৫৭ বর্ষ ৫০ ও ৫১ সংখ্যা / ৭ আগস্ট ২০২০ / ২২ শ্রাবণ ১৪২৭
নজরুলের ‘লাঙল’-এ কমিউনিস্ট পার্টি এবং কাকাবাবু
গৌতম রায়
‘নবযুগ’ পত্রিকার প্রথম পর্যায় (১৯২০) পরিচালনার সূত্রেই মুজফ্ফর আহ্মদ, কাজী নজরুলের চিন্তাচেতনার স্তরে ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সম্প্রীতির দ্যোতনার সঙ্গে যুক্ত করেছিলেন মেহনতি জনতার মুক্তির আকাঙ্ক্ষাটিকে। শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি জনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে কমিউনিস্ট ভাবধারার প্রতি নজরুলের যে আন্তরিক আকর্ষণ, তার একটা মূর্ত ছবি আমরা দেখতে পাই, নজরুল সম্পাদিত ‘লাঙল’ পত্রিকাতে। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার ভিতর দিয়ে একটা বড়ো অংশের মানুষ, যাঁরা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারত থেকে তাড়াতে তৎপর ছিলেন, তাঁদের উপর অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়েছিল ব্রিটিশ। নজরুল তাঁর ‘লাঙল’-এ মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় যুক্ত বিপ্লবীদের কর্মকাণ্ড যেভাবে অকুতোভয়ে প্রকাশ করেছিলেন, তেমনটা সমসাময়িক অন্যান্য পত্রপত্রিকায় প্রায় দেখাই যায় নি।তার পাশাপাশি ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রাথমিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত আলোচনা করে, সেই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কাকাবাবুর সংযোগের যে ধারাবিবরণী ‘লাঙল’-এ প্রকাশিত হয়েছিল, তা কেবল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষেত্রেই নয়, গোটা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটি বিশেষ প্রয়োজনীয় দলিল হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার দাবি রাখে।
নজরুল সম্পাদিত ‘লাঙল’-এই প্রথম (১৪ জানুয়ারি, ১৯২৬, পৃষ্ঠা-১৩) প্রকাশিত হয়ঃ ‘‘ভারতীয় প্রথম কমিউনিস্ট কনফারেন্স’’। সেখানে লেখা হচ্ছেঃ ‘‘যেহেতু দেশীয় ও বৈদেশিক ধনিকগণের দ্বারা এবং ভারতীয় জমিদারগণের শোষণবৃত্তির দ্বারা ভারতবর্ষের শ্রমিক ও কৃষকগণ মানুষের মতো জীবনযাপন করিতে পারিতেছে না, যেহেতু ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রীয় দলসমূহে বুর্জোয়া (অভিজাত)-দেরই সমধিক প্রভুত্ব বিদ্যমান রহিয়াছে আর সেই প্রভুত্ব সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় কৃষক ও শ্রমিকদের উন্নতির পরিপন্থী, সেইহেতু ভারতীয় কমিউনিস্টগণের এই সম্মিলন প্রস্তাব করিতেছে যে, ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকগণের মুক্তির জন্য একটি দল গঠিত হউক। এই দল ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি (Communist Party of India) নামে অভিহিত হইবে’’।
কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশ্যঃ ‘‘ভারতে কৃষক ও শ্রমিকগণের সাধারণতন্ত্র (স্বরাজ) প্রতিষ্ঠিত করা। ভূমি, খনি, গৃহ, টেলিগ্রাফ, রেলওয়ে ইত্যাদি যে সমস্ত জনসম্পদের উপর জনসাধারণের অধিকার স্থাপিত হওয়া উচিত সেই সমস্ত সম্পদকে সর্বাধিকারভুক্ত ও সর্বনাগরিকের আয়ত্ত করিয়া ভারতীয় শ্রমিক ও কৃষকগণের মানুষের মতো জীবনযাত্রা নির্বাহ করার ব্যবস্থা করা কমিউনিস্ট পার্টির সাক্ষাৎ উদ্দেশ্য হইবে।’’ এটি গত শতকের দুইয়ের দশকের মধ্যপ্রান্তে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষাতে লেখা একটি বড়ো রকমের সামাজিক বিপ্লবাত্মক কাজ হিসেবেই পরিগণিত হয়।
মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা ঘিরে গত শতকের দুইয়ের দশকে ভারতীয় সংবাদপত্রগুলি তেমনভাবে সোচ্চার ছিল না। বাংলা থেকে যেসব পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতো, সেখানেও সংশ্লিষ্ট বিষয়টি ঘিরে তেমন কিছু আলোচনা থাকত না। নজরুল কিন্তু অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কানপুরে অনুষ্ঠিত প্রথম ভারতীয় কমিউনিস্টদের সন্মেলনে ভারতীয় কমিউনিস্ট মুজফ্ফর আহ্মদের কারাবরণ ঘিরে যে সমবেদনা জ্ঞাপনের বিষয়টির বিস্তারিত উল্লেখ তাঁর ‘লাঙল’-এ করেছিলেন তার বিশেষ ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। কাকাবাবু সহ মোহাম্মদ আকবর খান (১০ বছরের বেশি সময় ব্রিটিশ তাঁকে কারারুদ্ধ করে রেখেছিল), গওহর রহমান (২ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন), মিঞা আকবর শাহ্ (২ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন), সৈয়দ মোহাম্মদ হাবিব (১ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন), আবদুল মজিদ (১ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন), রফিক আহমদ (১ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন), ফিরোজ দীন (১ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন), মোহাম্মদ সুলতান (১ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন), শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে (৪ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন), মোহাম্মদ শওকত উসমানী (৪ বছরেরও বেশি সময় কারারুদ্ধ ছিলেন), নলিনীভূষণ দাশগুপ্ত (৪ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। পাকস্থলীর বিশেষ সমস্যার জন্যে মুক্তি পেয়েছিলেন), মোহাম্মদ শফিক (৩ বছরেরও বেশি সময় কারারুদ্ধ ছিলেন)।
চার বছর মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় কারারুদ্ধ থাকার পর যক্ষ্মারোগে কাকাবাবুর জীবন বিপন্ন হওয়াতে ব্রিটিশ বাধ্য হয়েছিল তাঁকে মুক্তি দিতে - এই বিষয়টি বাঙালি পাঠকদের কাছে প্রথম তুলে ধরেছিল নজরুলের ‘লাঙল’। আরএসএস’র প্রতিষ্ঠার পর (’২৫) তাদের নেতারা সাম্প্রদায়িক অভিমুখে যাবতীয় কর্মকাণ্ডকে পরিচালিত করে তখন ব্রিটিশদের সাহায্য করতে সবরকমভাবে তৎপর। অপরপক্ষে সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলনের ভিতর দিয়ে ব্রিটিশদের দেশ থেকে তাড়াতে উদগ্রীব ভারতের জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা নির্বিশেষে একদল যুবক ব্রিটিশের জেলে নানা নির্যাতন সয়ে শ্রমিক-কৃষকের স্বরাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করছে - নজরুল তার অনুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরছেন। বন্ধু মুজফ্ফর আহ্মদের উপর কারাগারে ব্রিটিশের অত্যাচার কতখানি চরমপর্যায়ে যাওয়ার ফলে তাঁর যক্ষ্মারোগ একদম প্রাণঘাতী হয়ে দাঁড়ায় - এ বিষয়ে নজরুলের ‘লাঙল’ই প্রথম সোচ্চার হয়েছিল।
