৬০ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৭ এপ্রিল, ২০২৩ / ২৩ চৈত্র, ১৪২৯
পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত গণতান্ত্রিক কাঠামো তত্ত্ব ও তথ্য (ছয়)
ঈশিতা মুখার্জি
পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনায় এই সর্বশেষ পর্বে দেখে নেব কেমন আছেন গ্রামের মানুষজন? যে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের সূত্রপাত, কীভাবে বোঝা গেল যে সেই গণতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে? বোঝা যায় এই ধারণা থেকেই যে, গ্রামের মানুষ যখন ভালো থাকছে না, তখনো সেই একই নিয়মে পঞ্চায়েতের দুর্নীতি এবং মানুষকে বঞ্চনা করা অব্যাহত থাকছে। যদি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় থাকত, তাহলে তো এই অবস্থায় পঞ্চায়েত চলে যেত না। ২০১৮ সালের নির্বাচনের হিংসা প্রমাণ করছে যে কীভাবে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। ২০১৮ সালের হিংসা শুরু হয়েছিল পঞ্চায়েতে মনোনয়নপত্র পেশ করার সময় থেকেই। তৃণমূল কংগ্রেস ৩০,০০০ গ্রাম পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে। অন্য কোনো দলকে কার্যত মনোনয়নপত্র দিতে দেওয়া হয়নি। সব কটি সংবাদপত্র এবং গণমাধ্যম প্রায় একযোগে এই হিংসার কথা স্বীকার করে নিয়েছে। প্রশ্ন এখানেই, এত মরিয়া কেন হয়েছিল শাসকদল? এই মরিয়া হয়ে পঞ্চায়েত দখলে রাখার যে কারণগুলি সেদিন ছিল তা এইরকম।
প্রথম, পঞ্চায়েত গ্রামের মানুষকে জীবন-জীবিকা কোনভাবেই স্বস্তি দিতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে বেকারি চূড়ান্ত হারে বেড়ে গেছে ২০১১ সালের পর।বেকারের সংখ্যা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে গ্রাম থেকে দলে দলে মানুষ রাজ্য ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কোভিডের সময় দলে দলে মানুষের গ্রামে ফিরে আসা দেখে এই তথ্য প্রমাণিত হয়। যে জেলাগুলোতে বেকারি সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সেই জেলাগুলি হলো নদীয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, মালদা, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর দিনাজপুর। বেকারি বেড়েছে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও।
দ্বিতীয়, মানুষের হাতে আয় নেই।কৃষি ও গ্রামোন্নয়ন ব্যাঙ্ক দেশের রাজ্যগুলির কৃষকের আয় পরিমাপ করে ২০২২ সালে জানিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গে কৃষকের আয় সারা দেশের মধ্যে তলানিতে পৌঁছেছে। গ্রামে কৃষিজীবী পরিবারের গড় মাসিক আয় ৭৫৭৩ টাকা। এই রাজ্যের চেয়ে কম আর ৬টি রাজ্য রয়েছে। এটি গড় আয়। গ্রামে আর্থিক বৈষম্যও অত্যন্ত বেশি। কৃষিঋণের পরিমাণ এই রিপোর্ট অনুযায়ী এই রাজ্যে অনেক বেশি। কৃষিঋণ ছাড়াও গ্রামবাংলার মানুষ এ রাজ্যে ঋণগ্রস্ত অনেক বেশি ক্ষুদ্র ঋণসংস্থার কাছে। গ্রামে পরিবারগুলির মধ্যে ৫,০০০ টাকার কম আয় করছেন এমন পরিবারের সংখ্যা ৮২ শতাংশ। মাত্র ৬ শতাংশ পরিবার ১০,০০০ টাকার বেশি আয় করেন। তাহলে গ্রামে পরিবারগুলির মধ্যে আর্থিক বৈষম্য যে প্রকট তা বোঝা যায়। অক্সফোর্ডের মানোবন্নয়ন দপ্তরের দারিদ্র্য নিয়ে রিপোর্টে দেখা যায় যে, দরিদ্র গ্রাম ২০১৬ সালে যেরকম দরিদ্র ছিল ২০২২ সালেও তার কোনো উন্নতি হয়নি। গ্রামীণ পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় গ্রামের শিশুরা বিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, বিশেষকরে কোভিডের পরে। এ বছরেই আমরা দেখেছি মাধ্যমিক পরিক্ষার্থী কীভাবে কমে গেছে আমাদের রাজ্যে।
