৫৭ বর্ষ ৫০ ও ৫১ সংখ্যা / ৭ আগস্ট ২০২০ / ২২ শ্রাবণ ১৪২৭
জাতীয় শিক্ষানীতি - কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা
শ্রুতিনাথ প্রহরাজ
নজিরবিহীন কায়দায় একতরফা নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করল আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি সরকার। বারংবার দাবি করা সত্ত্বেও সংসদে এ নিয়ে কোনো বিতর্ক হলো না। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রতিনিধিরা তাদের মতামত জানানোর সুযোগ পেলেন না। শিক্ষা সংবিধানের যুগ্ম তালিকাভুক্ত অথচ নীতি প্রণয়ন ও গ্রহণের ক্ষমতা একচেটিয়া কুক্ষিগত করবার লক্ষ্যে, শিক্ষানীতি তৈরি ও চূড়ান্ত করবার সময় রাজ্য সরকারগুলির মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হলো না। সরকারিভাবে শিক্ষানীতি ঘোষণার সময় বলা হলো, সারাদেশে গত এক বছর ধরে এই নীতি নিয়ে আড়াই লক্ষ পঞ্চায়েত, ছয় হাজার ব্লক স্তর সহ বহু শিক্ষাবিদের সাথে নাকি মতবিনিময় হয়েছে। আসল সত্য কি? আদৌ কি এদেশে শিক্ষার স্বার্থের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন আলোচ্য শিক্ষানীতি নিয়ে তাদের মতামত দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন? উত্তর একটাই, না। বিরোধী রাজনৈতিক দল, ছাত্রসংগঠনগুলি, শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের সংগঠন নিজেদের উদ্যোগে যে পরামর্শ কেন্দ্রীয় সরকারকে দিয়েছিল, তা কি আদৌ সরকার বিবেচনায় এনেছিল? আবারও উত্তর একটাই, না। অথচ দাবি করা হচ্ছে, এই শিক্ষানীতি নিয়ে নাকি ব্যাপকভাবে আলোচনা হয়েছে। হ্যাঁ আলোচনা হয়েছে একথা ঠিক তবে তা সংঘ পরিবারের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মধ্যে, তার বাইরে নয়। শিক্ষানীতি প্রণয়নের সময় সঙ্ঘ পরিবারের লোকজন সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর কে কস্তুরীরঙ্গনকে নিয়ে আরএসএস নেতৃত্ব ও বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সরকারের সাথে খসড়া নীতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন একথা সত্য। তাই শিক্ষানীতি ঘোষণা হবার পর আরএসএস নেতৃত্ব খোলাখুলি তাদের সন্তুষ্ট হওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন। আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠান অখিল ভারতীয় ইতিহাস সংকলন যোজনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সঙ্ঘ নেতা বালমুকুন্দ পান্ডে দাবি করেছেন, তাঁর পরামর্শের শতকরা আশি ভাগ সরকার মেনে নিয়েছে। কোন্ কুড়ি ভাগ মানেনি তা অবশ্য তিনি বলতে অস্বীকার করছেন। সঙ্ঘ পরিচালিত আরেকটি প্রতিষ্ঠান অখিল ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শিক্ষক মহাসঙ্ঘের দায়িত্বপ্রাপ্ত সঙ্ঘনেতা মহেন্দ্র কাপুর জানিয়েছেন, শিক্ষানীতিতে তাদের বেশিরভাগ পরামর্শই মেনে নেওয়া হয়েছে। অথচ দেশের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার পরিচালিত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সর্ববৃহৎ দুটি শিক্ষক সংগঠন এআইফুকটো ও ফেডকুটা, এবং বিদ্যালয় শিক্ষকদের সর্বভারতীয় সংগঠন এসটিএফআই দাবি করেছে যে, এ নিয়ে তাদের লিখিতভাবে পেশ করা পরামর্শকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। একই বক্তব্য ছাত্র সংগঠনগুলিরও। সিপিআই(এম) দলের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি লিখিতভাবে খসড়া শিক্ষানীতির বিপদজনক অংশগুলির উল্লেখ করে তা সংশোধনের জন্য অনুরোধ করেন প্রধানমন্ত্রীকে। সঙ্ঘ পরিবারের আদর্শ ও লক্ষ্যে অবিচল নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকার তা বিবেচনা করবার প্রয়োজন বোধ করেনি। হিন্দুত্বের দর্শন প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আরএসএস তথা সংঘ পরিবারের এই সক্রিয়তা বৃদ্ধি, আগামী দিনে যে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
