E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩৪ সংখ্যা / ৭ এপ্রিল, ২০২৩ / ২৩ চৈত্র, ১৪২৯

মতাদর্শের চর্চা

ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (পাঁচ)

শ্রীদীপ ভট্টাচার্য


বৌদ্ধবাদ বা বৌদ্ধ দর্শন

গৌতম বুদ্ধ ছিলেন শাক্য বংশের রাজপুত্র। সময়কাল খ্রিস্ট পূর্বাব্দ ৫৬৩-৪৮৩, জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণার অবসানে, শান্তির খোঁজে যৌবনেই সংসার তিনি ত্যাগ করেছিলেন। তিনি মানব-জীবনের সর্বক্ষেত্রে দুঃখ-যন্ত্রণার সন্ধান পেয়েছিলেন। কোন কোন কারণে সিদ্ধার্থ গৃহত্যাগ করেছিলেন? প্রধানত সীমিত কৃষিজমি নিয়ন্ত্রণে বিবদমান গোষ্ঠীগুলির লড়াই, বর্ণাশ্রমের নামে বৈদিক পুরোহিতদের নিপীড়নমূলক কর্তৃত্ব, ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিভেদ, ক্রীতদাস ও শূদ্র জনগোষ্ঠীর অমানবিক পরিশ্রমের পরেও দুর্দশা, দুঃখ-যন্ত্রণা কাতর সিদ্ধার্থকে গৃহত্যাগে বাধ্য করেছিল। বুদ্ধর মতবাদে অস্তিত্বের তিনটি চিহ্নের কথা বলা হলো। (ক) অনিত্য, (খ) অনত্য, (গ) দুঃখ। অর্থাৎ কোনো কিছুই স্থায়ী নয়, কোনো জীবন্ত বস্তুর মধ্যে স্থায়িত্ব বা স্থায়ী আশা নেই, এই অস্থায়িত্ব সম্পর্কে অজ্ঞতাই সমস্ত দুঃখের কারণ। বৌদ্ধ মতবাদের সমস্ত ধারাই ৩টি রত্নের কথা বলে। (ক) বুদ্ধ, (খ) ধর্ম ও (গ) সংঘ।

(ক) জীবনে শৈশব থেকে প্রৌঢ় পর্যন্ত অসুস্থতা ও মৃত্যুভয় শোক-যন্ত্রণার কারণ। প্রিয়জনের সঙ্গে বিচ্ছেদ বা অপ্রিয়জনের সাথে মিলন অশান্তির কারণ। যা পাই তা ভুল করে পাই, যা চাই তা পাই না। সংক্ষেপে আমাদের সম্পর্ক। বন্ধনে দুঃখ কষ্টে পূর্ণ।
(খ) এই কষ্টের মূল কারণ কামনা ও বাসনা, ক্ষমতা ও আনন্দ-লিপ্সা।
(গ) এই কামনা-বাসনাকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে পারলে দুঃখ-যন্ত্রণার অবসান হবে।
(ঘ) এই বাসনাকে নির্মূল করেত অষ্টাঙ্গ-মার্গ (আটটি পথ) অনুসরণ করতে হবে। এই আটটি পথ হলো- সম্যক বিশ্বাস, সম্যক সংকল্প, সম্যক বক্তব্য, সম্যক কাজ, সম্যক জীবন-যাপন, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক চিন্তা, সম্যক একাগ্রতা।

