E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৫০ ও ৫১ সংখ্যা / ৭ আগস্ট ২০২০ / ২২ শ্রাবণ ১৪২৭

কাকাবাবুর সহকর্মী শ্রমজীবী আন্দোলনের নেত্রী প্রভাবতী দাশগুপ্ত

বনানী বিশ্বাস


আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রামে ১৯২০ সালকে মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওই বছরেই নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময়ের কথা বলতে গিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র শ্রদ্ধেয় নেতা মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ লিখেছেনঃ ‘‘বিশের দশক ভারতবর্ষে মজুর আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। দরখাস্ত লেখার আন্দোলন পরিণত হয়েছে সংগ্রামশীল আন্দোলনে।’’ বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরু থেকেই নানা ধরনের শ্রমিক সংগঠন গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন শিল্পে বিশেষত রেলওয়ে, সূতাকল ও চটকলে শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। ১৯২৭-র পর ভারতের শ্রমিক আন্দোলন নিজস্ব জঙ্গি রূপ নেয়। ১৯২৮ সালে সারা দেশে অন্তত ২০৩টি ধর্মঘট হয়। ৫ লক্ষের বেশি শ্রমিক এই সব ধর্মঘটে শামিল হন। এই ধর্মঘটগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কলকাতা ও হাওড়ার মেথর ও ঝাড়ুদারদের ধর্মঘট। ১৯২৮ সালের মেথর-ঝাড়ুদারদের আন্দোলনে অন্যতম নেত্রী ছিলেন প্রভাবতী দাশগুপ্ত।

১৯২৮-র মেথর ও ঝাড়ুদার আন্দোলনের সক্রিয় নেতাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। এই আন্দোলনের খুঁটিনাটি তথ্য তিনি লিখেছেন। - যারা শহরের জঞ্জাল পরিষ্কার করেন - সমাজ তাদের নাম দিয়েছেন মেহ্‌তর। মেহ্‌তর পারসি ভাষার শব্দ, তার অর্থ সমাজের শিরোমণি। রাজকুমার বা শাহজাদাকেও মেহ্‌তর বলা হয়। হিন্দুকুশ পর্বতের শেষ সীমাস্থিত রাজ্যের অধিপতিকেও বলা হত মেহ্‌তর। যাঁদের দ্বারা আমরা ঘৃণ্য কাজ করাই তাঁদেরই নাম দেওয়া হয়েছে মেহ্‌তর। মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ বলেছেনঃ ‘‘শোষণের এই এক অপরূপ ব্যবস্থা। মেহ্‌তর শব্দ ব্যবহারের ভেতর দিয়ে আমাদের নিকট মেথর হয়ে গেছে।’’

প্রভাবতীর জন্ম কলকাতায়, ১৮৯২ সালে। তাঁর বাবা ছিলেন আইনজীবী ও দার্শনিক তারকচন্দ্র দাশগুপ্ত। মা মোহিনী দেবী ছিলেন ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রথম হিন্দু ছাত্রী, গান্ধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবী। ১৯১৮তে সেন্ট পলস কলেজ থেকে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় পাশ করে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে বিদেশে যান। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ এবং ১৯২৩-এ ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। জার্মানিতে থাকার সময়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, সম্ভবত রায়ের মতাদর্শ তাঁকে কিছুটা প্রভাবিত করে। ১৯২৫-এ তিনি দেশে ফিরে আসেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন।

