৬০ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৭ এপ্রিল, ২০২৩ / ২৩ চৈত্র, ১৪২৯
ক্ষমতায়ন-অধিকার
চলুক ফিরে পাওয়ার লড়াই
কনীনিকা ঘোষ
গ্রামের সরকার, মানুষের সরকার - বামফ্রন্টের সময় পঞ্চায়েত মানে মানুষ তাই জানত। আজ যখন আকাশ ঢেকে যাওয়া বিজ্ঞাপনে আর প্রচারে উন্নয়নের কাণ্ডারি মাননীয়া ঘোষণা করছেন একের পর এক প্রকল্প, আর অনেক ক্ষেত্রেই তাঁর টার্গেট থাকছেন মহিলারা, তখন মহিলাদের অধিকার ক্ষমতায়ন এ প্রশ্নে মাথা চুলকে অনেক বিশেষজ্ঞ(!)ই সেই গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসাচ্ছেন যে, মহিলাদের অনেক উন্নয়ন হয়েছে - অধিকারের ভিত্তিতে ক্ষমতায়নে তারা আমাদের রাজ্যে এক নজির তৈরি করেছেন। সত্যিই কি তাই! কিছু বিষয় পূর্বের প্রতিপাদ্য আলোচনা করলেই আমরা আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি তা পরিষ্কার হবে।
৭৭’-পূর্ব গ্রামের জীবনঃ ‘‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে’’... কবির এ কবিতার লাইন ছিল গ্রাম জীবনের প্রতিচ্ছবি। গোরু চরাতে হাতে ছপটি নিয়ে এই হেট হেট করতে করতে ছোটো ছোটো বাচ্ছারা গোরুর পাল নিয়ে মাঠে যাচ্ছে এ হামেশাই দেখা যেত। গ্রামের পথ দিয়ে জমিদার কখনো হেঁটে গেলে সে পথে চাষি তথা প্রজাদের পা রাখা ছিল নিষিদ্ধ। ‘‘মন্বন্তরে মরেছি আমরা/ মারী নিয়ে ঘর করি’’ - এ ছিল গ্রামজীবনের মর্মবাণী। স্বাভাবিকভাবেই কাজের অভাবে, মজুরির অভাবে ধুঁকতে থাকা চাষি পরিবার ভাতের মাড়, মাইলো খেয়ে জীবন ধারণ করছে - এ ছবি গ্রামে দুর্লভ ছিল না। ছোটো ছেলেটার হাত ধরে আর গোপনে চোখের জল ফেলতে ফেলতে ভাতের অভাবে বাবুর বাড়ি দিয়ে আসত চাষি পরিবার, আর সেই ছেলেই সকালে কাজ সেরে এক মুঠো পান্তা পেয়েছে কি পায়নি বেরিয়ে পড়ত গোরু চরাতে - হ্যাঁ, এই ছিল সেদিনের গ্রাম। নির্বাচন হয়নি দীর্ঘদিন। ১৯৬৯ সালে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়। তারপর কোপ পড়ে অঞ্চল পঞ্চায়েত ও গ্রাম পঞ্চায়েতের ওপর। ফলে এই সময় পঞ্চায়েত ছিল বাস্তুঘুঘুর বাসা। শুধু জমিদার বা তার পরিবারের না, জমি ছিল তাদের পোষ্য কুকুর, বেড়ালেরও নামে।
১৯৭৭ - তারপরঃ ১৯৭৭-এ প্রতিষ্ঠা হলো দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের ফসল বামফ্রন্ট সরকার। মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু প্রথমদিনই ঘোষণা করলেন, তাঁদের সরকার শুধুমাত্র রাইটার্স বিল্ডিং থেকে পরিচালিত হবে না, পরিচালিত হবে গ্রাম-গ্রামান্তর থেকে, শহরের দূরতম প্রান্তর থেকে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই রাজ্য বাজেটের টাকা বরাদ্দ হলো পঞ্চায়েত-পৌরসভার ক্ষেত্রে। জাগানোর ব্যবস্থা হলো গ্রাম-শহরকে, কায়েমি স্বার্থের পঞ্চায়েতের পরিবর্তে আইন সংশোধন করে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা ১৯৭৮ সালের নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে প্রবর্তিত হলো। পরবর্তীকালে ৭৩তম সংবিধান সংশোধনের মধ্যে দিয়ে দেশে ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার আইন প্রবর্তিত হয়। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র (participatory democracy) রাষ্ট্র বিজ্ঞানের বইয়ের পাতা থেকে নেমে আসে মানুষের কাছে, মানুষের স্বার্থে। গ্রামীণ জনগণের স্বার্থরক্ষায় পঞ্চায়েত আইনকে বামফ্রন্ট সংশোধন করে ১৯৮৫, ১৯৮৮, ১৯৯৩, ২০০৩ সালে। ১৯৯৩ সালে বামফ্রন্ট সরকার সর্বপ্রথম আইন সংশোধন করে ৩৩ শতাংশ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত করে। বামফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সংরক্ষণের অনেক বেশি আসনে মহিলারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। ১৯৭৮ সালে যখন সংরক্ষণ ছিল না তখনই মহিলাদের জন্যে সর্বস্তরে দুজন করে মনোনীত সদস্যের ব্যবস্থা করা হয়।
যারা ছিল অবহেলিত - শুধুই হুকুম তামিল করা সেই মহিলারা উঠে এলো সামনে, আলাদা করে লিলি হেমব্রম, তাপসী মুন্ডা, সীমা ঘোষ, রীনা হীরা, মিলি সরেনদের পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হলো। মানুষ জানল পঞ্চায়েতের দিদিদের। সুযোগ পেলে মেয়েরা সফলতার সাথে মানুষের কাজে অংশ নিতে পারে, প্রশাসন পরিচালনা করতে পারে তা প্রমাণিত হলো। মহিলাদের সামনে আনার লক্ষ্যে তাদের ক্ষমতায়নের জন্য আর্থিক স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার জন্য বামফ্রন্ট সরকার একের পর এক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ২০০১ সালে প্রথমে ৩ লক্ষ মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে বামফ্রন্ট সরকার, পরে তা বেড়ে ১০ লক্ষে পৌঁছায়। আলাদা দপ্তর গঠন করা হয় স্বনির্ভর গোষ্ঠীর জন্য, আর উৎপাদিত পণ্য বিক্রির লক্ষ্যে গঠন করা হয় স্বরোজগার করপোরেশন। না, আজকের মতো শুধু ঋণ দেওয়া নেওয়ার জন্য গোষ্ঠী আর তার ফাঁক দিয়ে এমএফআই-এর ঢুকে পড়া না, স্বনির্ভর গোষ্ঠী ছিল প্রকৃত অর্থেই স্বনির্ভরতার জন্যে। একইসাথে মর্যাদার জন্য, মানুষ হিসাবে অধিকারকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার জন্যই সামাজিক ক্ষেত্রে পিতামাতা যৌথ অভিভাবকত্ব অধিকারের স্বীকৃতি চালু করা হয়। আজ এতদিন চলার পরে তা স্বাভাবিক মনে হয়, কিন্তু সেদিন এ বিষয় প্রতিষ্ঠা করা সহজ ছিল না। এখানেই স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি - যাতে বামফ্রন্ট ছিল অগ্রগণ্য।
সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার তাদের বিধানসভার শেষ অধিবেশনে ৫০ ভাগ আসন মহিলাদের জন্য সংরক্ষণ করে জনসংখ্যার অর্ধেক মহিলা তাই অর্ধেক আকাশ তারা থাকুক, নজর ছিল সেদিকে। তাই বামফ্রন্ট বলেছিল ন্যূনতম ৫০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের কথা। কিন্তু আজকের তৃণমূল বলেছে ৫০ ভাগের বেশি মহিলা নয়। স্বাভাবিকভাবেই এতে মহিলা আসন প্রকৃতপক্ষে কমবে। বামফ্রন্টের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অধিকার-মর্যাদা, আর এখন প্রকল্পভিত্তিক উন্নয়নের কথা বলে যেন ‘দয়ার দান’ দিচ্ছে সরকার - এরকম