৫৯ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৭ জানুয়ারি, ২০২২ / ২২ পৌষ, ১৪২৮
দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা লাগামছাড়া
কোভিড নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ কেন্দ্র, দিশাহারা রাজ্য সরকার
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের দাপটে নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে গোটা দেশ। করোনার এই নতুন পর্বে সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রধান কারণ, ভাইরাসের প্রকরণ হচ্ছে ওমিক্রন। দিল্লির বিভিন্ন পরীক্ষাগারে করোনায় আক্রান্তদের নমুনার জিন পরীক্ষায় দেখা গেছে ওমিক্রনের হার ৮১ শতাংশ। বাকিরা আক্রান্ত ডেলটায়। ৪ জানুয়ারির তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে, ২৪ ঘণ্টায় মহারাষ্ট্রে ওমিক্রনে আক্রান্তের সংখ্যা ৬শত পেরিয়েছে। দিল্লিতে ৪৬৪, কেরালায় ১৮৫, রাজস্থানে ১৭৪, গুজরাটে ১৫৪ এবং তামিলনাডুতে ১২১। এদিকে ৫ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে একদিনে ২৩ রাজ্যে চিকিৎসাধীন রোগী বৃদ্ধির সংখ্যা ২৬ হাজার ২৪৮। তারমধ্যে ওমিক্রনে আক্রান্তের সংখ্যা ১,৮৯২। করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৩৭ হাজার ৩৭৯। করোনায় একদিনে মৃত্যু হয়েছে ১২৪ জনের।
এদিকে কেন্দ্রের তথ্যে জানা যাচ্ছে, দেশে মোট ১৪৬.৭০ কোটি ডোজ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দেশে পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে দুই ডোজ প্রাপ্য বয়স্কদের ৬৪ শতাংশ। দেশে তৃতীয় তরঙ্গের মুখে এই ঘাটতি নিয়ে সমালোচনা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ২০২০’র জানুয়ারিতে দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস আক্রান্ত চিহ্নিত হয়। সেই বছরের ১৯ ডিসেম্বর মোট আক্রান্ত ১ কোটিতে পৌঁছায়। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের জেরে ২০২১’র ৪ মে আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি পেরিয়ে যায়। মাত্র ১ মাস পর ২৩ জুন সংক্রমণ পৌঁছে যায় ৩ কোটিতে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় দেশে দৈনিক সংক্রমণ ছিল ৪ লক্ষের কাছাকাছি। সেই পর্বে সংক্রমণের প্রধান কারণ ছিল ভাইরাসের ডেলটা প্রকরণ।
বর্তমানে গোটা দেশে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৯০,৯২৮ এবং মৃত্যু হয়েছে ৩২৫ জনের।
দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনা ভাইরাসের নতুন প্রকরণ প্রথম চিহ্নিত হয়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ওমিক্রনকে ‘উদ্বেগজনক প্রকরণ’ বলে উল্লেখ করেছে। ডেল্টার জেরে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে মারাত্মক শোচনীয় পরিস্থিতি তৈরি হয় দেশে। তৃতীয় তরঙ্গও সে দিকেই যাচ্ছে বলে বিশেষজ্ঞ অনেকেরই ধারণা। অথচ দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো এখনো সেই তিমিরেই রয়েছে। নমুনা পরীক্ষাও পর্যাপ্ত পরিমাণে হচ্ছে না। রাজধানী দিল্লিতে সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে। গত ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত এইমসে ৫০ জন এবং সফদরজং হাসপাতালে ২৬ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাভাবিক কারণেই এজন্য হাসপাতালের কাজে বিঘ্ন ঘটছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিয়ালও সংক্রমিত হয়েছেন বলে জানা গেছে।
প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতো মুম্বাইয়ে এবারে সংক্রমণের তীব্রতা আরও বেশি। ৪ জানুয়ারির পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমিত হয়েছেন ১০ হাজার ৮৬০ জন। এরমধ্যে ৮৯ শতাংশই উপসর্গহীন। ২৪ ঘণ্টায় মহারাষ্ট্রজুড়ে ২০ জন আক্রান্তের মৃত্যু হয়েছে। পাঞ্জাব, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক প্রভৃতি রাজ্যে কোভিড সংক্রমণ রুখতে নানা বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে।
