৫৭ বর্ষ ৫০ ও ৫১ সংখ্যা / ৭ আগস্ট ২০২০ / ২২ শ্রাবণ ১৪২৭
প্রাক্-স্বাধীনতাপর্বে বাংলায় শ্রমিক-কৃষক সংগঠন গড়ে ওঠা এবং কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ
শংকর মুখার্জি
উনিশশো কুড়ি সালের শুরুতেই কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ স্থির করলেন তাঁর ভবিষ্যৎ জীবনের পেশা হবে রাজনীতি। যদিও প্রবল ইচ্ছা ছিল একজন প্রবন্ধকার হওয়ার। তিনি নিজেই জানাচ্ছেনঃ ‘‘আমার মনে যে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলেছিল তাতে শেষপর্যন্ত জয় হলো রাজনীতির।’’ তবে তিনি নিজেও মনে করতেন, রাজনীতিক জীবন একজন প্রবন্ধকার হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক নয়।
গত শতকের বিশের দশকের শুরুতে যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন দেশে বোম্বাই-মাদ্রাজ-কলকাতা-লাহোরে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)’র জীবনে যিনি আমাদের সবার শ্রদ্ধেয় কাকাবাবু। সে সময়ে অবিভক্ত বাংলায় লালঝান্ডাকে উড্ডীন করতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি যে আত্মত্যাগ, যে মতাদর্শগত এবং সাংগঠনিক পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন তা এক মহাকাব্যিক বিষয়। একইভাবে, স্বাধীনতার পর দেশের বুর্জোয়া শাসকদের বিরুদ্ধে এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভ্যন্তরে সংশোধনবাদ ও সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। সেখানেও তাঁর অবদান এক গৌরবজনক অধ্যায়।
অন্যদিকে একজন প্রবন্ধকার বিশেষকরে রাজনৈতিক প্রবন্ধকার হিসেবে মুজফ্ফর আহ্মদ-এর জীবনটাও কম চিত্তাকর্ষক নয়। ১৯১৩ সাল থেকে ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর - মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রায় ছয় দশক আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাহিত্য বিষয়ে তাঁর লেখনী বাংলার প্রবন্ধ সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ। ১৯১৩ সালটা উল্লেখ করা এই কারণে যে, ওই বছরই তিনি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’তে যোগ দেন। যারা ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’ বার করত। ওই পত্রিকার লেখা সংগ্রহ, ছাপানো এবং পত্রিকা ডাকে দেওয়া - সব কাজই কাকাবাবু নিজে হাতে করতেন। এবং অবশ্যই লিখতেনও; বলা যায় এখানেই তাঁর লেখার হাতেখড়ি।
।। দুই ।।
পূর্ব বাংলার সন্দ্বীপের মুসাপুর গ্রামে ১৮৮৯ সালের আগস্ট মাসে মুজফ্ফর আহ্মদ-এর জন্ম। কাকাবাবুর নিজের ধারণা অনুযায়ী তারিখটা ৫ আগস্ট। ১৯২০ সালে তাঁর বয়স ৩১। রাজনীতিকেই জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু কোন্ ধারায় প্রবাহিত হবে এই রাজনৈতিক জীবন। রাজনীতিকে জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণের মতো এও ছিল সমধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব এক্ষেত্রে দিক-নির্দেশকের ভূমিকা পালন করল। যদিও তখন ওই বিপ্লবের সংবাদ এদেশে খুব একটা প্রচারিত হতো না। মার্কসবাদ ও রুশ বিপ্লব সম্বন্ধে দু’চারটি বই সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। সেটা ১৯২১ সাল। এইসব বই পাওয়াও সে সময়ে প্রায় অসম্ভব ছিল। কলেজ স্ট্রিটের চক্রবর্তী চ্যাটার্জি অ্যান্ড কোম্পানির দোকান থেকে বইগুলি সংগ্রহ করেছিলেন তিনি। বইগুলির মধ্যে লেনিন, ফিলিপস প্রাইস, অ্যালবার্ট রাইস উইলিয়ামসের লেখা বই ছিল। বিদেশ থেকেও, বিশেষ করে রাশিয়া, জার্মানি থেকে কমিউনিস্ট পত্র-পত্রিকা এদেশে আসা শুরু হয়। যেগুলি পড়ার সুযোগ হয়েছিল কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদ-এর।
।। তিন ।।
