৫৭ বর্ষ ৫০ ও ৫১ সংখ্যা / ৭ আগস্ট ২০২০ / ২২ শ্রাবণ ১৪২৭
ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসঃ ধর্মমুক্তি ও মুক্তিপথের ঠিকানার দিকে
শুভময়
ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর দ্বিশতজন্মবর্ষের এই পরিসরে বিগত ৫ আগস্ট পার হয়ে গেল তাঁর প্রয়াণদিবস। মার্কসবাদে বিশ্বাসী সারা দুনিয়ার সমাজকর্মী ও মানবমুক্তির কারিগরদের কাছে তাঁর জীবন এবং সাংগঠনিক ও তাত্ত্বিক কর্মের পরিসর আদর্শস্থানীয় ও পরিগ্রহণের নিত্য উৎস।
তিনি এবং কাল মার্কস - মার্কসবাদী তত্ত্ব অবয়বের যৌথ নির্মাতা, এবং সেই তত্ত্বের সফল বৈপ্লবিক প্রয়োগ শিল্পী ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনকে আদর্শ মান্য করে আমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টি পত্তনের অন্যতম এক স্থপতির জন্মদিনও ৫আগস্ট। মুজফ্ফর আহ্মদ। তাঁর নিজের নির্ণয় ছিল, ‘‘১৮৮৯ সালের ৫ আগস্টকে আমি আমার জন্মদিন বলব।’’
ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর জীবনের সূচনাপর্বের সঙ্গে মুজফ্ফর আহ্মদের শৈশব-কৈশোরের এক আশ্চর্য সামীপ্য স্মরণ করে এই লিখন স্বল্প পথ এগোতে চাইবে। নেহাত স্বল্পপথ। এঙ্গেলস-এর জন্মাঞ্চল জার্মানির প্রথম শিল্প এলাকা উপার নদীর তীরে রাইনভূমির বারমেন শহরের সঙ্গে মেঘনা আর সাগরের মোহনায় ভাসমান সন্দ্বীপের আর্থ-সামাজিক-ভৌগোলিক ফারাক একেবারে আকাশপাতাল। তবে একটি প্রকট মিলও আছে। বস্ত্র শিল্পাঞ্চল বারমেন কিংবা রাইনভূমিরই শিল্পশহর ব্রেমেনে ধর্মতন্ত্রীদের প্রভাব ছিল আঁটোসাঁটো। ধর্মের নাম চেহারা আলাদা হলেও মিলের জায়গাটা ওইখানেই। কাকাবাবু লিখেছেনঃ ‘‘মুসলিম প্রধান সন্দ্বীপে মোল্লা মৌলবীর অভাব নেই। গ্রামে গ্রামে পারসী আরবী পড়ানোর ছোটো ছোটো মাদ্রাসা।’’
অনিবার্যত, ধর্মপ্রভাব মথিত পরিবেশে সমর্পণ-অন্বেষণ-উত্তরণ - এই বৈপরীত্য ও দ্বান্দ্বিকতার মধ্য দিয়েই পার হয় ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর শৈশব কৈশোর ও প্রথম যৌবন। এঙ্গেলস-এর মতোই মুজফ্ফর আহ্মদেরও।
কাকাবাবু জানিয়েছেনঃ ‘‘আমি বাল্যের সীমা ছাড়িয়ে কৈশোরে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছিলেম। এই সময়ে অন্যদের দেখাদেখি আমি একরকম নিজে হতেই মাদ্রাসায় পড়া শুরু করে দিলাম।’’ কিন্তু ‘নিজে হতেই’ যে ব্যবস্থায় তিনি নিজের বিদ্যারম্ভের আয়োজন নিজেই করলেন, সেখানে শিকড় চারিয়ে দেওয়ার স্বস্তি যে তাঁর স্বভাবে নেই। বিপ্লবী জীবন স্বস্তির সে বর্ণমালায় অভ্যস্ত হতে চায় না। তিনি গাঁ ছেড়ে পালিয়েছেন, পথে পথে ঘুরেছেন, পরগৃহে আশ্রয় নিয়েছেন বিদ্যাশ্রমদানের বিনিময়ে, শুধুমাত্র একটিই লক্ষ্য নিয়ে তুলনায় আধুনিক এবং উচ্চতর শিক্ষা পথের সংযোগ দিতে সক্ষম হাইস্কুলে পড়বেন বলে।
হাইস্কুলে পাঠের সুযোগ মেলার পর, সেই পাঠকাল ও পাঠান্তেও ধর্ম-আবেশ বা আচরণিক ধর্মের বাঁধন থেকে তিনি যে মুক্ত হতে পেরেছেন তাতো নয়। তাঁর স্মৃতিকথনের তেমনই স্বীকারবিবৃতিঃ তবে সাম্প্রদায়িক কোনো ব্যাপারে আমি একেবারেই থাকিনি একথা বললে অপলাপ করা হবে। মুসলমানের বিশেষ দাবি দাওয়ার সভা সমিতিতে আমি তখন যোগ দিয়েছি। আমি সেই সময় ধার্মিক মুসলমানও ছিলেম। দিনে পাঁচবার নামাজ না পড়লেও রমজানের পুরো মাসটি দিনের বেলা উপোস করে কাটাতাম।
এঙ্গেলস-এর বেলায় এমন স্বীকারকথন যা উন্মোচক, আরও মেদুর ও মর্মরিত হয়ে ওঠে যেন। কারণ এগুলি যখন তিনি উচ্চারণ করছেন, তিনি কবি ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। নাট্যকার ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। পাঠকের ভাবনা হঠাৎ চলকে উঠতে পারে, কার্ল মার্কস কিংবা ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর এদেশে তাঁদের একনিষ্ঠ অনুগামী মুজফ্ফর আহ্মদও শুরুতে সাহিত্য না রাজনীতি এই দোটানায় যৌবনের কিছুকাল যাপন করেছেন। কাকাবাবু জানিয়েছেনঃ ‘‘আমার জীবনের পেশা কি হবে - সাহিত্য, না, রাজনীতি এই নিয়ে আমি পুরো ১৯১৯ সাল ভেবেছি। সত্য কথা বলতে আমার মনের ভিতরে সাহিত্য ও রাজনীতির দ্বন্দ্ব চলছিল।’’
দুই দেশের দুই মহান বিপ্লবীর স্বীকারকথনের সামীপ্যরেখা ধরে চলতে আমরা যে এতক্ষণ মজেছি, সে বোধহয় এই কারণে, এই অন্বেষণে যে যথাযথ বস্তুবাদী বিপ্লবীর জীবন প্রতিবেশ থেকে শুধু গ্রহণ করে না, বরং গ্রহণ বর্জনের এক নিয়ত অস্থির সক্রিয়তায় বিরামহীন থাকে, যা আদতে প্রদত্ত প্রতিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে এক দ্বান্দ্বিক মোকাবিলা, এবং এই মোকাবিলাই দেয় ক্রমউত্তরণের মুক্তিপথ।
।। দুই ।।
ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস-এর ক্ষেত্রে এই মোকাবিলা ছিল কঠিনতর।
তার মূল কারণ নিশ্চয় এই, তিনি বণিকী ধনে বর্ধিষ্ণু এক পরিবারে জন্মেছেন এবং একইসঙ্গে উৎপাদক ও বণিক - দুই বৃত্তিতেই সফল এই পরিবারের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ও ধর্মতন্ত্রের সম্পর্ক ছিল নিবিড়।
