৬০ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৭ এপ্রিল, ২০২৩ / ২৩ চৈত্র, ১৪২৯
ভার্চুয়াল থেকে রিয়েল - চোর তাড়াও, বাঙলা বাঁচাও
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
“রাম বড় সুবোধ।”... “সে কখনও কানাকে কানা, বা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিয়া ডাকে না। কানাকে কানা বা খোঁড়াকে খোঁড়া বলিলে, তাহারা বড় দুঃখিত হয়।” বিদ্যাসাগর মশাই বর্ণপরিচয়ের দ্বিতীয়ভাগে যা যা লিখে গেছেন তা মেনে চলাই শ্রেয়। তবে একথা উনি কখনই বলে যাননি যে, “চোরকে চোর বলিও না।” কারণ শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আর স্বভাব - এই দুটো এক বিষয় নয়। মাধব তো জানতো যে চুরি করা ভালো কাজ নয়। কিন্তু সে কী তার স্বভাব থেকে বেরোতে পেরেছিল? বিদ্যাসাগরমশাইতো লিখেই গেছেন - “মাধব আর সে অভ্যাস পরিত্যাগ করিতে পারিল না। ক্রমে ক্রমে যত বড় হইতে লাগিল, ততই তাহার ঐ প্রবৃত্তি বাড়িতে লাগিল।” ২০১১ সালের পর তাহা ক্রমান্বয়ে বাড়িয়াছে। শেষ লাইনটা যদিও বিদ্যাসাগর মশাই লিখে যাননি। ইহা নিতান্তই অনুভবজনিত উপলব্ধি।
১৮৫৫-র ১৩ এপ্রিল থেকে ২০২৩-এর ৩১ মার্চ। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় থেকে দুর্নীতির বর্ণপরিচয়ে পৌঁছাতে সময় লেগেছে ১৬৮ বছর। তবে শেষ ১২ বছরের বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে তুলনাহীন। নেচে নেচে, লাফিয়ে লাফিয়ে, দৌড়ে দৌড়ে চুরি করা চোরেদের এই বাড়বাড়ন্ত দেখে একটা পুরনো প্রবাদই শুধু মনে আসে। ‘অতি বাড় বেড়ো না...’। যদিও চোর কবেই বা ধর্মের কাহিনি শুনেছে। তাই রাস্তাঘাটে মানুষ এখন আঙুল তুলে ‘চোর চোর চোর’ বলে চ্যাঁচাচ্ছে। মানুষ যখন বলছে “ধর্ ধর্ ওই চোর, ওই চোর” তখন অন্যদিকে আরেক দল গলার শির ফুলিয়ে বলে যাচ্ছে, “নই আমি নই চোর, নই চোর, নই চোর”। দু’চারটে শিবপুর, রিষড়া ঘটিয়ে নজর ঘোরাতে চাইলেও বাঙলার আকাশে বাতাসে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, ‘চোর চোর’ শব্দের অনুরণন।
সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমা যখন হয়নি, যখন সদ্য সদ্য সমাজের ওপর থাবা বসাতে শুরু করেছে সামাজিক মাধ্যম, তখন একটা বিতর্ক বেশ দানা বেঁধেছিল। “হেঁটে না নেটে?” বিতর্কের যদিও কোনো অবকাশ ছিল না। তবুও বিতর্ক হয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে বিতর্ক অনেকটাই চাপা পড়েছে। আরব স্প্রিং থেকে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার, ওমেনস মার্চ - এক নিঃশ্বাসে এরকম একাধিক আন্দোলনের কথা বলা যায়, বিগত এক দশকে যেসব আন্দোলনের শুরুই হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এবং পরবর্তী সময়ে তা দানা বেঁধেছে। চোর টিএমসি হ্যাশট্যাগ প্রচারটাও অনেকটা এরকমই।
গত ৩১ মার্চ সকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে সাড়া ফেলে দেয় এক হ্যাশট্যাগ। মূলত বামপন্থী নেতা থেকে শুরু করে কর্মী-সমর্থক সকলেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনে #ChorTMC লিখে সারাদিন ধরে ফেসবুক, ট্যুইটারে পোস্ট করেন। একইসঙ্গে ‘দুর্নীতির বর্ণপরিচয়’ নামে একটি পোস্টার সিরিজও শেয়ার হয়। তৃণমূলের একের পর এক নেতা জেলে যাওয়ার পর থেকেই তৃণমূলকে ‘চোর’ বলে আক্রমণ শুরু হয়েছিল। মিটিং মিছিলে এই ‘চোর’ স্লোগান ব্যবহার শুরু হবার পরেই ডিজিটাল জগতেও তৃণমূলের বিরুদ্ধে সরাসরি শুরু হয় প্রচার।
