৫৯ বর্ষ ২১ সংখ্যা / ৭ জানুয়ারি, ২০২২ / ২২ পৌষ, ১৪২৮
মতাদর্শে দৃঢ় দায়িত্বসচেতন শোষিত মানুষের সাথে সম্পর্কযুক্ত ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ে তোলো
সিপিআই(এম) নদীয়া জেলা সম্মেলনের আহ্বান
সন্দীপ দে
পার্টির নদীয়া জেলা সম্মেলনের বর্ণময় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। রক্তপতাকা উত্তোলন করছেন বিজয় চট্টোপাধ্যায়।
মতাদর্শে দৃঢ়, দায়িত্বসচেতন, বঞ্চিত-শোষিত মানুষের সাথে জীবন্ত সম্পর্কের বন্ধনে সুদৃঢ়, ঐক্যবদ্ধ পার্টি গড়ার আহ্বান জানিয়ে শেষ হয়েছে সিপিআই(এম) নদীয়া জেলা ২৪তম সম্মেলন। ৩০-৩১ ডিসেম্বর কমরেড আশু ঘোষ ও কমরেড কমলেন্দু সান্যাল নগরে (কৃষ্ণনগর) কমরেড অজয় বিশ্বাস ও সরস্বতী মিস্ত্রি মঞ্চে (রবীন্দ্রভবন) এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন ডাক দিয়েছে - অবিরত নিজেকে পুনর্গঠিত করো, গতানুগতিকতা বর্জন করো এবং জনগণের সাথে দৈনন্দিন সম্পর্ক গড়ে তোলো। এই সম্মেলন যে অভিমুখে মুখ্য কাজের ধারা নির্দিষ্ট করেছে তা হলো - ‘প্রতিদিন পার্টি, প্রতি বুথে পার্টি’।
এক বর্ণাময় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সূচনা হয়। সম্মেলনের রক্তপতাকা উত্তোলন করেন নবতিপর পার্টি নেতা বিজয় চট্টোপাধ্যায়। শহিদদের স্মরণে স্মারক বেদিতে মাল্যদান করেন বিজয় চট্টোপাধ্যায়, পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মৃদুল দে, জেলা সম্পাদক সুমিত দে সহ পার্টির বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দ ও প্রতিনিধিরা।
প্রতিনিধি সম্মেলনের সূচনায় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, তাহেরপুর গণকণ্ঠ শাখার গাওয়া - ‘‘আজ মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে দুটো দল/আর মাঝামাঝি নেইতো কিছুই/হয় পা চাটা দালাল আর নয়তো/এক লড়াকু মজুর হবি তুই/বল কোন্ দিক সাথি কোন্ দিক বল কোন্ দিক বেছে নিবি তুই’’... গানে যে দৃপ্ত লড়াইয়ের স্পন্দন ছড়িয়েছিল সম্মেলন কক্ষ জুড়ে, তারই দীপ্ত অনুরণন যেন মূর্ত হয়ে উঠেছিল সূর্য মিশ্রের উদ্বোধনী ভাষণে এবং সেই রেশ ধরেই অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ও প্রতিনিধিদের সজীব আলোচনা সম্মেলনকে নিয়ে গেছে সুনির্দিষ্ট অভিমুখে।
আগামী কর্মসূচি
সিপিআই(এম) নদীয়া জেলা ২৪তম সম্মেলন আগামী কর্মসূচি হিসেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে - শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা, অর্জিত অধিকার, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ ও সম্প্রীতি রক্ষায় ধারাবাহিক সংগ্রাম গড়ে তুলবে পার্টি; আগ্রাসী দক্ষিণপন্থা, সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে এবং সমাজতান্ত্রিক বিকল্পের সপক্ষে প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে; দুর্নীতি, বেনিয়ম লুট, স্বজন পোষণ, কুসংস্কার, লিঙ্গ বৈষম্য, ভোগবাদ, মূল্যবোধের বিকৃতি, সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশের উপর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক লড়াই জারি রাখার পাশাপাশি সুস্থ সংস্কৃতি ও প্রগতিশীল মূল্যবোধের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলা; শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, কৃষি ক্ষেত্রে সংকটের বিরুদ্ধে এবং কাজ ও মজুরির দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন সংগঠিত করা; ব্যক্তি উপভোক্তাদের দাবি আদায়ের লড়াই জারি রাখা ও সহায়তা প্রদানে পাশে থাকা এবং স্থানীয় ও আদায়যোগ্য দাবিতে সর্বস্তরে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
