E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৭ এপ্রিল, ২০২৩ / ২৩ চৈত্র, ১৪২৯

দিল্লিতে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের শপথদীপ্ত বিশাল সমাবেশ


সুবিশাল সমাবেশে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের অঙ্গীকার।

বিশেষ প্রতিবেদনঃ আবারও রাজধানীর রাজপথে মেহনতি মানুষেরা। ৫ এপ্রিল দেশ দেখল, শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণি ঐক্য। করপোরেট-সাম্প্রদায়িক চক্রের বিরুদ্ধে আগামীদিনে লড়াই আরও তীব্র হবে তার ইঙ্গিত মিলেছে রামলীলা ময়দানের এদিনের সমাবেশে। এদিন দিল্লির রাজপথে স্লোগান উঠেছে ‘‘দেশ বাঁচাও, গণতন্ত্র বাঁচাও’’, ‘‘কিসকে বানায়া হিন্দুস্তান, দেশ কে মজদুর আর কিষান’’।

৫ এপ্রিল সংঘর্ষ র‌ালির নির্দিষ্ট তারিখ থাকলেও ৩ এপ্রিল থেকেই রাজধানী দখল নিয়েছিল লাল ঝান্ডা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মেহনতি মানুষেরা কার্যত ৪৮ ঘণ্টা আগে থেকেই মেলা বসিয়েছিলেন দেশের রাজধানীতে। নিজেরাই রান্না করে খেয়েছেন। রামলীলা ময়দানে করপোরেট রাজ, সাম্প্রদায়িকতা আর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঘনঘন স্লোগান উচ্চারিত হয়েছে। গ্রীষ্মের গনগনে আঁচ মাথার উপরে থাকলেও, লক্ষ লক্ষ মানুষের মাঝে সূর্যের তাপ লঘু হয়ে গিয়েছিল। সমাবেশে অংশ নেওয়া মেহনতিরা কাতারে কাতারে মিছিল করেছেন লাল ঝান্ডার লহর তুলে। এ এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। ফ্যাসিবাদ প্রতিহত করতে জাতপাত বিরোধী ও করপোরেট বিরোধী সংগ্রামকে একত্রিত করার শপথ ঘোষিত হয়েছে রামলীলা ময়দানে। অন্নদাতারা, শ্রমজীবীরা জানান দিয়েছেন - করপোরেটতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ভারতের সংবিধান ও গণতন্ত্র বাঁচানোর লড়াই জোরদার হবে।

আসমুদ্র হিমাচল গোটা দেশের মাটি কেঁপে উঠেছে ৫ এপ্রিলের সমাবেশের তীব্র ঝাঁকুনিতে।সমাবেশ থেকে ঘোষিত হয়েছে, আদানি-আম্বানিদের সম্পদ বৃদ্ধি করার বিনিময়ে জনসাধারণের সম্পত্তি লুট করা যাবে না। নেতৃত্ব ঘোষণা করেছেন, ভারতের মাটি আদানি-আম্বানিদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত করতে দেওয়া যাবে না। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরের গগনভেদী স্লোগানে দিল্লি কেঁপে উঠেছে। হার না মানা মেহনতিরা ঘোষণা করেছেন - লড়াই হবে দীর্ঘস্থায়ী, মোদি সরকার নীতি বদল না করলে সংঘাত অনিবার্য।

এদিনের সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সিআইটিইউ সর্বভারতীয় সভানেত্রী কে হেমলতা বলেন, দেশের সম্পদ যাঁরা তৈরি করেন তাঁরাই আজ বিপন্ন। শ্রমিকের শ্রম লুট হচ্ছে। খাবার যাঁরা তৈরি করেন তাঁদের খাবার নেই। যাঁরা খেতে কাজ করেন সেই খেতমজুরদের জমি নেই। কিষান ফসলের দাম পান না আবার শ্রমিক বাজারে গেলে এত জিনিসের দাম তাঁদের নাগালের বাইরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আশা, মিড-ডে মিল সহ প্রকল্পকর্মীদের অবস্থা সঙ্গীন।

সমাবেশে সারা ভারত কৃষক সভার সর্বভারতীয় সভাপতি অশোক ধাওয়ালে বলেন, মোদি সরকার করপোরেটদের স্বার্থরক্ষাকারী। কৃষককে বাঁচাতে গেলে ফসলের সহায়ক মূল্যর সম্পর্কিত নির্দিষ্ট আইন চাই। তিনি স্মরণ করিয়ে দেন - কৃষি কমিশনের মূল সুপারিশ ছিল, কৃষির উৎপাদনের খরচের সঙ্গে অতিরিক্ত ৫০ শতাংশ যুক্ত করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা এবং সব শস্যের ক্ষেত্রেই তা চালু করা। ১০০ দিনের কাজের অধিকার আইনকে ২০০ দিনে পরিণত করতে হবে।অরণ্যোর অধিকার থেকে আদিবাসীদের বঞ্চিত করা যাবে না।

সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের সর্বভারতীয় সভাপতি এ বিজয়রাঘবন বলেন, আসলে দেশে বিজেপি শাসনে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। দেশে বেরোজগারি মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। মোদি সরকার সাম্প্রদায়িক বিভাজন করে গরিব মানুষের ঐক্য ভাঙতে চাইছে। কিন্তু জাতের লড়াই নয়, জিতবে ভাতের লড়াই। পরাস্ত হবে বিভাজনের লড়াই। তিনি বলেন, কেরালার বাম গণতান্ত্রিক সরকার বিকল্পের সন্ধান দিচ্ছে।

এদিনের সমাবেশে সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বি. ভেঙ্কট বলেন, আদানি-আম্বানি এক ডবল ইঞ্জিন। আর শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুররা ট্রিপল ইঞ্জিন। রেগা’কে তুলে দিতে চাইছেন মোদি। তাই ধারাবাহিকভাবে রেগার বরাদ্দ ছাঁটাই হচ্ছে। বিপন্ন খাদ্য নিরাপত্তা। উৎপাদকদের পেটে লাথি মারছে বিজেপি সরকার। উৎপাদকরা খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করলেও গণবণ্টন ব্যাবস্থায় গরিব মানুষের বরাদ্দ ছাঁটাই করে চলেছেন। দলিত আর তফসিলিদের উপর আক্রমণ বাড়ছে।

সারা ভারত কৃষক সভার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক বিজু কৃষ্ণান বলেন, কৃষক -খেতমজুররা আত্মঘাতী হচ্ছেন। কৃষিজ উপকরণের দাম বাড়ছে। ফলে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। কিন্তু অন্নদাতারা ফসলের দাম পাচ্ছেন না। মোদি সমগ্র অর্থনীতিকে করপোরেটের হাতে তুলে দিতে চাইছেন। নয়া-উদারবাদী নীতিসমূহের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক লড়াই চলছে। কৃষক-শ্রমিক সংগঠনগুলি নিরবচ্ছিন্ন লড়াই পরিচালনা করছে। বিভিন্ন কৃষক সংগঠনগুলিকে নিয়ে যৌথভাবে কৃষক আন্দোলনও পরিচালিত হচ্ছে। এর আগে ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর শ্রমিক-কৃষক র‌ালি হয়েছিল।

সিআইটইউ’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তপন সেন বলেন, অন্নদাতা-শ্রমজীবীদের ধারাবাহিক লড়াইকে আরও তীব্র করতে হবে। তিনি বলেন, আগামীদিনে ভূমিস্তরে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। শ্রমিক-কৃষক যৌথ আন্দোলনের উপরেই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। শ্রমিকের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে করপোরেট শোষণের পথকে মসৃণ করতে ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, ন্যূনতম মজুরি, কাজের অধিকারকে কেড়ে নিতে চারটি শ্রম কোড চালু করা হয়েছে। করপোরেট দখলদারি কখনই দেশপ্রেমিক মানুষ মানবেন না।

সমাবেশে বক্তব্যে রাখতে গিয়ে হান্নান মোল্লা বলেন, লড়াই ছাড়া বিকল্প রাস্তা নেই। এর জন্য প্রয়োজন সংগঠন।

সমাবেশ উপলক্ষে গঠিত অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক প্রভাত পট্টানায়েক বলেন, আজকের সমাবেশের মধ্যে দিয়েই মোদি সরকারের নৈতিক পরাজয় ঘটেছে। বিত্তশ্রেণিদের উপর ১ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ সম্পদ কর বসালে ভারতবাসীকে খাদ্যে নিরাপত্তা, বিনামূল্যেই শিক্ষা, বিনামূল্যে। চিকিৎসা, কমদামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, কাজের ব্যবস্থা করা সম্ভব। শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের দাবি দেশের মানুষের দাবি।

৫ এপ্রিলের সমাবেশ এক নতুন পথের সন্ধান দিল। এই সমাবেশ করপোরেট দখলদারির বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম চলছে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে। নেতৃত্বের বক্তব্যক থেকে এটা পরিষ্কার, সংযত অথচ অত্যসন্ত উদ্দীপনাসম্পন্ন এক অবস্থার মাঝে ভারতে শ্রমিক-কৃষকদের আন্দোলনের অগ্রগতি শুরু হয়েছে। আন্দোলনই পারে সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে আকেজো করে দিতে। নির্মোহ বাস্তবে আরও চেতনাদীপ্ত বিশ্বস্ত হয়ে মহতী লক্ষ্য সাধনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা ঘোষণা করেছে ৫ এপ্রিল। আগামীদিনে দেশজোড়া জঙ্গি আন্দোলন গড়ে তোলার শপথ উচ্চারিত হয়েছে দিল্লির রাজপথে।