E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৫০ ও ৫১ সংখ্যা / ৭ আগস্ট ২০২০ / ২২ শ্রাবণ ১৪২৭

মুসলিম মহিলাদের ক্লাব

ক্লারা জেটকিন


জার্মান এবং আন্তজাতিক শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসের সাথে ক্লারা জেটকিনের (জন্ম ৫ জুলাই, ১৮৫৭, মৃত্যু ২০ জুন, ১৯৩৩) নাম বিশেষভাবে জড়িত। ১৮৮১ সালে তিনি জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। দেশান্তরী হতে বাধ্য হবার পর তিনি ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া এবং ইতালির সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৮৯০ সালে জার্মানিতে ফিরে এসে তিনি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক মহিলা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। নারী জাতির সমানাধিকারের সংগ্রামে তিনি তাঁর সমস্ত শক্তি-সামর্থ্য ব্যয় করেন। সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে তিনি প্রলেতারিয়েতের বিজয় লাভে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন।

মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবকে জেটকিন অভিনন্দিত করেছিলেন এবং সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি সংহতি আন্দোলনের তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় অংশীদার। ১৯২০ সালে তিনি প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নে আসেন। সোভিয়েতের মাটিতে কি বিপুল উৎসাহে জনগণ নতুন সমাজ নির্মাণের কাজে লেগেছে তা দেখে তিনি অতীব অভিভূত হয়ে পড়েন।

ক্লারা জেটকিন অনেকবার ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিল ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। তাঁদের এই সম্পর্কের কথা তাঁদের চিঠিপত্র এবং ক্লারা জেটকিনের স্মৃতিকথা থেকে জানা যায়।

সোভিয়েত সাধারণতন্ত্রের মুসলিম মহিলাদের ক্লাবগুলি প্রাচ্যের মহিলা জনসাধারণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই ক্লাবগুলির গঠন এবং উন্নয়ন ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

প্রাচ্যের যে শ্রমজীবী মহিলারা সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের মুক্তি খুঁজে পেতে চান তারা ক্রমশ জেগে উঠছেন এবং সক্রিয় হচ্ছেন। এদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি নিম্নস্তরে রয়েছেন, যাদেরকে প্রথা, আইন এবং ধর্মীয় ফতোয়ার বলে সামাজিক দাসত্বের গভীর গহ্বরে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল তারা ক্রমশ জেগে উঠছেন। লজ্জাশীলা এবং শরীর ও মনে আহত এই নারীরা যথেষ্ট দৃঢ়তার সাথেই নিজেদের স্বাধীনতা এবং সাম্য অর্জনের জন্য জেগে উঠছে। লেনিন খুব যথাযথভাবেই এই ঘটনাকে ঐতিহাসিকভাবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেছেন। বৈপ্লবিক শক্তির সামান্যতম বিকাশের প্রতি লেনিন সচেতন থাকতেন এবং সামগ্রিক সমাজ পরিবর্তনের কাঠামোর মধ্যেই তাকে সব সময় বিশ্লেষণ করতেন। প্রাচ্যের সাধারণ নারীদের এই সামান্য সক্রিয়তাকে হয়তো এই সময়ে কেবলমাত্র বিদ্যুতের সামান্য ঝলক বলে মনে হচ্ছে, কিন্তু আগামী দিনে এটি এক ঝড়ের বার্তা দিচ্ছে।

তারা এই নিশ্চয়তা দিচ্ছে যে, সর্বহারার বিপ্লব একটি বিশ্ববিপ্লবে পরিণত হবে যেখানে সবচেয়ে বেশি নিপীড়িত এবং দাসত্বের শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত ব্যক্তি নিজের শক্তিতে নিজেকে মুক্ত করতে পারবে। সোভিয়েত সাধারণতন্ত্রের মুসলিম মহিলাদের ক্লাবগুলি কেবলমাত্র ভোটাধিকারের জন্য আন্দোলনের কোমল মনোভাবকে লালন পালন করার ক্ষেত্র নয়, বরং তা বিপ্লবী শক্তির সম্মিলনের এবং শিক্ষার ক্ষেত্র।