অষ্টাঙ্গ মার্গের অনুসরণের মধ্য দিয়ে দুঃখ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়াকে ‘নির্বাণ’ বলা হয়। একমাত্র ‘নির্বাণ’ ব্যতিরেকে কোনো কিছুই স্বাধীন নয় সমস্ত কিছুই অপর কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল। বুদ্ধের সমগ্র বক্তব্য ও শিক্ষা সংবলিত মতবাদ ‘পালি’ ভাষায় তিনটি সংগ্রহে সংকলিত হয়েছে। বুদ্ধ যে অঞ্চলে বাস করতেন সেই অঞ্চলের ভাষা ছিল পালি। প্রাকৃত ভাষার অন্তর্গত। বুদ্ধ সংস্কৃত ভাষাও জানতেন। তিনটি সংগ্রহের একটি হলো ‘বিনয় পিটক’, নিয়ম-শৃঙ্খলার সংকলন। এর মধ্যে বৌদ্ধ ভিক্ষু বা সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের অর্থাৎ সংঘের জীবন চর্চার নিয়মকানুন লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো, ‘সূত্র পিটক’, যা বৌদ্ধ ধর্মের কথা অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের প্রাথমিক চিন্তা-ভাবনার কথা বলে। তৃতীয়টি হলো, ‘অভিধর্ম পিটক’। এটা মূলত দ্বিতীয় অর্থাৎ ‘সূত্র পিটক’-এর পরিশীলিত এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা। সমাজের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে বিষণ্ণ ছিলেন বু্দ্ধদেব। কিন্তু তিনি ভগবানের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেননি। ভগবানের প্রশ্ন অবতারণার কোনো প্রয়োজন তিনি বোধ করেননি। ঈশ্বর চিন্তা, বিশ্বস্রষ্টা বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করাকে তিনি সময়ের অপচয় মনে করতেন। তিনি তাঁর শিষ্যদের জনগণের দুঃখ-কষ্ট নিবারণে মনোনিবেশ করার কথাই বলতেন। মানুষের দুঃখ-কষ্ট নিবারণ করার জন্য উৎপাদনের শক্তিকে ব্যাপকভাবে উন্নত করার কথা বুদ্ধ বলতেন। উৎপাদিকা শক্তির ব্যাপক উন্নতি সমাজতন্ত্রেই সম্ভব। তবে গৌতম বুদ্ধের সময়কালে সমাজতন্ত্রের ভাবনা সম্ভব ছিল না। বুদ্ধদেব ধনীদের লোভ ক্ষমতার লালসাকে প্রতিহত করতে উপজাতি জনগোষ্ঠীদের নিয়ে ‘সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সমষ্টিগত উপজাতি সমাজের আদলে তৈরি এই সংঘে কোনো ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল না। সংঘের সদস্যদের মধ্যে ‘সাম্য’ ও ‘গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বুদ্ধের দৃঢ়মত ছিল, অহিংসার অর্থ একে অপরের প্রতি নিষ্ঠুরতা বর্জন। তিনি যুদ্ধরত বা বিবদমান গোষ্ঠীগুলির মধ্যে ঘৃণার পরিবর্তে সৌভ্রাতৃত্বের বার্তা প্রচার করেছিলেন। তাঁর এই অহিংসার আবেদন ব্রাহ্মণ্যবাদীদের যজ্ঞের নামে অহেতুক গবাদি পশু হত্যাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। আসলে বুদ্ধের এই বার্তা শূদ্র ও ক্রীতদাসদের বিশাল জনসংখ্যার কাছে পরম স্বস্তির কারণ হয়েছিল। এর কারণ ছিল সেই সময়ে পশুশক্তির বিকল্প হিসাবে মানবশক্তির অসাধু ব্যবহার তখন প্রচলিত ছিল। বুদ্ধদেব কার্যকারণের একটি তত্ত্বকে অবলম্বন করে দুঃখকষ্টের কারণের কথা বলেছিলেন। একে ‘প্রত্যুত-সমুৎপাদ’ বলা হয়। দুঃখকষ্টের কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বারোটি কারণের বর্ণনা করেছিলেন, যাকে ‘দ্বাদশ-নিদান’ বলা হয়। দ্বাদশ-নিদান যথাক্রমে অজ্ঞতা থেকে ধারণা ও স্ব-ভাব, স্ব-ভাব থেকে চেতনা, চেতনা থেকে দেহ-মন, দেহ-মন থেকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মানস, পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মানস থেকে স্পর্শ, স্পর্শ থেকে অনুভব, অনুভব থেকে বাসনা, বাসনা থেকে আসক্তি, আসক্তি থেকে জন্মের ইচ্ছা, জন্মের ইচ্ছা থেকে জন্ম, জন্ম থেকে বার্ধক্য এবং মৃত্যু, মৃত্যু থেকে দুঃখ, বিলাপ, যন্ত্রণা হতাশা। এই হলো দুঃখ কষ্টের উৎপত্তি। এই হলো বারোটি কারণ।