আলোচ্য জাতীয় শিক্ষানীতিতে বেশ কিছু ভালো কথা বলা হয়েছে যা প্রত্যক্ষভাবে স্ববিরোধিতায় ভরা। যেমন এক জায়গায় বলা হয়েছে, আগামীদিনে শিক্ষাখাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারকে মিলিতভাবে মোট জাতীয় আয় বা জিডিপির ৬ শতাংশ খরচ করতে হবে। স্ববিরোধী বলছি এই কারণে যে, কেন্দ্রীয় সরকার শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দের প্রশ্নে ঠিক কী ভূমিকা পালন করে এসেছে এযাবৎকাল, তার কোনো উল্লেখ এখানে নেই। সরকারি বা সরকার পোষিত প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও হায়ার সেকেন্ডারি বিদ্যালয়ের সংখ্যা এদেশে এখন প্রায় দশ লক্ষ। এগুলির বর্তমান অবস্থা কি? পঠন পাঠনের পরিবেশ ঠিক কত শতাংশ বিদ্যালয়ে যথাযথভাবে আছে? শিক্ষক নিয়োগের চিত্র কি এবং ছাত্র শিক্ষকের অনুপাত কত ও তা যথাযথ কিনা - এই প্রশ্নগুলি সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
২০১০ সালে যখন শিক্ষার অধিকার আইন চালু হয়, হিসেব করে দেখা গিয়েছিল, সাকুল্যে ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো অর্থ কেন্দ্রীয় সরকার বরাদ্দ করতে পারলে ওই আইনে যে যে বিষয় গুলি করবার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা কার্যকর হতে পারে। বাস্তবে দেখা গেল, ইউপিএ-২ সরকারের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ তার থেকে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা কম। ফলে আইনে বিস্তর ভালো ভালো কথা বলা থাকলেও, বাস্তবে তার সিকিভাগও কার্যকর হলো না। এই সুযোগ কাজে লাগালো দেশি ও বিদেশি কর্পোরেট পুঁজির মালিকরা শিক্ষায় তাদের বিনিয়োগ বাড়িয়ে। ২০১৪ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদী সরকার সেই একই পথের পথিক। শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ গত ছয় বছরে ধারাবাহিকভাবে কমেছে। ২০১৪ সালে যা ছিল মোট জাতীয় আয়ের ১.০৬ শতাংশ তা বর্তমান বছরে ০.৫ শতাংশেরও কম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশিক্ষা অভিযানের কেন্দ্রীয় বরাদ্দের অংশ ধারাবাহিকভাবে কমেছে। রাষ্ট্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান প্রকল্পে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের অংশ ৭৮ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৪৬ শতাংশে। রাজ্যগুলির অবস্থাও তথৈবচ। গত শতকের ছয়ের দশকে কোঠারি কমিশন শিক্ষাখাতে জিডিপি’র ৬ শতাংশ বরাদ্দ করবার পরামর্শ দিলেও আজ অব্দি এদেশে তা কার্যকর হয়নি। তাই আবার নতুন করে জিডিপি’র ৬ শতাংশ বরাদ্দের যে প্রতিশ্রুতি এখানে দেওয়া হয়েছে, তার কোনো বাস্তবিক ভিত্তি নেই যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকার তার ভাগ উল্লেখ করেনি। তারা নিজেরাই স্বীকার করেছে, এখনো পর্যন্ত শিক্ষাখাতে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলির মোট মিলিত খরচ জিডিপি’র ৪.৪৩ শতাংশের বেশি নয়, অথচ কেন্দ্রীয় বাজেটের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এই শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা নেই।