তিফলিশের মুসলিম মহিলাদের ক্লাব কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলেছে এবং পার্টির মহিলা শাখার এটি বিশেষ কাজ। সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রবর্তন মুসলিম মহিলাদের মনোজগতে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে, তাকে মাথায় রেখেই এই ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই ক্লাব তাদের জীবনের রূপান্তরের প্রতীক কারণ সোভিয়েতের আইনে পুরুষকে নারীর উপর প্রভুত্ব করার সুযোগ দেওয়া হয় না এবং কোনো লিঙ্গের বাড়তি অধিকার অনুমোদিত নয়। সমাজের সমস্তক্ষেত্রে মহিলাদের সম্পূর্ণ সমতার পক্ষে এই ক্লাব প্রচার করে এবং এরা প্রমাণ করেছে যে, সোভিয়েত ব্যবস্থা এই সাম্যকে অর্জন করার জন্য উদগ্রীব। সেই মুসলিম মহিলারা মনেপ্রাণে চান, সমাজের পরিবর্তনে অংশগ্রহণ করতে যার ফলে এমন এক নতুন কাঠামো গড়ে উঠবে যেখানে শ্রমজীবী মহিলাদের প্রতিভা যোগ্য মর্যাদা পাবে এবং তারা নতুন আইনি অবস্থান অর্জন করতে পারবেন। এখনো পর্যন্ত মুসলিম মহিলাদের জাগরণের পথে প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রাচীন অন্ধ কুসংস্কার। এর দরুন অধিকাংশ মহিলাই পুরুষদের পাশে তাদের অবস্থান বলিষ্ঠভাবে প্রকাশ করতে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন। তাদের আকাঙ্ক্ষা আর তার প্রাপ্তির মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হারেমের বন্ধ দরজা। তিফলিসের পুরুষ এবং মহিলা কমরেডরা এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে, নিভৃত গৃহকোণ আর সভাকক্ষের মাঝামাঝি জায়গায় মুসলিম মহিলাদের মেলামেশার একটা ক্ষেত্র তৈরি হওয়া দরকার। এ এক এমন জায়গা হতে হবে যেখানে গভীর আকাঙ্ক্ষা থেকে স্পষ্ট চেতনা ও লড়াইয়ের স্পৃহা জন্ম নেবে। সাধারণ মুসলিম মহিলাদের ঐকান্তিক ইচ্ছে এবং সহযোগিতা ছাড়া জর্জিয়ার বৈপ্লবিক পুনর্গঠন যে কখনোই সম্ভব হতে পারে না এইটি অনুধাবন করেই পার্টি মুসলিম মহিলাদের ক্লাব সংগঠিত করেছে।

এই প্রথম এরকম একটি ক্লাবের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি জেনেছিলাম এবং স্বাভাবিকভাবেই এই ক্লাবে যাওয়ার সময় রোমাঞ্চিত বোধ করছিলাম। এই ক্লাবের সদস্যরা আমার আসার বিষয়ে আগে থেকেই জানতেন, তা না হলে কেবলমাত্র সামান্য কয়েকজন মহিলা মুসলিম কমরেডের সঙ্গে দেখা করেই এবং বাড়িটি পর্যবেক্ষণ করেই আমাকে চলে আসতে হতো।

অবশ্য আমি একটি পুরো সম্প্রদায় সম্পর্কে একটা ধারণা নেওয়ার জন্য আগ্রহী ছিলাম এবং এই ক্লাবের কেমন প্রভাব মহিলাদের অন্যান্য ক্লাবের উপরে পড়ে সেটা জানায় আমার বেশি উৎসাহ ছিল।ক্লাবের পাশের এবং সামনের রাস্তায় মুসলিম মহিলারা ভিড় করে আমার আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন এবং এদের কারোরই মুখে আমি কোনো পর্দা দেখিনি।

