৫৭ বর্ষ ৫০ ও ৫১ সংখ্যা / ৭ আগস্ট ২০২০ / ২২ শ্রাবণ ১৪২৭
অ্যাট এ গ্লান্স...
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বপ্নরাজ্য হাতছানি দিচ্ছে। আর জাস্ট একটুখানি। তারপরেই তরতর করে মই বেয়ে দেশের মানুষ ঢুকে পড়বে সব পেয়েছির দেশে। দু’হাজার ফিট নিচে রূপোর ইটে কীর্তি পুঁতে দেওয়া হয়েছে। ভূমিপুজো সমাপ্ত। ত্রেতা ডাকিতেছে। অতঃপর কিয়দ্দিনের মধ্যেই ভারতবাসীর দরজায় দরজায় রামরাজ্য আসিয়া খটাং খট খটাং খট করিয়া কড়া নাড়িতে শুরু করিবে। ললিপপ চুষিতে চুষিতে কী আনন্দ, কী আনন্দ বলিয়া সমস্বরে নৃত্য শুরু হইলো বলিয়া। এক্ষণে দেশবাসীর আর কোনো চিন্তা থাকিবে না। ‘রামরাজ্য’, ‘আচ্ছে দিন’ অপেক্ষা অধিকতর উৎকৃষ্ট ও পুষ্টিকর খাদ্য। ইহা ‘ফিল গুড ফ্যাক্টর’ অপেক্ষায় অধিক উত্তম। ইহাতে পেটে খাইতে না পাইলেও পিঠে উত্তম সহিয়া যায়। দুই চারি পিস বেগড়বাই করা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বাদ রাখিয়া, বিকারহীন হাভাতে দেশবাসীর অধিক অংশের তাহাতেই সর্বসুখ। মহামারী যে এরূপ আশীর্বাদস্বরূপ ভারতভূমির উপর ঝরিয়া ঝরিয়া কৃপা বর্ষণ করিবে, সংস্কারের ওপেন মার্কেট খুলিয়া দিবে, তাহা কিয়দ্দিন পূর্বেও কল্পনার অতীত ছিল। আহা কী আনন্দ! আহা কী আনন্দ!
গুরুচণ্ডালী হয়ে গেল বুঝি? ও ঠিক আছে। এখন সব চলবে। আপনাদের দয়ার শরীর। এটুকু ক্ষমা ঘেন্না আপনারা করে নেবেন জানি। করে নেনও। এই যেমন ‘সীতা দেশের প্রথম টেস্ট টিউব বেবি। রামায়ণের সময়েও টেস্ট টিউব বেবির ধারণা ছিল’। ২০১৮ সালের ১ জুন উত্তরপ্রদেশের উপ মুখ্যমন্ত্রী দীনেশ শর্মার এই মন্তব্যে আপনারা কিছু মনে করেছেন? করেননি। মহাভারতের সময় সাংবাদিকতা ছিলো। সঞ্জয় কুরু পাণ্ডবের যুদ্ধের লাইভ টেলিকাস্ট করেছিলেন। দীনেশ শর্মার এই মন্তব্যেও আপনারা কিছু মনে করেননি সেটাও জানি। আবার মহাভারতের যুগে ইন্টারনেটের ব্যবহার ছিলো। ২০১৮-র ১৭ এপ্রিল করা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব-এর এই মন্তব্যেও আপনারা কিছু মনে করেননি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সত্যপাল সিং যেমন ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে বলেছিলেন - ডারউইন তত্ত্ব ভুল। কারণ কেউ কোনো বনমানুষকে মানুষে রূপান্তরিত হতে দেখেনি। আর ফেব্রুয়ারি মাসের ২৮ তারিখ বলেছিলেন - নিউটন আবিষ্কার করার বহু আগেই আমাদের দেশের মন্ত্রে গতিসূত্রের কথা বলা হয়েছিলো। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানি যেমন বলেছিলেন - নারদের মতই গুগলও সমস্ত তথ্য যোগায়। তাতেও আপনার কিছু মনে হয়নি। আবার ২০১৪ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বলেছিলেন গণেশের মাথায় হাতির মাথা আসলে প্লাস্টিক সার্জারির ফসল কিংবা কর্ণ মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নেননি। অর্থাৎ সেটা ছিল জেনেটিক সায়েন্স। তখনও তো আপনারা কিছু মনে করেননি। ভারতে মুসলিমরা আসার আগে পর্যন্ত স্বর্ণযুগ ছিলো সেটাও তো ইতিহাস না পড়েই আমাদের বেশ বিশ্বাস করিয়ে দেওয়া গেছে। কোনো সমস্যা হয়েছে কি? এই পথ ধরেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম কাব্যগ্রন্থের নায়ককে ইতিহাসের চরিত্র বুঝিয়ে দিতেও আমাদের অসুবিধে হয়নি। যদিও বঙ্কিমচন্দ্র বহুদিন আগেই ‘কৃষ্ণচরিত্র’তে লিখে গেছেন - ‘হিন্দুদিগের পুরাণেতিহাস মধ্যে ঐতিহাসিক তত্ত্বের অনুসন্ধান পরিত্যাগ করিয়া অন্য শাস্ত্রের আলোচনায় প্রবৃত্ত হউন।’ আপনি মানেননি। তিনিই তো লিখেছেন - ‘গ্রহণ করা না করা, পাঠকের নিজের বুদ্ধি ও চিত্তের ওপর নির্ভর করে, অনুরোধ চলে না।’
আসলে ‘যুক্তিযুক্ত আকারে না থাকলেও যুক্তি তো সবসময়েই থাকে।’ সবকিছুর পেছনেই থাকে। পুরাণ, ধর্ম, ইতিহাস - সবকিছু নিয়ে ঘোল বানিয়ে মানুষকে ঘোল খাওয়ানো, গোল বাধানো - এ সবকিছুর পেছনেও একটা নিখুঁত যুক্তি আছে। ধর্মের ঘুঁটে যুগ যুগ ধরেই ভালো জ্বালানি। আগুনের উপাদেয় খাদ্য। স্বপ্নের রামরাজ্যের সঙ্গে কল্পনার আচ্ছে দিন-এর মিশেল তাই পাবলিক ভালো খায়। অভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকের পেটের খিদে মেটানোর, কাজ না থাকা বেকারের মনের দুঃখ মেটানোর সবথেকে ভালো খাদ্য তাই রামরাজ্য। ‘নিপীড়িত প্রাণীর দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন বিশ্বের হৃদয়, আত্মহীন অবস্থার প্রাণ’কে ব্যবহার করে নিঃশব্দ এই খেলা বহুদিনের। খুড়োর কলের খুড়ো যেমন সামনে টাঙানো রুটি দেখে দেখেই রাস্তা পেরিয়ে যান অনেকটা তেমনই। ‘হেসে খেলে দু-দশ যোজন চলবে বিনা ক্লেশে,/খাবার গন্ধে পাগল হয়ে জিভের জলে ভেসে।’
দেশে করোনা সংক্রমণজনিত পরিস্থিতি যাই হোক না কেন সামনে রাম ঝোলানো থাকলে ইট পোঁতা আটকায় না। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিক্রি আটকায় না। ব্যাঙ্কের সংযুক্তি আটকায় না। এম এল এ কেনাবেচা আটকায় না। সরকার ফেলে দেওয়া আটকায় না। রেলের আংশিক বেসরকারিকরণ আটকায় না। মব লিঞ্চিং আটকায় না। লকডাউনের অজুহাত দিয়ে শ্রমিক, কর্মচারীদের বেতন কাটা আটকায় না। ছাঁটাই আটকায় না। কর্পোরেট হাউসের লাভের অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়া আটকায় না। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি আটকায় না। আর সবশেষে থালা বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে করোনা সংক্রমণ বা মৃত্যুও আটকায় না।