এঙ্গেলস পরিবারে ধনের সমৃদ্ধি, সঞ্চয় ও সক্রিয়তা জৌলুস পেতে থাকে ফ্রেডরিখ-এর প্রপিতামহ যোহান কাসপার (১৭১৫-৮৭)-এর সময় থেকে। যোহান কাসপারের নজর পড়ে রাইনের দক্ষিণ তীরের উপনদী ভুপারের চুনমুক্ত জলপ্রবাহের দিকে। এঙ্গেলস-এর সাম্প্রতিক জীবনীকার ট্রিসট্রাম হান্ট (Marx’s general: The Revolutionary life of Friedrich Engels, 2009) নজর করিয়ে দিয়েছেন কিভাবে প্রথম যোহান এই চৌখস নির্ণয়ের ফলেই দ্রুত সরে যাচ্ছেন কৃষি থেকে শিল্পতে। চলে এলেন ভুপার পাড়ের গঞ্জ বারমেনে, গড়ে তুললেন ব্লিচ করার কারখানা সমেত সুতোর ব্যবসা, তারপরেই যন্ত্রচালিত লেস উৎপাদন, তাঁর হাত ধরেই জার্মানিতে সেই শুরুয়াত।
প্রথম যোহানের ছেলেরা ব্যবসা উৎপাদন, দুইই বাড়িয়ে নিয়ে গেছেন। ধনবৃদ্ধি তাঁদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা দিয়েছে যতটা ততটাই বেড়েছে তাঁদের ধর্মতান্ত্রিক কৌলীন্য। ফ্রেডরিখ-এর পিতামহ দ্বিতীয় যোহান ১৮০৮ সালে বারমেনের কাউন্সিলর বনেছেন এবং পত্তন করেছেন ইউনাইটেড প্রোটেস্টান্ট চার্চ। ফ্রেডরিখ-এর বাবাদের তিন ভাইদের মধ্যে ব্যবসাপত্তর কারখানা নিয়ে ঝুটঝামেলা হয়েছে বিস্তর, হটে যেতে হয়েছে ফ্রেডরিখ-এর বাবাকেই। তাতে অবশ্য প্রথম ফ্রেডরিখের ধনভাগ্য মোচড় খেয়ে আরও তেজী হয়েছে। তিনি পৈতৃক ব্যবসা থেকে হঠে গিয়ে শরিকানা বেঁধেছেন দুই ওলন্দাজ বণিকের সঙ্গে - গডফ্রে এবং পিটার এরমেন। সুতো ব্লিচ করা থেকে সরে সুতো উৎপাদন, কারখানা বাড়ছে ক্রমশ। বারমেনে তো বটেই, কাছেপিঠে এঙ্গেলকিরচেনে এবং বস্ত্রবয়নের মক্কা ম্যাঞ্চেস্টারেও।
ততদিনে ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠেছে বারমেন। কারখানার ঘাড়ের উপর কারখানা, সরু রাস্তার হিজিবিজির দু-ধারে শ্রমিকবস্তি, কংক্রিটে বাঁধা পড়ছে ভুপার নদীর দুপাড়। নদী? কোথায় নদী, কারখানার বর্জ্য, ব্লিচিং আর রঙে সে তখন খোলামেলা নর্দমা মাত্র।
যত বেড়েছে শিল্পবর্জ্য, কারখানার বহর, শ্রমিকের দুর্দশা আর মালিকের প্রতাপ, তত বেড়েছে চার্চের দাপট আর চার্চ চত্বরে অন্দরে থিকথিকে ভিড়। বারমেন আর পাশের শিল্পশহর এলবারফিল্ড - এঙ্গেলস বলতেন গোঁড়া ‘ধর্মাচ্ছন্নতাবাদীদের একেবারে স্বর্গরাজ্য’। এরইমধ্যে ক্রমশ প্রভাব বাড়িয়ে নিয়েছে প্রোটেস্টান্ট খ্রিস্টধর্মের একটি নয়া সংস্করণ পায়েটিজম (Pietism)। লুথেরান প্রোটেস্টান্ট চার্চের অন্তর্গত এ ধর্মসংস্করণের জন্ম সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে হলেও উনিশ শতকের সেই শুরুর দিকে তার দাপট বাড়ছে ক্রমশ। এঙ্গেলস জীবনীকাররা সকলেই পায়েটিজম-এর চরিত্রকে বুঝতে চেয়েছেন, বিশ্লেষণ করতে চেয়েছেন মূলত এই কারণে, এঙ্গেলস পরিবারের নিপাট আনুগত্য ছিল খ্রিস্টধর্মের এই সংস্করণটির প্রতি। টেরেল কারভার তাঁর লেখা দুটি জীবনী (Friedrich Engels: this life and thought, 1990 এবং Engels: A very short Introduction, 1981)তেই পায়েটিজম-এর গণতান্ত্রিক চরিত্রের কথা বলেছেন যেহেতু এ ধর্ম পাদরি পুরোহিতের মধ্যস্থায় এবং ধাপে কোনো বিশ্বাস করে না। আবার তারাই মনে করে, শিক্ষাব্যবস্থা সামাজিক কাজকর্ম, নৈতিকতা এবং যাবতীয় মতামত চার্চের নজরদারির অধীনে থাকা উচিত। এরা ঈশ্বরের সর্বময় কর্তৃত্বে বিশ্বাস করে এবং খানিকটা বিষণ্ণতাবাদীও বটে, কারণ শাস্তিদানের বিষয়ে ঈশ্বর নাকি ভয়ানক কঠোর।
কিন্তু অষ্টাদশ শতকের অন্তিম আর উনিশ শতকের শুরুতে এদের এমন তৎপরতা ও প্রভাববৃদ্ধি কেন? এর একটা উত্তর অথবা উত্তরাভাস পাওয়া যায় ফ্রেডরিখ-এর অন্যতম জীবনীকার ডেভিড ম্যাকলেলান (Friedrich Engels, 1977)-র নির্ণয়ে। তিনি লিখছেন, উনিশ শতকের সূচনায় পায়েটিজম-এর বর্ধিষ্ণুতা যুক্তিবাদ ও ফরাসি বিপ্লবের প্রতিক্রিয়ায়। এবং অষ্টাদশ উনিশ শতকের শিল্প উদ্যোগপতিদের কাছে পায়েটিজম-এর ধরনধারণ-নীতিতত্ত্বাবলি বেশ উপযোগী হয়ে উঠেছিল, কারণ এই ধর্মসংস্করণ আলস্যের নিন্দায় বেজায় মুখর।
কিন্তু এঙ্গেলস-এর বেলায় মুশকিল হয়েছিল এই, তাঁদের পারিবারিক ধর্ম কোনোরকম বৌদ্ধিক ও সাংস্কৃতিক অন্বেষণ ও চর্চায় একেবারেই বিশ্বাস করে না। এঙ্গেলস-এর প্রথম জীবনীকার গুস্তাভ মায়ার (Friedrich Engels, 1936) খবর দিয়েছেন, উনিশ শতকের শুরুর দিকে নাকি এলবারফিল্ড বারমেনের ধর্মযাজকরা শহরে থিয়েটার চালু করার বিরুদ্ধে পিটিশন দাখিল করেছিল কারণ বিনোদন, তাদের মতে অধার্মিক কদাচার। আর ট্রিসট্রাম হান্ট যা খবর দিচ্ছেন সে একেবারে কিশোর ফ্রেডরিখ-এর ঘাড়ের উপর নিশ্বাস ফেলছে। একদিন, ১৮৩৫ সালের আগস্ট মাসে ফ্রেডরিখ-এর তখন তাহলে পনেরোও পার হয়নি, পিতা ফ্রেডরিখ তাঁর ছেলের টেবিলে দেখেন জার্মানির বীরযোদ্ধাদের নিয়ে একটি বই, তাতেই একেবারে হৃৎকম্প শুরু হয়ে যায় তাঁর। বাবার বাড়িতে যাওয়া স্ত্রীকে, ফ্রেডরিখ-এর মা এলিসে-কে তিনি লিখছেনঃ আজ ওর টেবিলে একখানা নোংরা বই দেখে আমি আবার বিপন্ন বোধ করি, বইটা ও লাইব্রেরি থেকে তুলে এনেছে, ত্রয়োদশ শতকের নাইটদের নিয়ে একটা গল্পের বই। যেরকম আলগা আর খোলামেলাভাবে বইটা ও পড়ার টেবিলে রেখে দিয়েছে, হতবাক করে দেয়। ঈশ্বর ওর চরিত্রের উপর নজর রাখুন, এমনিতে সুন্দর এই ছেলেটি নিয়ে আমার মাঝে মাঝে খুব ভয় করে।