স্বভাবতই গাড়ি অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছিল এবং আমি ক্লাবের গেট পর্যন্ত পৌঁছতে পারিনি। হাঁটার বদলে ওরা আমাকে ঠেলে এবং তুলে নিয়ে চলল। শেষপর্যন্ত আমি করিডোরে পৌঁছলাম এবং বাঁকানো সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলাম, আর পৌঁছে গেলাম ক্লাবের বিশাল ঘরটিতে। এখানেও সেই একই বদ্ধ আবহাওয়ায় ঠেলাঠেলি চলতে থাকল। মনে হলো যেন উইয়ের ঢিবির মধ্যে আলোড়ন পড়েছে।

১৯২৩ সালে যখন ক্লাবটি প্রতিষ্ঠিত হয় তখন এর সদস্যা ছিলেন ৪০ জন এবং নিঃসন্দেহে এ-ছিল এক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য। সোভিয়েত প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই সদস্য সংখ্যার অনুপাতে ক্লাবের জন্য জায়গা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা ছিল এমনই এক বৈপ্লবিক উদ্ভাবন যে কেউই এর দ্রুত উন্নতির কথা ভাবে নি। তবে অচিরেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটল। জমি উর্বর ছিল, ক্লাবের খবর প্রচারিত হতেই এক বছরের মধ্যে ২০০ জন সদস্যা হলেন এবং সদস্যপদের জন্য আরও আবেদন আসতে থাকল। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, সোভিয়েত সরকার শেষ পর্যন্ত এ ক্লাবের জন্য আরও বড়ো একটি বাড়ি দেবে। অবশ্য ক্লাবের নতুন বাড়ি অন্য একটি জায়গায় হতে হবে যেখান থেকে এর প্রভাব মুসলিম মহিলাদের বিরাট অংশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে ক্লাবের স্থানান্তরকরণ যত সহজে হবে বলে মনে হচ্ছে ততো সহজে হবে না।

এই ক্লাব যেহেতু মহিলাদের সেহেতু আমি যখন আসি তখন কেবল মহিলারাই উপস্থিত ছিলেন। ট্রান্স ককেশিয়ার বিভিন্ন পাহাড়ি এলাকা এবং স্তেপ অঞ্চলের মুসলিম মহিলারা ওখানে ছিলেন। তাদের পরনে ছিল বহুবর্ণে রঞ্জিত এবং সুতোর সূক্ষ্ম কারুকাজ করা পোশাক, মুখ ছিল অনাবৃত। তার ওপর ইলেক্ট্রিকের উজ্জ্বল আলো পড়ায় তাদের শরীর ও চলাফেরার সুষমা আরও ফুটে উঠছিল। তবে তাদের মুখে খুশির যে ঝলক দেখেছিলাম তা তাদের চমৎকার রঙিন পোশাকের চেয়েও বেশি আকর্ষণীয় ছিল। আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, এই সমস্ত মহিলার কাছে এমন এক বার্তা পৌঁছে গিয়েছে যাতে তাদের অন্তঃকরণ আলোড়িত হয়েছে। এরা প্রত্যেকেই এমন একটা চেতনা অর্জন করেছিল যাকে প্রকাশ করার জন্য সকলেই উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল। এই চেতনা ক্লাবের পরিধির বাইরে,এমনকি দেশের সীমানার বাইরে তাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। যে বৃদ্ধা মহিলা জীবনের উপান্তে পৌঁছে গিয়েছেন তাকে সান্ত্বনা দিয়েছিল সর্বহারার বিপ্লব, যিনি পরিণত তাকে সংগ্রাম ও কর্মমুখর এক নতুন জীবনের দিকে আবাহন করেছিল এবং যে যুবতী নারী যে এখনও শৈশবের অর্ধেক ছাপ বহন করছে তাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হতে শেখাচ্ছিল।