নতুন নেতৃত্ব
জেলায় আগামীদিনে সাধারণ মানুষের স্বার্থে বিভিন্ন আন্দোলন এবং মতাদর্শগত লড়াইকে জারি রাখতে সম্মেলন মঞ্চ থেকে ৫৫ জনের নতুন জেলা কমিটি সর্বসম্মতিতে নির্বাচিত হয়েছে। জেলা কমিটিতে মহিলা রয়েছেন ৮জন, তিনজন সদস্যকে পরে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সুমিত দে জেলা সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন।
সম্মেলন উদ্বোধন
সিপিআই(এম) নদীয়া জেলা ২৪তম সম্মেলন উদ্বোধন করেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র। তিনি বলেন, আমাদের মতাদর্শের মূল কথা হচ্ছে মার্কসবাদ-লেনিনবাদ। যা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক ও বিকাশমান। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে স্থান, কাল বিচার করে তা প্রয়োগ করতে হবে। সে অর্থে এটা হলো প্রয়োগের বিজ্ঞান। তাই এই মতাদর্শ প্রয়োগের পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে। তিনি বলেন, সমালোচনা-আত্মসমালোচনা ও বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্যের ভিত্তিতে আলোচনা করে পার্টিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সমালোচনা-প্রশ্ন ইত্যাদি না থাকলে পার্টি স্থবির হয়ে যাবে। সমালোচনার লক্ষ্য হলো পার্টির সাংগঠনিক-রাজনীতিগত ত্রুটি খুঁজে বার করা। মমত্ত্ববোধ না থাকলে সমালোচনা হয় না। কিন্তু আনুষ্ঠানিক আত্ম-সমালোচনা করলে হবে না। কীসের জন্য সমালোচনা তা বুঝতে হবে। এছাড়া মার্কসবাদী বিজ্ঞান বলে, মানুষ ভুল থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করে। তবে ভুলটাকে সংশোধন করতে হবে।
তিনি বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, ২০১৪ সালে মোদি সরকার দেশের শাসন ক্ষমতায় আসায় দেশের জাতীয় পরিস্থিতিতে বড়ো পরিবর্তন এসেছে। আরএসএস-র মতো একটা উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তির দ্বারা পরিচালিত বিজেপি রাষ্ট্রযন্ত্রে প্রবেশ করেছে। এটা অন্য কোনো বুর্জোয়া দলের মতো নয়। আরএসএস-বিজেপি’ই তৃণমূলকে তৈরি করেছে। এই শক্তি চাইছে দেশে যেন বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তাই আজ বিজেপি-তৃণমূল বিরোধী সমস্ত শক্তিকে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে।
সূর্য মিশ্র আরও বলেছেন, শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন স্তরে আদায়যোগ্য দাবিতে আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে এবং দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন জারি রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি দিল্লির সীমান্তে কৃষকদের নজিরসৃষ্টিকারী আন্দোলনের কথা তুলে ধরে বলেন, রোদ, ঝড়, জল, শীত, গ্রীষ্মকে উপেক্ষা করে তিন কৃষি আইন রুখতে দিনের পর দিন দিল্লি সীমান্ত অবরুদ্ধ করে দাবি আদায় করেছেন কৃষকরা। আমরাও কেন পারব না পশ্চিমবঙ্গে? তাই গ্রাম থেকে জেলাস্তর সর্বত্র সর্বস্তরের মানুষকে সংগঠিত করে ন্যায্য দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত লড়াই জারি রাখতে হবে।
প্রতিবেদন উত্থাপন
