৬০ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৭ এপ্রিল, ২০২৩ / ২৩ চৈত্র, ১৪২৯
নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ উঠছে কেন বারবার?
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে অসন্তুষ্ট কলকাতা হাইকোর্টের দুই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এবং বিশ্বজিৎ বসু। এ প্রসঙ্গে তাঁরা বেশ কিছুদিন ধরেই কয়েকবার মামলা চলাকালীন এজলাসে বসে দ্রুত তদন্ত করতে বলে তাদের অসন্তোষের কথা বলেছেন, সমালোচনা করেছেন কেন্দ্রীয় এজেন্সির। বলা যায় নিয়োগ দুর্নীতির সিবিআই তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রায় ধারাবাহিকভাবে, তিরস্কার করছেন হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতিরা। এই সব মন্তব্য তদন্ত সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করছে না জনমানসে।
কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার ঢিলেমি, গাফিলতির সঙ্গে এ রাজ্যের মানুষ পরিচিত। কারণ সারদা, নারদ মামলায় সিবিআইয়ের ভূমিকা। দু’টি ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ সুবিধা প্রাপক এবং চিহ্নিত অপরাধীদের বড়ো অংশই এখনও শাস্তি পায়নি। স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সময়সীমা বেঁধে দিয়ে দুটি মামলার নিষ্পত্তি করা হবে এমনটাই বলেছিলেন এরাজ্যে নির্বাচনী জনসভায়। কার্যকর হয়নি সে প্রতিশ্রুতি। তাই বামপন্থীদের করা মামলার জেরে নিয়োগ দুর্নীতির হাইকোর্ট নির্দেশিত তদন্ত চললেও বিচারপতিদের এহেন মন্তব্যের পর প্রকৃত চাকরি প্রার্থীরা আর কতদিন রাস্তায় বসে ধরনা দেবেন এই প্রশ্নের পাশাপাশি উঠছে আরও নানা প্রশ্ন।
শুধু এবছরের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাসেই নয়, সমালোচনা চলছে গত বছর থেকেই। গত জুন মাসেও বিচারপতিরা বিরক্তি গোপন করেননি এ প্রসঙ্গে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে সেসব ফলাও করে উল্লেখ করা হয়েছে। তার কয়েকটি উল্লেখ করলে প্রেক্ষাপটটি বুঝতে সুবিধা হবে।
সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত, সাম্প্রতিক যে মন্তব্যটি প্রথমেই উল্লেখ করা যেতে পারে তা হলোঃ ২৯ মার্চ নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় হাইকোর্টে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ...‘আমি দুর্নীতির মহাসমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি প্রাথমিকে বহু নিয়োগ বাতিল করতে গেলে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে’।
আবার অন্যতম অভিযুক্ত তৃণমূল বিধায়ক জেলবন্দি প্রাক্তন পর্ষদ সভাপতি মানিক ভট্টাচার্যকে জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে সিবিআই-এর বক্তব্যের পর তাদের ভর্ৎসনা করে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ‘আপনারা জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছুই পাচ্ছেন না। আমি এর থেকে ভালো জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারি। আইনজীবীরাও ভালো জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন’। আবার এর আগে তিনি কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা আধিকারিকদের নাম করেও সমালোচনা করেছেন। তদন্ত প্রত্যাশিত গতিতে না এগোনোয় কড়া বার্তাও দিয়েছেন, বদল করেছেন বিশেষ তদন্ত দলের আধিকারিককে।
তবে ওয়াকিবহাল মহলের পর্যবেক্ষণ, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ওই মন্তব্যের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ অংশ হলো, ‘সব নদীর জল গিয়ে মিশেছে সমুদ্রে। সেখান থেকে মানিক খুঁজে বের করে আনতে হবে’।
সিবিআই’র তদন্তের মন্থর গতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কলকাতা হাইকোর্টের আরও এক বিচারপতি বিশ্বজিৎ বসু। এর আগে ভরা আদালতে সিবিআইকে ভর্ৎসনা করে বিচারপতি বসু বলেন, ‘‘যে ভাবে স্কুলের নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত চালাচ্ছে সিবিআই, তা চলতে পারে না। ...যা করার তাড়াতাড়ি করুন।’’ আবার তিনি জানতে চান, ‘‘নিয়োগ দুর্নীতিতে যুক্ত বাকিরা কেন ঘুরে বেড়াচ্ছেন? তাঁদের কেন ছেড়ে রাখা হয়েছে?’’ বিচারপতি প্রশ্ন করেন, ‘‘যাঁরা টাকা দিয়েছেন এবং যাঁরা নিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? তাঁদের হেফাজতে নিয়ে কেন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে না? এখনও সিবিআই উদাসীন কেন? এত দিনে তো অনেক টাকা পাচার হয়ে গিয়েছে!’’ এরপর তিনি বলেছেন, ‘‘তদন্ত তাড়াতাড়ি শেষ করুন, মামলা ঝুলে থাকলে এসএসসি নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে পারবে না। শূন্যপদ থেকেই যাবে।’’
কোর্টে হাজির সিবিআইয়ের আইনজীবী এবং কর্তাদের জবাবের অপেক্ষা না করেই এর পর বিচারপতি বসু বলেন, ‘‘আপনারা কী করবেন আদালত তা বার বার বলে দেবে এটা ভাল দেখায় না। নিজেদের কাজ নিজেরা করুন। কাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন সেটাও বলে দিতে হচ্ছে। প্রতি দিন আসছেন আর কী করবেন সেটার উপদেশ শুনে চলে যাচ্ছেন। এটা চলতে পারে না। যা করার তাড়াতাড়ি করুন।’’
দুর্নীতির জাল শিক্ষা দপ্তরের নিয়োগের পরিধিকে পেরিয়ে যে পুরসভাগুলির নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিছানো তা জানা গেছে মাত্র কিছুদিন আগে। তাই নিয়োগ দুর্নীতির আওতায় রাজ্য সরকারের আর কোন কোন দপ্তর আসবে তা নিয়ে মানুষের জল্পনা চলছে। অন্যদিকে, রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলের পড়ুয়াদের অভিভাবকরা এখনও সন্দিহান, তাদের সন্তানেরা প্রকৃত মেধা সম্পন্ন উপযুক্ত শিক্ষকের থেকে পাঠ নিচ্ছেন, যারা কিনা ২০১১-র পরে নিযুক্ত।
পশ্চিমবঙ্গের তো বটেই, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে এই দুর্নীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল মানুষদের কার্যত মনের কথা উঠে এসেছে বিচারপতিদের নানা পর্যবেক্ষণ, উল্লিখিত প্রশ্ন ও সওয়ালে। তৃণমূল এবং বিজেপি’র গোপন ঢলাঢলি রাজ্যের মানুষ ধরে ফেললেও, এই দুই দলের নেতা-নেত্রীদের কোনো ভয় নেই। তাঁদের কোন কোন নেতা জেলে যাবেন বা ভাইপো গ্রেফতার হবেন কিনা, হলে কবে হবেন- এই হিসাব নিকাশেই ভয়ে সিঁটিয়ে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। মানুষের মন থেকে রাজ্যের বিরোধী দল হিসেবে বিজেপির অস্তিত্ব প্রায় মুছে গেছে। কিন্তু বিজেপি’র হারানো জমি পুনরুদ্ধারে মদত দিতে সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক মিছিলের খবর থাকা সত্ত্বেও উদাসীন থাকেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি প্রকাশ্যে স্বীকারও করেন রাজ্যে তৃণমূল জমানায় চাকরি বিলি বিক্রির প্রসঙ্গ। তাই দুর্নীতি বিরোধী লড়াইটা বরাবরের মতো শুধুমাত্র আদালত কক্ষেই লড়তে হবে তা নয়, লড়তে হবে রাজপথেও। তবেই দ্রুত তদন্তে করতে বাধ্য হবে কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলি। পর্যাপ্ত আধিকারিক না থাকার ছেঁদো যুক্তি খাড়া করবার সাহস পাবে না সংশ্লিষ্টরা।
বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের সেপ্টেম্বর মাসে দেওয়া একটি টিভি সাক্ষাৎকারের একটি মন্তব্য এপ্রসঙ্গে দেওয়া যেতে পারে - ‘এখানে দুর্নীতি আছে। দুর্নীতি ছাড়া এ ঘটনা হতে পারে না। তখন আমি আর কাকে দেব? আমার পুলিশের উপর ভরসা যথেষ্ট আছে, কিন্তু পুলিশতো নিয়ন্ত্রিত হয় বিভিন্ন রকমভাবে। আমি সেই জন্য সিবিআইকে দিলাম। সিবিআই-ও যে নিয়ন্ত্রিত হয় না তা আমি বলছি না, হয়। হয়তো কিছুটা কম হবে। হয়তো কিছু বেরোবে। আমাকে দেখতে হলো যে দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেতে হলে আমাকে একটা কোনো কড়া পদক্ষেপ নিতে হবে। আমি তো এখানে বসে চুপ করে থাকব না।’