তৎকালীন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং এইসব বই পড়ে যতোটুকু জ্ঞান-চেতনার উন্মেষ হয়েছিল তাতেই মুজফ্ফর আহ্মদ বুঝেছিলেনঃ কংগ্রেস স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করলেও শ্রমিক কৃষক ও অন্যান্য মেহনতি মানুষের স্বার্থের ব্যাপারে তারা ভাবিত নয়। এই কারণে মুজফ্ফর আহ্মদ কংগ্রেসে যোগদানে উৎসাহ বোধ করেন নি। পাথেয় করলেন শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থের রাজনীতিকে। এমনকি শ্রমিকশ্রেণির পার্টি গড়ে তোলার এক অস্পষ্ট ভাবনাও মনে জন্ম নিল। যদিও পরবর্তী সময়ে তিনি একাধিকবার নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সদস্য হয়েছিলেন।
মুজফ্ফর আহ্মদ কোনো রাজনৈতিক দলে যোগ না দিলেও রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যাওয়া শুরু করেন ১৯১৬ সাল থেকেই। ১৯২০ সালে খিলাফৎ-অসহযোগ আন্দোলনের যুক্ত সভাগুলিতেও যোগ দিতেন। একটা রাজনৈতিক মন গড়ে ওঠার এই সময়পর্বেই কবি নজরুল ইসলাম এবং আরও কয়েকজনকে নিয়ে ১৯২০ সালের জুলাই মাসে বার করলেন সান্ধ্য দৈনিক ‘নবযুগ’। ওই দৈনিকে মেহনতি মানুষের কথা লেখা হতো। যা সে সময়ে সত্যই দুর্লভ ছিল।
রাজনীতিকে জীবনের পেশা হিসেবে গ্রহণ করার আগে নানা কাজে যুক্ত ছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। এবং তা করেছেন পড়াশুনো করার সাথেই। ১৯১৩ সালে নোয়াখালি জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ। সেখান থেকে প্রথমে হুগলি কলেজে (এখন হুগলি মহসীন কলেজ), পরে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে পড়তে আসা। সেই থেকেই কলকাতায় থাকা শুরু। আর কাজ করেছেন সরকারি ছাপাখানার কেরানি, হোম ডিপার্টমেন্টের বাংলা অনুবাদক, স্কুল ইন্সপেক্টর, মাদ্রাসা শিক্ষক হিসেবে; এমনকি তিনি কাজ করেছেন কলকাতা কর্পোরেশনের স্লটার হাউসেও।
।। চার ।।
ইতিমধ্যে তাসখন্দে ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। তবে সে-খবর মুজফ্ফর আহ্মদ’রা জানতেন না। ১৯২২ সালের মে মাসে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে মুজফ্ফর আহ্মদ-এর পত্রালাপ শুরু হলো। আর বাংলায় কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে সহকর্মী হিসেবে পেলেন আবদুর রাজ্জাক খান এবং আবদুল হালীমকে।
অতি সামান্য কমিউনিস্ট কার্যকলাপেই সেদিন সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল ভারত সরকার। ফলে পুলিশের নজরে পড়ে যান মুজফ্ফর আহ্মদ। ১৯২৩ সালের ১৬ মে গ্রেপ্তার হলেন; জামিনে মুক্ত হবার পর আবার গ্রেপ্তার। মুজফ্ফর আহ্মদ, মানবেন্দ্রনাথ রায়, ডাঙ্গে প্রমুখ আটজনের বিরুদ্ধে ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে রুজু করা হলো কানপুর বলশেভিক মামলা। সাজা হলো চার বছর জেল। অসুস্থতার জন্য আগে ছাড়া পেলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। আলমোড়া থেকে কলকাতায় আসার আগে ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর যোগ দিলেন কানপুরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সম্মেলনে। সম্মেলন থেকে যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হলো তাতে নির্বাচিত হলেন; বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার দায়িত্ব দেওয়া হলো তাঁকে।
