৬০ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৭ এপ্রিল, ২০২৩ / ২৩ চৈত্র, ১৪২৯
সন্ত্রাস দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ার প্রস্তুতি চলছে
সন্দীপ দে
এক সময়ে হিংসা-সন্ত্রাসে দীর্ণ পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় আজ প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর ক্রমশ বাঙ্ময় হয়ে উঠছে। নন্দীগ্রামের সোনাচূড়া, সামসাবাদ, আবার খেজুরির বারাতলা অথবা অন্যদিকে পাঁশকুড়ার কেশাপাট, তমলুকের শান্তিপুর ১ পঞ্চায়েতের মতো - প্রায় সর্বত্রই মানুষের প্রতিবাদের ভাষায় আজ যেন বড়োই মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। কোনো রাখঢাক করে নয়, প্রকাশ্যেই তাঁরা শাসকদলের দুর্নীতি-লুট, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন। একটা সময়ে নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে তৃণমূল কংগ্রেসের হিংসা-সন্ত্রাসের যে ভয়ঙ্কর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা এখন প্রায় স্তিমিত। এই পালটে যাবার দৃশ্য এখন স্পষ্টতই চোখে পড়বে গোটা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রায় সর্বত্র। মানুষের বুকের গভীরে জমে থাকা বহুদিনের ক্ষোভ-বঞ্চনা আর অত্যাচারের ক্ষতকে লড়াইয়ের ভাষায় রূপান্তরিত করছে লালঝান্ডা।
অনেক ষড়যন্ত্র ও মিথ্যার জাল বুনে, বীভৎস হিংসা-অত্যাচার আর সীমাহীন অরাজকতার যে বীজ বোনা হয়েছিল নন্দীগ্রামে, সেগুলিই পরে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল গোটা জেলায় এবং রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তে। এভাবেই অগণিত বামপন্থী নেতা-কর্মীর রক্তসিক্ত পথেই রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। তারপর এই জেলায় চরম সন্ত্রাসের আবহ রচনা করে নিদান হেঁকে ছিলেন তৎকালীন তৃণমূলী সন্ত্রাসের অন্যতম নায়ক ও বর্তমানে নানা অপরাধ ঢাকতে বিজেপি'তে আশ্রয় নেওয়া শুভেন্দু অধিকারী - ‘জেলার কোথাও লালঝান্ডা উড়বে না’! আর আজ! শুধু নন্দীগ্রাম কেন, গোটা জেলায় লাল ঝান্ডার দৃপ্ত উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, সরকারের অপশাসন, দুর্নীতি, শাসকদলের দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে এবং সাম্প্রদায়িক বিজেপি'র বিভেদের রাজনীতিকে রুখে দিয়ে গণতন্ত্র আর মানুষের অধিকার যুঝে নেবার প্রস্তুতি চলছে জোরালোভাবেই।
২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক দলের সীমাহীন দৌরাত্ম্য ও হিংসায় যেভাবে কলঙ্কিত হয়েছিল রাজ্য, তার গভীর ক্ষত আজও রয়ে গেছে এই জেলাতেও। এই অবস্থা যাতে কিছুতেই ফিরে আসতে না পারে তার জন্য তৈরি হচ্ছেন গাঁয়ের মানুষও।
উন্নয়নের বদলে দুর্নীতি ও লুট