কমিউনিস্ট পার্টি গঠন সম্পর্কে কাকাবাবুর বিবৃতিটি ‘লাঙল’-এ প্রকাশ করে (৭ মাঘ ১৩৪২ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা-১৫) এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন নজরুল। বিবৃতিটিতে কাকাবাবু বলছেনঃ ‘‘সকলেই জানেন ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কানপুরে ভারতীয় কম্যুনিস্টদের প্রথম সম্মেলন হয়েছিল। স্থির হয়েছে বম্বেতে কম্যুনিস্টদের একটি কেন্দ্র কার্যালয়, আর কানপুর, কলিকাতা, লাহোর ও মাদ্রাজে পৃথক পৃথক শাখা কার্যালয় স্থাপন করা। বাংলাদেশ হতে প্রতিনিধি হিসেবে একমাত্র রাধামোহন গোকুলজি - উপস্থিত ছিলেন। আমিও উপস্থিত ছিলুম বটে, কিন্তু, আমি গিয়েছিলুম আলমোড়া থেকে। কলিকাতায় কার্যালয় স্থাপন করা ও বাংলাদেশে পার্টি গঠন করার ভার আমার ওপরে দেওয়া হয়েছে। আমার স্বাস্থ্য মোটেই ভাল নয়। সংযুক্ত প্রদেশের কারাগারে ক্ষয়রোগে ভুগে ভুগে যখন মরণাপন্ন অবস্থায় পৌঁছেছিলুম তখন ভারত গবর্নমেন্ট আমায় মুক্তি দিয়েছেন। তারপর কুর্ম্মাচলের আলমোড়াতে ৩ মাস থেকে যদিও চলাফেরার শক্তি কতকটা ফিরিয়ে পেয়েছি, তথাপি এই ঘৃণাত ব্যাধি হতে একেবারে মুক্ত হতে এখনো পারিনি এবং আর কখনো পারব কিনা তাও জানিনে। এ অবস্থায় কলিকাতায় থাকা আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর তো নয়ই, পরস্তু, সম্ভবপরও হয়তো হয়ে উঠবেনা। তবে, আমার একার অভাবে বাংলাদেশে কম্যুনিস্ট পার্টি গঠন স্থগিত থাকা কিছুতেই উচিত হবে না। বাংলায় যাঁরা কম্যুনিস্ট আছেন, তাঁরা সমবেত হয়ে পার্টি গঠন করুন, এই সনির্বন্ধ অনুরোধ আমি তাঁদের জানাচ্ছি। কম্যুনিস্ট হতে বলা এদেশের আইন অনুসারে অপরাধ নয়। বাংলাদেশের কম্যুনিস্টগণ পার্টি গঠন সম্বন্ধে কতদূর কি করতে রাজি আছেন তা আমায় জানালে আমি বড় বাধিত হব।’’ (‘লাঙল’-এর বানান অপরিবর্তিত) কাকাবাবুর স্বাক্ষরযুক্ত এই বিবৃতিটি প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর তৎকালীন কলকাতার সাময়িক বাসস্থান ৩৭ নম্বর হ্যারিসন (আজকের মহাত্মা গান্ধী) রোডের ঠিকানা থেকে।
কমিউনিস্ট মতাদর্শ এবং ধর্ম-এ নিয়ে বিতর্ক এবং নানা বিতণ্ডা মূল বিষয় থেকে মানুষদের দৃষ্টিকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। ‘সাম্যবাদ ও ধর্ম্ম’ ঘিরে ‘লাঙল’-এ লেখা হচ্ছেঃ ‘‘দুরভিসন্ধি প্রণোদিত হইয়া অনেকে বলেন, সাম্যবাদ ধর্ম্মের শত্রু। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, ধর্ম্মবিষয়ে আমরা যতদূর সম্ভব স্বাধীনতা ও পরমতসহিষ্ণুতা সমর্থন করিয়া থাকি। যে কেহ আমাদের নীতিতে বিশ্বাসবান হইবে, হিন্দু হউক, মুসলমান হউক, কি খৃষ্টান হউক বা বৌদ্ধ হউক, কোনো ধর্ম্ম তাহার থাক বা না থাক আমরা তাহাকেই আমাদের দলে গ্রহণ করিব। অর্থাৎ আমরা সকল ধর্ম্মকেই স্বীকার করি এবং কোনো ধর্ম্ম না থাকাটাকেও অর্থাৎ নাস্তিকতাকেও একটি ধর্ম্ম মনে করি। কোনো কোনো মুসলমান নেতা এই অমূলক অপবাদ দিতেছেন যে, সাম্যবাদ ইসলামের শত্রু। প্রকৃতপক্ষে ইহা আদৌ সত্য নহে, সাম্যবাদের চেয়ে ইসলামই ধনিকতন্ত্রের অধিকতর বিরোধী এবং যে পর্যন্ত একটি প্রাণীও অভুক্ত থাকিবে, সে পর্যন্ত ধনিকদের ব্যবসায়ে অর্থসঞ্চয় করিবার কোনো অধিকার নাই, এই জন্যই ‘জাকাত’-এর, বাধ্যবাধকতা ন্যস্ত করা হইয়াছে। নামাজের পরই কোরানে জাকাতের উপর জোর দেওয়া হইয়াছে। প্রথম খলিফা যাহারা ‘জাকাত’, দিতে অস্বীকার করিয়াছিল, তাহাদের বিরুদ্ধে ‘জেহাদ’ বা ধর্ম্মযুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছিলেন। পরিশ্রম বিনা শুধু মূলধনের উপর সুদ গ্রহণ অন্যায়, এই জন্যই মুসলমানদের পক্ষে সুদ খাওয়া নিষেধ। এই জন্যই ইসলামধর্ম্ম সুদ গ্রহণকে এত ঘৃণার চক্ষে দেখিয়াছেন। সাম্যবাদও এই সুদ গ্রহণ ব্যাপারটাকে অন্যায় বলিয়া ঘোষণা করিতেছে।’’ (ঐ)। মওলানা হসরৎ মোহানী কানপুরের সম্মেলনে যে বক্তৃতা করেন তার একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণও নজরুল ‘লাঙল’-এর ওই সংখ্যাতে প্রকাশ করেছিলেন।
‘লাঙল’-এ (১৪ মাঘ, বৃহস্পতিবার, ১৩৩২ বঙ্গাব্দ, পৃষ্ঠা-৯) কোথায় প্রতিকার নামক একটি আগুন ঝরানো লেখা কাকাবাবু লিখছেন। সেখানে তিনি লিখছেনঃ ‘‘বালির ওপরে বালির ইমারত তৈয়ার হতে পারে না, এ কথা সকলেই জানেন, কিন্তু, তথাপি আজ ক’বছর থেকে ভারতবর্ষে একারভাবে সে চেষ্টাই চলছিল। অদ্ভূত অবৈজ্ঞানিক উপায়ে কোনো কাজ করতে গেলে যা হয়ে থাকে, ভারতের ভাগ্যেও ঠিক আজ তাই হতে চলেছে, লক্ষ্মৌ কংগ্রেসের দিন থেকে ভারতে যে একটি রাষ্ট্রীয় পাকা ইমারত গড়ে উঠেছিল, সেইটে আজ ভেঙে পড়তে বসেছে - শুধু যে ভেঙে পড়তে বসেছে তা নয়, প্রকৃতির নিয়মানুসারে তাকে ভেঙে পড়তেই হবে। ভারতের জাতীয় মহাসমিতি (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস) (পাঠক এখানে কাকাবাবুর ‘কংগ্রেস’-এর প্রতিশব্দ হিসেবে শব্দ চয়নের দিকে লক্ষ্য রাখুন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ১৩০৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে লিখিত প্রবন্ধ, ‘নেশন কী’, যেটি ‘আত্মশক্তি’ নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে, সেখানে জাতীয়তার সংজ্ঞা নির্ধারণে যে ধরনের শব্দচয়ন করেছিলেন, কাকাবাবুর শব্দচয়নও কিন্তু তারই সমতুল। ‘কংগ্রেস’ যার বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ‘জাতীয় মহাসভা’ শব্দটি ব্যবহারের বিপদ বুঝিয়েছিলেন। ‘জাতীয়তা’ ইত্যাদি শব্দগুলির প্রতিশব্দ, সমার্থবোধক দ্যোতনার ভিতর দিয়ে বুর্জোয়া রাজনীতিকরা জাতীয় আন্দোলনের ক্ষেত্রে যে জটিলতা তৈরি করেছিলেন, তারই সুযোগ নিয়ে পরবর্তীকালে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি এই ‘জাতীয়তা’র ধারণাকে তথাকথিত ‘রাষ্ট্রবাদে’ পরিণত করেছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে কাকাবাবুর প্রদর্শিত পথকে যদি ভারত অনুসরণ করতো, তাহলে এ ধরনের বিপদের মোকাবিলা অনেক সহজ হতো) ভারতে সর্বাপেক্ষা বৃহত্তম ও