সম্মেলনে খসড়া রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করেছেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক সুমিত দে। তিনি তাঁর বক্তব্যে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন, ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন, ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীদের ক্রমাগত বিপর্যয়, পার্টির জনবিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি, বিজেপি’র মতো সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান, কোভিড পরিস্থিতির ভয়াবহতা, সরকারের উদ্যোগের অভাব ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, এ সমস্ত কিছুকে বিবেচনা করেই কোভিড পরিস্থিতিকে মান্যতা দিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। তিনি বলেন, ২০২১-এর বিধানসভায় আমাদের খারাপ ফলাফল হয়েছিল শান্তিপুর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস জোট ৪.৪৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। এবার উপনির্বাচনে সিপিআই(এম) ১৯.৬৮ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এটা এই পরিস্থিতিতেও একটা উল্লেখযোগ্য দিক।
তিনি বলেন, আজ পৃথিবীজুড়েই দক্ষিণপন্থার উদ্ভব হয়েছে। যুক্তি, আদর্শ, মূল্যবোধ, এগিয়ে চলার ভাবনা সব কিছুকে তছনছ করে দিচ্ছে। শ্রেণি ও সামাজিক আন্দোলনের উপর আঘাত নেমে আসছে। আমাদের দেশে এবং রাজ্যে তারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। আজ নানা ইস্যুতে মানুষ এগিয়ে আসছেন, প্রতিবাদমুখর হচ্ছেন। এই অবস্থায় স্থানীয়, আদায়যোগ্য দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেছেন, পার্টির সর্বভারতীয় প্লেনামে গণলাইনযুক্ত বিপ্লবী পার্টি গড়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। এটা মানুষকে বাদ রেখে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই আমাদের মতাদর্শে দৃঢ় সংগঠন গড়ে তোলা জরুরি। এ লক্ষ্যে দুর্বলতাকে আড়াল করে বা সাফল্যকে অতিরঞ্জিত করে সফল হওয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের আহ্বান - বুথভিত্তিক সংগঠন ও গণসংগ্রহের মধ্য দিয়ে মানুষের সাথে নিবিড় সংযোগ গড়ে তোলো।
তিনি কোভিড পরিস্থিতিতে জেলায় ও রাজ্যে রেড ভলান্টিয়ারদের দৃষ্টান্তমূলক কর্মকাণ্ডের কথা তুলে ধরে বলেন, একটা ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কেউ তাদের কর্মপদ্ধতি স্থির করে দেয়নি। মারণ সংক্রমণের ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গত মানুষ ও আক্রান্তদের পাশে সর্বতোভাবে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-যুবদের এই অসাধারণ উদ্যোগকে সর্বস্তরের মানুষ সমর্থন জানিয়েছেন এবং রেড ভলান্টিয়ারদের সাদরে গ্রহণ করেছেন। এ থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে।
পরিশেষে তিনি বলেন, মানুষ আজ নানাভাবে আক্রান্ত। পরিবর্তিত এই জটিল পরিস্থিতি মানুষ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। এই পরিস্থিতিতে সর্বস্তরের মানুষের কাছে আমাদের যেতে হবে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। আজ উদারনীতি ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির তীব্র আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, রাজ্যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে তীব্র করতে মতাদর্শগত লড়াই জারি রাখতে হবে। এ লক্ষ্যে মতাদর্শকে শানিত করতে পার্টি পত্র-পত্রিকার প্রচার ও প্রসারকেও গুরুত্ব দিতে হবে। সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