রাজ্যপাটে বসে মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর তৎকালীন অনুগত শাগরেদ শুভেন্দু অধিকারী নন্দীগ্রামকে ঘিরে প্রতিশ্রুতির একেবারে বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন। আর এখন সব জায়গায় কান পাতলেই শোনা যাবে শাসকদলের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি-কেলেঙ্কারির নানা ঘটনা। সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে একশো দিনের কাজে এবং ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে। তবে পঞ্চায়েতের অন্যান্য প্রকল্পে চুরি তো আছেই। নন্দীগ্রামে দুটো ব্লক (নন্দীগ্রাম ১ ও নন্দীগ্রাম ২), গ্রাম পঞ্চায়েত যথাক্রমে ১০ ও ৭ মোট ১৭টি। এখানকার মানুষের অভিযোগ, সমস্ত পঞ্চায়েতে একশো দিনের কাজে ভুয়ো মাস্টার রোল তৈরি করে কোটি কোটি টাকা লুট করেছে শাসক দলের মাতব্বররা। ওরা পরিত্যক্ত জেলিংহাম কারাখানার যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র কোটি কোটি টাকায় বিক্রি করে দিয়েছে। বয়াল ১ নং গ্রাম পঞ্চায়েতে হিজলি টাইডাল ক্যানেল পাড়ের মাটিও বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা গায়েব করেছে এরা। আবার খোদামবাড়ি পঞ্চায়েতে জাল মাস্টার রোল তৈরি করে রেগার টাকা লুটের ঘটনায় হাইকোর্টে জনস্বার্থে মামলাও হয়েছে। এছাড়াও নন্দীগ্রামে আরেকটি বড়ো দুর্নীতির হলো, সরকারি গাছ কেটে বিক্রি করে সেই টাকা দলীয় তহবিলে এবং নিজেদের পকেটে পুরেছে শাসক দলের স্থানীয় নেতারা।
শাসক দল যে আগাপাশতলা শুধু দুর্নীতিগ্রস্তই নয়, এরা কতটা নিষ্ঠুর এবং অমানবিক তা আবারও স্পষ্ট হলো অনেকের সঙ্গে কথা বলে! আমফান ঝড়ের দাপটে গোটা জেলা জুড়েই বিস্তর ক্ষতি হয়েছিল। নন্দীগ্রামের বিপুল অংশের মানুষও এই ঝড়ের অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপন্ন হয়েছিলেন। তখন ছিল ভয়াবহ কোভিডকাল। সেই দুর্যোগের সময়েও শাসক দল অসহায় মানুষদের পাশে না দাঁড়িয়ে তাদের ত্রাণ সামগ্রী বিশেষকরে চাল, ত্রিপল ও অন্যান্য সামগ্রী লুট করেছে। অথচ নন্দীগ্রামের মানুষের অভিজ্ঞতায় রয়েছে, শুধু আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাধ্যমতো সাহায্য করাই নয়, ঝড়ের আগে কোভিডের ভয়ঙ্কর সংক্রমণ রুখতে নন্দীগ্রামেও বামপন্থী ছাত্র-যুবরা রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তের মতো রেড ভলান্টিয়ার গড়ে আক্রান্ত, বিপন্ন ও অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। সাধ্য ছিল সীমিত, কিন্তু দুর্নিবার সাহস ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তখন নানাভাবে তৎপর ছিলেন রেড ভলান্টিয়াররা।
এ নিয়ে পার্টি নেতা মহাদেব ভূইয়ার কথায় অবাক হতে হলো। তাঁর কথায় জানা গেল, করোনার সময়ে পঞ্চায়েত বা শাসকদল সাহায্য করবে কী, উলটে ওরা অবৈজ্ঞানিক ধারণার বশবর্তী হয়ে রেড ভলান্টিয়ারদের কাজ করতে বাধা দিয়েছে! আবার এরাই দাউদপুর অঞ্চলে আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের বিভিন্ন গণসংগঠনের দেওয়া ত্রাণ যখন বামপন্থীকর্মীরা পৌঁছে দিতে গেছেন, তা লুট করে নিয়েছে। এদের এই সমস্ত অপকীর্তির জবাব দিতে মানুষও তৈরি হচ্ছেন।
নন্দীগ্রামের সামসাবাদ অঞ্চলের কিছু মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল একশো দিনের কাজ নিয়ে। জানা গেল পুকুর কাটার নামে টাকা স্থানীয় নেতাদের পকেটে গেছে! কিন্তু যে জমিতে পুকুর কাটা দেখানো হয়েছে তার মালিক কিছুই জানেন না এবং বাস্তবে পুকুর কাটাও হয়নি। আবার যারা আগে রেগার কিছু কাজ করেছিলেন, তাঁদের মজুরিও মেলেনি।