১৯২৭-র নভেম্বর মাসে কলকাতায় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টি থেকে সাফাই কর্মীদের নিয়ে আন্দোলন করার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিয়ন গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ইউনিয়নের নাম দেওয়া হয় দি স্ক্যাভেঞ্জার্স ইউনিয়ন অব বেঙ্গল। স্ক্যাভেঞ্জার্স মানে শহরের রাস্তা নর্দমা পরিষ্কার করার মজুর বা ধাঙর। নিপীড়িত সাফাইকর্মীদের সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ও ধরণী গোস্বামী। আসল কাজ শুরু করার আগে একটি কমিটি গঠন করা হলো। তাতে ডক্টর প্রভাবতী দাশগুপ্তকে করা হলো প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ আর ধরণী কান্ত গোস্বামীকে করা হলো সেক্রেটারি। প্রথমে ইউনিয়নের নামে দেবনাগরী হরফে হিন্দি ভাষায় একখানি ইশ্‌তিহার ছাপানো হলো। প্রভাবতী দাশগুপ্ত ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টির সভ্য ছিলেন না। তিনি শ্রমিক আন্দোলনে যু্ক্ত থাকার তাগিদে এসেছিলেন। প্রথম ইশ্‌তিহার ছাপানোর খরচ হয়েছিল পঁয়তাল্লিশ টাকা, তিনি তা দিয়েছিলেন। ধরণীকান্ত গোস্বামীর অনুরোধে তাঁকে প্রেসিডেন্ট করা হয়েছিল। বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে, ওদের সঙ্গে মেলামেশা করে ধাঙরদের তিনি সংগঠিত করেন। এ প্রসঙ্গে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ স্মৃতিচারণা করেছেনঃ ‘‘আমি জানতাম কৃষ্টিগতভাবে মেথর ও ঝাড়ুদারেরা সমাজের অতি নিম্নস্তরের লোক, অক্ষর জ্ঞান তাঁদের ছিল না। তবে কিঞ্চিৎ শ্রেণীচেতনা তাঁদের ভিতরেও ছিল। মেহনত যাঁরা বিক্রয় করেন তাঁদের কিঞ্চিৎ শ্রেণীচেতনার উন্মেষ না হয়ে পারে না। আমি ছাপানো ইসতিহারগুলি নিয়ে এই মজুরদের বস্তিতে, বেশিরভাগ ঝাড়ুদারদের বস্তিতে যেতাম। কলকাতায় তাঁদের সংখ্যাই বেশি। গিয়ে মেয়ে মজুরদের দেওয়া পিড়াতে বসতাম। আর পুরো ইসতিহারখানি তাদের পড়ে শোনাতাম, কিছু কিছু কথা নিজেও বলতাম তারপর পাড়ায় পাড়ায় ছোট ছোট মিটিং হলো, সবাইকে নিয়ে বড় মিটিংও হলো, অক্টারলোনি মনুমেন্টে, এখনকার শহীদ মিনারের তলায়।’’

সাফাইকর্মীদের আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করার আগে প্রভাবতী দাশগুপ্তের ব্যক্তিজীবন সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যেতে পারে। আদি নিবাস ঢাকার মানিকগঞ্জে, কিন্তু প্রভাবতীর জন্ম কলকাতায়, ১৮৯২ সালে। তাঁর বাবা ছিলেন আইনজীবী ও দার্শনিক তারকচন্দ্র দাশগুপ্ত। মা মোহিনী দেবী ছিলেন ভিক্টোরিয়া স্কুলের প্রথম হিন্দু ছাত্রী, গান্ধীবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী ও সমাজসেবী। ১৯১৮তে সেন্ট পলস কলেজ থেকে স্নাতক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় পাশ করে উচ্চশিক্ষা লাভ করতে বিদেশে যান। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ এবং ১৯২৩-এ ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। জার্মানিতে থাকার সময়ে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়, সম্ভবত রায়ের মতাদর্শ তাঁকে কিছুটা প্রভাবিত করে। ১৯২৫-এ তিনি দেশে ফিরে আসেন। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯২৮-এর মেথর ও ঝাড়ুদারদের ধর্মঘটের প্রেক্ষাপটে ১৯২৪ সালে একটি ঘটনা উল্লেখ করতে হয়। ১৯২৪-এ কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তার ফলে সাফাইকর্মীরা মনে সাহস সঞ্চয় করে মাইনে বাড়ানোর আর্জি জানান। চিত্তরঞ্জন তাদের আবেদনে সাড়াদিয়ে দু’টাকা মাইনে বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতি কার্যকর হয়নি। সাফাইকর্মীরা সে কথা ভোলেননি। তাঁরা বুঝতে পারেন বেতন বৃদ্ধি বা অন্যান্য সুযোগসুবিধা আদায় করতে হলে আন্দোলনে শামিল হওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।

আন্দোলনের পরবর্তী মোড় ঘুরল অনেকটা আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিতভাবে। ১৯২৮-এর ৪ মার্চ মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ ও কয়েকজন ২/১ ইউরোপিয়ান এসাইলাম লেনে পার্টি অফিসে বসেছিলেন। সেই সময়ে ২/৩ জন ঝাড়ুদার এসে জানালেন তাঁরা ধর্মঘট শুরু করে দিয়েছেন। নেতৃত্ব তখন বললেন কোনো দাবি পেশ করা হলো না, নোটিশ দেওয়া হলো না, একেবারে ধর্মঘট করে খবর দিতে এলেন। নেতৃত্ব তখন সর্বত্র খবর দিতে ছুটল, যে সব জায়গায় ধর্মঘট তখনও হয়নি সেইসব জায়গায় ধর্মঘট করাতে হবে। কলকাতা কর্পোরেশনের এলাকায় সর্বাত্মক ধর্মঘট হলো।

