E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৭ এপ্রিল, ২০২৩ / ২৩ চৈত্র, ১৪২৯

প্রসঙ্গঃ অর্থনীতি

আমেরিকার ব্যাঙ্কে ধস

প্রভাত পট্টনায়েক


আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্ক এবং সিগনেচার ব্যাঙ্কে ধস নামার পেছনে কোনো রহস্য নেই। শুধু তাই নয় সমগ্র পুঁজিবাদী বিশ্বে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা যে একটি সংকটের মধ্যে পড়েছে তার মধ্যেও কোনো রহস্য নেই। যখনই এই ব্যবস্থার একটি অংশে ধস নামে তখন অন্য অংশে তার বোঝা চাপে যা কীনা ধসে যাওয়া অংশের দায় এবং এর ফলে গোটা ব্যবস্থায় ক্রমান্বয়ে প্রভাব পড়তে থাকে। আসল কথা হচ্ছে যে, আমেরিকার পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এরকম একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন কীভাবে হলো, যেখানে তার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা এইরকম সংকটের মধ্যে পড়ে গেল? এই সমস্ত ব্যাঙ্ক ধসে যাওয়া বিশেষত সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কে ধস নামা যেহেতু কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয় নয় বরঞ্চ এই ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্বের প্রতিফলন; সেক্ষেত্রে জানা দরকার যে এই দ্বন্দ্বটি কোথায় নিহিত আছে।

এই দুটি ব্যাঙ্কের পতনের পেছনে যে কারণটি সবচেয়ে সামনে উঠে আসছে তা হলো, সুদের হারের বৃদ্ধি। অবশ্য আমরা এখানে আমাদের আলোচনা সিলিকন ভ্যালি ব্যাঙ্কের মধ্যেই আবদ্ধ রাখব কেননা তা এই ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে অনেক বেশি স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে। সিগনেচার ব্যাঙ্কের বিষয়টি আলাদা কেননা এরা ক্রিপ্টো কারেন্সি নিয়ে ব্যবসা করেছে যা কীনা অত্যন্ত অস্থিতিশীল।

সুদের হার বৃদ্ধি পেলে স্বাভাবিকভাবেই বন্ডের মূল্য কমে যায়। বন্ড একটি নির্দিষ্ট সময়কালে চালু সুদের পরিপ্রেক্ষিতে একটা আয়ের ব্যবস্থা করে। এবার এই চালু সুদের হার বেড়ে গেলে বন্ড অলাভজনক হয়ে পড়ে। প্রত্যেকটি ব্যাঙ্কেরই যে সম্পদ থাকে তার মধ্যে বন্ড একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ অধিকার করে। সুদের হার বৃদ্ধি পেলে বন্ডের মূল্য কমে যাওয়ার দরুন ব্যাঙ্কের সম্পদ মূল্য তার দায়ভারের তুলনায় কমে যায়। ব্যাঙ্কের উপর একটা চাপ সৃষ্টি হয়।

এই চাপ কমানোর জন্য ব্যাঙ্ক কোনো প্রচেষ্টা নিলে এর অর্থ দাঁড়ায় যে - ব্যাঙ্ক প্রকাশ্যে ঘোষণা করছে যে, তা সংকটের মধ্যে রয়েছে এবং সেটা আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। তাই ব্যাঙ্কের শেয়ারের মূল্য কমে যায়, যার দরুন আমানতকারীরা টাকা তুলে নেয়। এর ফলে ব্যাঙ্ক আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে এবং সেই ব্যাংকের পতন ঘটে। একটা জিনিস খেয়াল করা দরকার যে, যখন একটি ব্যাঙ্ক এইরকম সংকটের মধ্যে পড়ে তখন সে যে পদক্ষেপই নিক না কেন তার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। যদি ব্যাঙ্ক কোনো পদক্ষেপ না নেয় তাহলে বুঝতে হবে যে, সে এই পতনের জন্য অপেক্ষা করে আছে; আর যদি কোনো পদক্ষেপ নেয় তাহলেও যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে যে ব্যাঙ্কটির পতন ঘটবে। এই পতনের জন্য সেক্ষেত্রে ব্যাঙ্কটিকেই কেবল দায়ী করা যায় না, এর জন্য বৃহত্তর অর্থনৈতিক কারণগুলির দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