একই অবস্থা ইন্দিরা আবাস প্রকল্পে ঘর পাওয়া নিয়েও। এ নিয়ে যে কী পরিমাণ দুর্নীতি হয়েছে, তা এখানে না এলে অনুমান করা যেত না। ইন্দিরা আবাসের ঘর করে দেবার নাম করে একেক জনের কাছ থেকে ২০/২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়েছে, কিন্তু কারো ঘর মেলেনি। পশ্চিম সামসাবাদের ১৯৭ নং বুথের সেখ সেলিম।দিন মজুরি করে কোনোভাবে দিন গুজরান হয় তার। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে মাথার উপর ত্রিপল এবং খড় ও বাঁশের চাটাই দেওয়া ঘরে নিদারুণ কষ্টে চলছে তাঁর দিন যাপন। প্রায় একই অবস্থা সামসাবাদ কুলসুমিয়া গ্রামের ক্ষুদ্র দর্জি শ্রমিক সেখ মহিদুল ইসলামের হাল। মুলি বাঁশের ভাঙা দরমা ঘেরা জরাজীর্ণ বাড়ির বাসিন্দা মহিদুলের কাছেও কাটমানি হিসেবে চাওয়া হয়েছিল বিশ হাজার টাকা। কিন্তু স্বভাবিকভাবেই সে টাকা দিতে না পারায় তাঁর ঘর মেলেনি। কাঞ্চননগরে ২০২ নং বুথ অঞ্চলের রীনা খাতুন। এই দরিদ্র বিধবা মহিলা একটি অপরিসর ভাঙাচোরা মাটির বাড়িতে খুবই কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। অনেক চেষ্টা করেছেন ঘর পাবার জন্য। কিন্তু ঘর পাননি। গোটা নন্দীগ্রামে এমন হত দরিদ্র প্রায় ৭০ জনের নামের তালিকা তাদের জীর্ণ-ভাঙা বাসস্থানের ছবি সহ বিডিওকে স্মারকলিপি আকারে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কোনো সুরাহা মেলেনি। স্থানীয় মানুষরাই বলছেন, এই সব বিশাল দুর্নীতিতে কেবল পঞ্চায়েত সদস্যরাই নন, জড়িয়ে আছেন আমলারাও। তাই বিডিও’র কাছে বার বার ডেপুটেশন দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। ধানের ন্যূনতম সহয়ক মূল্যের জন্য প্রশাসনের তরফে অনলাইন ব্যবস্থাপনার অনেক হাঁকডাক হয়েছিল। কিন্তু গাঁয়ের গরিব চাষিদের কোনো সুরাহা হয়নি। মাঝখান থেকে ফয়দা লুটেছে তৃণমূল আশ্রিত ফড়েরা।
গ্রামের গরিব দুঃস্থ বঞ্চিত মানুষদের যখন এভাবেই কষ্ট যন্ত্রণার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে, তখন তৃণমূল নেতা আবু সুফিয়ানের ‘জাহাজ বাড়ি’, আগের তৃণমূল নেতা ও এখন শুভেন্দু অধিকারীর অনুচর মেঘনাদ পালের প্রাসাদপম বাড়িতে সুইমিং পুল অথবা সোনাচূড়ায় ‘শহিদ মিনার’-এর নামে গগনচুম্বী সৌধ নন্দীগ্রামের বহু বিজ্ঞাপিত ‘উন্নয়ন’কে যেন আজ তীব্র পরিহাস করছে!
খেজুরিতে হিংসা ও লুটের কারবার
নন্দীগ্রামের মতো খেজুরিকেও মারাত্মকভাবে সন্ত্রস্ত করে কার্যত একেবারে কবজা করে রেখেছিল শাসকদল। আর তার মধ্যদিয়েই ওদের মাত্রাছাড়া দুর্নীতি আর লুটের রাজত্ব চালাতে সুবিধা হয়েছে। এখানেও চুরি হয়েছে সর্বত্র। গরিব মানুষদের মাটির বাড়ি পাকা করে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেছে।কিন্তু কারও ঘর জোটেনি। অন্যদিকে বাম সমর্থক হবার জন্য একেবারে চাল চুলোহীন গরিব মানুষদেরও নাম আবাস যোজনার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আর রেগার কাজে যাদের জব কার্ড আছে তাদের কার্ডগুলো নিয়ে কোনো কাজ না করিয়েও তাদের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকিয়ে সেই টাকার সামান্য দিয়ে বাকি টাকা স্থানীয় তৃণমূলের কেষ্টবিষ্টুরা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব দুর্নীতির অভিযোগ জানাতে স্থানীয় বিডিও থেকে এসডিও, এমনকী ডিএম'র কাছেও ডেপুটেশন দিয়েছেন গ্রামের মানুষ। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিস্তর ক্ষোভ জমা হয়েছে। তাই এলাকায় এসে 'দিদির দূত' তন্ময় ঘোষকে প্রবল বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে। তাই এখানেও শাসকদলের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করেই মানুষের প্রতিবাদের স্বর ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে।
বঞ্চিত গরিব মানুষ
পাঁশকুড়া ১ ব্লকের কেশাপাট গ্রাম পঞ্চায়েতের ছবিও প্রায় একই। গায়ের জোরে পঞ্চায়েত দখল করার পর থেকেই চলছে লুটের কারবার। উন্নয়নের কোনো কাজই হচ্ছেনা। তবে এখন এই অঞ্চলে মানুষের ক্ষোভ ও প্রতিবাদে অবস্থা অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। সম্প্রতি পাঁশকুড়ার যশোড়া সমবায়ে বাম ও প্রগতিশীল প্রার্থীদের জয়ে তার আভাস মিলেছে। এখানে হাতিশাল এলাকায় এসে দিনমজুর মধুসূদন দোলই, সঞ্জয় হেমব্রম, কৃষ্ট দাস, সুস্মিতা দোলই, সরস্বতী ভৌমিকদের দুঃখের রোজনামচা শোনার অভিজ্ঞতা হলো। তাঁরা প্রত্যকেই তাঁদের জরাজীর্ণ ঘরদোর দেখালেন। প্রত্যেকেই জানালেন পঞ্চায়েতের কোনো সুবিধাই পাননি। একশো দিনের কাজ যেটুকু করার সুযোগ তাঁরা পেয়েছিলেন তারও মজুরি পাননি। আবার এই পঞ্চায়েতেরই জিয়াখালিতে এসে জানা গেল এখানে বেশিরভাগ মানুষই নাকি বাম সমর্থক। তাই গরিব মানুষগুলোকে বঞ্চিত করে নিজেদের সম্পদ ক্রমাগত বাড়িয়েছেন গ্রাম প্রধান দিলীপ সাঁতরা সহ শাসকদলের স্থানীয় মাতব্বররা।
বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ
পঞ্চায়েতে শাসক দলের সীমাহীন লুট, দুর্নীতি, অপশাসন আর নিদারুণ বঞ্চনা মানুষের জ্বালা-যন্ত্রণা আর ক্ষোভকে কোন মাত্রায় নিয়ে পারে তা প্রত্যক্ষ করা গেল তমলুক বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত শান্তিপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এসে। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এই পঞ্চায়েত পরিচালনা করেছে বামফ্রন্ট। পরে এই পঞ্চায়েতটি পেশিশক্তির জোরে দখল নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। আর তখন থেকেই স্তব্ধ উন্নয়ন, লুটের শুরু। এই পঞ্চায়েতের শান্তিপুর দক্ষিণপাড়ায় এসে পঞ্চায়েতের হালহকিকত জানতে চাওয়ায় স্থানীয় শুকদেব বেরা, নিয়তি চক্রবর্তী, জয়দেব মান্নারা নিয়ে গেলেন কাছেই আইসিডিএস সেন্টারের সামনে। দেখা গেল চৈত্রের সামান্য অকাল বর্ষণেও অঞ্চল ডুবে আছে। রাস্তার দুপাশ ঢেকে আছে কচুরিপানায়। আইসিডিএস সেন্টারে ঢোকাও সমস্যা। দরজার সামনেই জল। চারদিক আগাছায় ভরতি। ভেতরটাও অস্বাস্থ্যকর। জানা গেল এখানে ৬৩টি বাচ্চাকে মায়েরা নিয়ে আসেন। সেখানেই রান্না হয়, আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষাও হয়। কিন্তু রোজ এই সেন্টার খোলা হয়না। একজন দিদিমণি দু'জায়গায় সেন্টার চালান। আরেকজন মহিলা আছেন রান্নার দায়িত্বে। এই