বর্তমানে তৃতীয় তরঙ্গের মারাত্মক সংক্রমণ সম্পর্কে বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাক্তার দীপ্তেন্দ্র সরকার জানিয়েছেন, কোনো দ্বিধা নেই যে আমরা মারাত্মক তৃতীয় তরঙ্গের মধ্যে রয়েছি। এ প্রসঙ্গে সংক্রমণের হার সম্পর্কে উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেছেন, আগেরবারের সংক্রমণের তুলনায় এবারে দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩৫০ থেকে ৩৫ হাজার মানুষের মধ্যে সংক্রমণ হয়েছে মাত্র দশ দিনে। শতাংশের বিচারে তা প্রায় এক হাজার শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। ইংল্যান্ডের ক্ষেত্রে ২ লক্ষ থেকে সোয়া দু’লক্ষ মানুষের সংক্রমণ হয়েছে ১০ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে। ভারতে এবং পশ্চিমবঙ্গে এই সংক্রমণ যা গত ২৭-২৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়েছিল তা আগামী ১০-১২ দিনের মধ্যে দৈনিক প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। এই তরঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে ডাক্তাররা মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হচ্ছেন। যাঁরা প্রথমবার সংক্রমিত হয়েছেন তাঁরা আবারও আক্রান্ত হচ্ছেন। এক একটি হাসপাতালে এই সংক্রমণের সংখ্যা ৫০ থেকে ৬০-৭০ পর্যন্ত হচ্ছে। গোটা বিশ্বের সংক্রমণের নিরিখে দেখা যাচ্ছে, স্বাভাবিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা (ন্যাচারাল ইমিউনিটি) গত ১২ থেকে ১৫ মাসের মধ্যে হ্রাস পেয়েছে। তিনি জোরের সাথে বলেছেন, এই মুহূর্তে সুরক্ষার প্রধান উপকরণ হচ্ছে মাস্ক।
পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা
করোনার নতুন প্রকরণ ওমিক্রনের হানায় দেশের অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে এরাজ্যেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে মারাত্মকভাবে। সাধারণ মানুষ থেকে চিকিৎসক, পুলিশ কর্মী, পড়ুয়া সবাই আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে নতুন কোভিড প্রকরণ ওমিক্রনের মারণ ক্ষমতা কিছুটা কম থাকায় দুশ্চিন্তা কম থাকলেও এর সংক্রমণ ক্ষমতা এবারে মারাত্মক জায়গায় পৌঁছাতে পারে। স্বাস্থ্য দপ্তরের অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে, অনতিবিলম্বে রাজ্যের দৈনিক সংক্রমণ ৩০ হাজার পেরিয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে রাজ্যের প্রায় দুই শতাধিক ডাক্তার ও চিকিৎসাকর্মী এবং ৮ জন আইপিএস সহ প্রায় শ’খানেক পুলিশ আধিকারিক সংক্রমিত হয়েছেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে তৃতীয় তরঙ্গের শুরুতেই কলকাতায় শুরু হয়েছে গোষ্ঠী সংক্রমণ। গত ৪ জানুয়ারির তথ্য অনুযায়ী কলকাতায় পজিটিভিটি রেট ৩৩.৯ শতাংশ।
সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী রাজ্যে গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি আক্রান্তের সংখ্যা ৪৫,৪১৭ আর মৃত্যু হয়েছে ১৭ জনের।
প্রসঙ্গত, রাজ্যে প্রথম সংক্রমণের ঢেউ এসেছিল ২০২০ সালের মার্চ মাসে। এরপর দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ দেখা যায় ২০২১ সালের মে-জুন মাসে। এরপর ছয় মাস কাটতে না কাটতেই তৃতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ দেখা দিয়েছে। বর্ষশেষ এবং বর্ষবরণের উৎসবে মাতোয়ারা কলকাতায় বছরের শেষ থেকেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সংক্রমণের সংখ্যা।
বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যে কনটেইনমেন্ট জোনের মোট সংখ্যা এ পর্যন্ত হয়েছে ৪০৩। কলকাতার সাথে পাল্লা দিয়ে হাওড়া ও উত্তর ২৪ পরগনায় প্রতিদিন লাফিয়ে বাড়ছে সংক্রমণ। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতি তিন জনের মধ্যে এক জনের কোভিড পজিটিভ হচ্ছে। কিন্তু দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাওয়া এই সংক্রমণকে রাজ্য সরকার তৃতীয় ঢেউ বলতে রাজি না হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন দিল্লি- মুম্বাইয়ের সাথে কলকাতা সহ রাজ্যে তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে। বড়োদিন আর নববর্ষ উদযাপনে প্রশাসনের শিথিলতা, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর বড়োদিনের উৎসবে যোগদান এবং সেপাইসান্ত্রী ও অনুচরদের নিয়ে গঙ্গাসাগরে গিয়েছেন, কপিলমুনির আশ্রমে পুজো দিয়ে গঙ্গাসাগরকে জাতীয় মেলার দাবি তুলে ধরেছেন। এসবের সঙ্গে উৎসবের দিনগুলিতে মানুষের লাগামছাড়া মেলামেশা এই সংক্রমণকে দ্রুত ছড়াতে সাহায্য করেছে।
