৫৭ বর্ষ ৫০ ও ৫১ সংখ্যা / ৭ আগস্ট ২০২০ / ২২ শ্রাবণ ১৪২৭
মতাদর্শগত দৃঢ়তা-মার্কসবাদীদের বৈশিষ্ট্য
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
২০১৮ সাল ছিল কার্ল মার্কসের দ্বিশততম জন্মবর্ষ। ২০২০ সাল হলো কার্ল মার্কসের আজীবন সহকর্মী ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের মতবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের দ্বিশতজন্মবার্ষিকী। আবার এবছর কমরেড ভি আই লেনিনের ১৫০তম জন্মবার্ষিকী। মার্কস, এঙ্গেলস এবং লেনিনের জন্মবর্ষগুলিকে উপলক্ষ করে ব্যাপকভাবে মতাদর্শগত চর্চার বিষয়টিকে পার্টির পক্ষ থেকে উৎসাহিত করা হয়েছে। মতাদর্শগত চর্চা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে পার্টির পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সামগ্রিকভাবে মানবসভ্যতার এক সঙ্কটপূর্ণ সময়ে এই মতাদর্শগত চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
নিঃসন্দেহে এক সঙ্কটপূর্ণ সময়
কোভিড-১৯ অতিমারীর প্রভাব পড়েছে সমগ্র বিশ্বজুড়ে। ইতিমধ্যেই প্রায় দু’কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। ভারতে সংক্রমণের হার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের দৈনিক সংক্রমণের ২০ শতাংশ ভারতে হচ্ছে। এই হার ক্রমবর্ধমান। বাড়ছে মৃত্যুর হারও। এই ভাইরাসের প্রতিষেধক (Vaccine) এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে গবেষণা খুব দ্রুতগতিতে চলছে। বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করেই এই সময়ে সংক্রমণ প্রতিরোধের সংগ্রাম চলছে।
এই সময়ে আমরা দেখছি কোভিড অতিমারীর সংক্রমণের সামনে বিশ্বের পুঁজিবাদী দেশগুলির পরিস্থিতি বড়ই সঙ্গীন। জনস্বাস্থ্য পরিষেবা বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে মুনাফা অর্জনের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করা হয়েছে। সমগ্র জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিপর্যয়কর চিত্র কোভিড অতিমারী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। জনস্বাস্থ্যকে বেসরকারি ক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে নিয়ে নেওয়ার দাবিও পুঁজিবাদী দেশগুলিতে উঠতে শুরু করেছে।
সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে আমরা দেখছি ভিন্ন চিত্র। অতিমারীর মোকাবিলায় রাষ্ট্রের অত্যন্ত তৎপরতা, পরীক্ষা, চিহ্নিত করা, বিচ্ছিন্ন করে কোয়ারেন্টাইন করা, প্রয়োজনে চিকিৎসা করা - সমস্ত কিছুই পরিকল্পনামতো পরিচালিত হওয়ার ফলে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক জনস্বাস্থ্যের দায়িত্ব পালিত হওয়ার ফলে অতিমারীর মোকাবিলায় চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, উত্তর কোরিয়া, লাওসের নজির অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এর প্রভাব অতি উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলির জনগণের ওপরও পড়ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে কল্যাণকর অর্থনীতির যে পথ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কর্তৃক কিছু দায়িত্ব গৃহীত হয়েছিল। যা নয়া-উদারনীতির যুগে সম্পূর্ণ বিসর্জিত হয়েছে, তা পুনরায় ফিরিয়ে আনার দাবিও কিছুক্ষেত্রে উঠতে শুরু করেছে।
বিকল্প সমাজতন্ত্র
মার্কসীয় মতাদর্শের শ্রেষ্ঠত্ব হলো তা একদিকে বৈজ্ঞানিক ও অপরদিকে বিপ্লবী। মানবসমাজের বিকাশের নিরন্তর অগ্রগতির ধারাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পুঁজিবাদ। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বিপুল গতিতে ঘটলেও, জন্মলগ্ন থেকেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সঙ্কটে নিমজ্জিত। এই সঙ্কট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিপুল অগ্রগতি ঘটিয়ে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেলেও, উৎপাদিত সামগ্রী ভোগকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পুঁজিবাদ করতে সক্ষম নয়। মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের মুনাফা বৃদ্ধি করাই হলো পুঁজিবাদের মর্মবস্তু। সম্পদহীন, দরিদ্র মানুষের সংখ্যার স্ফীতি ঘটে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটেই চলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়। অতি-উৎপাদনের সঙ্কট পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। পুঁজিবাদী উৎপাদন যা সৃষ্টি করে, তার বাজার তুলনামূলকভাবে সংকুচিত হয়। এই সঙ্কটের সমাধানের লক্ষ্যে পুঁজিবাদ যে পদক্ষেপ নেয় (হয় ইতিমধ্যে সৃষ্ট উৎপাদিকা শক্তির একটা অংশ ধ্বংস করে অথবা আরও নতুন ক্ষেত্রের উন্মোচন শোষণের লক্ষ্যে) তার ফলে সাময়িকভাবে সঙ্কট থেকে মুক্ত হলেও, আগামীদিনে আরও নতুন সঙ্কটের জন্ম হয়। চক্রাকারে এই সঙ্কট ঘটতে থাকে।
বর্তমান সময়ে বিশ্ব পুঁজিবাদী সঙ্কট যা ২০০৮ সাল থেকে তীব্র রূপ পরিগ্রহ করেছে, তার থেকে কিছুতেই বিশ্ব পুঁজিবাদ মুক্ত হতে পারছে না। এটাকে বলা হচ্ছে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সঙ্কট। সামাজিক উৎপাদনের সাথে ব্যক্তিগত মালিকানার দ্বন্দ্ব। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিপুল অগ্রগতি উৎপাদনের চরিত্রকে আরও বেশি করে সামাজিক করে তুলেছে। অথচ মালিকানার ব্যক্তিগত চরিত্র এক সাধারণ সমাধানের অতীত দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সুবিপুল অগ্রগতি কোভিড অতিমারীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে মানবসমাজকে বেশ কিছুটা সক্ষম করতে পারলেও (যদিও এখনও ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি) পুঁজিবাদী দেশগুলির জনস্বাস্থ্যক্ষেত্র পুঁজির মুনাফার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। সামাজিক মালিকানায় স্বাস্থ্য থাকলে আজ বিশ্বের স্বাস্থ্য চিত্র এতটা করুণ হতো না। এই ব্যবস্থাজনিত সঙ্কটের সমাধান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সম্ভব নয়। একমাত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসানই সামাজিক মালিকানাসম্পন্ন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। সমাজতন্ত্রের অনিবার্যতা সামনে আসছে।
লগ্নিপুঁজি ও সাম্রাজ্যবাদ এবং লেনিন
পুঁজিবাদ বিকাশের পর্যায়ে সাম্রাজ্যবাদের স্তরে উন্নীত হয়। ‘সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’- এভাবেই লেনিন বিশ্লেষণ করলেন। শিল্পপুঁজি ও ব্যাঙ্কপুঁজির মিলনই লগ্নিপুঁজির সৃষ্টি করে। লগ্নিপুঁজি হলো সাম্রাজ্যবাদের বৈশিষ্ট্য। সাম্রাজ্যবাদের প্রথম যুগে লগ্নিপুঁজির চরিত্রের সাথে বর্তমান সময়ে লগ্নিপুঁজির চরিত্রের পার্থক্য ঘটেছে। যার প্রতিফলন ঘটেছে বর্তমানে বিশ্ব পুঁজিবাদে ও সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতিতে। সাম্রাজ্যবাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বের পরিণতিতে বিশ্বজোড়া যুদ্ধ ফেটে পড়ছে না। পুঁজির রপ্তানি নতুন শিল্প সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে না, তৈরি করতে পারছে না নতুন কর্মসংস্থান। লগ্নিপুঁজির ফাটকামুখী চরিত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার জন্য আর্থিক লেনদেন ও পণ্য লেনদেনের গুরুতর ভারসাম্যহীনতা লক্ষিত হচ্ছে।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ - এঙ্গেলসের অবদান
বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সমন্বয়ে গঠিত দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ শ্রমিকশ্রেণির দার্শনিক হাতিয়ার। সমস্ত কিছুর ক্ষেত্রে বস্তুগত ভিত্তিকে বিচার করা এবং বিকাশের ধারায় বস্তুবাদকে বিচার করা - এটাই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির ধারায় আজ আর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করা যাচ্ছে না। বৈপরীত্য (Contradiction), গতি, বিকাশ, নানারূপে দ্বান্দ্বিকতা এগুলি সর্বজনীনতা অর্জন করছে।