সমবেত মহিলারা আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গাইলেন। আমি রাশিয়ার সর্বহারা নারী ও পুরুষকে অটল বিশ্বাস এবং বৈপ্লবিক প্রস্তুতি নিয়ে সংগ্রাম ও আশার বার্তাবাহী এই কমিউনিস্ট সঙ্গীত গাইতে বহুবার দেখেছি। কিন্তু তিফলিশের মুসলিম মহিলা ও বালিকারা যে আকর্ষণীয়ভাবে ও পরম গুরুত্বের সাথে এই গানের প্রতিটি শব্দ তাদের সুরেলা কন্ঠে উচ্চারণ করলেন এমনটা আমি কখনো শুনিনি। তাদের হৃদয় ও সমগ্র সত্তা এই গানে প্রতিফলিত হচ্ছিল। যেভাবে একজন ধর্মপ্রাণ প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টান যিশুখ্রিস্টের শেষ নৈশভোজের স্মরণে সুরা এবং রুটি গ্রহণ করে ঈশ্বর এবং যিশুখ্রিস্টের সাথে নিজের সম্পর্ক স্থাপন করছেন বলে মনে করেন সেই রকমই এক গভীর বিশ্বাস থেকে এই মহিলারা আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গাইলেন। তারা এই ভেবে অনুপ্রাণিত এবং অভিভূত যে এই গান তাদের মনুষ্যত্ব এবং মানবিক মর্যাদার স্বীকৃতি দেয়। তারা এটা অনুধাবন করেছেন যে, এই গান পুরুষদের সাথে তাদের সমানাধিকার স্বীকার করে যার ফলে পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ মানুষের সাথে তারা সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারে। ক্লাবের কয়েকজন মুসলিম মহিলা যে আবেগদৃপ্ত বক্তৃতা দিয়েছিলেন তার থেকে এই মনোভাবই ফুটে উঠেছিল। তাদের মধ্যে একজন যুবতী মহিলা কমরেড ছিলেন তিনি অত্যন্ত উত্তেজনার ফলে প্রায় কিছু বলতেই পারছিলেন না। মহিলা হিসেবে তাদের নতুন অবস্হান ও মূল্যায়ন এবং সারা বিশ্বের স্বাধীনতার যোদ্ধাদের সাথে তাদের একাত্ম হতে পারার এই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এর সাথে সর্বহারা বিপ্লব এবং সোভিয়েত ব্যবস্থার মুক্তিকামী কাজের প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছিল। তবে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, অপমান এবং তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতিও তাদের বক্তৃতায় বারেবারে উঠে আসছিল। সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলি কি আবার ফিরে আসবে এবং আমাদের ফুলের মতো কন্যাদের জীবনকে আবার পিষে ফেলবে? সমবেত মনোযোগী শ্রোতারা আবেগ দৃপ্ত কণ্ঠে বলে উঠেছিলেনঃ ‘‘সেইসব ভয়ঙ্কর দিন আবার ফিরে আসার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়'’’। এই দৃপ্ত ঘোষণার পর পুরো ক্লাব ঘর করতালিতে মুখরিত হয়েছিল।

একজন বক্তা বলে উঠলেনঃ ‘‘বিপ্লবের আগে আমাদের জীবন কেমন ছিল? দশ, বারো এমনকি তারও কম বয়সে আমাদের বাবারা কচি ভেড়ার মতো আমাদের বিক্রি করে দিত। আমাদের স্বামীরা আমাদের কাছ থেকে স্নেহ, ভালোবাসা চাইতো, এমনকি যখন তাদেরকে দেখে আমাদের মধ্যে বিতৃষ্ণার উদ্রেক হতো তখনও। ওদের যখন ইচ্ছে হতো তখন আমাদেরকে লাঠি বা চাবুক দিয়ে পেটাতো। দাসীর মতো দিনরাত আমাদের তাদের সেবা করে যেতে হতো। তাদের যখন আমাদের আর ভালো লাগত না তখন আমাদেরকে নরকে যেতে বলত।আমাদেরকে তাদের বন্ধুদের কাছে রক্ষিতা হিসেবে বেচে দিত। যখন তাদের মন চাইতো তখন আমাদের না খাইয়ে রাখত। আমাদের চোখের মণি আর দুর্বল শরীরের অবলম্বন আমাদের প্রিয় মেয়েদেরকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে চলে যাওয়া হতো। যেভাবে তারা আমাদেরকে কিনেছে সেভাবেই তারা আমাদের মেয়েদের বেচে দিত। যখন আমরা কোনো বিপদে পড়তাম কো‍‌নো মোল্লা আমাদের সহযোগিতা করার জন্য আসত না। এমন কো‍‌নো বিচারক কোথায় পেতাম, যিনি আমাদের আইনি সহায়তা দিতে পারতেন?