মনোভাব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু কার টাকা কে দেয়? টাকা তো মানুষের, সেই টাকাই তো সরকার দিচ্ছে, কিন্তু একের পর এক নতুন প্রকল্পের নামের আড়ালে আসলে যে প্রকল্পগুলো চালু ছিল তা স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনাই হোক বা ইন্দিরা আবাস যোজনা অথবা প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা সেইগুলোর অবস্থা কী? তাকেই নতুন মোড়কে পরিবেশন করা হচ্ছে কিনা তা গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বামফ্রন্ট সরকার তো শুধু রিলিফ দেয়নি, বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনার অন্তর্গত হয়ে সমগ্র গ্রামীণ ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজিয়েছিল। তার মাধ্যমেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে মহিলাদের এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছিল।
আজ লুট-লুট-লুটের পঞ্চায়েতঃ ২০১১-পরবর্তী সময়ে মূল্যবোধের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে ‘আমরা’র থেকে ‘আমি’তে আনছে সরকার। স্বভাবতই সমষ্টিগত অংশগ্রহণে যা জোয়ার এনেছিল তা আজ অনুপস্থিত। দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক স্থাপন করা হচ্ছে সরকারের সঙ্গে মানুষের। ব্যক্তিগত উপভোক্তা, শাসকদলের প্রতি আনুগত্যের বিনিময়ে তা তার কাছে পৌঁছাবে এরকম জায়গা তৈরি হচ্ছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি, লুট, তোলাবাজ আজ নিয়মে পরিণত হয়েছে। রেগার মজুরি থেকে আবাস প্রতিটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি, বঞ্চনা। সমস্ত ক্ষেত্রে যুক্ত শাসকদলের কেষ্টবিষ্টুরা। নিয়োগ দুর্নীতি আজ নজিরবিহীন রূপ নিয়েছে। সবই মানুষ দেখছেন। শিক্ষায় মধ্যমিকে কমেছে ৪ লক্ষ ছাত্রছাত্রী। স্কুলছুট বাড়ছে প্রতিদিন, সেখানে বড়ো অংশ ছাত্রী। স্বাস্থ্যে নীল-সাদা রঙের আড়ালে অবহেলিত হচ্ছে জনস্বাস্থ্য। এর বীভৎস প্রমাণ আমরা দেখেছি কোভিডে, দেখছি অ্যাডিনো ভাইরাসে একের পর এক শিশুর মৃত্যুতে। পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন, অথচ নাবালিকা বিয়ের শীর্ষে পশ্চিমবঙ্গ। ‘এগিয়ে বাংলা’র বিজ্ঞাপনে মহিলা নির্যাতন-ধর্ষণ হিংসায় এগিয়ে বাংলা - এ লজ্জা আমরা রাখব কোথায়?
তাই গ্রাম আজ পালটে ফেলার-বদলে দেওয়ার। দেশের গণতন্ত্রকে পায়ের তলায় পিষে দিচ্ছে বিজেপি-আরএসএস। আর রাজ্যেও গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলোকেই নষ্ট করছে তৃণমূলও। তাই তো আজ লড়াই বিকল্প প্রতিষ্ঠার, লড়াই জাত-ধর্ম-পুরুষ-মহিলা সকলে মিলে নতুন করে মানুষের অধিকার ফিরে পাওয়ার, মর্যাদা প্রতাষ্ঠার। এই লড়াই আপনার লড়াই-আমার লড়াই, আমাদের সবার লড়াই একাজ করতে পারে একমাত্র বামপন্থীরাই। তাই পরিধিকে আরও অনেক বড়ো করে বিজেপি-তৃণমুল বিরোধী শক্তিকে সমবেত করে গড়ে তুলতে হবে লড়াই। তাই লুটের পঞ্চায়েতকে অবসান ঘটিয়ে গড়তে হবে আমাদের পঞ্চায়েত, মানুষের পঞ্চায়েত, সবার পঞ্চায়েত।