‘‘অ-এ অজগর আসছে তেড়ে, লুঠের টাকা দিচ্ছে মেরে’’ অথবা “উট চলেছে মুখটি তুলে, মন্ত্রীরা সব যাচ্ছে জেলে” গোছের শব্দবন্ধে ঝড়ের গতিতে ভাইরাল হয় ‘চোরটিএমসি’ হ্যাশট্যাগ। যে প্রচারের শেষে বলা ছিল, “ওদের কাণ্ডে রাজ্য ফেঁসে, ঘুষের টাকা নিচ্ছে হেসে। ঔষধ নিয়ে হাজির আছে, লাল পতাকা রাত জাগছে’’। প্রচার শুরু হবার পরেই মুহূর্তের মধ্যে তা ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুক, ট্যুইটারে। একসময় রাজ্যের হ্যাশট্যাগ ক্যাম্পেনের হিসেবে এই হ্যাশট্যাগ এক নম্বরে উঠে আসে। এমনকী সর্বভারতীয়ভাবেও ট্রেন্ডিং লিস্টে ঢুকে যায় ‘চোরটিএমসি’ হ্যাশট্যাগ। তৃণমূল নেতাদের একাধিক কুকীর্তির হিসেবে ভরে যায় সোশ্যাল মিডিয়ার দেয়াল। একথা সত্যি যে, বাম কর্মী সমর্থকদের পাশাপাশি বহু সাধারণ মানুষও ওইদিনের প্রচারে অংশ নেন। যা না হলে হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ডিং সম্ভব হতো না।
এই প্রচার সম্পর্কে সিপিআই(এম)রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেন, আমরা বলছি ‘চোর তাড়াও’। আর মানুষ আওয়াজ তুলেছে ‘চোর তৃণমূল’। সেটাই সোশ্যাল মিডিয়াতে ট্রেন্ডিং হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, ভাদু শেখের বাড়ি দেখিয়ে আমরা বলেছিলাম পঞ্চায়েতে তৃণমূলের লুটের নমুনা ছড়িয়ে আছে। তারপর মানুষ নানা এলাকা থেকে আমাদের কাছে তৃণমূলের দুর্নীতির নানা তথ্য পাঠিয়েছেন। আমাদের পাহারায় পাবলিক প্রচারে রাজ্যের বহু মানুষ অভিযোগ জানিয়েছেন। কারণ তাঁরা ‘দিদিকে বলো’-তে জানিয়েও সুরাহা পাননি।
যেদিন এই প্রচার চলছে সেদিন মুখ্যমন্ত্রী ধরনামঞ্চে আর শহিদ মিনারে তৃণমূলের কর্মসূচি। সেই কর্মসূচি থেকে ফেরার পথে তৃণমূল সমর্থকদের বাস লক্ষ্য করেও সাধারণ মানুষ ‘চোর চোর’ বলে চিৎকার শুরু করে দেয়। একইদিনে সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল থেকে বাস্তবের মাটিতে নেমে আসে ‘চোরটিএমসি’ প্রচার।
এই ঘটনার একদিন পরেই হুগলির মানকুণ্ডু স্টেশনে দেখা যায় ‘চোর তাড়াও’ পোস্টার। যেখানে লেখা ছিল ‘গোপনে চোর তাড়ান, গলায় জোর বাড়ান’। ওই পোস্টারেই লেখা ছিল ‘রাতের অন্ধকারে চোখের সামনেই পাচার হচ্ছে বালি, ইট, কয়লা। পঞ্চায়েতে কাজ বন্ধ। পুরসভায় উন্নতি নেই রাস্তাঘাটে। সমাধান পেতে আজই মেল করুন chortrinamool@gmail.com-এ।’
রাজ্যে বিগত ১২ বছরে চুরি, দুর্নীতি সাধারণ মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। একদিকে ভুরি ভুরি মিথ্যে আর অন্যদিকে নির্লজ্জ চুরি, দুর্নীতি। কয়লা থেকে গোরু হয়ে বালি, শিক্ষক থেকে করণিক নিয়োগ - ছাড় মেলেনি কোথাও। সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল জগৎ থেকে বাস্তবের মাটিতে নেমে এসে সাধারণ মানুষের উঠোনে ঢুকে যাওয়া সাড়া জাগানো এই প্রচারের সুরে সুর মিলিয়ে বাঙলাও এখন বলছে ‘চোর তাড়াও, বাঙলা বাঁচাও’।