পিতা ফ্রেডরিখের ভয় পাওয়ার তখনও অনেক বাকি আছে।
আমরা শুধু এইটুকু মনে নেব, ১৮৩৯ সালে ফ্রেডরিখ লিখতে বসবেন একটি মহাকাব্যনাট্য, যার নায়ক লোককথার বীর সিগফ্রিড। এবং এই নাট্যকাব্যে পুত্র সিগফ্রিড এবং বাবা সিগহার্ড-এর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইটা জমে উঠেছিল বেশ। মনে করে নেব, আরও এগারো বছর পর, ১৮৫০ সালে এঙ্গেলস যখন লিখবেন ‘জার্মানিতে কৃষক যুদ্ধ’, তখনও তার নায়ক হয়ে উঠবেন এক বীর ধর্মনেতা টমাস মুনৎসার।
বীরত্ব, বীরের মতো লড়াই চিরকালই বড়ো বেশি টানে ফ্রেডরিখকে।
।। তিন ।।
সতেরো-আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত ধর্মে দিব্যি মতিগতি ছিল ফ্রেডরিখ-এর। ১৮৩৭ সালে ঈশ্বরপুত্র যিশুকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন। স্থানীয় যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন তিনি, সেখানে জ্ঞানবিকাশের আবহাওয়া ছিল না তেমন, ধর্মভাবনায় বাঁধা ছিল পরিবেশ। ১৪ বছর বয়সে তাঁকে বদলি করে ভর্তি করে দেওয়া হলো এলবারফিল্ডের এক জিমনাসিয়মে। সে পঠনপাঠন ব্যবস্থার মধ্যে আসা এবং মাস্টারমশাই ডঃ ক্লসেন-এর কাছে আসতে পারা একটা বাঁকবদল বটে।
কিন্তু ঘোরতর বাঁকবদলটা ঘটল তিনি যখন শিল্পশহর ব্রেমেনে এলেন। দারুণ কৃতি হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বাবা তাঁকে ঘাড় ধরে ছাড়িয়ে নিয়েছেন বিদ্যায়তনিক পড়াশুনা থেকে। বন্ধ করে দিয়েছেন উচ্চশিক্ষার পথ। বদলে চিনিয়ে দিয়েছেন শিল্পবিপ্লবের দুনিয়া, ছেলেকে নিয়ে পৌঁছে গেছেন ম্যাঞ্চেস্টার অবধি। তারপর জুড়ে দিয়েছেন বাণিজ্যিক শিক্ষানবিশির কাজে, ব্রেমেন শহরে। পড়াশুনার বদলে ফ্রেডরিখ তখন সুতো, কাপড় ব্লিচিং কিংবা রঙ করার ঘোর দুনিয়ায়। সেইসঙ্গে বণিকী চিঠির মুসাবিদা করছেন যা পাঠানো হবে হাভানা, বাল্টিমোর, ওয়েস্ট ইন্ডিজ সহ দুনিয়ার দেশে দেশে, যেখানে যেখানে এগিয়ে চলেছে শিল্পদুনিয়ার দখলদারি। এককথায়, আন্তর্জাতিক ধনবাদের সেবা করার পাঠ নিচ্ছেন ফ্রেডরিখ যিনি ধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে শ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুলি দিয়ে যাবেন মানবসভ্যতার হাতে।
এবং এই শহরই তাঁকে দিচ্ছে মুক্তির নানাবিধ পথ। ঘুরে বেড়াতে পারছেন শহরের বইয়ের দোকানগুলোতে, ঘোড়ায় চড়ছেন দুরন্ত গতিতে, তলোয়ার খেলছেন দুঃসাহসে, ভর্তি হচ্ছেন নাচের ক্লাসে। যেন নবজাগরণের এক আদর্শ চরিত্র যাঁর দিকে বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয়।