সাফাইকর্মীদের এই ধর্মঘট স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। মেথর-ঝাড়ুদাররাই সব এলাকায় যোগাযোগ করেন এবং তাঁদের চিরাচরিত পঞ্চায়েতের মাধ্যমে চিঠি আদানপ্রদান করেন। কলকাতাবাসী ইংরেজদের বাড়িতে যে জমাদাররা কাজ করতেন তাঁরা তুলনামূলকভাবে কিছুটা বেশি বেতন পেলেও হরতালে সকলেই শামিল হন।

কিশোরীলাল ঘোষ ও মৃণালকান্তি বসু বেঙ্গল ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের (পরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস নাম হয়) কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁরাই উদ্যোগ নিয়ে মেয়র মিস্টার জে এম সেনগুপ্তের বাড়িতে ৯ মার্চ সকালবেলা বৈঠক করেন। কংগ্রেসীরা মিস্টার সেনগুপ্তকে বোঝান যে তিনি এলাকায় এলাকায় মেথর মজুরদের কাজে ফিরে যেতে বললেই তারা কাজে যোগ দেবেন। তাঁর সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সেইজন্যই বৈঠকে তিনি আগ্রহী হন। বৈঠকে স্থির হয় কলকাতা কর্পোরেশন মেথর ও ঝাড়ুদারদের প্রত্যেককে মাসে দু’টাকা হিসাবে বেতন বাড়িয়ে দেবে এবং ধর্মঘট করার জন্য কারোর চাকরি যাবে না। এই শর্তে মেয়র সই করেন এবং ধর্মঘটীদের পক্ষে প্রভাবতী দাশগুপ্ত, ধরণীকান্ত গোস্বামী ও মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ সই করেন। এই শর্তে কর্পোরেশনের প্রশাসনিক কর্তা বা চিফ একজিকিউটিভ অফিসার সই করেন নি (চুক্তিভঙ্গের জন্য একমাত্র তাঁকেই দায়ী করা সম্ভব)। কাউন্সিলরদের সভায় প্রস্তাবটি নাকচ হয়। ধর্মঘট করার জন্য কারো চাকরি যায়নি বা মজুরদের কারো বেতন কাটা হয়নি - তবে তাঁদের বেতনবৃদ্ধি হলো না। তারই অনিবার্য পরিণতিতে কয়েক মাস পরেই ১৯২৮এর ২৪ জুন কলকাতার মেথর আর ঝাড়ুদাররা দ্বিতীয়বার ধর্মঘট করলেন।

একদিকে সাফাইকর্মীদের দৃঢ় ঐক্য ও শক্তিশালী নেতৃত্ব তাদের মনোবলকে অটুট রাখতে সমর্থ হয়, নেতারা বিশেষ করে প্রভাবতী দাশগুপ্ত ধাঙড় বস্তিতে ঘুরে ঘুরে তাঁদের অভাব অভিযোগ নিজের কানে শুনে তাঁদের পাশে দাঁড়ালেন। সাহস যোগালেন। তিনি ক্রমে সকলের ‘মাতাজি’ হয়ে উঠলেন।

কর্পোরেশনের আইন অনুযায়ী ১৩/৪/১৯২৮ তারিখে নোটিশ পাঠানো হলো। নোটিশে জানানো হলো, একমাসের ভেতর দাবি পূরণ না হলে মজুরেরা আবার ধর্মঘট করবেন। প্রথম ধর্মঘটের পর অকংগ্রেসী কাউন্সিলরা কোয়ালিশন দল নামে একটি দল গঠন করেন। সেসময় প্রতি বছর মেয়র নির্বাচন হতো। ১৯২৮ সালের মেয়র নির্বাচনের তারিখ ছিল ২ এপ্রিল। এবার কংগ্রেসের প্রার্থী হলেন সুভাষচন্দ্র বসু। কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় সুভাষচন্দ্র বসু পরাজিত হন। জয়ী হলেন কোয়ালিশন দলের বিজয়কুমার বসু।

১৯২৮ সালের ২৪ জুন মেথর আর ঝাড়ুদারেরা দ্বিতীয়বার ধর্মঘট করেন। কর্পোরেশন মেথর-ঝাড়ুদারদের ধর্মঘটের নোটিশের প্রাপ্তিস্বীকার করেনি। তারা স্থির করেছিলেন ধর্মঘটের শুরু থেকেই প্রতিরোধ করবেন।