রাস্তা ধরে এগোলে জলা জঙ্গল। শুধু যে সেদিনের অকাল বৃষ্টিতেই জলে ঢেকেছে রাস্তার নানা দিক তা নয়, এই অবস্থা বছরের বেশিরভাগ সময়েরই। এই জল মাড়িয়েই এলাকার মানুষজনকে এবং প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চাদের যাতায়াত করতে হয়। বার বার পঞ্চায়েতে, বিডিওকে জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি। এখানেই সদ্য নির্মিত একটি ড্রেনের অবস্থা দেখালেন সোমনাথ ও চণ্ডী মান্নারা। কাজ হয়েছে বলে দু’লক্ষ টাকার প্রকল্পের কংক্রিটের বোর্ড বসে গেছে। কিন্তু দেখা গেল ড্রেন তৈরির মান এতটাই দুর্বল যে কিছুদূর এগোনোর পরই তা ভঙে হেলে পড়ে আছে। তাছাড়া ড্রেনটিও যতোটা বানানোর কথা তা হয়নি। কিন্তু পুরো দু’লক্ষ টাকাই তুলে নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া এখানে একশো দিনের কাজ ও আবাস প্রকল্প নিয়ে অভিযোগের শেষ নেই। জন্মগত প্রতিবন্ধী রাজু হাজরা, ভ্যান চালক মন্টু হাজরা, বাড়ির কাজে যুক্ত রোমিলাদি সকলেই জানালেন তাঁদের দুঃস্থ অবস্থার কথা। আমফান ঝড়ে এলাকায় বিপুল ক্ষতি হয়েছিল। অসংখ্য গরিব মানুষের ঘরবাড়ি ভঙেছিল। কিন্তু পঞ্চায়েতের কোনো সাহায্যই আসেনি, ঘরও মেলেনি। একশো দিনের কাজও প্রায় পাননি কেউই। আরও আশ্চর্যের বিষয়, এখানে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পানীয় জল সরবরাহের কোনো উদ্যোগই নেই পঞ্চায়েতের। এলাকার মানুষ নিজেরাই চাঁদা তুলে সাবমার্সিবল পাম্প বসিয়ে খাবার জলের ব্যবস্থা করেছেন।
সকলেরই একই বক্তব্য, কেবল বামফ্রন্টের বোর্ডের সময়েই নয়, পরে সঞ্জীব আচার্য যতদিন সিপিআই(এম)'র পঞ্চায়েত সদস্য ছিলেন, ততদিন এলাকার অনেক উন্নয়নের কাজ হয়েছিল। আর এখন শুধু লুট আর বঞ্চনা। এদিকে পঞ্চায়েত প্রধান সেখ সেলিম এবং ব্লক সভাপতি দিবাকর জানা নানা অপকীর্তিতে এখন তমলুক জেলে। উপপ্রধানের বিপুল সম্পত্তির বহর (তিনটি বিশালাকায় বাড়ি সহ) নিয়ে এলাকায় সবার মুখে মুখে সরস আলোচনা চলছে। তৃণমূলের জমানায় গোটা জেলাজুড়েই এই চিত্র এখন চোখে পড়বে। সবার এখন একটাই প্রত্যাশা এবারে কোনোভাবেই আর ২০১৮ -র সন্ত্রাসের পরিবেশকে ফিরিয়ে আনতে দেওয়া যাবেনা। তাই সমস্ত সন্ত্রাস-অপশাসনকে প্রতিহত করে এখন বুথে বুথে চলছে সংগ্রামী দুর্গ গড়ার কাজ।
লক্ষ্য মানুষের পঞ্চায়েত গড়া
আর শাসকদলের রক্তচক্ষু ও সন্ত্রাসে পিছু হটা নয়, ভয়-সন্ত্রাসকে প্রতিহত করে আরও কঠিন লড়াইয়ের প্রত্যয় নিয়ে এখন প্রতিবাদী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। ইতিমধ্যে মানুষের দাবি দাওয়া নিয়ে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে অসংখ্য মিছিল, বিক্ষোভ আর সমাবেশে রক্ত পতাকা হাতে অকুতোভয় অগণিত মানুষ পথে নেমেছেন। আগামী ১০ এপ্রিল বামফ্রন্টের ডাকে তৃণমূলের এই সমস্ত দুর্নীতি -অপশাসনের বিরুদ্ধে নিমতৌড়ীতে জেলা শাসকের দপ্তর অভিযানে এই প্রতিবাদী মানুষেরাই আসবেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে তাই এখন লালঝান্ডার সমস্ত প্রতিবাদী মিছিল-সমাবেশে প্রত্যয় দৃপ্ত মানুষের উপস্থিতি নতুন সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।