কানপুর সম্মেলনের আগেই বাংলায় গড়ে ওঠে ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টি। পরে বোম্বাই, পাঞ্জাব, যুক্তপ্রদেশে এই পার্টি গড়ে উঠেছিল। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় এক সম্মেলনের মধ্যদিয়ে এই পার্টি সর্বভারতীয় রূপও পায়। বহু কমিউনিস্ট এই পার্টির অভ্যন্তরে কাজ করতেন। মুজফ্ফর আহ্মদও ভাটপাড়ায় অনুষ্ঠিত এই পার্টির রাজ্য তৃতীয় সম্মেলনে সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি, ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজান্টস পার্টি এবং ‘গণবাণী’ পত্রিকার কাজে কঠোর পরিশ্রম করতে হয় মুজফ্ফর আহ্মদকে। ‘গণবাণী’ পত্রিকা ১৯২৬ সালের ১২ আগস্ট আত্মপ্রকাশ করে। এই পত্রিকা বলা যায়, সেসময়ে বাংলায় পার্টির মুখপত্রের মতোই কাজ করত। এই পত্রিকায় মুজফ্ফর আহ্মদ অনেক মূল্যবান প্রবন্ধ এবং সম্পাদকীয় লিখেছেন।
কমিউনিস্ট পার্টির কাজের অর্থই হলো বিপ্লবী মতাদর্শে শ্রমিক, কৃষকদের সংগঠিত করার কাজ। কৃষক সংগঠন ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলার কাজ। গ্রেপ্তার হবার আগে মুজফ্ফর আহ্মদ সামান্যই এ কাজ করতে পেরেছিলেন, তাও শুধুমাত্র জাহাজী শ্রমিক এবং হোটেল খানসামাদের মধ্যে। এখন শ্রমিক আন্দোলনের কাজে সম্পূর্ণ নিজেকে আত্মনিয়োগ করলেন।
।। পাঁচ ।।
১৯২৭ ও ১৯২৮ সাল ভারতের অন্যান্য অংশের মতো বাংলাও শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল হলো। এই আন্দোলনে একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। গড়ে তুললেন জাহাজী ও খানসামাদের সংগঠন। নেতৃত্ব দিলেন কাশীপুর জুট প্রেস শ্রমিক, কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট মজুর এবং খড়্গপুরে বেঙ্গল-নাগপুর রেলওয়ে ওয়ার্কশপ মজুরদের ধর্মঘটে। একেবারে শ্রমিকদের পাশে থেকে ধর্মঘট পরিচালনায় সাহায্য করলেন কলকাতা ও হাওড়ায় ধাঙড়-ঝাড়ুদারদের, কেশোরাম কটন এবং চেঙ্গাইল ও বাউড়িয়া চকটল এবং লিলুয়ার রেল কারখানার মজুরদের ধর্মঘটে। এমনকি, ১৯২৮ সালে কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানাতে বিরাট শ্রমিক সমাবেশও সংগঠিত হলো। এসবের মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটেই মুজফ্ফর আহ্মদ ১৯২৮ সালে ধানবাদ অধিবেশনে অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ময়মনসিং, ত্রিপুরা, নোয়াখালি প্রভৃতি স্থানে স্থানীয়ভিত্তিতে কিছু কৃষক আন্দোলনেও যুক্ত হন। শ্রমিক-কৃষকের স্বার্থে যে রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন তা আস্তে আস্তে সাকার হতে শুরু করল মুজফ্ফর আহ্মদ-এর জীবনে।
কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার রাজনৈতিক কর্মসূচি জনপ্রিয় হবে তা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারেনি দেশের ঔপনিবেশিক সরকার। তারা উঠেপড়ে লাগল এই পার্টিকে ধ্বংস করতে। আর সেই লক্ষ্যেই ১৯২৯ সালের ২০ মার্চ মুজফ্ফর আহ্মদ সহ ৩২ জন কমিউনিস্ট ও শ্রমিক আন্দোলনের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হলো। এই ৩২ জনের মধ্যে সে সময়ে পার্টির ১০ জনের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির ৯ জনই ছিলেন। শুরু হলো মীরাঠ কমিউনিস্ট ষড়যন্ত্র মামলা। প্রথমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও পরে এলাহাবাদ হাইকোর্ট মুজফ্ফর আহ্মদ-এর সাজা কমিয়ে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেয়। ১৯৩৬ সালের ২৪ জুন তিনি জেল থেকে মুক্তি পান।
পুরো নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করেও সেদিন কমিউনিস্ট পার্টিকে ধ্বংস করতে পারেনি ব্রিটিশরা। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলা চলার সময়ে বাংলা এবং দেশের অন্যান্য প্রদেশে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটেই মুক্তিলাভের পর মুজফ্ফর আহ্মদ-এর সামনে তিনটি প্রধান কাজ উপস্থিত হয় - নতুন পরিস্থিতিতে পার্টির পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণ, বাংলায় ও ভারতে কৃষক আন্দোলন ও সংগঠন এবং শ্রমিক-কৃষকের মৈত্রীর ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক ঐক্য গঠন।
