৫৭ বর্ষ ৫০ ও ৫১ সংখ্যা / ৭ আগস্ট ২০২০ / ২২ শ্রাবণ ১৪২৭
জন্মদিনে কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ-এর শিক্ষা ও আদর্শকে অনুসরণ করার শপথ
পার্টির রাজ্য দপ্তরে কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ-এর আবক্ষমূর্তিতে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন বিমান বসু।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ-এর ১৩২তম জন্মদিবসে রাজ্যজুড়ে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদিত হয়েছে। করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্যবারের মতো এবারে ৫ আগস্ট দিনটিতে প্রকাশ্যে পার্টি সদস্য-অনুরাগীদের উপস্থিতিতে কলকাতায় কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। তার পরিবর্তে ভারচুয়াল সভার মধ্য দিয়ে পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কাকাবাবুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। এই সভা ডিজিটাল মাধ্যমে সিপিআই(এম)-র পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে সম্প্রচারিত হয়েছে, যা রাজ্যজুড়ে প্রত্যক্ষ করেছেন পার্টিকর্মীরা। কলকাতায় এদিনের মূল অনুষ্ঠানে নেতৃবৃন্দ কাকাবাবুর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লকডাউনের সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রের শাসকদল এবং সংঘ পরিবার যেভাবে উগ্র-সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে মতাদর্শের ভিত্তিতে ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন-সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তাঁরা গণতন্ত্রের সপক্ষে এবং মানুষের জীবন-জীবিকার সংগ্রামকে তীব্র করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিনের এই সভায় সভাপতিত্ব করেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য বিমান বসু। বক্তব্য রেখেছেন পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এবং পলিট ব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম। করোনা সংক্রমণের জন্য মহম্মদ সেলিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। সেখান থেকেই তিনি বক্তব্য রেখেছেন। সভায় এবারে মুজফ্ফর আহ্মদ স্মৃতি পুরস্কারপ্রাপ্ত তিনটি বইয়ের নাম ঘোষণা এবং বইগুলি ও লেখকদের সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরেছেন পার্র্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মৃদুল দে।
বিমান বসু তাঁর বক্তব্যে ভারতের বুকে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কাকাবাবুর বিরাট অবদানের কথা তুলে ধরে বলেছেন, তিনি তাঁর জীবনের ব্রত হিসাবে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শ গ্রহণ করে তার ভিত্তিতে জীবনসংগ্রাম পরিচালনা করেছেন। ১৯৬৩ সালে রাজ্যে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সামনে এক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সময়ে যে বিশেষ পরিস্থিতিতে কাকাবাবুর জন্মদিন পালনের সূচনা হয়েছিল, তার বিবরণ দিয়ে তিনি বলেন, আজ ৫৭ বছরে পা দিয়ে কোভিড-১৯-এর সংক্রমিণজনিত বিপদের জন্য ভারচুয়াল সভা করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হচ্ছে। তিনি বলেন, কাকাবাবু তাঁর সংগ্রামী জীবনের অভিজ্ঞতায় সত্যকে যেমন যাচাই করে নিয়েছেন, তেমনি শত্রু চিনেছেন, মিত্র চিনেছেন, আবার বন্ধুবেশী শত্রুকেও নির্দিষ্ট করতে পেরেছিলেন। তিনি যে দর্শন নিয়ে চলেছেন, তার ভিত্তিতে শ্রেণিশোষণ থেকে শোষিত-নিপীড়িত মানুষকে মুক্ত করার জন্য সারাজীবন লড়াই করেছেন।
বিমান বসু বলেন, কাকাবাবুর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সমস্ত বামপন্থী গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে সমবেত করতে হবে। আজ দেশে মানুষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলতে পারছেন না। গোরক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের ওপর নারকীয় আক্রমণ নামিয়ে আনা হচ্ছে। ধর্মীয় কার্যকলাপে রাষ্ট্রনেতারা সরাসরি যুক্ত হয়ে পড়ছেন। এ সমস্ত কিছুই সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে লঙ্ঘন করছে। তাই বিভিন্ন জাতি, ধর্ম, ভাষার মানুষের ঐক্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে তুলে ধরতে হবে। একইসঙ্গে শোষিত-নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামকেও আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
