৫৯ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৭ জানুয়ারি, ২০২২ / ২২ পৌষ, ১৪২৮
গ্রামের মানুষের সোৎসাহ অংশগ্রহণের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হলো সিপিআই(এম) বাঁকুড়া জেলা সম্মেলন
মধুসূদন চ্যাটার্জি
পার্টির বাঁকুড়া জেলা সম্মেলনের উদ্বোধন পর্বে জনসমাবেশ।
লালঝান্ডা হাতে নিয়ে গরিব মানুষের লড়াই করতে গিয়ে তৃণমূলের ঘাতকবাহিনীর হাতে যাঁরা শহিদের মৃত্যু করেছেন সেই শহিদ পরিবারের মানুষজনকে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিনগুলিতে লালঝান্ডার সমস্ত স্তরের কর্মীরা গরিব মানুষের অর্জিত অধিকার রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার বিরামহীন লড়াই চালিয়ে যাবে - এই অঙ্গীকার নিয়েই ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বর সিপিআই(এম) বাঁকুড়া জেলা ২৩তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে বিষ্ণুপুরের রাধানগর গ্রামে। এই সম্মেলনকে সামনে রেখে এলাকার নামকরণ করা হয়েছিল জেলার প্রবাদপ্রতিম কৃষক আন্দোলনের নেতা কমরেড নকুল মাহাতো নগর। মঞ্চের নামকরণ করা হয় কৃষক নেতা সত্য ব্যানার্জি ও শিক্ষক আন্দোলনের নেতা কমরেড হিরালাল পালের নামে।
৩০ ডিসেম্বর এক বর্ণাঢ্য মিছিলের ভেতর দিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। মিছিল রাধানগর গ্রামের একটা বড়ো অংশ পরিক্রমা করে। এই সম্মেলনকে ঘিরে মিছিলের সূচনায় রাধানগর গ্রামের মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল দেখার মতো। মানুষজন জানান, বিষ্ণুপুর থানা বহু ঐতিহাসিক আন্দোলনের পীঠস্থান। এখানকার গৌরবময় শিল্প, সংস্কৃতির পাশাপাশি খেটে খাওয়া মানুষের ধারাবাহিক আন্দোলনের ইতিহাস আছে। এই বিষ্ণুপুরের বাঁধগাবাতে কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। সেই আন্দোলনে সদ্য স্বাধীন সরকারের পুলিশ গুলি চালিয়ে ৭ জন কৃষককে খুন করে। তার পরও এখানে আন্দোলন থেমে থাকেনি। রক্তাক্ত হয়েও মানুষ লালঝান্ডা সামনে রেখে আন্দোলন চালিয়ে গেছেন। ছিনিয়ে এনেছেন জয়ও। আবার এই রাধানগর গ্রামেরই মানুষ ছিলেন অগ্নিযুগের বিপ্লবী এবং সিপিআই(এম) বাঁকুড়া জেলার প্রাক্তন সম্পাদক কমরেড মৃত্যুঞ্জয় ব্যানার্জি। আন্দামান থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনিও হাতে লালঝান্ডা তুলে নেন, নেতৃত্ব দেন সারা জেলাজুড়ে। তাঁর জন্য গর্বিত রাধানগর। তাই যে মুহূর্তে পার্টি রাধানগরে জেলা সম্মেলনের কথা জানায় মানুষজন তা সাদরে গ্রহণ করেন। এই সম্মেলনকে ঘিরে শুরু হয় ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা। পার্টি কর্মীরা বিষ্ণুপুর থানার সমস্ত গ্রামে যান সম্মেলনের বার্তা নিয়ে। প্রায় ১০ হাজার পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। সেই মানুষগুলো জানান, পার্টিকে আমরা এভাবেই রাস্তায় দেখতে চাই। গরিব মানুষ এখনও লালঝান্ডা ছাড়েনি। লালঝান্ডার জন্য আমরা মরতে পারি। খালি রাস্তা দেখাতে হবে কোন পথে আমরা এগোব। লায়েকবাঁধ, যন্তা, অবন্তিকা, দ্বারিকা, বাকাদই, বেলশুলিয়া, অযোধ্যা, জয়কৃষ্ণপুর সহ একাধিক গ্রামের মানুষ সম্মেলনকে সফল করতে এগিয়ে আসেন। তাঁরা অর্থ সাহায্য করেন। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সময়ই পার্টি কর্মীরা জানতে পারেন সংশ্লিষ্ট এলাকার আশু সমস্যা কী। কীভাবে তার সমাধান করা যায়। মানুষের উঠানেই তৈরি হয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আগামীদিনে লড়ায়ের কর্মসূচি। জেলা সম্মেলনের প্রচারে এটা ছিল একটা বাড়তি অভিজ্ঞতা। মানুষের বক্তব্য রাধানগরকে লালে লাল করে তুলতে হবে। এখানকার লড়াইয়ের গৌরবগাথাই যেন সম্মেলনস্থলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। তাই কৃষক, শ্রমিক, মহিলা, সাক্ষরতা, জনস্বাস্থ্য, সমবায় আন্দোলনের ছবি মাটির মূর্তির ভেতর দিয়ে সম্মেলন স্থলে রাখা হয়। সবটাই করেছেন রাধানগর গ্রামের মানুষজন। এই সম্মেলন কেবল সিপিআই(এম)-র কর্মসূচি ছিলনা,যেন হয়ে উঠেছিল গ্রামের মানুষের উৎসব। এই সম্মেলন সফল করাটা পুরো রাধানগর গ্রামের মানুষের কাছে ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। সেখানে সার্থক হয়েছেন তাঁরা। জেলার নানা প্রান্ত থেকে আসা মানুষজন মুগ্ধ হয়ে গেছেন রাধানগরকে সাজানো দেখে।
মিছিল শেষে সম্মেলনের পতাকা উত্তোলন করেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য বিমান বসু। শহিদ বেদিতে মাল্যদান করেন বিমান বসু, পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী, অমিয় পাত্র, জেলা সম্পাদক অজিত পতি, পুরুলিয়ার জেলা সম্পাদক প্রদীপ রায় সহ নেতৃবৃন্দ, কর্মী ও রাধানগর গ্রামের অসংখ্য মানুষ। এই স্থানেই ২০১১-র পর তৃণমূলবাহিনীর হাতে খুন হওয়া ৮ জন শহিদের পরিবারকে সংবর্ধনা জানানো হয়। কমরেড অজিত লোহার, কমরেড অলোক বেওড়া, কমরেড বলরাম সিং, কমরেড লিয়াকত আলি মিদ্যা, কমরেড সীতারাম কুণ্ডু, কমরেড অরুণ সর্দার, কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যা ও কমরেড কাজল চন্দ-র পরিবারের মানুষজন হাজির হয়েছিলেন। তাঁদের হাতে শীতবস্ত্র তুলে দিয়ে সম্মান জানান নেতৃবৃন্দ। সমস্বরে স্লোগান ওঠে ‘শহিদের রক্ত হবে নাকো ব্যর্থ’। জনগণের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘শহিদ রে তোর অমর স্মৃতিতে রাখি রক্তিম হাজার সেলাম, লাল সেলাম’। এই অনুষ্ঠানে শোক, যন্ত্রণার দৃশ্যের পাশাপাশি ছিল আগামী লড়ায়ের অঙ্গীকারও। শহিদ পরিবারের মানুষজন জানান, এই সময়ের মধ্যে তাঁদের উপর নানা ধরনের প্রলোভন, হুমকি এসেছে। কিন্তু তাঁরা আত্মসমর্পণ করেননি। লালঝান্ডাই হাতে ধরে রেখেছেন এখনও, আগামী দিনেও থাকবে। রাধানগরের মানুষ জানিয়েছিলেন বিমান বসু, সুজন চক্রবর্তীরা আমাদের গ্রামে আসছেন, রাজ্যের গণআন্দোলনের শীর্ষ নেতৃত্ব তাঁরা। তাঁরা পার্টি সম্মেলনের ভেতরে থাকবেন। সেখানে বলবেন। আমরা সেখানে যাবনা। কিন্তু তাঁদের মুখে আমরা কিছু কথা শুনতে চাই। মানুষের এই বক্তব্যকে মর্যাদা দিয়েই শহিদ মঞ্চের সামনে বিমান বসু, সুজন চক্রবর্তীরা কিছুক্ষণ বক্তব্য রাখলেন। বিমান বসু জানান, ১৯৩৫ সালে এই জেলার পাত্রসায়রে হয় কৃষকসভার রাজ্য সম্মেলন। সেই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন প্রখ্যাত মডার্ন রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক এই জেলারই মানুষ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। সেই সম্মেলনের পরই বাংলা জুড়ে কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। সুজন চক্রবর্তী জানান, শহিদের এই লড়াই ব্যর্থ হবেনা।
প্রতিনিধি অধিবেশন পর্বের উদ্বোধন করছেন সুজন চক্রবর্তী। মঞ্চে বিমান বসু সহ নেতৃবৃন্দ।
বাঁকুড়া জেলা সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, মানুষ গত লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসকে চায়নি। বিজেপি’কে এ রাজ্যে একটা সমর্থন দেন। আবার সেই মানুষই ২০২১সালে বিজেপি’র বিরুদ্ধে রায় দেন। তৃণমূলকে নিয়ে আসেন। মানুষ এখন বিকল্প খুঁজছেন। মানুষের বক্তব্য লালঝান্ডাকে শক্ত হতে হবে। লালঝান্ডাকে এধার ওধার করা চলবেনা। মানুষের মনোভাবকে মর্যাদা দিয়েই আগামী দিনে আমাদের আন্দোলনের ময়দানে থাকতেই হবে।
সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন পার্টির বাঁকুড়া জেলার বিদায়ী সম্পাদক অজিত পতি। সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের উপর আলোচনা করতে গিয়ে বিভিন্ন এরিয়া কমিটি ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিরা জানান, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েই আন্দোলনে নামতে হবে। মানুষের কাছে তার যেন আক্ষরিক অর্থেই প্রভাব পড়ে সেটা দেখতে হবে। প্রতিনিধিরা জানান, কংসাবতী জলাধার থেকে তৃণমূলের রাজত্বে বোরো, রবি চাষে কৃষকরা জল পাননা। জলাধারের জল অপরিকল্পিতভাবে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। জল নদীতে বয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনের সময় কৃষক জল পাচ্ছেননা। বালি মাফিয়া আর কংসাবতীর ঠিকাদারদের স্বার্থেই এই কাজ হচ্ছে। কেন এই নিয়ে আন্দোলন করা যাবেনা। এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামতেই হবে। প্রতিনিধিরা জানান, জঙ্গলমহল এলাকায় কেন্দুপাতা, জঙ্গলের সম্পদ সংগ্রহ করা সরকারি ল্যামপসগুলিতে আজ তালা ঝুলছে। বেশ কয়েকবছর আগে সংগ্রহ করা কেন্দুপাতা ল্যামপসের গোডাউনে থেকে পচে যাচ্ছে। অন্যদিকে জঙ্গলের কেন্দুপাতার কারবারে ঢুকেছে বেসরকারি মালিকরা। নামমাত্র মজুরিতে কাজ করতে হচ্ছে শ্রমিকদের।এই ক্ষেত্রের একটা বিশাল সংখ্যক শ্রমিকের জীবনে হাহাকার নেমে এসেছে। আন্দোলনের ভেতর দিয়েই এই সংকটের মোকাবিলা করা দরকার। জেলায় বহু কারখানা বন্ধ গেছে এই দশ বছরে। কাজ হারা শ্রমিকরা হন্যে হয়ে একটা সামান্য মজুরির কাজের জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ধুঁকছে পরিবারগুলি। নিরব প্রশাসন। এই অবস্থা চলতে পারেনা। খালি শ্রমিক সংগঠনই নয়, সমগ্র পার্টিকে এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ময়দানে নামতে হবে। ৫৪ জন প্রতিনিধি আলোচনা করেন।
দ্বিতীয়দিন সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিমান বসু বলেন, লড়াই’ই হলো আসল কথা। সামনে পৌরসভার নির্বাচন। এই নির্বাচনে বিভিন্ন পৌরসভার ভিন্নতাকে মেনেই সেখানে প্রার্থী মনোনয়ন করতে হবে। এ ব্যাপারে রাজ্য বামফ্রন্ট কোনো হস্তক্ষেপ করবেনা। কিন্তু ভোটে জেতার জন্যই সর্বশক্তি নিয়ে লড়তে হবে।
বক্তব্য রাখতে গিয়ে অমিয় পাত্র বলেন, পার্টিতে নিষ্ক্রিয়তার কোনো জায়গা নেই। মানুষের কাছে গেলেই সমস্ত নিষ্ক্রিয়তা ভেঙে যাবে।
এছাড়াও সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে বক্তব্য অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি কিরীটি মুখার্জি, সম্পাদক শুভাশিস বিশ্বাস। জবাবি ভাষণ দেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক অজিত পতি।
সম্মেলন থেকে ৫৫ জনের জেলা কমিটি সর্বসম্মতিতে নির্বাচিত হয়। সম্মেলন মঞ্চে অনুষ্ঠিত নবনির্বাচিত জেলা কমিটির সদস্যরা অজিত পতিকেই সম্পাদক হিসাবে পুনর্নির্বাচিত করেন। এছাড়া পার্টির আগামী রাজ্য সম্মেলনের জন্য ১৪ জন প্রতিনিধিও সর্বসম্মতিতে নির্বাচিত হয়েছেন। সম্মেলনে ৩১২ জন প্রতিনিধি ও ২৭ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন এসএফআই’র জেলা সম্পাদক অনির্বাণ গোস্বামী (২৩) এবং বয়োজ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি হিসাবে ছিলেন ধ্রুবলোচন মণ্ডল (৭৭)। সম্মেলন পরিচালনা করেন দেবলীনা হেমব্রম, মনোরঞ্জন বসু, মাধব মণ্ডল, শেখ ইউনুস ও পূর্ণিমা বাগদি।