বস্তুবাদকে যান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করে দ্বান্দ্বিকতার সাথে যুক্ত করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠায় মার্কসের সাথে এঙ্গেলসও সমভাবে ভূমিকা পালন করেছেন। বস্তুকে ভিত্তি করেই চেতনা - এর অন্যথা নয়। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের দ্বারা তা আরও শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত।
সামাজিক ঘটনাবলির ব্যাখ্যায় ঐতিহাসিক বস্তুবাদের সঠিকতা আজ আরও বেশি করে প্রমাণিত। ঐতিহাসিক বস্তুবাদ সমগ্র ইতিহাস চর্চাকে বিজ্ঞানের রূপ দিয়েছে। হেরাক্লিটাস, ডেমোক্লিটাস থেকে শুরু করে কান্ট, হেগেল, ফয়েরবাখ প্রমুখ দার্শনিকদের কাজগুলি চর্চা করেই মার্কস ও এঙ্গেলস বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি হিসাবে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন। এই দর্শনকে আত্মস্থ করার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস আমাদের সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের সৈনিকে রূপান্তরিত করবে।
মতাদর্শগত দৃঢ়তা ও প্রকৃত বিপ্লবী সংগঠনের সমন্বয়
এক কঠিন ও অভূতপূর্ব পরিস্থিতির মধ্যে সমগ্র মানবসমাজ। মানবসমাজ সাফল্যের সাথে এই অবস্থার অবসান ঘটাবে। বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে মানবসভ্যতা জয়ী হবেই। এই মুহূর্তে সংক্রমণের যে হার, আমাদের সকলকে সতর্ক হতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত স্বাস্থ্যবিধিকে মান্যতা দিতে হবে। আবার এর অর্থ এটা নয় যে, আমরা ভয়ের মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হবো। প্রকৃত কমিউনিস্টরা প্রতিকূলতার সামনে কখনও ভেঙে পড়ে না। মুষড়ে পড়ে না। মতবাদকে ভিত্তি করে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম কমিউনিস্টদের বৈশিষ্ট্য।
শতবর্ষ পূর্বে পরাধীন ভারতে মার্কসীয় মতাদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ভারতের বুকে একদিকে পরাধীনতার অবসান ঘটানো এবং তারইসঙ্গে সমস্ত ধরনের শোষণ থেকে দেশকে মুক্ত করার লক্ষ্যে এদেশে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। যদিও পার্টির প্রথম প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দ শহরে। পরাধীন ভারতে ব্রিটিশদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে, সমস্ত আক্রমণ, প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে মার্কসীয় মতাদর্শের ভিত্তিতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার অন্যতম কারিগর ছিলেন কমরেড মুজফ্ফর আহম্দ। কাকাবাবু হিসাবেই তিনি পার্টিকর্মীদের কাছে পরবর্তীকালে পরিচিত হয়েছেন। কাকাবাবুর সমগ্র জীবন সংগ্রামের জীবন। ওনার সমগ্র জীবন আমাদের কাছে অসাধারণ শিক্ষা।
মতাদর্শ ব্যতিরেকে কমিউনিস্ট পার্টি তথা কমিউনিস্ট কর্মী গড়ে উঠতে পারে না। সমগ্র জীবন এই উপলব্ধি নিয়েই কমরেড মুজফ্ফর আহম্দ চলেছেন। মার্কসীয় মতবাদের চিরায়ত রচনাবলি, বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সৃষ্টিগুলি প্রগতিশীল মানুষ, বিশেষ করে কমিউনিস্ট কর্মীদের কাছে সহজে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি’র প্রতিষ্ঠায় তিনি মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বহুবিধ কষ্ট ও প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতেই হবে। মতাদর্শে বলীয়ান হলেই সেই আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে, যার ওপর ভিত্তি করে যে-কোনো ধরনের কঠিন অবস্থার মোকাবিলা করা সম্ভব। কমরেড মুজফ্ফর আহম্দ ও তাঁর সমসাময়িক কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথপ্রদর্শকদের সমগ্র জীবন তার বলিষ্ঠ উদাহরণ। আবেগে না ভেসে মার্কসীয় মতবাদের ভিত্তিতে পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করা ও এগিয়ে চলার পথ চিহ্নিত করা - একাজ তাঁরা করতে সক্ষম হয়েছেন। আবার মতাদর্শগত বিচ্যুতির সাথে আপস করেননি। সংশোধনবাদী বিচ্যুতিই হোক, অথবা সঙ্কীর্ণতাবাদী বিচ্যুতিই হোক, যে-কোনো ধরনের মতাদর্শগত বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সংগ্রামও করেছেন।