কিন্তু এখন আমার প্রিয় বোনেরা দেখো সব কিছু কিভাবে পরিবর্তন হয়ে গেছে! বিপ্লব এসেছে এক প্রচণ্ড শক্তিশালী বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ঝড়ের মতো! অন্যায় ও দাসত্বকে সে ধূলিসাৎ করেছে। আর আমাদের মতো গরিব ও নির্যাতিতের জন্য এনেছে ন্যায়বিচার ও মুক্তি। আমাদের বাবারা আর যুবতী কন্যাদের যখন খুশি টেনে নিয়ে জোর করে অচেনা স্বামীর বিছানায় ঠেলে দিতে পারবে না। আমরা এখন নিজেদের স্বামী নিজেরাই নির্বাচন করতে পারব এবং সে আর কখনো আমাদের প্রভু হবে না বরং সে হবে আমাদের বন্ধু এবং কমরেড। আমরা তার পাশে একসাথে কাজ করতে চাই,লড়াই করতে চাই এবং এক নতুন সমাজ গড়ে তুলতে চাই। প্রত্যেকের জন্যই এক নতুন জীবন শুরু হওয়া দরকার। সোভিয়েত ব্যবস্থায় নতুন আইন লেখা হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে যে, পুরুষদের মতো আমরাও মানুষ এবং আমরাও স্বাধীন এবং তাদের মতো আমাদেরও একইরকম অধিকার আছে। সোভিয়েতগুলিতে আমরাও নারী ও পুরুষ উভয়কেই আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে পাঠাতে পারি এবং আমরাও সেখানে কাজ করতে পারি। যখন স্বামী অথবা প্রতিবেশী অথবা আমাদের কো‍‌নো উপরওয়ালার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ থাকবে তখন আমরা তাদেরকে জনসাধারণের বিচারালয়ে নিয়ে যেতে পারি। যদি আমরা সঠিক কাজ করি তাহলে আমাদের পক্ষেই বিচার হবে। এখানে কেউ আমাদের বলে দেয় না যে, কোনো পয়গম্বরকে আমরা অনুসরণ করবঃ মহম্মদ, মোজেস না যিশুখ্রিস্ট। সোভিয়েতব্যবস্থা আমাদের মুক্তি এনেছে। আমরা তাদের প্রতি অন্তহীন কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি!’’