প্রতিনিধিদের আলোচনা
খসড়া রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রতিবেদনের ওপর দু’দিন ধরে আলোচনায় ৭৪জন প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। তাঁদের আলোচনায় প্রধানত প্রাধান্য পেয়েছে পার্টি সংগঠনকে মতাদর্শের ভিত্তিতে সুদৃঢ় করা। এই লক্ষ্যে শাখা সংগঠন ও বুথ সংগঠনকে শক্তিশালী করার কথা উল্লেখ করেছেন প্রতিনিধিরা। তাঁরা বলেছেন, পার্টি সংগঠনে আরও বেশি বেশি করে মহিলাদের নিয়ে আসা প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন তাঁদের রাজনীতি সচেতন করা। প্রতিনিধিরা বলেছেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের শাসনে সাধারণ মানুষের জীবন-যন্ত্রণা যেমন বাড়ছে, তেমনি তাঁরা নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের অধিকারহরণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, শ্রমজীবী মানুষের মজুরি কমছে, বেকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বামফ্রন্ট আমলে প্রতিষ্ঠিত ত্রিস্তরের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তৃণমূল জমানায় ভেঙে পড়েছে। সেখানে পুলিশ ও মাফিয়াদের নিয়ে চলছে শাসকদলের অবাধ লুঠের কারবার। জেলায় শিল্প মুখ থুবড়ে পড়েছে। সরকারের যে কয়েকটি প্রকল্প চলছে, তার সুফল পাচ্ছেন না বৃহত্তর অংশের মানুষ। এছাড়া ১০০ দিনের কাজে ব্যাপক দুর্নীতি, রাস্তাঘাট, পানীয় জল, বিদ্যুৎ, বিশেষ করে স্বাস্থ্য পরিষেবা অপরিমিত এবং চরম অব্যবস্থার ফলে গরিব মানুষ ব্যাপক দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন।
এছাড়াও প্রতিনিধিদের বক্তব্যে উঠে এসেছে, বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ভূমিসংস্কারের সুফল রূপায়ণের মধ্য দিয়ে যে গরিব ভূমিহীন মানুষ জমির পাট্টা পেয়েছিলেন, তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর অনেক জায়গাতেই সেই সমস্ত জমি শাসকদলের দুর্বৃত্তরা কেড়ে নিয়েছে। তাঁরা বলেছেন, এই সময়ে কৃষকরা ফসলের ন্যূনতম দাম না পেয়ে, ঋণের ফাঁদে জর্জরিত হচ্ছেন, খেতমজুররা কাজ ও মজুরি পাচ্ছেন না। কেন্দ্রের মতো রাজ্য সরকারও কৃষক বিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে চলেছে। কৃষিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে চাইছে। রাজ্যে কাজ নেই। তাই গ্রামাঞ্চলের গরিব পরিবারের বেকার যুবকরা নানা ঝুঁকি নিয়ে কাজের সন্ধানে পাড়ি দিচ্ছে ভিন রাজ্যে।
প্রতিনিধিরা এই সমস্ত বিষয় তুলে ধরে দৃঢ়তার সঙ্গেই বলেছেন, এই সমস্ত বিষয় ও দাবি-দাওয়া নিয়ে পঞ্চায়েত থেকে জেলা ও রাজ্যস্তর পর্যন্ত কেবল অবস্থান, ধরনা, ডেপুটেশনই যথেষ্ট নয়, মানুষকে ব্যাপকভাবে সংগঠিত করে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন জারি রাখতে হবে।
এছাড়াও প্রতিনিধিদের আলোচনায় জেলায় তাঁত শিল্পের সংকট, তাঁত শিল্পীদের নানা সমস্যা-যন্ত্রণা, পলাশিতে চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অধিগৃহীত জমি তৃণমূলের মদতে জমি মাফিয়াদের হাতে চলে যাওয়া, ইত্যাদি নানা বিষয় উঠে এসেছে। তাঁদের সুনির্দিষ্ট অভিমত হলো, অবিলম্বে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি নিয়ে জোরালো প্রচার আন্দোলন জরুরি।