মতাদর্শে দৃঢ় না হতে পারলে বর্তমান জটিল সময়ে যখন সাম্রাজ্যবাদ বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে নিজের মতো করে ব্যবহার করছে, মানবচিন্তন জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে, মানবসমাজের ওপর নানাবিধ নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে, মতাদর্শগত বিভ্রান্তির জাল তৈরি করছে, তখন সমাজের মৌলিক রূপান্তরের অর্থাৎ শোষণভিত্তিক সমাজের অবসান ঘটিয়ে শোষণহীন স্তরে মানবসমাজের উত্তরণের মূল সেনানী কমিউনিস্টদের মার্কসীয় মতাদর্শকে ভিত্তি করে মতাদর্শগত দৃঢ়তা বড়ো বেশি প্রয়োজন। মতাদর্শকে ভিত্তি করে বিপ্লবী রাজনীতি ও তার সাথে প্রকৃত বিপ্লবী সংগঠনের সমন্বয় - সমাজের বৈপ্লবিক রূপান্তরের জন্য যা প্রয়োজন। মতাদর্শগত দৃঢ়তা এবং সর্বহারা বিপ্লবী সংগঠক - এই দুইয়ের সমন্বয় ঘটেছিল কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের জীবনে।
মার্কসবাদ-লেনিনবাদের শ্রেষ্ঠত্ব এইখানে, এই মতবাদ প্রকৃত মানবমুক্তি ও মানববিকাশের পথ চিহ্নিত করেছে।
বিজ্ঞানভিত্তিকভাবে শোষণমুক্ত মানবসমাজ প্রতিষ্ঠা কিভাবে সম্ভব, তা উপস্থিত করেছে। মানবজ্ঞানের ভাণ্ডারে অমূল্য রত্ন হলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। এই মতবাদের শ্রেষ্ঠত্বের আর একদিক হলো এটা সৃজনশীল বিজ্ঞান। প্রয়োগের ধারায় তা নিরন্তর বিকশিত হচ্ছে। মতান্ধতা, গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই মার্কসীয় মতাদর্শে।
ভারতীয় সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমরা প্রবেশ করেছি। আরএসএস-বিজেপি’র সরকার করোনা অতিমারীর মোকাবিলায় চরম ব্যর্থ। তার সাথে নয়া-উদারনীতির পথ ধরে আরও দ্রুতগতিতে তারা অগ্রসর হওয়ার পরিণতিতে আক্রান্ত শ্রমজীবী মানুষ - তাদের রুটি-রুজি ও অধিকার। কর্মহীনতা ভয়ঙ্করভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্ষুধার যন্ত্রণার শিকার এসব ভারতবাসীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে ক্রমান্বয়ে পুষ্ট করা হচ্ছে। আক্রান্ত, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের প্রতিরোধ-আন্দোলন ভেঙে দেওয়ার লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর আক্রমণ তীব্রতর হচ্ছে। রাজ্যের অধিকার হরণ প্রক্রিয়া বৃদ্ধি পেয়েছে। সাজানো মামলায়, বিনাবিচারে বিরোধীদের জেলে পোড়া হচ্ছে, স্বৈরাচারী আক্রমণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র বোঝাপড়ার রাজনীতি আমরা প্রত্যক্ষ করছি। সমস্ত প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে এই কথা প্রচার করতে যে, এরাজ্যে হয় বিজেপি, নয় তৃণমূল - আর কেউ নেই। বামপন্থীদের অপ্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা চলছে। এই রাজ্যে তৃণমূলের ভয়ঙ্কর দুর্নীতি চলছে, স্বৈরাচারী একটি দল তৃণমূল কংগ্রেস। শ্রমিক, কৃষক, মেহনতি মানুষের স্বার্থের চরম বিরোধী এই রাজ্য সরকার। অতিমারীর মোকাবিলায় যেমন এরা ব্যর্থ, ‘আমফান’ ঘূর্ণিঝড়ের মোকাবিলায়ও এরা ব্যর্থ। চরম মিথ্যাচারী এই তৃণমূল কংগ্রেস দল এবং সরকার। ছাত্র, শিক্ষক, কৃষক সহ সমগ্র মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার এই রাজ্যে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত।
আত্মবিশ্বাসের সাথে অতিমারীর মোকাবিলা এবং আরএসএস-বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস - এই দুই শক্তিকে এই রাজ্যে পরাস্ত করার দায়িত্ব আমাদের সামনে। এই লড়াইয়ে যাদের ঐক্যবদ্ধ করা যায়, এমন সকলকে ঐক্যবদ্ধ করেই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। মতাদর্শগত দৃঢ়তাই সাফল্যের গ্যারান্টি। ‘‘মার্কসবাদী আপ্তবাক্য নয়, চলার ক্ষেত্রে পথনির্দেশক’’ - কমরেড লেনিনের এই মহান শিক্ষাকে স্মরণে রেখেই আমাদের মতাদর্শে বলীয়ান হয়ে অগ্রসর হতে হবে। মতাদর্শগত দৃঢ়তা ও সুসংহত সংগঠন - এই দুইয়ের মেলবন্ধন ঘটুক আমাদের সকলের জীবনে।