।। ছয় ।।
সারা ভারত কৃষক সভার প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৬ সালের এপ্রিল মাসে, লক্ষ্ণৌয়। অর্থাৎ মুজফ্ফর আহ্মদ-এর জেল থেকে মুক্তির দু’মাস আগে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি ওই সম্মেলনে উপস্থিত থাকতে পারেননি। কিন্তু বাংলায় কৃষকসভা গড়ে তোলার কাজ জেল থেকে মুক্ত হবার পরই শুরু করে দিলেন। শুধু সাংগঠনিক দিক দিয়ে নয়, এর তাত্ত্বিক ভিত্তিও গড়ে তুলতে ভূমিকা পালন করলেন।
প্রথম বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বাঁকুড়া জেলার পাত্রসায়রে ১৯৩৭ সালের মার্চ মাসে। মুজফ্ফর আহ্মদ সম্মেলনের সভাপতিমণ্ডলীতে নির্বাচিত হন এবং সম্মেলনে তাঁর রচিত একটি নিবন্ধ পাঠ করা হয়। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে বাংলাদেশের কৃষক আন্দোলনের বিপ্লবী ভূমিকা কি হবে তা তিনি সূত্রায়িত করেছিলেন ওই নিবন্ধে। ‘শ্রেণি সংগ্রামই কৃষক সমস্যার মূল’ শীর্ষক এই নিবন্ধে মুজফ্ফর আহ্মদ বললেনঃ ‘‘কৃষক-সমস্যার মূলীভূত কারণ শ্রেণি-সংগ্রাম... মোটের উপরে, ভূমির তথাকথিত মালিকগণই কৃষকগণের প্রথম নম্বরের শোষক। অকর্মণ্য মহাজনগণ কৃষকদের দ্বিতীয় নম্বরের শোষক।... কৃষিজাত দ্রব্যের বিক্রয়ের ব্যাপারে দালাল, ফড়িয়া ও আড়তদার প্রভৃতিও কৃষকদের শোষণ করিতে ছাড়ে না। আরও বহু লোক কৃষকদের নানাভাবে শোষণ করিবার জন্য বসিয়া আছে, কৃষকদের শোষণ করিলেই তাহাদের দিন চলে। সর্বোপরি, ব্রিটিশ ইম্পিরিয়েলিজমই হইতেছে ভারতীয় কৃষকগণের বড় শোষক।
‘‘...এদেশের সমাজের সম্পত্তিগত সম্বন্ধ হইতেই যখন উহার উদ্ভব হইয়াছে তখন কাহারও কথায় কিংবা ইচ্ছায় উহা থামিয়া যাইবে না; বরঞ্চ ক্রমশ উহা প্রখর হইতে প্রখরতর হইয়া উঠিবে। এই শ্রেণি-সংগ্রামের ভিতর দিয়াই আমাদের জনগণ সর্ববিধ শোষণ ও অত্যাচারের হাত হইতে মুক্তিলাভ করিবে।’’
প্রাদেশিক কৃষকসভার প্রথম ও দ্বিতীয় সম্মেলনে (হুগলি, জেলার বড়গ্রাম, ১৯৩৮, ২-৩ ডিসেম্বর) সভার গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়। এই গঠনতন্ত্রও ছিল মুজফ্ফর আহ্মদ-এর রচনা। ময়মনসিং ও ফরিদপুর জেলা কৃষক সম্মেলনে সভাপতি হিসেবে মুজফ্ফর আহ্মদ যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতেও বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লিখিত হয়েছিল। শুধু বাংলা নয়, অসমের সুরমা ভ্যালি, যুক্তপ্রদেশ, বিহার ও পাঞ্জাবের কৃষক আন্দোলনের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে ওঠে। ১৯৪৫ সালে নেত্রকোণায় কৃষকসভার সর্বভারতীয় সম্মেলনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন।
ত্রিশের দশকের শেষদিকে আন্দামানসহ দেশের বিভিন্ন জেল থেকে মুক্ত মার্কসবাদে বিশ্বাসী বহু রাজবন্দী মুজফ্ফর আহ্মদ-এর সঙ্গে দেখা করেন; তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টিতে কাজ করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেন। এঁদের মধ্যে যাঁরা কলকাতায় থাকবেন তাঁদের ট্রেড ইউনিয়নে এবং যাঁরা গ্রামে গেলেন তাঁদের কৃষকসভার কাজে নিয়োগ করলেন মুজফ্ফর আহ্মদ। সামগ্রিকভাবে এর এক ইতিবাচক প্রভাব পড়ল। মজুফ্ফর আহ্মদ লিখছেনঃ ‘‘আমরা দেখতে পেলাম দার্জিলিঙ জিলাকে বাদ দিয়ে বাঙলাদেশের সব জিলায় কৃষক সমিতি গঠিত হয়েছে। এই রকমটা ভারতের অন্য কোনো প্রদেশে হয়নি। কলকাতায় আমাদের ট্রেড ইউনিয়নগুলিও শক্তিশালী হয়েছিল। জিলায় জিলায় আমাদের পার্টি ইউনিটও গড়ে উঠল। এটাও ছিল ভারতবর্ষে অভিনব ব্যাপার। সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী আন্দোলন হতে আমরা যে অবদান পেলাম তা থেকে বাংলায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বিশেষ শক্তিশালী হয়েছিল।’’