প্রতিনিধিরা আলোচনা করেছেন, কেন্দ্রের সরকারের উদারনীতি, শিক্ষায় বেসরকারিকরণ ও গৈরিকীকরণ নীতি, গণতান্ত্রিক পরিবেশকে নস্যাৎ করে দেওয়ার পাশাপাশি রাজ্যে এবং জেলায়ও শাসকদলের দুর্বৃত্তদের দ্বারা শিক্ষা ব্যবস্থা আক্রান্ত হওয়া, শিক্ষক-অধ্যাপক-শিক্ষাকর্মীদের শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা এবং রাজ্য সরকারের শিক্ষাবিরোধী অগণতান্ত্রিক নানা পদক্ষেপের বিষয়। তাঁরা বলেছেন, নানা বাধা-হুমকি সত্ত্বেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিবাদ আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলনকে আরও প্রসারিত করার কথা বলেছেন তাঁরা। তাঁরা বলেছেন, তৃণমূল জমানায় তরুণ প্রজন্ম যেমন নানা দিক থেকে আক্রান্ত হচ্ছে, আবার তারা বিপথগামী হচ্ছে, ভোগবাদে আকৃষ্ট হচ্ছে। তৃণমূল একটা অংশের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের সচেতন প্রয়াস জারি রাখতে হবে। এছাড়াও প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে, কোভিড পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় ধরে লক ডাউনের ফলে কীভাবে বিভিন্ন স্তরের ছাত্র-ছাত্রী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনলাইন পঠনপাঠন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছাত্রছাত্রীদের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া এই সংকটকালে বেড়েছে ড্রপআউট ও বাল্য বিবাহের প্রকোপ। এই সমস্যা রুখতে ছাত্র সংগঠনের সীমিত উদ্যোগে কিছু প্রচেষ্টা চললেও সরকারের কোনো হেলদোল নেই।
প্রায় প্রতিটি এরিয়া কমিটির প্রতিনিধিদের আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে করোনার মারণ সংক্রমণের ভয়াবহকালে জেলাজুড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা রেড ভলান্টিয়ারদের অনন্য ভূমিকার কথা। তারা জীবনকে বাজি রেখে যেভাবে দুর্গত-পীড়িতদের ত্রাণ ও সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন তা জনমানসে উজ্জ্বল নজির তৈরি করেছে। যে কাজ সরকারের উদ্যোগে হবার কথা ছিল, তা রেড ভলান্টিয়াররা তাঁদের সীমিত সাধ্যে করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। ফলে বড়ো বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়েছেন আক্রান্ত মানুষ, সমাজ।
প্রতিনিধিরা বলেছেন, আজ বিজেপি মোহ যেমন কাটছে, তেমনি তৃণমূল ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। আর সামান্য হলেও বামপন্থীদের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজেপি-তৃণমূলের মধ্যে যে গোপন বোঝাপড়া রয়েছে, সে সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে হবে। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত উদ্যোগে জনগণের মধ্যে প্রচার সংগঠিত করতে হবে এবং আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকার ও দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। এর মধ্য দিয়েই পার্টির ভিতকে শক্তিশালী ও প্রসারিত করা সম্ভব।
জবাবি ভাষণ
