৬০ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৭ এপ্রিল, ২০২৩ / ২৩ চৈত্র, ১৪২৯
রাম নবমীর মিছিলের নামে সংঘপরিবারের সাম্প্রদায়িক বজ্জাতি
অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়
রাম নবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে গত ৩০ মার্চ আমাদের রাজ্য সহ দেশের আরও অনেক রাজ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসা, আক্রমণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি যে সব ঘটনা ঘটেছে, তার ভয়ঙ্কর সব বিবরণ ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি। আমাদের রাজ্যে তার জের এখনও চলছে। আমাদের রাজ্যে ডালখোলায় রামের নামে মিছিলকে ঘিরে শুধু সংঘর্ষ, লুটপাট নয়, একজনের প্রাণও গেছে। হাওড়ার শিবপুরে মিশ্র বসতি এলাকায় মিছিলকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, হিংসা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনা অভাবনীয় মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছিল। আতঙ্ক ও থমথমে ভয়ের পরিবেশ, চাপা উত্তেজনা তারপরেও কয়েকদিন থেকেছে। হাওড়ার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২ এপ্রিল, রবিবার হুগলি জেলার রিষড়ার শ্রমিক অধ্যুষিত মিশ্র বসতি এলাকায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো। তার রেশও এখনও মেলায়নি। রাম নবমী পালন হয়ে গেছে ৩০ মার্চ, অথচ ২ এপ্রিল তারিখেও, হাওড়ার অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও রামের নামে মিশ্র বসতি এলাকায় মিছিল করতে দেওয়া একটুও তাৎপর্যহীন নয়।
রাম নবমীর মিছিল সংগঠিত করার ডাক দেওয়া হয়েছিল বিজেপি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, বজরঙ্গ দল ইত্যাদি আরএসএস নিয়ন্ত্রিত সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে। ৬ এপ্রিল হনুমানের জন্মদিন পালন করার কর্মসূচিও সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ আবার একটা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও হিংসা ছড়ানোর পরিকল্পনা।
এই যে রাম নবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক হিংসা ও উত্তেজনার এতসব ঘটনা ঘটলো, এসব কি হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো অঘটন! মোটেই তা নয়, এসবই আরএসএস নিয়ন্ত্রিত সংঘ পরিবারের পরিকল্পিত কর্মসূচি। ধর্ম হলো বিজেপি’র রাজনৈতিক হাতিয়ার। ধর্মকে ব্যবহার করে তারা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, ঘৃণা ও বিভাজন সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণ করতে চায়। বিজেপি’র এই মারাত্মক কর্মসূচি জানা থাকা সত্ত্বেও রাজ্য প্রশাসন কেন তার অনুমতি দিল, কেন পুলিশ প্রশাসন নির্বিকার ভূমিকা পালন করল, তার রাজনৈতিক তাৎপর্যও কম নয়। তৃণমূল এবং বিজেপি দু’পক্ষের রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির এই কৌশলও মারাত্মক।
এ বিষয়ে আলোচনায় প্রবেশের আগে বিভিন্ন রাজ্যে রাম নবমীর মিছিলকে ঘিরে গত কয়েকদিন সাম্প্রদায়িক হিংসা ও বিদ্বেষের যেসব ঘটনা ঘটেছে সেগুলি দু’এক কথায় লিপিবদ্ধ করা যায়। বিহারে সাসারাম ও বিহার শরিফে রাম নবমীর মিছিলকে ঘিরে চরম সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখা গেছে। সংঘ পরিবারের পক্ষ থেকে ওইদিন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকেও নওয়াদায় নিয়ে এসে সমাবেশের নামে হিংসা ছড়ানোর পরিকল্পনা করা হয়েছিল। রাজ্য প্রশাসন হিংসা ঠেকাতে নানা আইনি নিষেধাজ্ঞা সময় মতো জারি করায় অমিত শাহর কর্মসূচি বাতিল হয়ে যায়। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বলেছেন, যা ঘটেছে তা মোটেই স্বাভাবিক নয়, পরিকল্পনা করেই বিজেপি এসব করেছে। বিহারে রোহতাস, নালন্দা, গয়া এবং ভাগলপুরেও মিছিলকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করা হয়েছিল। গুজরাটের বরোদায়, মহারাষ্ট্রের মুম্বাই এবং আউরঙ্গাবাদে, ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে, উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরে, হায়দরাবাদের চারমিনার অঞ্চলে দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।
বিজেপি’র এই সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি এবং আমাদের রাজ্যে এইসব কর্মসূচিকে ছড়িয়ে দিতে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস ও তার নেত্রী মমতা ব্যানার্জির সহযোগিতাপূর্ণ আচরণ ও ভূমিকা রাজ্যকে গভীর বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। জননেতা জ্যোতি বসুর সেই মন্তব্য আমাদের বারবার মনে পড়ে যখন তিনি বলেছিলেন, মমতা ব্যানার্জির সবচেয়ে বড়ো অপরাধ হলো তিনি বিজেপি-কে এ রাজ্যে ডেকে এনেছেন। মমতা ব্যানার্জির সেই অপরাধের বিষময় ফল আজ রাজ্যের মানুষকে ভোগ করতে হচ্ছে।
নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য দাঙ্গা সংগঠিত করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন ঘটানো এবং হিন্দু জনমতকে হিন্দুত্ব’র পক্ষে সংগঠিত করা হলো সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক কৌশল এবং কর্মসূচি। সেই মতোই, ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে দিল্লিতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সুবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, দেশের সব রাজ্যের প্রত্যেকটি জেলায় হিন্দু সম্মেলন হবে এবং ২১ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল রাম নবমী ও রাম জন্মোৎসব পালন করা হবে। সেই থেকেই রাম নবমীকে কেন্দ্র করে উগ্র জেহাদি সশস্ত্র মিছিল এ রাজ্যেও আমরা শুরু হতে দেখেছি।