যে সরকার ধারাবাহিকভাবে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমিয়ে, নিজেদের দায় এড়িয়ে, শিক্ষানীতিতে সরকারি এবং বেসরকারি বিদ্যালয়কে সমগোত্রভুক্ত করবার কথা ঘোষণা করে, তাদের আসল লক্ষ্য যে শিক্ষাক্ষেত্রে বেপরোয়া বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের পথ প্রশস্ত করা, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না। এই শিক্ষানীতির ছত্রে ছত্রে এদেশে শিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগকে স্বাগত জানানোর কথা খোলাখুলি বলা হয়েছে। চালু নিয়ন্ত্রণ বিধি নস্যাৎ করে, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের শিক্ষার বাজারে ঢালাও মুনাফা লুট করবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে বিজেপি বরাবরই হিন্দুত্ব ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী দর্শনের প্রচারে আগ্রহী। তাই কেন্দ্রে বা রাজ্যে যখন যেখানে ক্ষমতায় এসেছে, বিজেপি’র কর্মসূচির অন্যতম একটি বিষয় হয়ে উঠেছে হিন্দুত্বের দর্শন মেনে শিক্ষার পাঠ্যসূচির খোলনলচে বদল ঘটানো। এনসিইআরটি ও তার অধীন ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক-কে (এনসিএফ) পাঠ্যসূচি গেরুয়াকরণের কাজে সেইভাবে তারা ব্যবহার করেছে। নতুন শিক্ষানীতিতে এই ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক-কে দিয়ে সারা দেশের জন্য বিদ্যালয় শিক্ষায় অভিন্ন পাঠ্যসূচি নির্মাণের কথা বলা হয়েছে যা অত্যন্ত বিপজ্জনক সংকেত। অন্তত গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা তাই বলে।
২০০১ সালে এই কাজ তারা প্রথম শুরু করে মুরলী মনোহর যোশীর নেতৃত্বে। আরএসএস নেতা যোশী তখন কেন্দ্রীয় মানব সম্পদ উন্নয়ন তথা শিক্ষামন্ত্রী। সঙ্ঘ পরিবারের নির্দেশে এনসিইআরটি-কে দিয়ে পাঠ্যসূচির গেরুয়াকরণের লক্ষ্যে পুরোদস্তুর কাজ শুরু হয়েছিল। হিন্দু ধর্মের আলোকে পাঠ্যসূচি নির্মাণ ছিল প্রধান লক্ষ্য।
২০১৪ সালে দ্বিতীয় দফায় কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর এই কাজে গতি আনতে, দেশের গুরুত্বপূর্ণ সবকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাথায় সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ মানুষদের বসিয়ে দিয়েছে বিজেপি।
বিজেপি নেতৃত্বাধীন প্রথম এনডিএ সরকারের আমলে, বিদ্যালয় পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি ঠেকানোর জন্য সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থে মামলা হয়েছিল। সংবিধানের ২৮ নম্বর আর্টিকেলে পরিষ্কার উল্লেখ আছে যে, সরকারি বা সরকারি অর্থে পরিচালিত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধর্মীয় শিক্ষাকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে না। অথচ সেই মামলার রায় দিতে গিয়ে বিচারপতি বলেন, শিশুমনে মূল্যবোধের শিক্ষা গড়ে তোলার জন্য ধর্মীয় শিক্ষা প্রয়োজন, তাই একে বন্ধ করার দরকার নেই। মামলার এই রায়ে সঙ্ঘ পরিবার নতুন করে অক্সিজেন পায়। শিক্ষায় গেরুয়াকরণের কর্মসূচির গতি বাড়তে থাকে।
গুজরাট বা রাজস্থানে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর অতি দ্রুত সেখানকার বিদ্যালয় পাঠ্যসূচির বদল ঘটিয়েছে। নরেন্দ্র মোদী গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর শিক্ষাগুরু আরএসএস নেতা দীননাথ বাটরাকে দায়িত্ব দিয়ে বিদ্যালয় শিক্ষার পাঠ্যসূচির ব্যাপক রদবদল ঘটিয়েছিলেন। এমনকি পাঠ্যপুস্তক রচনা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাঁদেরকেই। এখনো গুজরাটে বিদ্যালয়গুলিতে সেই সব বই পড়ানো হয়। হিন্দু ধর্মের মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় অন্য