এই অনুষ্ঠানে সূর্য মিশ্র তাঁর বক্তব্যের সূচনায় কাকাবাবুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, আজ আমাদের রাজ্য, দেশ এবং দুনিয়াব্যাপী দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। ১৯৩০-এর দশকে পৃথিবীতে যে মহামন্দা দেখা দিয়েছিল, বর্তমান অবস্থা তার চেয়েও কঠিন। এই পরিস্থিতিকে বলা হচ্ছে ‘নিউ নর্মাল’। এই অবস্থায় গোটা বিশ্বে মতাদর্শ এবং রাজনীতির লড়াই চলছে। কিছু লোক ভাবছে এই পরিস্থিতিতে যা পাচ্ছো লুটে নাও, মুনাফা আরও বাড়াও। আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি আজ কোনো একটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। কিছু লোকের কাছে এই ‘নিউ নর্মাল’ মানে হচ্ছে, এত মানুষের দরকার নেই, কিছু মানুষের কাজ চলে যাক। ওরা বলে ‘সামাজিক দূরত্ব’ আর আমরা বলছি ‘শারীরিক দূরত্ব।’ বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আজ চরম সঙ্কটে। এই অবস্থায় অনেক সরকার স্বাস্থ্য, বিজ্ঞান, শিক্ষা, ওষুধ, ভ্যাকসিন ইত্যাদি জরুরি ক্ষেত্র থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছে। পরিবেশ সম্পর্কে ওদের কোনো ভাবনা নেই। পরিবেশ ধ্বংসের জন্য অতিমারীর সংকট বাড়ছে।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিকে ওরা যেমন ওদের স্বার্থে দুনিয়াকে ঘোরাতে চাইছে, তেমনি আমাদের বামদিকে ঘোরানোর জন্য চেষ্টা চালাতে হবে। আমরা মানুষকে নিয়ে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করবো। আজ খাদ্য উৎপাদন করে যে কৃষকরা, তাঁদের কী অবস্থা? বাণিজ্যিক কৃষিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ২ হাজার কৃষক কৃষি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা। এদিকে আম্বানি গোষ্ঠী পৃথিবীর ১০ জন ধনীর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। কৃষির পাশাপাশি শিল্পেও সঙ্কট বাড়ছে। যোগীর রাজ্যে ৩৮টি শ্রম আইন বাতিল হয়ে গেছে। যুবকদের কাজ নেই। বর্তমান অবস্থায় ১৬ কোটি মানুষের কাজ চলে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বিদেশিদের কাছে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ছাত্ররা কী করে লেখাপড়া করবে! লেখাপড়া অনলাইনে চলবে। দেশে কত লোকের মোবাইল ফোন আছে! কিন্তু আমরা সকলের শিক্ষার অধিকার চাই। শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকীকরণ হচ্ছে। আজ আদিবাসী, দলিত, পিছিয়ে পড়া - সমগ্র অংশের মানুষের ওপর আক্রমণ নেমে এসেছে। আদিবাসী-সংখ্যালঘুরা সামাজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে আমাদের দেশে, রাজ্যে যা চলছে, তাতে বিজ্ঞান নেই। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় গোল গোল দাগ আঁকছেন। তিনি বলেন, এই সময়ে যেমন বৈষম্য বাড়ছে, তেমনি মানুষের জীবন-জীবিকা, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আক্রমণ নেমে এসেছে। ধর্মের ওপর ভিত্তি করে মেরুকরণের চেষ্টা হচ্ছে। দিল্লি ও রাজ্যের সরকার ভিতরে ভিতরে সম্পর্ক রেখে চলেছে। ওরা চাইছে পরিস্থিতিকে ডানদিকে ঘোরাতে। আমাদের এই পরিস্থিতিকে বামদিকে ঘোরাতে হবে।
সূর্য মিশ্র বলেন, আমরা এই পরিস্থিতিতে কী বিকল্পের কথা বলছি? আমরা চাই সকলের জন্য শিক্ষা, কাজ, বাসস্থান। আমাদের হাজার হাজার যুবক কাজ হারানো মানুষের কাছে, বিপন্ন অসহায় মানুষের কাছে খাদ্য, সাবান, স্যানিটাইজার পৌঁছে দিয়েছেন। রক্ত দিতে গিয়ে সরকারের বাধার মুখে পড়েছেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে বইপত্র তুলে দিয়েছেন। সরকার যে কাজ করতে পারছে না, আমরা, যাঁরা নাকি ৭ শতাংশ - তারাই একাজ করছে। আমরা নৈরাজ্যবাদী নই, স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমাদের নতুন আন্দোলন-সংগ্রামের ফর্ম আয়ত্ত করে লড়াই-আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কাকাবাবুর জন্মদিনে আমরা এই শপথই গ্রহণ করছি।