বিজেপি যেমন এই কর্মসূচিকে হিন্দু ভোট সংহত করার কাজে ব্যবহার করেছে, ঠিক তেমনই তৃণমূল কংগ্রেসও বিজেপি’র পালটা হিসেবে হিন্দু ভোট পক্ষে ধরে রাখতে রাম নবমীর মিছিল দলীয় কর্মসূচি হিসেবেই বিভিন্ন জেলায় সংগঠিত করেছে। তারাও রামের নামে তরোয়াল নিয়ে মিছিল করেছে। সশস্ত্র হনুমান জয়ন্তী পালন করেছে। এইভাবেই রাজ্যে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িক কর্মসূচি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই পালন করে চলেছে। মেহনতি মানুষের শ্রেণি ঐক্যকে দুর্বল করে দিতে, ভেঙে দিতে ধর্মকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির এই কৌশল বিজেপি’র মতো এই রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসও গ্রহণ করে চলেছে।
শুধু রাম নবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে নয়, মহরমের মিছিলকে কেন্দ্র করে ২০১৫ সাল থেকেই সাম্প্রদায়িক সংঘাত বেড়ে চলে। দিল্লির ত্রিলোকপুরী, গুজরাটের ভাদোদরা, উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর, বিহারের আজিজপুরে মহরমের মিছিল আক্রান্ত হয়েছিল, দাঙ্গা ঘটেছিল।
কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদির সরকার দেশের স্বার্থবিরোধী, জনবিরোধী একের পর এক নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে চলেছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজন ধনপতি নিজেদের সম্পদ শত শত গুণ বাড়িয়ে চলেছে, অপরদিকে দেশের অধিকাংশ মানুষ ক্রমশ নিঃস্ব হচ্ছে। রাজ্যে মমতা ব্যানার্জির সরকার শুধু দুর্নীতিতে হাবুডুবু খাচ্ছে তা নয়, অপশাসনে রাজ্য ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মজুরি সব কিছুতেই মানুষ বঞ্চিত। এক গভীর অন্ধকারের দিকে রাজ্য এগিয়ে চলেছে, নিজেদের ব্যর্থতা এবং মানুষের দুর্দশা ও ক্ষোভ থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস একই অপকৌশলের পথ ধরেছে।
হিন্দু এবং মুসলিম উভয় ধর্মের মৌলবাদী নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিভেদ-বিদ্বেষ ছড়ানো এমন কী মানুষ খুন স্বাধীন ভারতে কোনো বিরল ঘটনা নয়, তার বহু নজির রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণে ধর্মের সাম্প্রদায়িক ব্যবহার গত শতাব্দীর নব্বই দশকের শুরু থেকে আরএসএস’র রাজনৈতিক শাখা বিজেপি এবং সংঘ পরিবারের বিভিন্ন সংগঠন যেমন - বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, বজরঙ্গ দল ইত্যাদি প্রকাশ্যে ভয়ঙ্করভাবে শুরু করে। সাম্প্রদায়িকতার কলুষ স্পর্শে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রবলভাবে আক্রান্ত হতে শুরু করে। রাম মন্দিরের দাবিতে বিজেপি নেতা আদবানির নেতৃত্বে অযোধ্যা যাত্রা, তার পরবর্তী পদক্ষেপ বাবরি মসজিদ ধ্বংস গোটা দেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ সৃষ্টি করে। দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, ধর্মীয় স্থানে আক্রমণ শুধু নয়, কতশত মানুষকে দাঙ্গার বলি হতে হয়। সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শকেও ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করা হয়। আরএসএস’র স্বপ্ন ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই পথ অবলম্বন করে।
ওই পথ ধরেই বিজেপি নেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে প্রথম এনডিএ সরকার প্রতিষ্ঠা হয়। মনে রাখতে হবে ১৯৯৯ সালে গঠিত ওই কেন্দ্রীয় সরকারের রেলমন্ত্রী ছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জি। আরএসএস’র সঙ্গে তাঁর সংযোগ এবং সুসম্পর্ক তখন থেকেই। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি পেয়ে যায় তার চরম বিশ্বস্ত সঙ্গীকে। ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গে পৌর নির্বাচনে বিজেপি এবং তৃণমূল জোট বেঁধে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করে। ২০০১ সালেই মমতা ব্যানার্জি প্রকাশ্যে টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে নির্দ্বিধায় বলেছিলেন বিজেপি আমাদের স্বাভাবিক মিত্র। স্বভাবতই মমতা ব্যানার্জি এবং তার দল ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যার কোনো প্রতিবাদ বা নিন্দা করেনি।
গুজরাট গণহত্যার পরেও ২০০৩ সালে কেন্দ্রের মন্ত্রী হিসেবে মমতা ব্যানার্জি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (এনআরসি) সমর্থন করেছিলেন। ওই একই সময়ে দিল্লিতে আরএসএস’র এক বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে তিনি প্রকাশ্যে গর্বের সঙ্গে জানিয়েছিলেন কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইতে তিনি আরএসএস’র সঙ্গে আছেন। সুতরাং, ঘটনাক্রম দেখিয়ে দিচ্ছে মমতা-বিজেপি বোঝাপড়া নতুন কিছু নয়, বামপন্থা ও কমিউনিস্ট বিরোধিতা তাদের উভয়ের সাধারণ লক্ষ্য তো বটেই, সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণের যাত্রা পথে তারা একই নৌকার যাত্রী।