এদিকে সরকার ও প্রশাসন এবারের সংক্রমণকে তৃতীয় ঢেউ বলে প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও অবস্থা বেগতিক বুঝে সংক্রমণ প্রতিরোধে কিছু বিধিনিষেধ জারি করেছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, কোনোরকম যুক্তি বুদ্ধি ও বাস্তবতা বিচার না করে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ন্যূনতম জ্ঞান, এমনকী সাধারণ জ্ঞানকেও বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। যেমন সারা দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের উপস্থিতিতে গঙ্গাসাগর মেলার আয়োজনে ছাড় দেওয়া হয়। সরকার ও প্রশাসনের মতে গঙ্গাসাগর মেলায় সংক্রমণের ভয় থাকবে না। কেবল বন্ধ রাখা হচ্ছে স্কুল, কলেজ সহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু হোটেল, রেস্টুরেন্ট, পানশালা, শপিংমল ইত্যাদি রাত দশটা পর্যন্ত খোলা রাখার ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক বিজ্ঞপ্তিতে লোকাল ট্রেন সাতটায় বন্ধ হবার নির্দেশ জারি ছিল। এর ফলে বিধিনিষেধ জারির পরদিন ৩ জানুয়ারি হাওড়া, শিয়ালদহ স্টেশনে তাড়াহুড়ো করে যাত্রীদের বাড়ি ফেরার তাড়নায় পদপিষ্ট হয়ে মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। পরে নবান্ন থেকে সন্ধ্যা সাতটায় লোকাল ট্রেন বন্ধের নিষেধাজ্ঞা রাত ১০টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়। লন্ডন থেকে আসা ফ্লাইট বন্ধের নির্দেশ জারি হয়েছে। কিন্তু দেশের অন্যান্য জায়গা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্লেন অবতরণে কোনো বিধিনিষেধ জারি হয়নি। ৩ জানুয়ারি থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধের ফলে মারাত্মক সমসার মুখে পড়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা। এসব নিয়ে সরকারের কোনো উচ্চবাচ্য নেই। আসলে তৃতীয় তরঙ্গ নিয়ে সরকারের যে উদ্দেশ্যহীন মনোভাব এবং অজ্ঞতা প্রবল তা প্রকট হয়ে উঠেছে।
এবারের সংক্রমণের তরঙ্গ নিয়েও সরকার ও প্রশাসনের রাখঢাকের অন্ত নেই। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি নিভৃতাবাসে রয়েছেন গত কয়েকদিন ধরে। কিন্তু কী জন্য তা প্রকাশ্যে আনা হয়নি। অথচ দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর সংক্রমণের খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদিরও নবান্নে না আসার খবর মিলেছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, মুখ্যসচিবের যখন এই অবস্থা, তখন রাজ্যের হালটাও সহজেই বোঝা যাচ্ছে। এদিকে রাজ্যে যখন সংক্রমণ দ্রুত ছড়াচ্ছে, তখন শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস সমস্ত কাণ্ডজ্ঞান বিসর্জন দিয়ে পৌর নির্বাচনে সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকে অমান্য করেই মিছিল, জমায়েত ও উৎসবে মেতেছে। এই দল যে কতটা রাজ্যের প্রতি, মানুষের প্রতি দায়িত্বশীল তা এইসব ঘটনায় প্রকট হয়ে উঠছে।
এদিকে কোভিড পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করে সিপিআই(এম)’র কয়েকটি জেলা সম্মেলন আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পার্টির উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পার্টির সম্মেলন স্থগিত রাখার কথা উল্লেখ করে পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের অবিবেচনাপ্রসূত কাজকর্মের ফলে করোনা সংক্রমণের বিপদ বাড়ছে। কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুসারে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মহামারী মোকাবিলার পথে চলছে না। ফলে শুধু সংক্রমণের বিপদই বাড়ছে না, মানুষের জীবন-জীবিকার সংকটও বাড়ছে। তিনি বলেছেন, সঠিকভাবে মহামারী মোকাবিলার সঙ্গে অর্থনীতি ও মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্নও জড়িত। সরকারের এবিষয়ে কোনো ভাবান্তর নেই।
রাজ্য সরকার ও শাসকদল যখন এই ভয়াবহ সংক্রমণ নিয়ে চূড়ান্ত অবিবেচকের মতো কাজ করছে, তখন দায়িত্ব- সচেতন এবং মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ দল হিসাবে সিপিআই(এম)’র এই সিদ্ধান্ত।