আজ বৃহস্পতিবার, ৬ আগস্ট সকালে কেন্দ্রীয় সরকারের পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে করোনা সংক্রমিত প্রায় সাড়ে ১৯ লাখ। মৃত্যু হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষের। করোনা সংক্রমণে ত্রস্ত মহারাষ্ট্র থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু থেকে কর্ণাটক, দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশ। অবশ্য চিন্তার কোনো কারণ নেই। থালা বাজানো, দিয়া জ্বালানো, ‘গো করোনা গো’, বলে নাচের পর বাজারে নতুন আমদানি - ‘‘আসুন আমরা সবাই মিলে মানুষের সুস্থতা কামনায় এবং করোনা ভাইরাস মহামারীর অবসান ঘটাতে আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা করি। ২৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধে ৭টায় নিজের বাড়িতে পাঁচবার করে হনুমান চালিশা পাঠ করুন। ৫ আগস্ট ঘরে প্রদীপ জ্বালিয়ে রামের উদ্দেশ্যে আরতি করে এই অনুষ্ঠান (হনুমান চালিশা পাঠ) শেষ করুন।’’ বক্তা মালেগাঁও বিস্ফোরণে অন্যতম অভিযুক্ত বর্তমানে বিজেপি সাংসদ সাধ্বী প্রজ্ঞা। অতএব, ৫ আগস্ট যেহেতু চলে গেছে তাই করোনার বিদায় এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ধর্মে মিলায় বস্তু, বিজ্ঞানে বহুদূর।
গল্পটা অনেকটা সেই মাছ ধরা শেখানোর মতো। মাছ ধরা শেখার পরে মানুষ যে মাছটা ধরেন সেটা তাঁর নিজের নয়। কাউকে না কাউকে সেই মাছের জন্য পয়সা দিতে হয়। আর মাছ ধরার নেশা যেহেতু ধরিয়ে দেওয়া হয় তাই মাছের জন্য পয়সা দিয়েই যেতে হয়। নেশাই আপনাকে ছুটিয়ে মারবে। নেশা কাটানোর পথ খুঁজতে গেলেই রাজনীতি। করোনার ভরা বাজারে লকডাউন আর আনলকের গল্প করা ছাড়া আর কীই বা করার আছে বলুন। রাজনীতি তো এইসময় করা যাবে না। ধর্মচর্চা চলতে পারে। তিরুপতি মন্দিরের পুরোহিত সহ বহু কর্মী করোনা সংক্রমিত হলে, প্রাক্তন পুরোহিতের মৃত্যু হলেও মন্দির খোলা রাখা যেতে পারে। আদালতের বিশেষ অনুমতিতে ঐতিহ্য বজায় রাখতে রথযাত্রা হতেই পারে। বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নমাজ হতে পারে, জামাত হতে পারে। অয্যোধ্যায় বহু মানুষ করোনা সংক্রমিত হলেও এই সময়েই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হতেই পারে। সমস্ত মৃত প্রজন্মের ঐতিহ্য জীবন্তদের মস্তিস্কে দুঃস্বপ্নের মতো বহন করে চলা নিয়ে বেশি ভেবে লাভ কী!