কৃষিজীবী মানুষের জন্য অকৃষি কাজের সুযোগ কমছে। চাষের খরচ বাড়ছে, বাড়ছে ঋণ, বাড়ছে দেনা, ফলনের দাম পাচ্ছে না কৃষক। কিছুদিন আগে আলুচাষিদের বিক্ষোভ সেই কথাই স্মরণ করিয়ে দিল। রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার জাতীয় ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরোকে দেওয়া তথ্যে জানিয়েছে যে, আমাদের রাজ্যে কোনো কৃষক আত্মহত্যা ঘটেনি। যদিও এ বাংলার মানুষ জানে যে, এই তথ্য অসত্য, তবু সেই কথা প্রমাণ করার জন্য তথ্যের অধিকার আইনে প্রশ্ন করেছিলেন কেউ। তাতে জানা যায় যে, শুধুমাত্র ২০২১ সালে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় ১২২ জন কৃষক আত্মহত্যা করেন। পশ্চিমবঙ্গে আত্মহত্যার সংখ্যা সারা দেশে চতুর্থতম। এর মধ্যে বেশিরভাগ আত্মহত্যা হয়েছে গ্রামবাংলায়।
যে প্রসঙ্গ দিয়ে আলোচনা শুরু করেছিলাম, সেই প্রসঙ্গে ফিরে যাই। কেন পঞ্চায়েত ভোটে এই হিংসা সংঘটিত হলো? কেন পঞ্চায়েত দখল করতে তৃণমূল কংগ্রেস মরিয়া হয়ে উঠেছিল? তার কারণ পাওয়া যায়, যদি তৃণমূল কংগ্রেস পঞ্চায়েতের সদস্যদের বা তৃণমূল কংগ্রেসের গ্রামবাংলার বিধায়কদের অপরাধের ইতিহাস দেখি। দুর্নীতি এদের পেশা। গ্রামবাংলাকে ঘিরে গোরুপাচার, বালিপাচার, কয়লা পাচারের কর্মকাণ্ড রমরমা করে তুলেছে ২০১১ সাল থেকেই। পঞ্চায়েত কেন কোনো ভোট হোক তা চায় না তৃণমূল কংগ্রেস। কিন্তু ভোট ঘোষণা করতে যখন তারা বাধ্য হলো, তখন গ্রামবাংলা দখলে রাখার মরিয়া প্রচেষ্টা তারা করল। এই কারণেই এত হিংসার বাতাবরণ তৈরি হলো।তৃণমূল কংগ্রেস দলের নেতা নেত্রীদের গড় সম্পদ রাজ্যের মানুষের গড় সম্পদের চেয়ে বেশি যে সব জেলায় সেগুলি হলো দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, পশ্চিম বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ এবং কোচবিহার। দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা নেত্রীদের দলীয় নির্বাচনে টিকিট দেওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। আবারও সেই বালিপাচার, কয়লা পাচার, গোরু পাচারের চক্র সহ নানা অপরাধ চক্রের অপরাধীরাই ২০২১ সালে নির্বাচনে দাঁড়ালেন। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবার সময়ে তাঁরা যে হলফনামা দিয়েছিলেন, সেই হলফনামা অনুযায়ী তথ্য জানাচ্ছে যে, মুর্শিদাবাদ, পূর্ব এবং পশ্চিম বর্ধমান, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বীরভূম, পুর্ব মেদিনীপুর জুড়ে এই অপরাধীদের রাজত্ব। এই অপরাধের রাজত্ব বজায় রাখার জন্য, এই দুর্নীতির আখড়া চালানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। তাই ২০১৯ সালে এই হিংসার বলি হলো গ্রামের মানুষ।
গ্রামের উন্নয়ন নয়, পঞ্চায়েতকে ব্যবহার করে গ্রাম লুঠ এই লুঠ পুরোমাত্রায় আর্থিক। ঠিক এই কারণেই দিনে দিনে আর্থিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে গ্রামবাংলার মানুষ।
আমাদের রাজ্যে পঞ্চায়েত পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে বামফ্রন্টের সময়ে। কিন্তু বর্তমানে বহু রাজ্যে বিজেপি চালিত পঞ্চায়েত রয়েছে। ২০২১ সালে উত্তর প্রদেশের গ্রামের মানুষ বিজেপি-কে পঞ্চায়েত ভোটে পরাস্ত করে এই কারণে যে, বিজেপি গ্রামোন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেয় না। মহারাষ্ট্রে বিজেপি পঞ্চায়েতের বিরুদ্ধে লুঠ এবং দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।একটি রাজ্যেও বিজেপি কোনো বিকেন্দ্রীভূত পঞ্চায়েত পরিচালনার দিশা দেখাতে পারেনি। পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরের গুরুত্ব কমিয়ে দিয়ে পঞ্চায়েতকে শাসনের জায়গায় লুঠের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছে বিজেপি চালিত পঞ্চায়েত অন্যান্য রাজ্যে।
বামপন্থীদের মডেল একমাত্র মানুষের অংশগ্রহণে মানুষের পঞ্চায়েত গঠনের কথা বলে। সেই মডেলেই একমাত্র মানুষের জীবন-জীবিকার গুরুত্ব আছে। সেই মডেলেই মানুষের পঞ্চায়েতের পুনর্জন্ম সম্ভব এই রাজ্যে।
(সমাপ্ত)