এই পর্যন্ত যে সমস্ত যুক্তির অবতারণা করা হলো তা পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে যে, সুদের হারে কোনরকম বৃদ্ধি হলেই তা ব্যাঙ্কের পতন ত্বরান্বিত করে। কিন্তু বিষয়টি আদৌ সেরকম নয়। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হারের ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনে তা মূলত খুব ক্ষুদ্র পরিবর্তন। সেক্ষেত্রে সুদের হারে অল্প বৃদ্ধি ঘটলে ব্যাঙ্ক সেই চাপ বহন করতে পারে। ‘‘বাজারে’’ কোনরকম আতঙ্ক সৃষ্টি না করেই ব্যাঙ্কের পক্ষে সেই কাজ করা সম্ভব। কিন্তু যখন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ব্যাপকভাবে সুদের হার বাড়িয়ে দেয় তখন ব্যাঙ্ক তার সম্পদ আর দায়ের মধ্যে যে ফারাক তাকে শান্ত ও সুষ্ঠুভাবে মেটাতে পারে না।

সাম্প্রতিককালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে সুদের হার ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে সুদের হার ছিল ০.২৫ শতাংশ তা ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪.৭৫ শতাংশ। এই স্বল্প সময়ে সুদের হারে ব্যাপক বৃদ্ধির ফলে ব্যাঙ্কগুলি তাদের ব্যালেন্স শিটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে ব্যর্থ হয়। এখন আসল প্রশ্ন হলো, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারাল রিজার্ভ বোর্ড যা কীনা সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সমতুল্য তা এইভাবে সুদের হার বাড়াল কেন?

আসল কথা হলো - নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থায় অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার একটি মাত্র জায়গা মুদ্রানীতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দীর্ঘকাল ধরে রাজস্ব সংক্রান্ত নীতি ছিল রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের মূল জায়গা। কিন্তু নয়া-উদারবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের এজাতীয় হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজি জিডিপি'র পরিপ্রেক্ষিতে রাজস্ব ঘাটতির একটা নির্দিষ্ট ঊর্ধ্বসীমা বেঁধে দিতে রাষ্ট্রকে বাধ্য করে। আর যেহেতু পুঁজিপতি এবং সামগ্রিকভাবে ধনীদের ওপরে কর আরোপ করলে বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজি রুষ্ট হয়ে ওঠে, তাই অর্থনীতিতে সক্রিয়তা আনবার জন্য সুদের হার কমানোর পথ অবলম্বন করে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র।

একথা সত্য যে, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ‘‘রাজস্ব সংক্রান্ত দায়িত্বে’’র সাথে সম্পর্কিত কোনো আইন নেই। তাছাড়া আইনগতভাবে বা বাস্তবসম্মত কারণে আমেরিকা থেকে পুঁজির নির্গমনের কোনো ভয় না থাকায় (কেননা আমেরিকার মতো এরকম নির্ভরযোগ্য জায়গা থেকে পুঁজি নির্গমনের কোনো কারণই থাকতে পারে না) সেখানে রাজস্ব সংক্রান্ত ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ করবার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু আমেরিকা যদি রাজস্ব সংক্রান্ত ঘাটতি বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতিতে সক্রিয়তা আনতে চায় তার অর্থ দাঁড়াবে বিদেশের মাটিতে কাজ তৈরি করা (যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যয়ের একটা বড়ো অংশই বিদেশে তৈরি হওয়া পণ্য এবং পরিষেবার চাহিদার সাথে সম্পৃক্ত) এবং বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধি করা। এ কথা ঠিক যে, অতিমারীর সময় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র তার রাজস্ব সংক্রান্ত ঘাটতি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছিল যা কীনা অনেকের মতে বর্তমানে আমেরিকায় মুদ্রাস্ফীতির জন্য অন্যতম কারণ। কিন্তু এটা হয়েছিল কেবলমাত্র অতিমারীর জন্য। কেননা, ‘‘আবাসনের বুদবুদ’’ (Housing bubble) ফেটে যাওয়ার পর দীর্ঘকাল ধরে আমেরিকাতে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার প্রধানতম উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে সুদের হারকে অত্যন্ত কমিয়ে দিয়ে প্রায় শূন্যের কাছে নিয়ে যাওয়া।