প্রতিপত্তিশালী সঙ্ঘ। এক ফুৎকারে যেমনি তাসের ঘর উড়ে যায় ঠিক তেমনিভাবে আজ জাতীয় মহাসমিতি উড়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। ধরতে গেলে অনেকটা উড়েই গিয়েছে’’। এই প্রবন্ধেই কাকাবাবু লিখছেনঃ ‘‘এই আন্দোলনে (অসহযোগ আন্দোলন) আসমুদ্রহিমাচল সমগ্র ভারত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল বটে, কিন্তু হিন্দু আর মুসলমান তাঁদের সাথে মিশে কাজ করবেন, আবার অনেক মুসলমান ভারতের জাতীয় আন্দোলনে শুধু এই জন্যে এসেছিলেন, - যেহেতু হিন্দুরা খিলাফৎ আন্দোলনে মুসলমানের পক্ষ নিয়েছিলেন। বাদ্য আর খাদ্যের একটা হাস্যষ্পদ প্রশ্ন ছিল নন-কো-অপারেশন আন্দোলনের সর্বপেক্ষা বড় প্রশ্ন। গোরু নাকি হিন্দু দেবতা, সে জন্যে মুসলমানদের বলা হয়েছিল, ‘তোমরা কখনো গোরু খেয়োনা’। মসজিদে, মসজিদে মুসলমানেরা ‘নামাজ’ পড়ে থাকেন। সেই নামাজের নাকি ভয়ানক ব্যাঘাত ঘটে হিন্দুরা তার সন্মুখ দিয়ে বাদ্য বাজিয়ে গেলে।
বড়ো বড়ো শহরে ট্রামের ঘরঘরানিতে কোনো ব্যাঘাত হয় না, মোটরের ভোঁ-ভোঁতেও কোনো ব্যাঘাত হয় না, এমন কি মোহররামের বাদ্য যত তুমুলভাবেই বাজুক না কেন তাতেও নামাজে এতটুকুও ব্যাঘাত প্রাপ্ত হয় না - হয় কেবল হিন্দুর বাদ্য ধ্বনিতে। মুশকিল এই যে, এই বাদ্য বাজানো বা সংকীর্ত্তন করা হিন্দুর আবার ধর্ম্মকর্ম্ম। গোরু খাওয়ার বিরুদ্ধে দু’শ্রেণির হিন্দু দুই দিক থেকে আপত্তি করে থাকেন। এক শ্রেণির হিন্দু বলেন এবং বিশ্বাসও করেন যে গোরু তাঁদের দেবতা। আর এক শ্রেণির হিন্দুর মনে গোরু যে দেবতা এ কুসংস্কারটি বদ্ধমূল হয়ে আছে, কিন্তু এই জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগে এমন হাস্যষ্পদ কথাটি তাঁরা কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারেন না। তাই তাঁরা আপত্তিটি তুলে থাকেন ঠিক অন্যভাবে। তাঁরা বলেন, নানাদিক থেকে মানুষের সেবার জন্য গোরু একটি বিশেষ আবশ্যক জন্তু। খেয়ে খেয়ে গোরুর সংখ্যা কমিয়ে দিলে একদম গোবংশ সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে।...
আমি জানি ধর্ম্মের স্বাভাবিক ঋণ আমাদের দেশের লোকদের এমনি অন্ধ করে রেখে দিয়েছে যে, তারা অপর ধর্ম্মাবলম্বীকে তার ন্যায্য অধিকার দিতে পারে না।এ অন্ধত্ব হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে সমানভাবে আছে।...
একটিমাত্র জিনিস কম্যুনিজম - আজ ভারতবর্ষকে ধ্বংস হতে রক্ষা করতে পারে। কম্যুনিস্টরা মনুষ্যত্বটাকে বড়ো বলে মানে, সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির প্রশ্রয় তারা একেবারেই দেয় না। তারা ধনিকদের লোভ লোলুপতার অবসান দিতে চায়। সমস্ত রাষ্ট্রীয় অধিকার আয়ত্ত করে, সর্ব্ব সম্পদ ও উৎপাদিত যাবতীয় সামগ্রী জাতীয় সম্পত্তিতে পরিণত করে এবং উৎপাদন ও বণ্টনের সুব্যবস্থা করে কম্যুনিস্টরা জগতে স্থায়ী শান্তি আনয়ন করবে।’’ ‘‘লাঙল’’ ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ১৩ ফাল্গুন, বৃহস্পতিবারের সংখ্যায় কাকাবাবুর লেখা ‘শ্রেণিসংগ্রাম’ (পৃষ্ঠা ১৫২-১৫৩) সম্ভবত বাংলা ভাষায় শ্রেণিসংগ্রাম সম্পর্কে লেখা প্রথম প্রবন্ধ।