বুদ্ধের দৃষ্টিতে সমস্ত কিছু এক শাশ্বত প্রবাহ এবং ধ্রুব পরিবর্তনের অধীন। প্রখ্যাত দার্শনিক দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের মতে ভারতীয় দর্শনে এটিই সম্ভবত দ্বান্দ্বিক চিন্তা-ভাবনার প্রথম উদাহরণ। মনে রাখা দরকার, কোনো বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির নির্যাস হিসাবে নয় উপনিষদের ধর্মীয় প্রতিক্রিয়া হিসাবেই এই ভাবনার উদয় হয়েছিল।

একথা স্বীকার করতেই হবে যে অশান্ত বিশ্বের কাছে, অস্থির, অনিশ্চিত এ উত্তেজনায় আবিষ্ট এক জনগোষ্ঠীর কাছে, বৈদিক আচার-অনুষ্ঠানের ও নিপীড়নের সংস্কৃতির বিপরীতে বুদ্ধের বাণী, বুদ্ধের শিক্ষা এক শান্তির বাতাবরণ তৈরি করেছিল, শুরুতে বৌদ্ধধর্ম সেই কারণেই বিশাল জনগোষ্ঠীর সাথে বণিক ও রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল। বৌদ্ধধর্মের নীতি ও আদর্শ প্রচারে সন্ন্যাসী ও সংঘের মাধ্যমে বিপুল অর্থ ব্যয়িত হয়েছিল। এই ব্যয় করেছিল বণিক ও রাজারা। খ্রিস্টধর্ম তৃতীয় শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধ ধর্ম সর্বশ্রেষ্ঠ রাজত্ব মৌর্য রাজত্বের রাষ্ট্রধর্ম হয়ে ওঠে। চিরাচরিত ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও শাসকশ্রেণির এই পৃষ্ঠপোষকতা ধীরে ধীরে বৌদ্ধধর্মকে তার মূল অবস্থান থেকে সরিয়ে দেয়, শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার ফলে পরবর্তীকালে বৌদ্ধ দর্শনের মূল অন্তর্বস্তু দুর্বল হয়, অকেকাংশে বিকৃত হয়। সমগ্র আন্দোলনের যে চূড়ান্ত রূপ দাঁড়ালো তা হলো চোখ ধাঁধানো পার্থিব চাহিদাকে অস্বীকার করল, সাথে সাথে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির পৃষ্ঠপোষকতা করল। বিজ্ঞানের শত্রুতা করার সাথে সাথে নানান কুসংস্কারের পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়ালো সমগ্র আন্দোলন। বুদ্ধের নিজের ঈশ্বর তত্ত্বের প্রতি বিতৃষ্ণা ছিল। বৌদ্ধ দর্শন ছিল ঘোষিত নিরীশ্বরবাদী। সেই প্রেক্ষিতে বৌদ্ধ দর্শনের পরবর্তীকালের অগ্রগতি অদ্ভুত বলে মনে হওয়াটাই অস্বাভাবিক নয়। ক্রমান্বয়ে দার্শনিক সন্ন্যাসীদের উৎপাদন প্রক্রিয়া থেকে সরে আসার মধ্যে হয়ত এর কারণ নিহিত আছে। বণিক ও রাজাদের দানে নির্ভরশীল সন্ন্যাসীদল শিক্ষা ও মননের চর্চায়, বক্তৃতা-বিতর্কের আবহে ভারতীয় দর্শনকে এক নতুন স্তরে উন্নীত করেছিল।