সেইসঙ্গে খুব কাছ থেকে দেখে নিতে পারছেন, বস্ত্রবণিক আর উৎপাদকের জার্মান ভাষায় যাদের বলা যাবে ফ্যাব্রিকান্তেন, ধর্মীয় আনুগত্যের সহযোগে শোষণকর্মের তীব্রতা। কার্ল গুৎসকাও-এর কাগজ টেলিগ্রাফ-এ এঙ্গেলস যে কলম লিখছেন, সেখানে স্পষ্ট করে লিখে দিচ্ছেন, যে কারখানা মালিকরা যত বেশি তাদের ঈশ্বরপ্রীতি বিজ্ঞাপিত করে তারা তত বেশি তাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের শোষণ করে।
এই সময়েই এঙ্গেলস-এর হাতে আসে একটি বই, ডেভিড ফ্রিডরিখ স্ট্রাউস-এর যিশুর জীবন পর্যালোচনা (Das Leben Jesu, 1835)। স্ট্রাউস বাইবেল-এর উপদেশাবলিকে অবশ্য অনুসরণীয় নৈতিকতা হিসাবে না দেখতে বলার যুক্তি সাজালেন, বরং তাদের পর্যালোচনা করতে বললেন, নানাবিধ প্রবাদ প্রবচনের পরিপ্রেক্ষিতে সাংস্কৃতিক উপাদান হিসাবে। সেগুলি সমকালে আর প্রযোজ্য নয়, বরং মানবপ্রগতির একটি ধাপ হিসাবে তাদের বিবেচনা করতে হবে, এবং যিশুজীবনকে সব থেকে ভালো বোঝা যাবে ধর্মপ্রবক্তা হিসাবে নয়, মানবতার একটি ধারণা হিসাবে।
মোহিত হলেন ফ্রেডরিখ। হ্যাঁ মোহিত। এতটাই মোহিত, তিনি জানিয়েদিলেন, তখন তিনি স্ট্রাউসবাদী। স্ট্রাউস তাঁকে শেখালেন প্রচলিত ধর্মভাবনাকে সন্দেহ করতে, সমস্ত মূল্য চুকিয়ে দিয়ে তাকে ঝেড়ে ফেলতে। বন্ধু ফ্রেডরিখ গ্রেবারকে তিনি লিখলেনঃ ...তুমি স্বস্তিতে তোমার বিশ্বাস নিয়ে আছ যেন উষ্ণ বিছানায়, এবং তখন তুমি জানো না আমাদের মতো মানুষকে কী লড়াই করতে হয় যখন আমাদের স্থির করে নিতে হয় ঈশ্বর আছে কি নেই। তুমি জানো না প্রথম অবিশ্বাসের সময় একজনকে কী দুর্বহ ভার বহন করতে হয়, যখন তাকে স্থির করে নিতে হয় এই বিশ্বাস নিয়েই তুমি হাঁটবে নাকি তাকে ঝেড়ে ফেলে দেবে।
এই চিঠির একটি বাক্য এখনও উদ্ধৃত করিনি আমরা। ‘‘আমার চোখ জলে ভরে উঠছে যখন আমি এই কথাগুলো লিখছি।’’
ডেভিড ম্যাকলেলান অবশ্য তাঁর এঙ্গেলস-জীবনীতে শুধু ডেভিড স্ট্রাউস নন, আরেকজন জার্মান দার্শনিককে রাখছেন, ফ্রেডরিখ শ্লেইমাখার। আপাতত আমাদের শুধু এইটুকু বলা, যথার্থ বিপ্লবীর মতোই ফ্রেডরিখ তাঁর বিশ্বাসী অতীত নিয়ে স্বীকার-উচ্চারণ করছেন, চোখের জলে লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই বর্জন করছেন সে অতীতকে।
এঙ্গেলস লিখছেনঃ ‘‘স্ট্রাউসের মধ্য দিয়েই আমি হেগেলপন্থার দিকে সোজা পথ ধরলাম।’’
ক্রমশ কাছাকাছি আসছে ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস আর কার্ল মার্কস-এর জীবনপথ। যে যৌথপথ ক্রমশ গড়ে দেবে মানবমুক্তি পথের ঠিকানা।