প্রতিনিধিদের আলোচনা শেষে জবাবি ভাষণ দেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক সুমিত দে। তিনি তাঁর বক্তব্যে বর্তমান সময়ে তৃণমূল এবং বিজেপি বিরোধী ব্যাপক ঐক্য গড়ে তুলে সংগ্রামে অবতীর্ণ হবার কথা বলেন। তিনি দেশে নজিরবিহীন কৃষক আন্দোলনের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, সেই আন্দোলনে লালঝান্ডা যেমন পাশে থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি আজকের দিনে বহুধা বিস্তৃত লড়াই-আন্দোলনের পাশে আমাদের দাঁড়াতে হবে, মানুষকে সংগঠিত করে ব্যাপক আন্দোলন নির্মাণে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। স্থানীয় ও আদায়যোগ্য দাবিতে নাছোড় আন্দোলনে বৃহত্তর অংশের মানুষকে সংগঠিত করতে হবে আমাদের। এক্ষেত্রে আন্দোলনের আঙ্গিকটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি মতাদর্শগত চেতনায় সমৃদ্ধ হবার পাশাপাশি মানুষের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে পার্টিকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানিয়েছেন।
নেতৃবৃন্দের বক্তব্য
সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বক্তব্য রেখেছেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মৃদুল দে এবং রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পলাশ দাস। মৃদুল দে তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, বর্তমান সময়ে কী করে আরও বেশি সংখ্যায় মানুষকে পার্টিতে নিয়ে আসতে পারব - এটাই আমাদের কাছে বড়ো চ্যালেঞ্জ। মানুষ বেশি বেশি করে আমাদের চাইছেন। তাঁদের এই আকাঙ্ক্ষার উপযোগী হয়ে উঠতে হবে আমাদের। তিনি লেনিনের কথা তুলে ধরে বলেন, আমাদের কিছুটা পিছোতে হয়েছে, আমাদের যা ত্রুটি ছিল তা থেকে শিক্ষা নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। তিনি বলেন, বিপ্লবী পার্টির প্রধান পরিচয় নিষ্ক্রিয়তা মুক্ত পার্টি। তাই সেদিকে লক্ষ্য রাখার পাশাপাশি গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হবে। মতাদর্শের ভিত্তিতে সমালোচনা-আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে পার্টিতে কমরেডসুলভ মনোভাব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। পার্টি প্লেনাম যে নির্দেশ দিয়েছিল, সেই গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ার উদ্যোগ নিতে হবে আমাদের। আজকের পরিস্থিতিতে আমরা ছাড়া বিকল্প নেই। সামনে আমাদের আরও বড়ো লড়াই। পরিচিতিসত্তা, জাতপাতের বিভাজন, উদারীকরণ, সাম্প্রদায়িকতার আক্রমণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
পলাশ দাস তাঁর ভাষণে পরিসংখ্যানসহ উল্লেখ করেন, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিরাট আসন প্রাপ্তি সত্ত্বেও দেখা যাচ্ছে বেশিরভাগ মানুষ কিন্তু তৃণমূলের বিরুদ্ধেই ভোট দিয়েছেন। আবার কেন্দ্রের শাসকদল একের পর এক নির্বাচনে পরাজিত হচ্ছে। কৃষি আইন নিয়ে কেন্দ্রকে মাথানত করতে হয়েছে। অন্যদিকে বামপন্থীদের প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধিও লক্ষ করা গেছে সদ্যসমাপ্ত কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচন থেকে শান্তিপুর বিধানসভা উপনির্বাচনে। তাই বামপন্থীদের হতাশার কিছু নেই। আমাদের দুর্বলতা কাটানোর অস্ত্রই হচ্ছে জনসংযোগবৃদ্ধি। তিনি বলেন, গত ২রা মে নির্বাচনের ফলাফলে আমাদের বিপুল পরাজয় সত্ত্বেও রাজ্যজুড়ে রেড ভলান্টিয়াররা জীবনকে বাজি রেখে মানুষের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এই উদ্যোগে ব্যাপক অংশের মানুষ আমাদের সমর্থনে পাশে থেকেছেন। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আন্দোলনে রূপায়িত করতে হবে। সমস্ত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, শ্লথতা কাটিয়ে সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে আমাদের।