তিফলিশের মুসলিম মহিলাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের যে সমস্ত প্রশিক্ষিত মহিলা কমরেড কাজ করছেন তারা এই সভার মেজাজ এবং তাৎপর্য আমার কাছে স্পষ্ট করে তোলেন। কয়েকজন বাদ দিলে এখানে যে সমস্ত মহিলা ছিলেন তারা সমাজের নিম্নতম স্তর থেকে এসেছিলেন। নিকটবর্তী পাহাড় এবং স্তেপ অঞ্চল থেকে তারা বিপ্লবের আগেই তিফলিশে এসেছিলেন এই আশাতে যে এখানে তারা অনেক সহজে ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারবেন। তাদের বাড়ির পুরুষেরা কেউ জিনিসপত্র বিক্রি করেছে, দিনমজুর,বাহক বা ভৃত্যের কাজ করেছে, নানারকমের দৈহিক পরিশ্রমের কাজ করে উপার্জন করার চেষ্টা করেছে। তাদের স্ত্রীরা বাড়িতে অত্যন্ত দৈন্যদশায় বাচ্চাদের নিয়ে থেকেছে। শহরে চলে আসার জন্য এই মহিলারা অতীতে যে অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ করত তা বন্ধ হয়ে যায়। অতীতের কুটির বা তাঁবু থেকে, মাঠ ও পশুদের পাল থেকে বিচ্ছিন্ন এই মহিলারা এখন আদিমতম উৎপাদনমূলক কাজের সাথেও যুক্ত থাকতে পারে না। নিজের পরিবারের চাহিদাটুকু তারা পূরণ করতে পারে না। সমস্ত কিছু তাদেরকে বাইরে থেকে কিনতে হয় এবং তাদের কাছে কেনার মতো কো‍‌নো টাকা থাকে না। কেবলমাত্র স্বামীর কাছেই টাকা থাকে। এর ফলে স্বামীর কাছে সংসার প্রতিপালনের সহকারী হিসেবে মুসলিম মহিলার গুরুত্ব কমে গিয়েছে। অতীতের পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের ভিত্তি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে,যদিও পরিবারের মধ্যে পুরুষের আধিপত্য অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও বজায় রয়েছে। মহিলারা এখন আগের চেয়েও বেশি নিজেদেরকে দাসীর মতো, পুরুষের সম্পত্তির মতো মনে করেন। প্রথা, ঐতিহ্য,ভাষা, ধর্ম - সবকিছুর বিচারেই তারা শহরের অপরাপর অংশের থেকে পৃথক,এমনকি গরিব মানুষের কাছ থেকেও তারা আলাদা। তাদের দৈন্য, একাকীত্ব এবং হতাশা এখন তীব্র আকার ধারণ করেছে। তারা যেন গাছ থেকে খসে-পড়া পাতা যাদেরকে নিয়ে হাওয়া খেলা করছে। আক্ষরিক অর্থেই তিফলিশের এই মুসলিম মহিলাদের জন্য বিপ্লব এসেছে পরিত্রাতা রূপে। এর ফলে তাদের জীবনে অভাবনীয় ঘটনা ঘটেছে যা তাদেরকে অভিভূত করেছে।

মহিলা কমরেডরা আমাকে বোঝাচ্ছিলেন যে, শহরের মুসলিম মহিলাদের এই ক্লাবের সবচেয়ে বেশি তাৎপর্য কোথায়। মহিলাদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি প্রতিভাবান, কর্মচঞ্চল এবং জ্ঞানপিপাসু তারা এখানেই তাদের প্রথম রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য সমবেত হন। এখানে তারা নানা ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে পারেন। কেউ কেউ কমিউনিস্ট পার্টিতে যুক্ত হয় তাদের স্ব-ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে প্রচারক এবং সংগঠকের ভূমিকা পালন করার জন্য। যে সমস্ত মুসলিম মহিলা অন্যায়ের হাত থেকে, আরও দৈন্য এবং অন্ধবিশ্বাসের গহ্বরে তলিয়ে যাওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করবার জন্য সাহায্য এবং পরামর্শ চান তাদের কাছেও এই ক্লাব হচ্ছে এক আশ্রয়স্থল। এই ক্লাবে সাংস্কৃতিক কাজের জন্য আলাদা বিভাগ আছে যেখানে পক্বকেশ মহিলারা কুঁড়ির মতো বালিকাদের পাশে বসে অত্যন্ত উৎসাহের সাথে বর্ণমালা শিখছে এবং পড়াশোনার চেষ্টা করছে। প্রকৃতিবিজ্ঞান এবং সমাজবিজ্ঞানের মৌলিক শিক্ষা দেওয়ার জন্য এখানে বিভিন্ন বক্তৃতা এবং পাঠক্রমের ব্যবস্থা রয়েছে। দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে তিনজন আইন বিশেষজ্ঞ কমরেড উপস্থিত থাকেন যারা বিচারবিভাগীয় বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে সাহায্য করেন। এদের কাজ বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। আইনের চোখে নারী ও পুরুষের সমতার কথা বললেই শত শত বছর ধরে মহিলাদের প্রতি যে ধরনের মনোভাব গড়ে উঠেছে তাকে কোনো জাদুমন্ত্রে খুব দ্রুত দূর করে দেওয়া যায় না। অনেক সময়ই মহিলাদেরকে ন্যায়বিচারের জন্য বিচারসভার দ্বারস্থ হতে হয়। এই ক্লাবে মহিলাদেরকে সেলাইয়ের কাজ ও এমব্রয়ডারির কাজও শেখানো হয়। অধিকাংশ শহুরে মুসলিম মহিলারা তাদের মায়েদের কাছ থেকে সুতোর কাজ শেখেন নি এবং যারা ছোটো তারা তো সূঁচ ধরতেই জানে না।