ধর্মকে ছোট করে দেখা বা ঘৃণা করা, ইতিহাসের বিকৃতি, প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে কল্পনাকে মিলিয়ে দেওয়া, পুরাণ বা মহাকাব্যকে প্রকৃত ঘটনা হিসেবে তুলে ধরা, পুরাণের কল্পকাহিনীকে বিজ্ঞানের কাহিনী হিসেবে পরিবেশন করা, বিদ্যালয় স্তরে বৈদিক গণিতের অন্তর্ভুক্তি - এসবই হল ওই পরিবর্তিত পাঠ্যসূচির অন্যতম অংশ। এরকম আরো কত বিপদজনক বিষয় স্কুল পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তার সীমা-পরিসীমা নাই যা এদেশের বহুত্ববাদী সংস্কৃতিকে বিপন্ন করছে, করবেও আগামী দিনে। এইসব বই পড়িয়ে শিশুমনকে বিষিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে। অবিজ্ঞান ও কুসংস্কারের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে বর্তমানের এইসব শিশু-কিশোরের দল। এই সঙ্ঘ পরিবারের হাতে সারা দেশের স্কুল শিক্ষার পাঠ্যসূচি নির্মাণের দায়িত্ব আগামী দিনে তুলে দিলে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য তা কতটা বিপদজনক হয়ে উঠবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
নয়া শিক্ষানীতির এক জায়গায় বলা হয়েছে, রাজ্যগুলি চাইলে নিজেদের পাঠ্যসূচি তৈরি করতে পারে তবে তা করতে হবে কেন্দ্রীয়ভাবে তৈরি হওয়া পাঠ্যসূচির আদলে। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ যে শিক্ষানীতির প্রধান অভিমুখ সেখানে রাজ্যগুলি আগামী দিনে আদৌ তাদের ভাবনার প্রয়োগ শিক্ষাক্ষেত্রে করতে পারবে কিনা, তা যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রাখে। কোভিড অতিমারীর সময় রাজ্যগুলিকে যেভাবে শর্তসাপেক্ষে বাজার থেকে অর্থ সংগ্রহের কথা বলা হয়েছে, আগামী দিনে শিক্ষায় কেন্দ্রীয় বরাদ্দের প্রশ্নে একইরকমভাবে রাজ্যগুলির উপর শর্ত আরোপ করা হবে, কেন্দ্রীয়ভাবে তৈরি পাঠ্যসূচি মেনে বিদ্যালয় শিক্ষা পরিচালনার জন্য। ছাত্র-ছাত্রীদের বিপদকে উপেক্ষা করে অসহায়ভাবে রাজ্যগুলিকেও তা মেনে নিতে হবে, যদি না এখন থেকে এই জনবিরোধী শিক্ষানীতির প্রতিবাদে সর্বস্তরে সহমত তৈরি করে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা যায়।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে রাজস্থানে বিজেপি সরকার এই পাঠ্যসূচি তৈরি করার জন্য যে ১৬০ জন মানুষকে দায়িত্ব দিয়েছিল, পরে জানা যায় যে তারা প্রায় সকলেই সঙ্ঘ পরিবারের সঙ্গে যুক্ত। প্রথম শ্রেণী থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বিদ্যালয় পাঠ্যসূচির ঢেলে পরিবর্তন ঘটানো হয় যা পরবর্তীকালে অন্যান্য বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকারগুলি নিজের নিজের রাজ্যে প্রয়োগ করে। প্রধান লক্ষ্য ছিল আরএসএস পরিচালিত বিদ্যাভারতী স্কুলের পাঠ্যসূচির মডেলে এই পাঠ্যসূচির বদল ঘটানো এবং সেইমতো টেক্সট বই রচনা করা।
প্রতিটি পাঠ্য বই শুরু হয়েছে ভারতমাতার গুণকীর্তনে দেশ ভক্তির কবিতা দিয়ে। এমনকি রাজস্থানের বিদ্যালয় পাঠ্যসূচিতে এদেশে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া সতীদাহ প্রথারও গুণকীর্তন করা হয়েছে। বইগুলিতে ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের মানুষদের হয় ‘অন্যান্য’ বা ‘বহিরাগত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সপ্তম শ্রেণীর ইংরেজি বইতে উন্নত প্রযুক্তির বিষয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক থেকে জহরলাল নেহরু ও দেশ গঠনে তাঁর ভূমিকা বাদ দেওয়া হয়েছে। সচেতন ভাবেই আড়াল করা হয়েছে গান্ধী হত্যা ও নাথুরাম গডসে’র প্রসঙ্গটি। আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি সরকারের হাতে শিক্ষানীতি প্রণয়নের দায়িত্ব থাকলে তা কতটা বিপদজনক হতে পারে তার আরো একটি নমুনা এ প্রসঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে। সাম্প্রতিককালের করোনা আবহে বিদ্যালয় পাঠ্যসূচির ভার লাঘব করার কথা ঘোষণা করে মোদী সরকার। সেই অনুযায়ী সিবিএসই ও অন্যান্য কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত সংস্থার দশম ও দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যসূচির কিছু অংশ বাদ দেওয়া হয়। এখন দেখে নেওয়া যাক এই সুযোগে সংঘ পরিবার নিয়ন্ত্রিত বিজেপি সরকার কোন্ কোন্ অংশ বিদ্যালয় পাঠ্যসূচি থেকে সুকৌশলে বাদ দেওয়ার বন্দোবস্ত পাকা করলো। নবম শ্রেণীর সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচি থেকে ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’ শীর্ষক অধ্যায়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। দশম শ্রেণীর বইয়ের ‘গণতান্ত্রিক রাজনীতি’ শীর্ষক অধ্যায় থেকে ‘গণতন্ত্র ও বৈচিত্র’, ‘জনপ্রিয় আন্দোলন ও সংগ্রাম’, ‘গণতন্ত্রের কাছে চ্যালেঞ্জ’, ‘লিঙ্গ ধর্ম ও জাত’ বিষয়ের আলোচনাগুলি বাদ দেওয়া হয়েছে। দশম শ্রেণীর পাঠ্যসূচি থেকে ‘নাগরিকত্ব, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার’ অধ্যায়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্যসূচি থেকে ‘ভারতীয় অর্থনীতির ক্রমবিকাশের ইতিহাস’ ও ‘পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা’ শীর্ষক অধ্যায় দুটি ছেঁটে ফেলা হয়েছে। এরকম আরো বহু ঘটনা ঘটছে। আসলে আরএসএস তথা সঙ্ঘ পরিবারের দর্শন হলো হিন্দুত্ব, হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় আধিপত্যের দর্শন, তাই স্কুল পাঠ্যসূচি থেকে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ শীর্ষক আলোচনা সুপরিকল্পিতভাবেই বাদ দেওয়া হয়েছে। ওরা পরিকল্পিত অর্থনীতির বিরোধী, সেই কারণ প্ল্যানিং কমিশন তুলে দিয়েছে, আর তাই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দিয়েছে।
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ সরকার ঘোষণা করে, এখন থেকে, সংবিধান প্রণেতা ড. বি আর আম্বেদকর-কে ছাত্র-ছাত্রীরা জানবে ভীমরাও রামজি আম্বেদকর - পুরো নামে, অর্থাৎ 'রামজি' যা কিনা আম্বেদকরের বাবার নাম, তারও স্পষ্ট উল্লেখ করতে হবে। তারা আরো ঠিক করে, নবম শ্রেণী থেকে সঙ্ঘের তাত্ত্বিক নেতা দীনদয়াল উপাধ্যায় ও তাঁর জীবন ও কর্ম ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হবে।
যারা কোভিড অতিমারীর এই বিপর্যয়ের সময়ে প্রায় চল্লিশ হাজার ভারতীয় জনগণের অসহায় মৃত্যুকে উপেক্ষা করে, ঢাক ঢোল পিটিয়ে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে ‘রাম জন্মভূমি পূজনে’র আয়োজন করতে পারে, তাদের হাতে আগামী দিনের শিশু-কিশোরদের লেখাপড়ার দায়িত্ব তুলে দিলে তা আদৌ কতটা নিরাপদ হবে সে বিষয়টি এই মুহূর্তে ভাবা অত্যন্ত জরুরী।
জাতীয় শিক্ষানীতির কোথাও জাতীয় সাক্ষরতা মিশনের সীমাবদ্ধতাগুলি উল্লেখ করা হয়নি। বলা হয়নি এদেশে এখনো প্রায় ২৫ভাগ মানুষ নিরক্ষর। প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কাও সাক্ষরতার হারে আমাদের তুলনায় এগিয়ে। শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে মানবসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের নাম আবার পাল্টে আগের মত শিক্ষামন্ত্রক করা হবে। এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই একথা ঠিক, তবে এই সিদ্ধান্ত কতটা প্রাসঙ্গিক বা এর আদৌ কি প্রয়োজন ছিল তা ব্যাখ্যা করা হয়নি। পরে অবশ্য সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গেল, সঙ্ঘ পরিবারের নির্দেশে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিদ্যালয় শিক্ষায় আগেকার ১০+২ কাঠামো বদলে এবার ৫+৩+৩+৪ করবার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার অধিকার আইন যখন চালু হয়, ৩-৬ বছর ও ১৪-১৮ বছর পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষার দায়িত্ব সরকার নিতে অস্বীকার করে। কিন্তু এই নয়া শিক্ষানীতিতে ৩-১৮ বছর পর্যন্ত ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয় শিক্ষাকে সরকারি দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও কিভাবে তা কার্যকর করা হবে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পথ চিহ্নিত করা হয়নি। যেমন, প্রাক শৈশব শিক্ষা অর্থাৎ প্রথম পাঁচের প্রথম তিন বছর শিশুদের শিক্ষার দায়িত্ব আইসিডিএস অর্থাৎ অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের কাঁধে তুলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এও বলা হয়েছে যে, এর জন্য অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলির সংস্কার করা হবে এবং কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। একবারও বলা হলো না, এদেশে এখন যে ১৩ লক্ষ ৭৭ হাজার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র আছে সেগুলির প্রকৃত অবস্থা কী? এই কেন্দ্রগুলিতে কর্মরত মানুষগুলি কী অবস্থায় আছেন? তাদের দুর্দশা কি কেন্দ্রীয় সরকার জানে না? অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী বা সহায়িকাগণ কেন বারংবার দাবি করা সত্ত্বেও ন্যূনতম মজুরি ১৮ হাজার টাকা পান না বা তাদের চাকুরির স্থায়ীকরণ হলো না। খোঁজ নিলেই জানা যাবে, এদের অধিকাংশই হয় ৪,৫০০ টাকা বা ৩,০০০ টাকায় কাজ করেন। অল্প কিছু রাজ্যে অতিসম্প্রতি এদের সামান্য কিছু টাকা বাড়ানো হয়েছে। কেরালা একমাত্র রাজ্য যেখানে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা ১০,০০০ টাকা বেতন পান। সহায়িকাগণ পান ৭,০০০ টাকা। আগে তো এইসব অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের অস্তিত্বের বিপন্নতা থেকে উদ্ধার করতে হবে তাদের চাকরির স্থায়ীকরণের মাধ্যমে। তা না করে কেবল দায়িত্ব অর্পণ করার কথা বলে দিলে তা কতটা কার্যকর হবে আপনারাই বিচার করে দেখুন। বহু জায়গায় অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিও ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। সেগুলির ভবিষ্যৎ কি হবে, তা এখানে উল্লেখ করা হয়নি। শিশুশিক্ষার ভিত গড়বার লক্ষ্যে যদি সত্যিই এঁদের ব্যবহার করতে হয়, তবে সর্বাগ্রে এইসব কর্মী ও সহায়িকাদের জীবন মান উন্নয়নের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারকে নিতে হবে, যাতে তাঁরা এই কাজে নিজেদের অনুপ্রাণিত করতে পারেন।
আলোচ্য শিক্ষানীতিতে প্রাক প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার গুরুত্বের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি বহুল আলোচিত। এ নিয়ে আবারও বিতর্ক হতে পারে তবে এই পর্যায়ে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা অস্বীকার করা যাবে না। তার মানে এই নয় যে, এই কারণে ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা শিক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করা হবে না। খসড়া নীতিতে হিন্দি ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়ার কথা বলা থাকলেও চূড়ান্ত পর্বে