।। সাত ।।
১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। এর কয়েকমাস পর ১৯৪০ সালের জানুয়ারিতে ভারতরক্ষা আইনে মুজফ্ফর আহ্মদকে কলকাতা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়। আদেশ অমান্য করায় তাঁর একমাসের জেল হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে জনগণকে সংগঠিত করা, সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগঠিত করা এবং মহামারী ও দুর্ভিক্ষের রিলিফ কাজে পার্টি যে বিরাট উদ্যোগ নিয়েছিল তাতে মুজফ্ফর আহ্মদ একবারে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। অন্যদিকে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে স্বাধীনতা আন্দোলনে জোয়ার এলো। আজাদ হিন্দ ফৌজের মুক্তির আন্দোলন, নৌবিদ্রোহ, রশিদ আলী দিবস, ডাক-তার কর্মীদের সর্বভারতীয় হরতালকে কেন্দ্র করে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। কমিউনিস্ট পার্টি এই আন্দোলনসমূহে একেবারে সামনের সারিতে ছিল। স্বাভাবিকভাবেই এই আন্দোলনগুলিতে মুজফ্ফর আহ্মদ-এর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল।
।। আট ।।
এইসব গণ-আন্দোলনের সাথেই শ্রমিক-কৃষক ঐক্য এবং যৌথ আন্দোলনে মুজফ্ফর আহ্মদ সবসময়ে গুরুত্ব দিতেন। তাঁর কথায়ঃ ‘‘স্বাধীনতা লাভের ও ক্ষমতা হস্তগত করার ব্যাপারে শ্রমিকগণ শুধু আপন শ্রেণীর সংগ্রামের পরিচালনা করিবেন না, তাঁহারা কৃষকগণের সংগ্রামের নেতৃত্বও গ্রহণ করিবেন।... গ্রামের কৃষক আন্দোলন ও শহরের শ্রমিক আন্দোলনের মধ্যে একটা যোগাযোগ আমাদিগকে অবশ্যই স্থাপন করিতে হইবে। শ্রমিক আন্দোলনের সংস্রবে না আসিলে কৃষক সংগঠন গড়িয়া তুলিবার পরিষ্কার ধারণা কৃষক সংগঠনকারীদের মনে জন্মিবে না।’’
এসবের মধ্য দিয়ে শুধু বাংলায় নয়, সারা ভারতে শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে পার্টির প্রভাব প্রসারিত হলো। তৎকালীন সময়ে তেভাগা, তেলেঙ্গানা, সুরমা ভ্যালি, ত্রিপুরা এবং ওয়ারলির কৃষক বিদ্রোহগুলি পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত হলো। বাংলা, বোম্বাইও শ্রমিক আন্দোলনে উত্তাল হলো।
যার পরিণতিতে স্বাধীনতা লাভের পরই পার্টির উপর কংগ্রেস সরকারের দমননীতি নেমে আসে। ১৯৪৮ সালের ২৬ মার্চ পশ্চিমবঙ্গে পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করল কংগ্রেস সরকার। সারা ভারতেও পার্টির কার্যকলাপ প্রায় বেআইনি হয়ে গেল। হাজার হাজার পার্টি নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হলেন। গ্রেপ্তার হলেন মুজফ্ফর আহ্মদও।
ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার প্রথম তিন দশকে ব্রিটিশ সরকারের যে অত্যাচার দমন-পীড়নের মোকাবিলা পার্টিকে করতে হয়েছিল তা দেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রে হয়নি। মীরাট ষড়যন্ত্র মামলায় আদালতে মুজফ্ফর আহ্মদ বলেছিলেনঃ ‘‘...জাতীয় স্বাধীনতার জন্য একটি পরাধীন জাতির সংগ্রাম এবং অর্থনীতিক শোষণ থেকে শ্রমিক ও কৃষকশ্রেণির মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম - এই দু’টো সংগ্রাম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।’’ পরাধীন ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এরই বাস্তবায়ন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন মুজফ্ফর আহ্মদ।
তথ্যসূত্রঃ
(ক) আমার জীবন ও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি - মুজফ্ফর আহ্মদ
(খ) মুজফ্ফর আহ্মদ নির্বাচিত প্রবন্ধ
(গ) মুজফ্ফর আহ্মদ স্মরণে - মুজফ্ফর আহ্মদ স্মারক কমিটি কর্তৃক সংকলিত