মহিলা কমরেডরা জোরের সাথে এ বিষয়টি বলেছিলেন যে, স্বাভাবিকভাবেই কমিউনিস্টদের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে মহিলাদের যুক্ত করা। তবে জর্জিয়ার আধুনিক শিল্প যতদিন শৈশব অবস্থায় আছে ততদিন এই কাজ করা খুব কঠিন। তিফলিশের কাছে কুরা নদীর ধারে প্রথম বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে উঠলে খুব দ্রুতগতিতে এই কাজ হবে। বর্তমানে সোভিয়েত সরকার এই বিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তুলছে। মধ্যবর্তী সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির মহিলাদের শাখা বিভিন্ন মহিলাদের আলাদাভাবে কাজ পেতে সহায়তা করছে। কেউ কেউ কার্টোন কারখানায়, কেউ তামাক ও বস্ত্র শিল্পে কাজ করছেন। এই ক্লাবের আয়তন আরও বৃদ্ধি পেলে মহিলা কমরেডদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এখানে মহিলাদের সমবায় গড়ে তোলা হবে। এই সমস্ত উৎপাদনমূলক সমবায় কাজ করলে মুসলিম মহিলাদের আত্মবিশ্বাস বাড়বে এবং নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠবে। তার ফলে কমিউনিজম সম্পর্কে তাদের ধারণা আরও উন্নত হবে এবং ক্লাবেরও উন্নতি ঘটবে। ইতিমধ্যেই এই শহর এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অনেক মুসলিম মহিলাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে এই ক্লাব। ২০০ জন সদস্যের বাইরে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। এই ধারণা যে অতিরঞ্জিত নয় তার প্রমাণ হচ্ছে প্রত্যেক সদস্যের সঙ্গে আরও দশ জন মহিলা যুক্ত আছেন, যার ফলে প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং ঘটনার ক্ষেত্রে এই ক্লাব অধিকাংশ মুসলিম মহিলার সমর্থন পেয়ে থাকে। ক্লাবের প্রত্যেক সদস্য এই ক্লাবের বিজ্ঞাপন এবং এই ক্লাবের বার্তাকে তারা উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে এবং এমনকি গভীর ধর্মীয় আবেগের সাথে নিজেদের বন্ধু এবং আত্মীয়দের মধ্যে প্রচার করে।

ক্লাবের শিক্ষক এবং পরিচালকগণ যখন আমাকে পাশের একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণের বিভিন্ন বিষয়বস্তু এবং আলমারি ও বাক্সভর্তি বিভিন্ন সুতোর কাজ করা জিনিস দেখাচ্ছিলেন তখন মুসলিম মহিলারা ভিড় করে সেই ঘরে গিয়ে উপস্থিত হয়। সকলেই চাইছিল যে ক্লাবের এই কাজের যে প্রশংসা হচ্ছে তার অংশীদার হতে এবং সেই সাফল্যের জন্য আনন্দ প্রকাশ করতে। তারা বলতে থাকলেনঃ ‘‘এই দেখুন আমাদের পড়ার বই যেখানে দেখানো আছে বিপ্লবের আগে মানুষ কীভাবে কাজ করত’’, ‘‘এই ব্ল্যাকবোর্ডে আমাদের শিক্ষক দেখান যে সোভিয়েত ইউনিয়নে এখনো কতজন নিরক্ষর আছেন’’, “এখানে আমাদের শেখানো হয় কি করে আমাদের বাচ্চাদের যত্ন নেওয়া উচিত’’।