২৫ জুন প্রভাবতী দাশগুপ্ত ও মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ হাজরা পার্কে সভা শেষ করে যাবার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের মতের অনৈক্য ছিল, তাসত্ত্বেও তিনি তাঁদের অনৈতিক গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ময়দানে বক্তৃতা দেন। প্রভাবতী দাশগুপ্ত ও মুজফ্‌ফর আহ্‌মদের গ্রেপ্তারের পরেও সাফাইকর্মীদের ধর্মঘট না ভাঙায় আন্দোলনকারীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হলো। রাস্তাঘাট থেকে ধরপাকড় করে পুলিশ কোর্টে হাজির করা হলো, মিথ্যা মোকদ্দমা দায়ের করা হলো। কোর্ট ছিল চার জায়গায় - আলিপুর, শিয়ালদা, ব্যাঙ্কশাল স্ট্রিট ও জোড়াবাগানে। চার জায়গায় কোর্ট হওয়াতে সঙ্গে সঙ্গে কোর্টে জরিমানা দিয়ে খালাস করে আনা সম্ভব হতো না। কোথায় কোন্‌ দলকে পুলিশ ধরত তার খবরও পাওয়া যেত না। বহুসংখ্যক সাফাইকর্মী জেলে গেলেন। রাস্তায় কল থেকে জল নিতে গিয়ে বা গণশৌচাগার ব্যবহার করতে গিয়েও তারা বাধা পেয়েছেন। ধর্মঘট চলতে থাকায় শহরের অবস্থা ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ালো। দৈনন্দিন জীবন ভয়াবহ হওয়ার অনেক ‘ভদ্রলোক’ এই ধর্মঘটকে সমর্থন করলেন না। এমনকি ‘শনিবারের চিঠি’ বা রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘‘প্রবাসী’’তে বিরোধিতা করা হলো না শুধু, ব্যঙ্গোক্তি করা হলো। ‘শনিবারের চিঠি’তে প্রভাবতী দাশগুপ্তর কিছু ব্যঙ্গ চিত্র ছাপা হলো।

তৎকালীন মেয়র বিজয় কুমার বসু আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে আশ্বস্ত করলেন যে সাফাইকারীদের নিয়ে কোনো দলাদলি করা উচিত নয় - সাধারণ নাগরিকদের অসুবিধার কথা ভেবে দ্রুত সমাধান সূত্র খুঁজে বের করার জন্য অবশেষে ধর্মঘটের দ্বাদশ দিবসে ৫ জুলাই ১৯২৮ সাফাইকর্মীদের বেতন বৃদ্ধি, ধর্মঘটীদের নামে মোকদ্দমা প্রত্যাহার ইত্যাদি কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। তবে প্রভাবতী দাশগুপ্ত ও মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ জানান, তাঁদের বিরুদ্ধে যে মামলা করা হয়েছে তা তুলে নেওয়া হোক তাঁরা চান না। আদালতে মামলা লড়তে চান। সাফাইকর্মীদের সব কিছু বুঝিয়ে বলা হলো, শর্তগুলির কথা জানানো হলো, তাঁরা কাজে যোগ দিতে সম্মত হলেন। বারো দিনের জমা ময়লা তাঁরা মাত্র দুদিনে অক্লান্ত পরিশ্রম করে পরিষ্কার করলেন। ৭ জুলাই তারিখে ইংরেজি দৈনিক ‘ফরওয়ার্ড’ লিখল - কলকাতা নগরকে আর ময়লা দেখাচ্ছে না।

সাফাইকর্মীদের দু’দফার ধর্মঘট বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে গিয়ে আন্দোলনের নেত্রী প্রভাবতী দাশগুপ্তের ভূমিকা আমাদের কাছে বিস্ময় জাগায়। বিদেশে উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশে ফিরে সমাজের পশ্চাৎপদ মেথর-ঝাড়ুদারদের সংগঠিত করে তাঁদের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন, তাঁদের আপনজন হয়েছেন, তারা ‘মাতাজি’ বলে সম্বোধন করতেন তাঁকে। পরে তিনি চটকল শ্রমিকদের আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছেন। ১৯২৯ সালে ঐতিহাসিক চটকল ধর্মঘট পরিচালনায় তিনি অর্থ, সামর্থ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন। ‘জুট ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের’ সভাপতি ছিলেন। ১৯৪০-৪১ সালে কংগ্রেস কর্মী বাখর আলি মির্জাকে তিনি বিবাহ করেন এবং স্বামীর সঙ্গে হায়দরাবাদে বসবাস করেন, ১৯৭৬ সালে তাঁর জীবনাবসান হয়।