প্রতিনিধি সম্মেলন পরিচালনা করেছেন রমা বিশ্বাস, মেঘলাল সেখ, রঞ্জিত মণ্ডল ও গায়েত্রী সরকারকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী। প্রতিনিধি সম্মেলনের সূচনায় শহিদ স্মরণে ও শোক প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য রমা বিশ্বাস।
সম্মেলনে মোট ৩৬৯ জন প্রতিনিধি ও ৩৮ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। সর্বজ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন বাসন্তী মিত্র (৭৬) এবং সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন পিনাকী মজুমদার (২২)। প্রতিনিধিদের মধ্যে ১৩৬ জন কৃষক ও ৯৩ জন শ্রমিক উপস্থিত ছিলেন। এই সময়কালে সাধারণ মানুষের স্বার্থে আন্দোলন করতে গিয়ে জেল খেটেছেন ৩৩ জন প্রতিনিধি। মিথ্যা মামলা হয়েছে ১১৮ জনের বিরুদ্ধে।
সম্মেলন থেকে পার্টির আসন্ন রাজ্য সম্মেলনের জন্য ১৪ জন প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করা হয়েছে।
কমিশন ভিত্তিক আলোচনা
সম্মেলনে উত্থাপিত প্রতিবেদনের ওপর আলোচনা ছাড়াও প্রতিনিধিরা ৯টি গুরুত্বপূর্ণ কমিশন পেপারের ওপর গ্রুপভিত্তিক আলোচনায় অংশ নিয়েছেন। বিষয়গুলি হলো - নদীয়া জেলায় কৃষির বৈচিত্র্যকরণ-মার্কেটিং সমস্যা-আন্দোলন সংগ্রাম; ক্ষুদ্র ব্যবসার ক্ষতিতে নদীয়া জেলায় মার্কেট এবং ই-মার্কেটিংয়ের প্রভাব; জেলায় উদ্বাস্তু কলোনির সমস্যা, উদ্বাস্তু আন্দোলন গড়ে তোলার প্রেক্ষিত, কলোনি এলাকার বাইরের উদ্বাস্তু মানুষের সমস্যা; শহর এলাকার উন্নয়নের অসামঞ্জস্যতা, উন্নয়নের প্রশ্নে সরকারগুলির ভূমিকা, উন্নয়নের আন্দোলনে রাজনৈতিক ভরসার স্থান; জেলার সীমান্ত সমস্যা, আন্দোলনের ইস্যু, বিএসএফ-র প্রভাবাধীন অঞ্চল বৃদ্ধির কারণ; নদীয়া জেলায় সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সম্ভাবনা; নদীয়া জেলার মাইক্রোফিনান্স ও সুদখোর মহাজনদের দৌরাত্ম্য; পরিবেশ, জলাভূমি সংকীর্ণতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, নাব্যতা এবং নদীয়া জেলায় জনবিন্যাসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি-সাম্প্রদায়িকতা-প্রতিরোধ সাফল্য।
গৃহীত প্রস্তাব
সিপিআই(এম) নদীয়া জেলা ২৪তম সম্মেলনে নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ ও শিক্ষাক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে; কৃষি সংকট ও কৃষকের সমস্যা নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন গড়ে তোলার সপক্ষে; শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থবিরোধী শ্রমকোড বাতিলের দাবিতে; বিজেপি-সঙ্ঘ পরিবারের সাম্প্রদায়িক রজানীতিকে পরাস্ত করতে; স্বাস্থ্য বাঁচানো, জনস্বাস্থ্য আন্দোলন গড়ে তোলা, বিজ্ঞান আন্দোলন গড়ে তোলা এবং বুথে বুথে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার সপক্ষে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
পার্টির নদীয়া জেলা সম্মেলনে ক্রীড়াবিদকে সংবর্ধনা
কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম) নদীয়া জেলা সম্মেলনে প্রতিনিধি, স্বর্ণপদক জয়ী ক্রীড়াবিদ রচনা সরকার-কে সংবর্ধনা জানানো হয়। রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র তাঁর হাতে পুষ্পস্তবক ও উপহার সামগ্রী তুলে দেন। সম্প্রতি বারাণসীতে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার দৌড়, লং জাম্প ও জ্যাভলিন প্রতিযোগিতায় তিনটি বিভাগেই প্রথম হন রচনা।