‘‘দেখুন আমি লিখেছি; আমি এই বিরাট কম্বলটাতে এমব্রয়ডারি করতে সাহায্য করেছি এবং এই ব্লাউজটা আমি বানিয়েছি’’, ‘‘আমি এই ধরনের জামা সেলাই করতে পারি’’। আমার চারপাশে এরকম নানা কথা হতে থাকল এবং আমি বুঝতে পারলাম এখানে কাজের সাথে প্রত্যেকে কিরকম একাত্ম হয়ে গিয়েছে এবং সমষ্টিগত চিন্তায় তারা শিক্ষিত হয়েছেন। এর পাশের ঘরেই ছিল আইনি পরামর্শদাতারা যাদের মহিলারা আক্ষরিক অর্থে ছেঁকে ধরেছিলেন।

এই ক্লাব যে বিনোদন এবং আনন্দেরও জায়গা সেটা ওরা আমাকে দেখালেন। পিয়ানো বাজানো শুরু হলো এবং নাচ আরম্ভ হলো। প্রথমে নাচতে শুরু করল একজন মহিলা কমরেডের পাঁচ বছরের কন্যা। ওর চেহারা, মুখ ও পোশাক দেখে আমার মনে পড়ে গেল যে, ছোটোবেলায় আমি শেবার রানি এবং সেমিরামিসের চেহারা নিয়ে কি কল্পনা করতাম। ছোট্ট মেয়েটির কালো চুল আর বড়ো, বড়ো উজ্জ্বল চোখ অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল।

শিশুটির অঙ্গসৌষ্ঠব এবং মুখের অভিব্যক্তি ছিল অসাধারণ। সঙ্গীতের রূপ এবং ছন্দের দ্রুত পরিবর্তনের সাথে সাথে তা পরিবর্তিত হচ্ছিল। নিঃসন্দেহে ওই ছিল ক্লাবের সকলের সবচেয়ে আদরের। এর পরে নাচতে শুরু করল তরুণী মেয়েরা। অধিকাংশ সময়ে ওরা একা নাচছিল,কখনও বা যুগলে। পশ্চিমী দুনিয়ায় প্রাচ্যের নাচের ক্ষেত্রে যে ধরনের ভঙ্গিমা সাধারণভাবে দেখা যায় তার থেকে ওদের অঙ্গসৌষ্ঠব ছিল একেবারেই আলাদা। এখানে শরীরের উত্তেজক প্রদর্শন ছিল না, বরং চলমান জীবনের আনন্দময় বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল। তবে নাচের পর্ব ছিল এই সন্ধ্যার এক ছোটো অংশ। তাদের ভাবনা-চিন্তা,অনুভূতির কেন্দ্রে ছিল বিপ্লব এবং ‘নতুন জীবনের উন্মেষ’। ওদের প্রশ্ন, মন্তব্য, বক্তৃতা, আশ্বাস সমস্ত কিছুর মধ্যেই আন্তর্জাতিক বৈপ্লবিক সংহতির বহিঃপ্রকাশ ঘটছিল। বোঝা যাচ্ছিল যে, মুসলিম মহিলাদের এতকালের সঙ্কীর্ণ জীবন এখন কতটা প্রসারিত হয়েছে।

সংহতির এই অনুভূতি প্রাচ্যের উদীয়মান মহিলাদের কাছে মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছে এবং তাদের মধ্যে এক অগ্নিগর্ভ শক্তির সঞ্চার করেছে। তারা এখন জানে এবং বিশ্বাস করে, ‘‘এই প্রতীক তাদের বিজয় নিশ্চিত করবে’’।

আমি ক্লাব ছেড়ে যাবার সময় ক্লাবের ভেতরে এবং রাস্তার উপরে আবার আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গাইলেন মুসলিম মহিলারা। সর্বহারার বিপ্লব বিধ্বংসী ঝড়ের মতো গোটা পৃথিবীর যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটাতে চলেছে তাকে প্রতিহত করতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বুর্জোয়া সরকার এবং শক্তিশালী পুঁজিবাদী সংস্থাগুলি কি প্রয়াস চালাচ্ছে সেই খবর প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় প্রকাশিত হচ্ছিল। তবু ‘‘পরিবর্তন হবে, কারণ আমরা পরিবর্তন ঘটাব’’ - এই শপথ, এই বিশ্বাস পৃথিবীর গভীর থেকে উচ্চারিত হচ্ছিল।


(অনুবাদঃ অর্ণব ভট্টাচার্য)