তা বাতিল করা হয়েছে। বিদ্যালয় স্তরেই প্রথাগত শিক্ষার সাথে সাথে বৃত্তিমূলক শিক্ষা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। অতি উত্তম প্রস্তাব তবে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসবে, এরজন্য যে অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন তা জোগাড় হবে কোত্থেকে? সরকার যদি এই দায়িত্ব না নেয়, তবে এই প্রস্তাব কার্যকর হওয়ার কোনো অবকাশ থাকে না। বেসরকারি শিক্ষা ব্যবসায়ীদের হাতে এই দায়িত্ব সঁপে দিলে, তাদের মুনাফা বাড়বে ঠিকই, সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব পরিবারের ছেলে মেয়েরা এর থেকে উপকৃত হবে না। কাঠামো বদলের কারণে মাধ্যমিক পরীক্ষার গুরুত্ব খাটো করা হয়েছে অথচ একথা কি অস্বীকার করা যাবে যে এ রাজ্যে বা দেশেও মাধ্যমিক পাশের সার্টিফিকেট নিয়েই অনেকে অল্প হলেও কিছু অর্থ উপার্জনের পথ খুঁজে পেতেন। চূড়ান্ত পর্ব আরও দু’বছর পিছিয়ে গেল তার প্রভাব পড়বে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনে।
স্বীকৃত বোর্ড বা পর্ষদের পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে দিয়ে জাতীয় স্তরে একটি মাত্র মূল্যায়ন সংস্থার হাতে যাবতীয় পরীক্ষা নেওয়ার দায়িত্ব তুলে দেওয়ার যে প্রস্তাব এই শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে তা আদৌ বিজ্ঞানসম্মত নয়। এতে ছাত্র-ছাত্রীদের মনের উপর অনেক বেশি চাপ সৃষ্টি হবে, পরীক্ষা সম্পর্কে অযথা আতঙ্ক তৈরি হবে, যার সুযোগ নেবে বেসরকারি টিউটোরিয়াল হোম বা কোচিং সেন্টারের মালিকের দল।
সরকারি বা সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলির যথাযথ মানোন্নয়ন কেন ঘটছে না তার কোনো বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ এই শিক্ষানীতিতে নেই, যা থাকা দরকার ছিল। অতীতের যথাযথ মূল্যায়নই ভবিষ্যতের পথ নির্দেশ করে। কেন শুধুমাত্র ছাত্র সংখ্যা কম এই অজুহাতে গত পাঁচ-ছ বছরে লক্ষাধিক প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তার উল্লেখ এখানে নেই। আসলে কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থবাহী বর্তমান শাসকদলের প্রধান লক্ষ্যই হলো সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনাস্থা বাড়িয়ে বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের শিক্ষাক্ষেত্রে পুঁজি বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করা। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন সংগঠিত করতে না পারলে আগামীদিনে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবারের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার আঙিনা থেকে বেরিয়ে যাবে কারণ বেসরকারি বিদ্যালয়ের বিরাট অঙ্কের মাস মাইনের টাকা জোগানো এইসব পরিবারের পক্ষে সম্ভব নয়।
পরিশেষে বলি, এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে জাতীয় শিক্ষানীতির মূলত বিদ্যালয় শিক্ষার কিছু অংশ আলোচনার জন্য তুলে ধরা গেল। উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি সহ শিক্ষার বাকি বিষয়গুলি নিয়ে স্বতন্ত্র পরিসরে আলোচনার অবকাশ রইল। তবে শিক্ষা বাঁচানোর লক্ষ্যে সর্বস্তরের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে নিয়ে এই জনবিরোধী শিক্ষানীতি প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। বিজেপি লকডাউন-এর সুযোগ নিয়ে এই শিক্ষানীতি ঘোষণা করেছে এবং তা দ্রুত চালু করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমাদেরকেও একে প্রতিরোধ করার লক্ষে পথে নামতে হবে।