটিংয়ে গিয়ে সৌমেন্দুর ঘনিষ্ঠতা হলো সুব্রত মিত্রের সাথে। গুরু মানলেন তাঁকে। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘দেবী' (১৯৫৫-৬০) পর্যন্ত সেই বিরল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হলো সৌমেন্দু রায়ের শিল্পীসত্তা। ১৯৬১ সাল থেকে সত্যজিতের ‘তিন কন্যা’ এবং ওই বছরই তথ্যচিত্র ‘রবীন্দ্রনাথ'-এ স্বাধীনভাবে শুরু হলো সৌমেন্দুর সিনেমাটোগ্রাফার ক্যারিয়ার। ‘পোস্টমাস্টার’ ছবির চরিত্র রতনের গান গাওয়ার দৃশ্যের অনবদ্য ক্লোজআপ আর তারপর ক্যামেরার ট্র্যাক ব্যাক করে নন্দবাবু আর রতনকে এক ফ্রেমে ধরে এক অনবদ্য মানবিক মুহূর্তের জন্ম দিল সৌমেন্দুর ক্যামেরা। ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্র নির্মাণের সময় খরস্রোতা পদ্মা নদীতে সত্যজিৎ রায়ের সাথে জীবন বিপন্ন করে গলা অবধি জলে নেমে তুলেছিলেন কিছু অসাধারণ দৃশ্য। বৃষ্টির ফোঁটা যেখানে নদীর জলকে স্পর্শ করেছে সেখানে পৌঁছে গেছিল সৌমেন্দুর ক্যামেরা। মেঘের ছায়াপড়া কালো নদীর জল আর সরু নদীর চরে কাশফুলের অনবদ্য সমন্বয়ে দর্শক সাক্ষী হয়েছিল এক অসামান্য দৃশ্যের। ‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং যে রাজবাড়িতে হয়েছিল সেই বাড়ির পঞ্চাশ ফুট উঁচুতে ক্যামেরা রেখে ১৫ ইয়েলো ফিলটার আর ৫.৬ এফ এইট অ্যাপারচার ব্যবহার করে সৌমেন্দু তুলেছিলেন প্রকৃতির জলছবি, যাকে সেলুলয়েডের কবিতাও বলা যেতে পারে। একটি দৃশ্যের জন্য এই আত্মনিবেদন এক প্রকৃত শিল্পীরই মহৎ গুণ। সৌমেন্দু রায়ের ক্যামেরা বহুবার আমাদের সাক্ষী করেছে এমন দুর্লভ মুহূর্তের। এই ছবিতেই দেখা গেছে ডালহৌসি পাহাড়ে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পায়ের কাছে বসে রবীন্দ্রনাথ গান গাইছেন। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। এই অনবদ্য দৃশ্যটি কিন্তু জন্ম হয়েছিল কাঠফাটা রোদে ক্যামেরায় রেড ফিল্টার ব্যবহার করেই। এই সৃজনশীল দৃশ্যটি নির্মাণের জন্য স্বয়ং সত্যজিৎ রায় প্রশংসা করেছিলেন সৌমেন্দুর।
‘গুগাবাবা’-য় গুপি আর বাঘা হাততালি দিয়ে যখন বলল, ‘শুন্ডি’, তখনই আমরা জাম্পকাটে দেখলাম এক দেশের চোখ জুড়ানো পাহাড়ি গ্রামের ছবি। যে দেশে অস্ত্র নেই, ঘোড়া নেই, উট নেই, সৈন্য সামন্ত নেই, শুধু আছে ক্ষেতে সোনার ফসল, গাছে ফুল আর শান্তি। সিনেমার পর্দায় ধান খেতের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া মৃদু হাওয়া, ছোটো ছোটো টিলা, তাল গাছের সারিই যেন বুঝিয়ে দিল সত্যিই এদেশে শান্তি আছে। আজকের দিনের করপোরেট-সহায়তাধন্য পরিচালকদের মতো এই দৃশ্য নির্মাণ করতে যেতে হয়নি কুইন্সল্যান্ড বা মিশর বা অন্য কোনো বিদেশি লোকেশনে। গ্রাম বাংলাকেও কত দৃষ্টি নন্দন করে তুলে ধরা যায় তা যেন প্রমাণ করলেন আলোকচিত্রী। কেউ ভুলতে পারবে ‘হাল্লা চলেছে যুদ্ধে’ গানটার সময় তিনটি ক্যামেরার শট ডিভিশন এবং উটের মিছিলের অনবদ্য সেই দৃশ্যের কথা। জনঅরণ্য ছবিতে ট্যাক্সির ডিকির ভেতর ক্যামেরা রেখে ছবির অ্যাঙ্গেল ধরা অথবা অরণ্যের দিনরাত্রি ছবিতে চার ফুট গর্ত করে তার নিচে ক্যামেরা রেখে ধরা লো অ্যাঙ্গেলে শমিত ভঞ্জ আর সিমির ঘনিষ্ঠ মুহূর্তের দৃশ্যটি বাংলা ছবির সম্পদ। অসীম সহ চার বন্ধু যখন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটছে তখন সাদাকালো ছবিতেও আমরা অনুভব করলাম সূর্যাস্তের নরম আলো, যা একজন জাত শিল্পীর পক্ষেই তুলে নির্মাণ করা সম্ভব। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা' ছবিতে সহকারী হিসেবে সৌমেন্দু, সুব্রত মিত্রের কাছে শিখেছিলেন কম আলোতেও কীভাবে লাইট বাউন্সব্যাক করে ছবি তোলা যায়। সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে ‘অশনি সংকেত' ছবিতে পড়ন্ত বিকেলের নরম আলোয় খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা অনঙ্গ বউয়ের অনবদ্য ক্লোজ আপ দেখে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’র বিশ্ববিশ্রুত চলচ্চিত্র সমালোচক পলিন কেইল দৃশ্যটির প্রশংসা করে লিখেছিলেন - ‘মানুষের গায়ের রং এমন উজ্জ্বল, প্রকৃতির রঙে এমন সজল শ্যামলিমা, সিনেমার ফটোগ্রাফির ইতিহাসে বিরল’।
সত্যজিৎ-এর ছোটো, বড়ো নানা দৈর্ঘ্যের ২১ টি ছবিতে ক্যামেরার দায়িত্ব সামলানো ছাড়াও সৌমেন্দু রায় সিনেম্যাটোগ্রাফারের ভূমিকা পালন করেছেন তপন সিনহা, উৎপলেন্দু চক্রবর্তী, তরুণ মজুমদার এবং বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিতেও। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ‘চরাচর' ছবির শেষ দৃশ্যে লক্ষ্মীন্দর (রজত কাপুর) যখন দুহাত মেলে সমুদ্রের দিকে ছুটে যাচ্ছে তখন তার সাথে অনেকগুলো পাখি উড়ে গেল, তখন ক্যামেরাশিল্পীর গুণে মনে হয় লক্ষ্মীন্দর যেন আর মানুষ নয়, সে নিজেই একটা পাখি। আর একটা শটেই তোলা অনবদ্য এই দৃশ্যটি ভারতীয় ছবিতে চিরকালের জন্য জায়গা করে নিল। ক্যামেরা হাতে সেলুলয়েডে এইরকম অসংখ্য সব মুহূর্তের জন্ম দিয়েছেন সৌমেন্দু রায়, যা কখনো হয়ে উঠেছে চিত্রকলা কখনো বা সেলুলয়েডের কবিতা।
সারাজীবনে সৌমেন্দু রায় পেয়েছেন অসংখ্য সম্মান। অশনি সংকেত, সোনার কেল্লা, শতরঞ্জ কি খিলাড়ি ছবির জন্য পেয়েছেন বেস্ট সিনেমাটোগ্রাফারের পুরস্কার। ১৯৯৩ সালে রাজা সেনের তথ্যচিত্র ‘সুচিত্রা মিত্র’র জন্য পেয়েছেন বেস্ট নন-ফিচার ফিল্ম সিনেম্যাটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড। ভারতীয় চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ প্রতিভাদের সঙ্গে সহাবস্থানের অভিজ্ঞতাই সৌমেন্দুর শিল্প সত্তাকে উত্তীর্ণ করেছিল এক অনন্য নান্দনিকতায়। তাঁর নিজের ভাষায় ‘All experience is an arch to build upon'।
বাংলা ছবিতে তার সৃষ্ট অনবদ্য সব দৃশ্যান্তর আমাদের স্মৃতির দরজায় কড়া নেড়ে যায় আজও। সেলুলয়েডের চিত্রকর সৌমেন্দু রায় জীবনের চিত্রনাট্য মেনে ‘আউট অফ ফ্রেম’ হয়ে গেলেন। চলে গেলেন দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে। কিন্তু তাঁর সিনেমাটোগ্রাফি রয়ে গেল আগামী পৃথিবীর জন্য।