২০০৮ সালে ‘‘আবাসনের বুদবুদ’’ ফেটে যায়। ২০০৯ সালের শেষ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আমেরিকায় সুদের হার মোটামুটি ছিল ০.২৫ শতাংশ। কেবলমাত্র ২০১৬ থেকে ২০২০-র মধ্যবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে সুদের হার সর্বোচ্চ ২ শতাংশ বাড়ানো হয়। এই অত্যন্ত দীর্ঘসময় ধরে অত্যন্ত সুলভ অর্থের জোগান একদিকে মার্কিন শিল্পপতিদের মুনাফার হার বৃদ্ধির ও পণ্যের মূল্যের বৃদ্ধি ঘটানোর ক্ষেত্রে ঝুঁকি কমিয়ে দেয়, অন্যদিকে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি ঘটায়। অথচ এর ফলেও আমেরিকার অর্থনীতিতে যথেষ্ট পরিমাণ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়নি। যদিও একথা ঠিক যে, সরকারিভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার মাত্র চার শতাংশে নেমে আসে, কিন্তু এর সাথে সাথে শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণের হারও কমে যায়।

বেকারত্বের হার গণনা করবার সময় ধরে নেওয়া হয়েছিল যে, শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণের মাত্রা ২০০৮ সালের মধ্যবর্তী পর্যায়ে যেমন ছিল তাই থাকবে। সেই হিসাবে ২০০৮ সালের পরবর্তী সময়ে বেকারত্বের হার বেশি ছিল। এবার যখন মুদ্রাস্ফীতি ঘটল তখন হঠাৎ করে সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়া হলো। মুদ্রা সংক্রান্ত নীতিতে এই আপাতত অযৌক্তিক পরিবর্তনের মূল কারণ এই যে, বিশ্বজুড়ে চলমান লগ্নিপুঁজির আধিপত্যের পরিপ্রেক্ষিতে এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। অর্থাৎ এই আপাতত অযৌক্তিক ভাবনার কারণ সরকারের কোনো খামখেয়ালিপনা নয়। এর কারণ লুকিয়ে আছে বিশ্বায়িত লগ্নিপুঁজির আধিপত্যের মধ্যে।

সুদের হারের এই ধরনের ব্যাপক পরিবর্তনের কুফল আরও বৃদ্ধি পায় আরেকটি কারণে। যখন সুদের হার কমে এবং বন্ডের মূল্য বাড়ে, তখন অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ চাঙ্গা হোক বা না হোক এর জন্য ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় কোনো বিপদ ঘনিয়ে আসে না। ব্যাঙ্কের সম্পদ বৃদ্ধি পেলে তা তো তার বিপদের কারণ হতে পারে না। কিন্তু যখন সুদের হার বৃদ্ধি পায় এবং বন্ডের মূল্য কমে যায় তখন ব্যাঙ্কের আর্থিক দায়ের পরিপ্রেক্ষিতে তার সম্পদের মূল্য কমতে থাকে। বাজারে এর প্রভাব পড়ে এবং ব্যাঙ্ক পরিচালনা করা মুশকিল হয়ে যায়। অর্থাৎ সুদের হার বৃদ্ধি এবং হ্রাসের প্রভাবের যে ভিন্নতা তা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করে।

সরকারিভাবে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য সুদের হার বৃদ্ধির যে সিদ্ধান্ত তার দ্বারা কেবলমাত্র আমেরিকার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা নয়, বরং গোটা পুঁজিবাদী দুনিয়ার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা আক্রান্ত। সম্প্রতি ক্রেডিট সুইসের মতো নামজাদা ব্যাঙ্কেরও শেয়ারে পতন ঘটেছে এবং তাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যাঙ্ক ইউবিএস কিনে নিচ্ছে।

সর্বোপরি পুঁজিবাদী দুনিয়ার ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার উপর এই আক্রমণ আদৌ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ফেডেরাল রিজার্ভ বোর্ড এর আগেই পরিকল্পনা করেছিল যে, তারা মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য আরও বেশি সুদের হার বাড়াবে। আমেরিকার দুটি ব্যাঙ্ক পতনের পর হয়তো তারা কিছুটা ধীরে চলবে। কিন্তু মুদ্রাস্ফীতি যে হারে ঘটছে তাতে সুদের হার বাড়ানো ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই কেননা পুঁজিবাদ কর্মহীনতা বৃদ্ধির মাধ্যমেই মুদ্রাস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং আজকাল এই কাজটি করা হচ্ছে সুদের হার বাড়িয়ে। যখন পুঁজিবাদ সংকটের মধ্যে রয়েছে, তখন গোটা ইয়োরোপ জুড়ে শ্রমিকদের যে বিক্ষোভ চলছে তা প্রমাণ করে দিচ্ছে যে, পুঁজিবাদ এই নয়া-উদারবাদী পর্বে একটা অন্ধগলিতে ঢুকে পড়েছে।

(ভাষান্তরঃ অর্ণব ভট্টাচার্য)