কমরেড সেলিম তাঁর বক্তৃতায় বলেন, এক বিশেষ পরিস্থিতিতে এই পদ্ধতিতে আজ কাকাবাবুর জন্মদিবস পালিত হচ্ছে। আজ গোটা বিশ্ব এবং দেশের পরিস্থিতির সাপেক্ষে আমাদের দেশের যে সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা, মানুষের অধিকার যেভাবে হরণ করা হচ্ছে, দেশের সম্পদকে বহুজাতিকদের কাছে যেভাবে নিলাম করা হচ্ছে, এনআরসি-এনপিআর-সিএএ-র মাধ্যমে দেশের ১০ কোটির বেশি মানুষকে দেশছাড়া করার চক্রান্ত চলছে - সেসবের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের শপথ নেবার দিন। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী রামমন্দির নির্মাণের ঘটনাকে দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনের সাথে তুলনা করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে অবমাননা করেছেন। ওরা স্বাধীনতা আন্দোলনে ছিল না। তাই স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসও জানে না। সরকার নিজেই সুপ্রিম কোর্ট থেকে রায় বার করে মন্দির নির্মাণকে সরকারের সাফল্য হিসাবে দেখাতে চাইছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সত্যের জয় হলো। আসলে ওরা মিথ্যার বেসাতি করছে। কাকাবাবুর মতো মানুষ তখনকার সময়েই সাম্প্রদায়িকতার বিপদ বুঝতে পেরেছিলেন বলে ধর্মকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার কথা বলেছিলেন।
তিনি বলেন, ৫ আগস্ট দিনটিকে রামমন্দিরের শিলান্যাসের দিন হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল এই জন্যই যে, গতবছর এই দিনে জম্মু-কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল হয়েছিল। আজকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রামমন্দিরের শিলান্যাস করছেন। তিনি আরেকটি মিথ্যা কথা বলেছেন - রামমন্দির হলে নাকি দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা মিটে যাবে। যে সময়ে দেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল হাসপাতাল, অক্সিজেন, ভেন্টিলেটর, নার্স ইত্যাদি, তখন ওরা রামমন্দির নিয়ে রাজনীতি করছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের সবাই নাকি রামমন্দির চেয়েছেন। তাহলে রথযাত্রার সময় এত দাঙ্গা হলো কেন?
তিনি বলেন, এরাজ্যে বিজেপি-কে সুযোগ দিয়েছেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী। ভুবনেশ্বরে গিয়ে অমিত শাহ-র সঙ্গে সেটিং করেছেন, সিপিআই(এম)-কে বাংলাছাড়া করতে আরএসএস-র টাকা ও সাহায্যে, মাওবাদীদের মদতে বিজেপি-কেই সুযোগ করে দিয়েছেন। কিন্তু আজকে এই মহামারীর সময়ে বামপন্থীরাও রয়েছেন মানুষের পাশে। কমিউনিস্টরা যেমন ময়দানে লড়াই করছেন, তেমনি ত্রাণের কাজও করছেন। এটাই আমাদের ঐতিহ্য। আর তৃণমূল-বিজেপি রেশনের চাল, ত্রাণ চুরি করছে। তাই আমাদের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি বিজেপি-তৃণমূল উভয়ের বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
এদিন কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ-এর ১৩২ তম জন্মদিন উপলক্ষে সকালে পার্টির রাজ্য দপ্তরে আবক্ষ মূর্তিতে মাল্যদান করেন পার্টি নেতৃবৃন্দ। সকালে গোবরা করবস্থানে কাকাবাবুর সমাধিস্থলে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়া পার্টির রাজ্য দপ্তরে মুজফ্ফর আহ্মদ পাঠাগার, গণশক্তি প্রিন্টার্সেও শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়। গণশক্তি ভবনে একটি অনলাইন প্রদর্শনীরও উদ্বোধন হয়।
কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পাথিকৃৎ ও পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ-এর জন্মদিন উপলক্ষে সিপিআই(এম)-র পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, হাওড়া, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলি জেলা কমিটির উদ্যোগে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রদ্ধার সঙ্গে দিনটি পালিত হয়েছে। অন্যান্য জেলাতেও একইভাবে কাকাবাবুর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।