আমি বেশ বুঝতে পারছি রাজনীতি এড়িয়ে চলতে গিয়ে লেখাটা ভীষণ রকমের ঘেঁটে গেছে। কোনটা রাজনীতি, কোনটা ধর্ম, কোনটা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য, রুটি রুজির লড়াইয়ের জন্য প্রধান প্রয়োজন - সবই বেমালুম গুলিয়ে গেছে। হ্যাঁ। আপনারও গেছে। আপনি যখন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার তাগিদে বারবার হাত স্যানিটাইজ করছেন, তখন অন্যদিকে বেচার তাড়নায় দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সম্পদের মালিকানা থেকে হাত ধুয়ে ফেলছে সরকার। ফিকি-র এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রকের অতিরিক্ত সচিব কে কে রাজারাজন জানিয়েছেন, ১ লক্ষ কোটি টাকার সম্পত্তি বিক্রির একটি পরিকল্পনা রয়েছে নীতি আয়োগের। এরপর আগামী ৫ বছরের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করার কথাও নীতি আয়োগকে বলা হয়েছে। এই পরিকল্পনার সঙ্গেই সরকার ঠিক কোন কোন সেক্টরকে বিক্রি করতে চায় তা ঠিক করা হবে। এসব নিয়ে বেশি চিন্তা করবেন না। বিজেপি নেতা, মেঘালয়ের রাজ্যপাল ‘দক্ষিণপন্থী’ তথাগত রায় তো বলেই দিয়েছেন - “সরকারি শিল্প বেচে দেওয়া হচ্ছে বলে অনেকে খুব ক্ষুণ্ণ হয়েছেন। এই ক্ষোভ আর কিছু নয় নেহরুবাদী-বামপন্থী শিক্ষার কুফল। কারখানা বেচে দেওয়াই উচিত, কারণ সরকারের কাজ নয় শিল্প চালানো, সরকারের কাজ শিল্পের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। সরকার শিল্প চালাতে গিয়েই সোভিয়েত দেশ উঠে গেল।” মাথা থেকে পা, শিং থেকে লেজ - বক্তব্য একই। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে স্বাদ বদলে বদলে পরিবেশন। সেখানে রায়, শাহ, মোদী, রূপানি, দেব, নাথ-এ কোনো পার্থক্য নেই। সবটুকুই ক্রোনোলজি মেনে।
যেমন সবকিছু বেচার ক্রোনোলজি মেনেই সম্প্রতি সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাঙ্কগুলোকে আরও পেশাদারি পদ্ধতিতে চালানোর জন্য সরকারি অংশীদারিত্বের পরিমাণ ২৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হোক বলে প্রস্তাব দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। এই আর্থিক সংস্থাগুলো আরও পেশাদার ভঙ্গিতে কাজ করুক তা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে এই প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কোটি কোটি টাকা ঋণ মকুব, ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণের পর এবার নতুন পদক্ষেপ। আপনার আচ্ছে দিন কবে আসবে জানা নেই। তবে বিশ্বাস রাখবেন যে - মোদী হ্যায় তো সবকুছ মুমকিন হ্যায়। সবকুছ বেচ ডালনা ভি। আপনি যে দড়িটা এঁদের গলায় পরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এঁরা তো সেই দড়িটাও আপনাকে বিক্রি করবে।
যে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন - আত্মনির্ভরতা নয়, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আত্মসমর্পণ চলছে বিদেশী পুঁজির কাছে। একের পর এক দেশের সম্পত্তি বেচে দেওয়া হচ্ছে। দেশের সম্পদ তুলে দেওয়া হচ্ছে বিদেশী কোম্পানির কাছে। তিনি এই সময়েই আরও জানিয়েছেন -‘‘গরিব ভারতীয়দের থেকে লাভ করার নাম মোদিনোমিক্স, যেখানে ধনী পুঁজিপতিরা লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ ছাড় পেয়ে যান। সরকারের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব অত্যন্ত লজ্জাজনক এবং নিন্দনীয়।”
এতখানি লিখে ফেলার পর এবার অবশ্যম্ভাবী প্রশ্ন অতঃ কিম? লাখ টাকার প্রশ্ন সেটাই। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো অথবা স্রোতের বিপরীতে যাত্রা। বামপন্থীরা যে চলতি হাওয়ার স্রোতে গা ভাসাতে রাজী নয় তার প্রমাণ তো এই পরিস্থিতিতেও প্রতিদিন দাঁতে দাঁত চেপে মানুষের পাশে থাকার লড়াই জারি রাখা, লড়াই চালিয়ে যাওয়া। হাজারো আচ্ছে দিন-এর গল্প শোনানোর পরেও হাসিম শেখ আর রামা কৈবর্তদের এখনও ‘দুই প্রহরের রৌদ্রে, খালি মাতায়, খালি পায়ে, এক হাঁটু কাদার উপর দিয়া দুইটা অস্থিচর্ম্মবিশিষ্ট বলদে, ভোঁতা হাল ধার করিয়া আনিয়া’ জমি চাষ করতে হয়। তাঁদের সুদিন ফেরানোর লড়াই লড়তে বামপন্থীরা অঙ্গীকারবদ্ধ।