ক্রমান্বয়ে শ্রম বিমুখ ও উৎপাদন থেকে নিযুক্ত সন্ন্যাসী সম্প্রদায় (সং‌ঘী) সম্পূর্ণ ভাববাদী দর্শন চর্চায় নিয়োজিত হয়। ‘বিনয় পিটক’-এ যে সংঘের নিয়ম কানুন বর্ণিত হয়েছিল, সেই নিয়মগুলিও ক্রমাগত শিথিল হতে থাকে। ক্রমে ক্রমে বুদ্ধকে অতিমানবীয় আখ্যা দিয়ে বোধিসত্ত্বের পুনর্জন্মকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস শুরু হয়। ‘জাতক’-এর কাহিনির মাধ্যমে বোধিসত্ত্বের পুনর্জন্মের বিষয়টিকে জনপ্রিয় করা হয়। বুদ্ধের মৃত্যুর কয়েকশত বছর পর বৌদ্ধ ধর্ম ‘মহাযান’ ও ‘হীনযান’ - এই দুইটি ধারায় বিভক্ত হয়। বোধিস্বত্বেম র ধারণা ‘মহাযান’ পন্থীদের পক্ষ থেকে প্রচার করা হয়। ‘হীনযান’ পন্থীরা অনেক বেশি গোঁড়াপন্থী। হীনযান ধারাকে ‘থেরাভাদ’ বলেও উল্লেখ করা হয়। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন (ভারতের ইতিহাসে অন্যতম সেরা দার্শনিক) ‘শূন্যবাদ’-এর তত্ত্ব প্রচার করেন, যা ভাববাদী দর্শন ছাড়া আর কিছু নয়। প্রসঙ্গত এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ‘মহাযান’ ও ‘হীনযান’-এর মধ্যে গুরুতর পার্থক্য রয়েছে।

বৌদ্ধ ধর্ম মূলত নাস্তিক দর্শন হলেও দর্শনের মৌলিক প্রশ্ন অর্থাৎ বস্তু ও চেতনার সম্পর্কের প্রশ্নের উত্তর সরাসরিভাবে সন্ধান করেনি। বৌদ্ধ দর্শনে ঈশ্বরের অপ্রাসঙ্গিকতার কথা যেমন তুলেছে, বৈদিক আচার অনুষ্ঠান ও পু‍‌রোহিত তন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রশ্নও উত্থাপন করেছে। যদিও জাত-পাত, বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে কোনো গুরুতর চ্যালেঞ্জ বৌদ্ধ দর্শন উপস্থিত করেনি। সেই কারণে প্রায় এক হাজার বছর ধরে ভারতে আধিপত্য করলেও বৌদ্ধ মতবাদ বর্ণ ব্যবস্থার ওপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি।

বৌদ্ধ দর্শনের থেরাভাদা ধারার উদ্ভব ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ২০০ শতাব্দীততে। এই থেরাভাদা ধারাকেই ‘হীনযান’ ধারা বলেও অভিহিত করা হয়। ‘মহাযান’ ধারার উদ্ভব সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে ১০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বিভিন্ন মহাযান রচনার হদিশ পাওয়া যায়। ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্যের ভিত্তিতে বিচার করলে, সাথে সাথে নির্দেশ, প্রয়াস, আত্মীকরণ এবং সময় ‘হীনযান’ নিম্নতর অবস্থানে থাকে। তাই এ‍‌কে ‘হীনযান’ বলা হয়। হীনযানের দৃষ্টিতে হীনযানপন্থীর চূড়ান্ত ভালোর অর্থ নিজের নির্বাণ অর্জন করা। মহাযানপন্থীদের লক্ষ্য শুধুমাত্র নিজের মুক্তি নয়, সমস্ত জীবজগতের মুক্তি অর্জন করা। সেই জন্যই মহাযানপন্থীদের তুলনায় হীনযানপন্থীরা নিম্নতর পর্যায়ের।

মহাযানপন্থীরা মনে করে, সমস্ত কিছুই অপ্রয়োজনীয় ও অনির্ধারিত চরিত্রের এবং নিচে অকার্যকর। অপরদিকে হীনযানপন্থীরা মনে করে সমস্ত কিছুই অস্থায়ী। তবে এর থেকে আর বেশি কিছু তারা বলে না।

প্রকৃত অর্থে সমস্ত মহাযানপন্থীরা শূন্যবাদ তত্ত্বেরই প্রচারক। শূন্যবাদ তত্ত্বের মূল বক্তব্য হলো সমস্ত বহিঃপ্রকাশই (appearance) সারহীন এবং শূন্যতা। অর্থাৎ একমাত্র নাগার্জুনই নয়, তার বহু পূর্ব থেকেই এই ‘শূন্যবাদী’ তত্ত্বের অস্তিত্ব ছিল। নাগার্জুন এই তত্ত্বকে শক্তিশালী দ্বান্দ্বিকতার সাহায্যে উপস্থিত করলেন।